ভালো তোকে বাসতেই হবে পর্ব ১১+১২

পর্ব ১১+১২
#ভালো তোকে বাসতেই হবে❤️
#পরিধি রহমান বিথি🍁
#পর্ব-১১

,,,,”রাত তুই নতুন বউ পেলি কোথায়? এখানে তো ‌ মিষ্টি মা এসেছে,,”

❤️
কেন আম্মু দেখছো না? এই যে লাল ওড়না মাথায় নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দরজায়। (রাত ভাইয়া পেছন থেকে ভালো আন্টির গলা জরিয়ে ধরে হালকা গলায়) আম্মু বরন করে ঘরে তোলো,,,??

মূহুর্তেই মাথাটা গরম হয়ে গেল।লাল ওড়না পড়েছি তাই কিভাবে আমাকে অপমান করল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছি না ভালো আন্টির সামনে দ্বিধাবোধ করছি। হাজার হোক নিজের ছেলের বিরুদ্ধে কোনো কথা কি আর তার সামনে বলা যায়??তাই ভদ্র মেয়ের মতো ভদ্রতা বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি ।

ভালো আন্টি এবার মৃদু হাসলেন কারণ সে বুঝতে পেরেছে নতুন বউ শব্দটা রাত ভাইয়া আমার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। ভালো আন্টি বাম হাত বাড়িয়ে রাত ভাইয়ার মাথায় চাটি দিয়ে বলল,

,,,,”কি যে বলিস না রাত… আমি তো ভাবলাম হয়তো সত্যিই কোনো নতুন বউ‌ এলো,,,।

ভালো আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

,,,,”তুই কিছু মনে করিস না মিষ্টি মা।ও একটু এমনি।তুই ভেতরে আয়।”

ভালো আন্টি আমাকে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছেন।রাত ভাইয়া গিয়ে সোফায় বসলেন আমি আড়চোখে রাত ভাইয়ার প্রতিটা খুঁটিনাটি দেখছি।উনি এখনো ড্রেস পাল্টাননি। কলেজের আগের ফর্মাল ড্রেসেই আছেন। আমাকে ড্রপ করে অফিসে যাওয়ার কথা শুনেছি। হয়তো অফিস থেকে ফিরলেন। ওনার সিল্কি চুলগুলো বড্ড এলোমেলোভাবে ভাবে দুলছে। সাদা গালটায় খোঁচাখোঁচা দাড়ির ফাঁকে একটা ছোট তিল বারবার উঁকি দিয়ে গালের শোভা বাড়াচ্ছে।দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে। আমার মতে গোছানো রাতের চেয়ে অগোছালো রাতকেই আমার বেশি মনে ধরেছে। তবে সব থেকে সুন্দর ওনার গোলাপি ঠোঁটজোড়া।কি সুন্দর নিঃশ্বাসের তালে তালে নিজের অবস্থানের জানান দিয়ে কেঁপে উঠছে। দেখলেই বোঝা যায় সিগারেট আজ পর্যন্ত তার ঠোঁট ছুতে পারে নি। ওনার এই ভূবন ভোলানো রুপ দেখে নিজের অজান্তেই আমার ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। ডাইনিং টেবিলে মার রান্না করা খাবার রেখে ভালো আন্টির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

,,,”ভালো আন্টি মা এগুলো তোমাদের জন্য পাঠিয়েছে। আমি এগুলো দিতেই এসেছি। আচ্ছা ভালোআন্টি ,, আমি বরং এখন বাসায় যাই পড়ে আসবো নাহয়”।

ভালো আন্টি চোখ রাঙিয়ে বললেন,

,,”কি বললি তুই?? তুই এখন কোথাও যাচ্ছিস না। আমি পায়েস রান্না করছি তুই খেয়ে তারপর যাবি।

রাত ভাইয়া ডান হাতের মধ্যে বাম হাত ঢুকিয়ে দিতে হাজির,,।ফোন টিপতে টিপতে অডার‌ দিচ্ছে,,

