মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব -৬+৭

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৬
অথৈ উদ্বিগ্ন চোখেমুখে কান্নারত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।অতঃপর কাছে গিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।মেয়েটাও তার সাথে একই ক্লাসে পরে।তবে ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন।অথৈর হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটা তাকায় অথৈর দিকে।পর পর আবার কেঁদে দেয়।অথৈ নরম গলায় সুধাল,
‘ কি হয়েছে?কেন কাঁদছ তুমি?আজও কি কেউ তোমায় ডিস্টার্ব করেছে?করলে বলতে পারো আমায়।কোনো ভয় নেই।আমি আর আমার বন্ধুরা আছি তো।’

মেয়েটা কিছুই বলল নাহ।তবে পাশে থেকে ওর বান্ধবী বলল,
‘ ও কাঁদছে কারন ওইযে রুদ্রিক ভাইয়া আছে নাহ?তাকে আমাদের লিয়া পছন্দ করে।তাই আজ সাহস করে নিজের মনের কথা বলেছে ও গিয়ে। রুদ্রিক ভাইয়া তা গ্রহন তো করলই নাহ।সাথে লিয়াকে সবার সামনে অপমান করেছে।ওকে ধাক্কা মেরে আঘাত ও করেছে।’

সবটা শুনে অথৈর রাগ আকাশচুম্বি।কাউকে ভালো লাগতেই পারে।আর তাকে গিয়ে মনের কথাও জানাতে পারে।কিন্তু তাই বলে এইভাবে একটা মানুষকে হেনেস্তা করার কোনো মানে হয় নাহ।অথৈ রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
‘ কোথায় আছে এখন তারা।’
‘ ভার্সিটির পিছনে ওই পুকুরের কাছে।’

অথৈ এইবার রিধি,পিহু,আহিদ,প্রিয়ানের সামনে দাঁড়াল।রাগি গলায় বলে,
‘ চল আমার সাথে।’

প্রিয়ান যতোই খামখেয়ালি করুক না কেন! যতোই হাসিঠাট্টায় মেতে থাকুক। কিন্তু ওদের বন্ধুদের মাঝে বিপদের সময় ওই সবচেয়ে বুদ্ধিমান হয়ে উঠে।প্রিয়ান অথৈর হাত ধরে থামিয়ে দিল।ফলে রাগি চোখে তাকায় অথৈ।প্রিয়ান অথৈকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
‘ দেখ অথৈ রাগের মাথায় কিছু করিস নাহ।আগে ভালোভাবে সব জেনে নেহ।মনে রাখিস এক হাতে তালি বাজে নাহ।মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ দুপিঠই থাকে।তাই আগে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়ে এরপর কিছু বলিস।’

অথৈ প্রিয়ানের হাতের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
‘ আমি বাচ্চা নই।সবটা জেনে শুনেই যা করার করব আমি।’

———–
রুদ্রিক পুকুর পাড়ে বসে সিগারেট টানছে।প্রচন্ড রাগ লাগলে বা কষ্ট পেলে রুদ্রিক এই কাজটা করে।ইহান রাগান্বিত রুদ্রিকের কাধে হাত রাখল।হেসে বলল,
‘ আরে রাগ ঝেরে ফেল।হয়েছে তো।’

রুদ্রিক সিগারেটে লম্বা টান মেরে তার ধোঁয়াগুলো বাতাসে উড়িয়ে দিল।ইহানের কথায় ঘাড় ফিরিয়ে বলে,
‘ তুই আমায় রাগতে মানা করছিস?মানে আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না।মেয়েটা কি পরিমান চাইল্ডিস হলে আমার কথা মতো সত্যি সত্যি পুকুরে ঝাপ দিতে চলে গিয়েছিল।মানে এতো বোকা মানুষ হয় কিভাবে?এইসব ফালতু প্রেম ভালোবাসার কথা বলে নিজের জীবনটা দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায়। নিজের পরিবারের কথাও একবার ভাবল নাহ।’

ইহান রুদ্রিকের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলল,
‘ ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়।তখন আর কোনো হুশ জ্ঞান থাকে না।তুই যখন কাউকে ভালোবাসবি।তখন বুঝবি।’

রুদ্রিক রাগি গলায় বলে,
‘ যদি এটাকে ভালোবাসা বলে।তাহলে বলব স্যরি টু স্যে আরিহান রুদ্রিকের জন্যে ভালোবাসা নাহ।’

ইহান শান্ত স্বরে বলে,
‘ হয়েছে থাক।আজ যেই শিক্ষা দিয়েছিস মেয়েটাকে এতে সুধরে যাবে মেয়েটা।’
‘ হোপ সো।’

নীল,সাফাত,অনিক ওদের সামনেই বসে ছিল।হঠাৎ সাফাত দূর থেকে অথৈকে এদিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল।ওকে এইভাবে দাঁড়াতে দেখে সকলের দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়।ইহান নিজের বোনকে এইভাবে রনচণ্ডী রূপে এদিকে তেড়ে আসতে দেখে হকচাকাল।বলে উঠল,
‘ এর আবার কি হলো?ওমন বাঘিনী রূপে এমন তেড়েমেড়ে আসছে কেন?’