,,,”আম্মু আমি রুমে যাচ্ছি। আমার জন্য একটা কপি পাঠিয়ে দিও।আর আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে। আমি একটু রেস্ট নেব”।(এটা আমার কাছে অডার বলেই মনে হলো।সে যাই হোক রাত ভাইয়া বলেই তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলেন রুমে)

ভালো আন্টি পায়েস রান্নায় বেস্ত আর আমি এখানে চেয়ারে বসে আছি ,,বলা চলে বসে বসে বোর হচ্ছি,, আর কি?? এই বিরক্তির মাঝে এক আশার আলো উঁকি দিল মানে ভালো আন্টির ডাক পড়ল। দৌড়ে গেলাম আন্টির কাছে। খুব উৎসাহ প্রকাশ করে বললাম,

,,,”হ্যাঁ,, আন্টি বল। আমি কিছু করব?”

একটা কফির মগ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ,, হালকা বেচারা লুক নিয়ে বললেন,

,,”এই কফিটা একটু রাতকে দিয়ে আসবি মা?? পায়েসটা প্রায় হয়ে এসেছে এখন গেলে নিচে লেগে যেতে পারে।

আমি ও এখন বেচারা। তাই সত অনিচ্ছার সত্তেও কাজটা আমায় করতে হবে।তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানান দিলাম তার অর্থ ,,” হ্যাঁ”,, আমি যাব।”

ভালো আন্টি খুশি মনে আমাকে কফির মগটা ধরিয়ে দিলেন। আমি ও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম রাত ভাইয়ার রুমের দিকে।সিড়ি বেয়ে উঠেই‌ ডান পাশের ফাস্ট রুমটা রাত ভাইয়ার।এর আগেও অনেকবার এবাড়িতে আমার আগমন ঘটলেও রাত ভাইয়ার রুমে কোনোদিন ঢুকিনি। কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছর রাত ভাইয়া বিদেশে ছিলেন আর এখানে তার রুমটা ছিল বন্ধ। মিউজিয়ামে যেমন ,,”রেস্ট্রিকটেড এড়িয়া”থাকে ঠিক তেমনটাই এই বাড়ীর সেই এড়িয়া হচ্ছে রাত ভাইয়ার রূম। কারণ সবাই এখানে এলাও না।

দাড়িয়ে আছি রাত ভাইয়ার রুমের সামনে দরজায় নক করতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা তাই আর নক না করেই ঢুকে গেলাম। চুপটি করে কফিটা রেখে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেই ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই আমার চোখ কপালে উঠলো। কারণ অন্যান্য ছেলেদের রুমের মতো ছিল না এই রুমটা। আমার মতে বেচেলার ছেলেদের রুম থাকবে অগোছালো,, জিনিসপত্র এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো থাকবে। কোনো রকম গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়া যায় এমন একটা অবস্থা থাকবে বেডের,,, ঠিক যেমনটা আমার বজ্জাতি মাইয়াটার থাকে। কিন্তু এখানে চেহারা ছিলো অন্যরকম। প্রথমবারে দেখে কারো বোঝার সামর্থ্য নেই যে এটা একটা ছেলের রুম। বেশ গোছানো,, আমার তো মনে হয় আমার রুমের থেকে ও বেশি গোছানো। রুমটা হালকা নীল আর সাদার কম্বিনেশনে সেজে আছে। নীল দেওয়ালের উপর সাদা পর্দাগুলো যেন চাঁদে ন্যায় অপূর্ব লাগছে। পুরো রুমটা ফাঁকা ,,রাত ভাইয়া নেই রুমে‌,,ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের আওয়াজ পেলাম মনে হচ্ছে উনি ওয়াশরুমে আছে। কফিটা রেখতে যাচ্ছিলাম তখনই নজর পড়ল একটা ডায়েরীর উপর।পুরো রুমটা গোছানো বলেই হয়তো বেড় সাইট টেবিলের উপর মেলে রাখা ডায়েরীটা আমার নজর কেড়েছে। ধীর গতিতে পা টিপে টিপে যাচ্ছি ডায়েরীটা বন্ধ করতে। কফিটা রেখে যেই চোখ ফেললাম ডায়েরীতে সেখানে খুব সুন্দর করে লেখা,

,”ওই মায়াবতীর মায়ার আগুনে আমি যে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি,,সে কি বোঝে না,,?,, আমি জ্বলতে নয় মায়াবতীর মায়া হতে চাই।,,,”❤️S,,,,

আর কিছু দেখতে পারিনি তার আগেই ওয়ালরুমের দরজা ঢেলে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন রাত ভাইয়া। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।রাত ভাইয়া গম্ভীর সুরে বললেন,

,,”সোনালী তুই আমার রুমে?”

আমি তাড়াতাড়ি কফির দিকে আঙুল জাগিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

,, ক ক ফি দিতেত এসেছিলাম।

চুল থেকে পানি পড়ছে ,, নিশ্চয়ই শাওয়ার নিয়েছেন। একটা ছাই রঙের থ্রিকোয়াটার আর নেভীব্লু টিশার্ট পড়নে । শরীরটা হালকা ভেজা তাই টিশার্টটা লেপ্টে আছে ওনার শরীরে।ঘোর লাগা নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ওনার এই আচরণের কারণ।ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ও অজানা ভয়ে পেছনে পেছাচ্ছি। একটা সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল আমার।উনিও আমার একদম সামনে চোলে এসেছেন। ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে আছি।উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে ,, আমার মাথার ওড়না টা ফেলে দিয়ে বললেন,

,,”বাচ্চা মেয়ে,, এভাবে ওড়না মাথায় দিয়ে বউয়ের মতো সাড়া বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেন??

আমি কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারছি না। কেন যেন সংকোচ বোধে ভুগছি আমি। তখনি ভালো আন্টির গলা পেলাম। আন্টি আমায় ডাকছে।রাত ভাইয়া পাশে সরে আমাকে যাওয়ার পথ করে দিলেন আমিও বাধ্য মেয়ের মতো নিচে নেমে এলাম।

ভালো আন্টির হাতের পায়েস খেয়ে পেট পুরো যায় যায়। কিন্তু উনি তো থামার নামই নিচ্ছে না। আমি হিমসিম খেয়ে আন্টিকে বললাম,

,,”ভালো আন্টি আমি আর পারছি না । আর খেলে পেট ফেটে যাবে।”

আন্টি একটু আদুরে ভাব নিয়ে বললেন,

,,”ঠিক আছে মা আর খেতে হবেনা”।

আমি ও ছাড়া পেয়ে বেজায় খুশি।এতো কিছুর মাঝে ও রাত‌ ভাইয়া একবার ও তার গুহা থেকে বেরিয়ে আসেননি।(গুহা মানে ওনার রুমে)।

রাত দশটা,,, বিছানায় শুয়ে রাত ভাইয়ার রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ আমি বসে আছি। যতই ভাবি এই জটলা কিছুতেই খুলতে পারছিনা ।খোলার পরিবর্তে যেন আর ও বেড়ে চলেছে। উনি এই❤️S ,,, শব্দ দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন?? এটা কি কারো নামের অক্ষর?? আচ্ছা একটা কি রাত ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষটির নামের অক্ষর??হলেই বা কে সে??এ ব্যাপারে আমি কাল জেরিনের সাথে কথা বলব। মেয়েটি যখন আমাদের ভার্সিটির তাহলে নিশ্চয়ই আমরা চিনবো। আচ্ছা আমার নামের প্রথম অক্ষর ও তো “s” । না না এসব কি ভাবছি?উনি কোথায় আর আমি কোথায়,, আমার মতো হাজার মেয়ে ওনার পিছনে ঘুরে।এসব ভাবতে ভাবতে বাত আঁধারে তলিয়ে গেলেন আর আমি ঘুমের সাগরে,,,

তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ক্লাস করে আবার জেরিনদের বাসায় ‌যেতে হবে ।আজ আমরা সবাই যাবো জেরিনের বাসায় ,,ভাইয়া আর ওর বিয়ের পাকা কথা বলতে। বাসায় বেশ রমরমা পরিবেশ। ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে বিদায় ভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে।বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় চেপে বসলাম।৫৬মিনিটের মাথায় পৌঁছেছি জেরিন দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে এগিয়ে চলেছি ক্লাসের দিকে। কিন্তু ‌ মনে হচ্ছে সবাই আমার দিকে নানা বাহানায় তাকিয়ে আছে। আমি প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারলাম ।কি এমন হলো সবাই আমার দিকে অস্বাভাবিক ভাবে তাকাচ্ছে??