নীল ইহানের ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে হেসে বলে,
‘ নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস।এইজন্যে তোকেই ক্যালাতে আসছে।’

ইহান নীলের কথায় চিন্তার জগতে চলে গেল।ভাবতে লাগল ও এমন কিছু কি করেছে যাতে অথৈ রেগে যাবে?কিন্তু নাহ এমন কিছুই করেনি।অন্তত ওর মনে পরছে নাহ।ইহান চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
‘ আমি এমন কিছুই করিনি যে ও এমন রেগে থাকবে।না জানি কি হয়েছে। ‘

অনিক বলে উঠে,
‘ উফ বাদ দে তো।আগে এসে নিক তারপর নাহয় বোঝা যাবে।’

একটু পরেই অথৈ থমথমে মুখে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।সাফাত হেসে হাত নাড়িয়ে বলে,
‘ হাই অথৈ।কেমন আছ?’
‘ হাই হ্যালো পরে।আর হ্যা আপাতত আমি ভালো নেই।একদম নেই।’

অথৈর এমন শক্ত কণ্ঠের কথা শুনে সাফাতের মুখটা একটুখানি হয়ে গেল।এ বেচারা অথৈকে ভীষণ পছন্দ করে।সেদিন শাড়িতে অথৈকে দেখে প্রথম দেখাতেই ওকে ভালোলেগেছিল।বন্ধুর বোন জেনেও পিছুপা হয়নি।এতোটাই পছন্দ হয়েছে।সেদিন লুকিয়ে চুড়িয়ে অথৈর একটা ছবিও তুলেছিল।এখন দিনরাত যখনই সময় পায় অথৈর ওই ছবিটা দেখে।ভীষণ ভালালাগে ওর।কিন্তু আজ অথৈ ওর সেই ভালোলাগায় তীক্ষ্ণ কথার ধ’নুক ছুড়ে মেরে তাকে আহত করে দিয়েছে।সাফাতের চুপসানো মুখটা দেখে অনিক সাফাতের কাধে হাত রাখল।সাফাত তাকালে তাকে চোখের ইশারায় শান্তনা দিল।
এদিকে ইহান এগিয়ে গেল অথৈর কাছে।নরম বলল,
‘ কিরে?এতো রেগে কেন তুই?কিছু কি হয়েছে? ভার্সিটিতে কেউ তোকে কিছু বলেছে?নাকি আমি কিছু করেছি?’

অথৈ ধারাল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইহানের দিকে।তারপর বলে,
‘ আমায় কেউ কেউ কিছু বলেনি আর করেওনি।কারন সেই সাহস করার আগেই আমি অথৈ কি করতে পারি তা তুমি ভালোভাবেই জানো।কিন্তু ঘটনা তো কিছু হয়েছে অবশ্যই।আমার সাথে না অন্য একটা মেয়ের সাথে।আর সেটা তুমি না করে থাকলেও করেছে তোমার বন্ধু।’

অথৈ অগ্নিদৃষ্টি গিয়ে ঠেকল রুদ্রিকের দিকে।ইহান সেটা লক্ষ্য করে বলতে চাইল,
‘ দেখ রাগিস না অথৈ।আগে সবটা শুনে নেহ।’
‘ যা শোনার আমি তোমার বন্ধুর থেকেই শুনতে চাই।আর যা বলার আমি তাকেই বলব।সো প্লিজ ভাইয়া চুপ থাকো।’