#পর্ব-১২

,,”কি এমন হলো সবাই অস্বাভাবিকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে?”

❤️
আবার কি হলো ?? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।এই “প্রান্ত রহমান রাত” আমার লাইফে এন্ট্রি মারার‌ পর থেকে এই এক ঝামেলা হরদম আমাকে তাড়া করে বেরায়,,কখন কোথায় কি হবে কে জানে??কোথা থেকে উদয় হবে কোথায় অস্তমিত হবে তা সে ছাড়া কেউ জানেনা। কিন্তু আজ ভার্সিটিতে কোন বিপদ উদয় হলো কে জানে ‌?? জেরিনের দিকে তাকালাম,, আমার সাথে সাথে ব্যাপারটা যে জেরিন ও আঁচ করতে পেরেছে সেটা ওর ভ্রু কোচকানো মুখই বলে দিচ্ছে। মুখে হাজার বিরক্তির ছাপ নিয়ে জেরিনের আঙ্গুল টিপে ইশারা করছি,,

,,”দেখ তো সবাই কি আমাদেরকেই দেখছে নাকি? আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের দিকেই চেয়ে আছে,,”

জেরিন বাম হাত দিয়ে চশমা ঠিক করায় ব্যস্ত । বারবার ওড়নাও ঠিক করছে,,।বেশ সংকোচ বোধের ফল বলা চলে একে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধীর গতিতে শুধু বলল,

,,”আমার ও তাই মনে হচ্ছে যে,,সোনু”

ওর এই বিরক্তিকর আচরণ দেখে আমি ও বেশ বিরক্ত হলাম। আমি একবার আমার নিজের দিকে চোখ উল্টে দেখে নিলাম । কোথাও কিছু গন্ডগোল আছে কিনা।,, কিন্তু না সব তো ঠিকই মনে হচ্ছে।তাহলে প্রবলেমটা কোথায়??

এই অজানা উত্তরের আশায় ওর দিকে নজর স্থির করলাম আর প্রশ্নের ঘা ছু্ড়লাম,

,,”সবাই যেভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে তো মনে হচ্ছে কোনো এলিয়েন দেখছে।,, আচ্ছা তুই কি কিছু জানিস??

মুহূর্তেই ভ্রুর সাথে সাথে কপাল কুঁচকে চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো জেরিন।মনে হচ্ছে এখনই আমাকে ভেনিস করে দিবে। তবে তেমন কিছু যদিও করে নি কিন্তু চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,,

,,”আমি জানলে কি তোকে বলতাম না?”

জেরিনের এই ঝাঁঝালো উত্তরে আমি চুপসে যাওয়া লুচির মতো নেতিয়ে গেলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সান্তনা দিলাম। জেরিনের কাঁধে হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বললাম,

,,, জেরিন তুই রেগে যাচ্ছিস কেনো??,, প্লিজ কাম ডাউন। এমনিই মাথায় হাজারটা টেনশন তার উপর তুই ও ভাবীগিরি ফলাচ্ছিস???(বলেই খিলখিল করে হেসে দিলাম)

জেরিন হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি কথাটা পরিবেশ শান্ত করার জন্য বলেছি ,, হাসতে হাসতে জেরিন বলল,

,,,,”ভাবীগিরি??বাহ বেশ ভালো বলেছিস তো।”(বলেই আবার হাসতে শুরু করলাম)

ভার্সিটি মাঠে উপস্থিত অনেক পাবলিকের আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ উদঘাটন যদিও করতে পারিনি ,, কারণ কাউকে সরাসরি জিজ্ঞেস করার মতো পরিবেশ ঠেকলাম না।যে যার মতো উঁকি ঝুঁকি দিয়ে যেমন চোরের মতো দেখছিল ,, তাতে এটা সিওর যে এদের কাছ থেকে আসল ঘটনা উদ্ধার করা সম্ভব না। কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে লক্ষ্য স্থির করলাম ক্লাসের দিকে। মাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি,, এমতাবস্থায় কান দুটো খাড়া হয়ে গেল কারো কন্ঠে,, একগুচ্ছ বিস্ময় নিয়ে জেরিন আর আমি চোখাচোখি করছি। উদ্দেশ্য একটাই ,,

,,”ভুল শুনলাম নাকি সত্যিই কেউ ডাকছে??”একটু পর আবার কানে এলো সেই কন্ঠ। বেশ উৎসাহ নিয়ে ডাকছে বটে।তবে এটা সিউর যে সত্যিই কেউ ডাকছে। পেছনে ফিরে তাকালাম। তখনই উদয় হলো আর এক রহস্যের। ছিপছিপে শরীরে ব্লু জিন্স আর মেরুন শার্ট,,, চোখে মোটা কাঁচের চশমা ,,কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে অগ্রসর হয়েছে এক তরুণ। আমার মনে তখন বাজচ্ছে একটা মিউজিক,,

,,,লালা লা,,লালা,,,,লালা লা লালা,,,

,,মনে হাসির ফোয়ারা থামছে না। কিন্তু এখানে তো হাসা যাবে না। কারণ ভার্সিটির সিনিয়র ভাইকে দেখে হাসাহাসি করা বিপদজনক বলে মনে করছি আমি।হাসি কন্ট্রোল করে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর জেরিন। এটা আমাদের কাছে শাস্তি স্বরূপ। দাড়িয়ে থাকাটা না,,,,হাসি। কন্ট্রোল করে দাঁড়িয়ে থাকা। সামনে এমন একটা হাসির কান্ড চলছে আর আমরা হাসতে পারছিনা,, আর হাসতে পারবো না ভেবে আরো হাসি পাচ্ছে। তারপর ও হাসি দমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা শাস্তি ছাড়া আর কি?? তবে আমি খুশিই হয়েছি লোকটিকে দেখে কারন লোকটি “রিয়াদ ভাইয়া” ।যে সেদিন আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিলেন। সেদিনের পর আজকে প্রথম ওনার সাথে আমার দেখা হলো। সেদিনের ব্যাপারে যদি কিছু জানা যায়..।

একটু পর,,,,,

,,, সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপানির রোগীর মতো হাপাচ্ছেন রিয়াদ ভাইয়া,, অনেকটা পথ যে দৌড়ে এলেন।হাঁপাতে হাঁপাতে বলছেন,

,,,স সো সোনালী ,,, আমার কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।

মানবতার খাতিরে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ওনার দিকে এগিয়ে দিলাম। যদিও আমার দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু জেরিনের খোঁচা খুচিতেই দেখালাম মানবতাটা,, আর বললাম,

,,”রিলেক্স ভাইয়া,, শান্ত হয়ে তারপর সব খুলে বলেন”।

কয়েক ঢোঁক পানি গিলে নিলেন রিয়াদ ভাইয়া,,হাপানিটা কমেছে,, মাঠের একপাশে দাড়িয়ে আছি আমি ,, জেরিন আর রিয়াদ ভাইয়া।এবার তার ইতিহাস শুরু করলেন,

,, সোনালী,, তুমি হয়তো জানো না আমি ভার্সিটিতে যেদিন প্রথম তোমায় দেখি সেদিন থেকেই তোমাকে আমার বেশ ভালো লেগে যায়। তোমার ওই বড় বড় চোখ দুটোর মায়ায় পড়ে যাই আমি।(আমার চোখে চোখ রেখে),,, তোমাকে আরো গভীর থেকে জানার ইচ্ছে প্রচন্ড রকমের তাড়া করে আমায়।তাই চেষ্টা করতাম তোমার আশেপাশে থাকার।(চোখটা নিচু করে),, কিন্তু তুমি কি ভাবতে আমার তা জানা নেই ,,(হালকা একটা হাসি দিয়ে) আমাকে দেখলেই ৪৪০ভোল্টের ঝটকা খেয়ে এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি শুরু করে দিতে। এই ব্যাপারটা আমায় আরো টানতো তোমার দিকে। একটা সময় আমিও বুঝতে পারলাম যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেকবার চেষ্টা ও করেছি তোমাকে বলার কিন্তু সেই সুযোগ হয়ে ওঠে নি।

আমি বেশ অবাক হলাম। আমার অজান্তেই এই লোকটা আমাকে ভালোবাসতো?তাই এতো আগেপিছে ঘুরঘুর করতো আমার ?? কিন্তু আমি তো ওনাকে কখনো এমন চোখে দেখিনি।

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,

,, সেদিন তোমায় আমার মনে কথাটাই বলতে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু তা তো আর হলো না তার আগেই,,,(বলতে গিয়ে ও থেমে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করলেন),, তখন ও আমি জানতাম না তুমি কার ভালোবা,,,,,,,,

আর কিছু বলবেন তার আগেই একটি ছেলের ডাকে থেকে যায় রিয়াদ ভাইয়া। ছেলেটি বলল,

“,,আয় রিয়াদ ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”

রিয়াদ ভাইয়া আযর কিছু বললেন না ,, শুধু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি ওনার কথাগুলো ভেবে যাচ্ছি ।তবে একটা কথা হচ্ছে উনি সেদিন ওনার মনের কথাটা বলে দিলেও হয়তো আমি ওনাকে মেনে নিতে পারতাম না কারণ ওনাকে তো আমি কোনো দিন ওই নজরে দেখিনি। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম,,১০.৩০টা বেজে গেছে,, পরবর্তী ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তাই জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললাম,

,,”জেরিন চল,, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”

জেরিন ও স্বাভাবিক হলো।ও এটা জানে যে আমি রিয়াদ ভাইয়াকে পছন্দ করতাম না।তাই নিজেদেরকে সামলে নিতে সময় লাগলো না। ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম,,কারন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে তাই,,,

বিকেল ৩টা বেজে একটু বেশি। বাড়িতে সবাই রেডি হতে ব্যস্ত,, আমি আর ও দশ মিনিট আগে রেডি হয়ে বসে আছি ড্রয়িং রুমের সোফায়।আজ জেরিনদের বাসায় যাচ্ছি ওদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে।ভাইয়া বেশ এক্সাইটেড। আমার ও দশ মিনিট আগে থেকে রেডি হয়ে বসে আছে।রাত ভাইয়া ভালো আঙ্কেল আন্টি ও যাচ্ছে আমাদের সাথে । অপূর্ব ভাইয়ার বিয়ে বলে কথা। তবে আমি তো যাচ্ছি আমার বান্ধবীর বাসায় আমার মধ্যে এখন ও তেমন কোনো এক্সাইটমেন্ট প্রকাশ পাচ্ছে না। আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর একে একে সবাই এসে হাজির। শুধু রাত ভাইয়া বাদে। এই লোকটা সব‌ সময় দেরি করে দেয় সব কাজে। ওনার উপর আমার রাগের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভাইয়াকে নাকি বলেছেন সবাইকে গাড়িতে উঠতে। এবার একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।আর অপেক্ষা করতে হবে না বলে। একটা গাড়িতে আম্মু-আব্বু আর ভালো আঙ্কেল আন্টি উঠেছে।পড়ের গাড়িতে ভাইয়া আর ড্রাইভার ফ্রন্ট সিটে আর আমি পেছনে।সবাই বসে গেছে,, এবার গাড়ি ছাড়ার পালা।এমন সময় এক যুবক তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে ঢুকে আমার পাশে বসে পরলো। আমি একটু অবাক হয়ে যেই চেঁচাতে যাবো তখন ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি লোকটা রাত ভাইয়া। আমি আবার দমে গেলাম। শান্ত হয়ে সিটে বসে পড়লাম।উনি পাঞ্জাবি পড়েছেন। ভাইয়া আর ওনার পাঞ্জাবিটা প্রায় সেম শুধু কালার ডিফারেন্ট। বেশ লাগছে ওনাকে।ব্রাউন কালারের পাঞ্জাবীটা ওনার ফর্সা দেহে অসাধারণ লাগছে। তার উপর কালো সানগ্লাস।উফফ,,, কি লাগছে লোকটাকে। আমি বারবার ক্রাশ খাই।উনি পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্টট দিতে বললেন।

এই পাঁচ মিনিটের যাত্রা পথে আমি বিরক্তির তুঙ্গে উঠে গেছি।এর কারণ আমি আমার মতো বসে আছি ,, রাত ভাইয়া আর অপূর্ব ভাইয়া তাদের মতো কথা বলছেন। ভাইয়া মাঝে মধ্যে আমার কথা মনে করলে ও‌ রাত ভাইয়ার পাশে যে আমি এমন একটা জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছি তার কোনো ভাবান্তর ওনার মধ্যে দেখলাম না। এই পুরো ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করে তুলে ছিল।তাই জানালার দিকে মুখ করে বসে আছি। হঠাৎ টের পেলাম কেউ আমার কেউ আমা চুলের কাঁটাটা খুলে দিল।আর আমার চুল গুলো ও বন্যার বাঁধের মতো তরতর করে খুলে ছড়িয়ে পড়লো। আমি আঁচ করতে পারছিলাম যে এটা রাত ভাইয়ার কাজ। ওদিকে ফিরেই ওনারদিকে ইশারা করে বললাম,

,,”এটা কি হলো??”

উনি মৃদু স্বরে বললেন,

,”, এমন বুড়িদের মতো চুলগুলো খোঁপা করেছিস কেন??খুলে রাখা(দাঁতে দাঁত চেপে)।

ওনার সাথে কথায় আমি পারবো না আর ভাইয়া ও সামনে তাই আর কথা বাড়ালাম না।

আরো মিনিট দশেক পরে গিয়ে পৌঁছলাম জেরিনের বাসার গেটে। আমাদের ওয়েল কাম করার জন্য আঙ্কেল (জেরিনের বাবা) দাঁড়িয়ে ছিলেন।সবাই একে অপরকে সালাম বিনিময় করে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।সবাই ড্রয়িং ‌রুমে বসলেও আমি জেরিনের রুমে চলে যাই। সেখানে স্লিভলেস টপ আর লং স্কার্ট পড়ুয়া একটি মেয়ে জেরিনকে শাড়ি পরতে হেল্প করছে। ভালো করে যখন খেয়াল করলাম তখন মনে হলো হয়তো মেয়েটাকে আমি কোথাও দেখেছি। কিন্তু কিছু তেই মনে করতে পারছিনা যে কোথায় দেখেছি। হঠাৎ জেরিন আমাকে দেখে দৌড়ে একটা হাগ করে বলল,

,,”তুই এসে গেছিস? বাবা বাঁচা গেল।(একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে),,দেখ আমি কিছু তেই শাড়ি পরতে পারছি না।আপু আর আমি সেই কখন থেকে ট্রাই করছি।ওহ,,,সরি ,,সোনু এটা আমার কাজীন প্রিতি আপু ।আর আপু এটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সোনালী।(মেয়েটির দিকে তাকিয়ে)। আমাদের বিয়ের উপলক্ষে আমাদের বাসায় এসেছে আপু।”

আমি হায় বলে জেরিনকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কারণ ওনাকে দেখে এতো উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না তাই।একটু বাদেই জেরিনের ডাক পড়ল ড্রয়িং রুমে। তিনজনে একসাথে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলাম।প্রিতি আপুতো রাত ভাইয়াকে দেখে অবাক , রাত ভাইয়ার ও একি দশা। দুজনি একসাথে বলে উঠল,

,”তুই এখানে??

আমার ও মনে পড়লো এটাটো সেই মেয়েটা যার সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। যেদিন রাত ভাইয়ার বাইকে চড়ে আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম,,,

,, চলবে,,??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here