অথৈ ইহানের পাশ কাটিয়ে গিয়ে রুদ্রিকের সামনে দাঁড়াল।রুদ্রিকের কোনো হেলদোল নেই।ওর সামনে যে অথৈ এসে দাঁড়িয়ে আছে সেটার বিন্দুমাত্র আভাস ও পায়নি এমন একটা ভান ধরে আছে।নির্বিকার ভঙিতে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।এতে যেন অথৈর রাগ আরো বারল।ও হাত উঠিয়ে রুদ্রিকের ঠোঁটে গুজে থাকা সিগারেটটা টেনে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিল।তারপর তা পা দিয়ে পি’ষে ফেলল।অথৈর এমন ভয়ানক এক কান্ডে সবার মুখে হাত।কারন রুদ্রিকের সাথে এমন আচরণ করার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি।কিন্তু আজ সেটা অথৈ করে দেখিয়েছে।এদিকে যাকে নিয়ে সবাই এতো ভয় পাচ্ছে সে নিজেই শান্ত হয়ে বসে।চুপটি করে অথৈর রাগান্বিত লাল হয়ে থাকা মুখশ্রীতে তার দৃষ্টি মেলে রেখেছে।রুদ্রিককে এখনও এমন শান্ত দেখে অথৈ রেগে বলে,
‘ আপনার লজ্জা করে না একটা মেয়ের সামনে এভাবে বসে সিগারেট খেতে।’
‘ নাহ করে না।কারন আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে সিগারেট খায়নি।উলটো মেয়েটা আমার সামনে এসেছে।দ্যান হোয়াট ক্যান আউ ডু?’

রদ্রিক কথাগুলো বলে আবারও একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরাতে যাবে।অথৈ তা টেনে নিয়ে আবারও পানিতে ফেলে দিল।রুদ্রিক আবারও একই কাজ করলে অথৈও নিজের কাজ রিপিট করে।এভাবে চার পাঁচটা সিগারেট ফেলে দিয়ে অথৈ বিরক্তির চরম শিখায় পৌছে গিয়েছে।রুদ্রিক এইবার সিগারেটের গোটা প্যাকেটটাই অথৈর দিকে এগিয়ে দিল।অথৈ রাগে ফেটে যাচ্ছে।ও প্রায় একপ্রকার রুদ্রিকের হাতে খামছি মেরেই রুদ্রিকের হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে পানিতে ফেলে দিল।রুদ্রিকের হাতে নখের আঁচড়ে খানিক র’ক্তও বেরিয়েছে। তবে ও খুব শান্ত।শান্ত স্বরেই বলে,
‘ সব সিগারেট ফেলে দিয়েছ।নাউ হ্যাপি?যদি খুশি হয়ে থাকো তাহলে তুমি এখন আসতে পারো।’

অথৈ দাঁতেদাঁত চেপে বলে,
‘ বাট আমার আপনার সাথে কথা আছে।’
‘ ওকে ফাইন।বলতে থাকো।আমি শুনছি।সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।’

অথৈর মন চাচ্ছে এই রুদ্রিকের মাথায় বড় একটা ইট মে’রে এর মাথা ফা’টিয়ে দিতে।নাহলে জোড়েসোড়ে একটা খুশি মেরে এই পুকুরে ফেলে দিতে।তারপর আচ্ছামতো একে চুবিয়ে চুবিয়ে আধম’রা করে তারপর উঠাতে।এতো এটিটিউট কাকে দেখাচ্ছে এই হনুমানটা।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রিক হাত ঘড়িয়ে সময় দেখে নিয়ে বলে,
‘ তোমার ৪৫ সেকেন্ড অলরেডি শেষ।তাড়াতাড়ি করো।’

অথৈ চোখ বন্ধ করে জোড়ে শ্বাস ফেলল।নিজের রাগটুকু সামলে নিয়ে বলে,
‘ আপনায় একটা মেয়ে আজ প্রপোজ করেছিল।আপনি এক্সেপ্ট করেননি তাই নাহ?’
‘ হুঁ!’
‘ আপনি কি মেয়েটাকে পুকুরে ঝাপ দেওয়ার জন্যে ফোর্স করেছিলেন?’
‘ উহু ভুল বললে।আমি ঝাপ দিতে বলেছি।কিন্তু ফোর্স করেনি ওকে।ও সেচ্ছায় গিয়েছে।’

রুদ্রিক শুধরে দিল অথৈর কথায়।অথৈ আবার বলে,
‘ আপনি মেয়েটাকে অপমান করেছেন?’
‘ হুঁ! সি ডিজার্ব ইট।’

অথৈ দাঁতেদাঁত চেপে বলে,
‘ মেয়েটাকে দুই দুইবার ধাক্কা মেরেছেন।’
‘ হুঁ!করেছি তো.?’

রুদ্রিক অথৈর সকল প্রশ্নের জবাব সোজাসাপ্টা দিয়ে দিয়েছে।কোনো ভণিতা করেনি।কিন্তু রুদ্রিকের এমন আচরণে রেগে এক অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটিয়ে ফেলল।একেবারে রাগে বাঘিনী হয়ে রুদ্রিকের শার্টের কলার ধরে ফেলল।
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৭
রুদ্রিক খুব শান্তভাবে তাকিয়ে দেখছে অথৈকে।ওকে এতোটা শান্ত দেখে ইহান,সাফাত,নীল আর অনিক প্রচুর ঘাবড়ে আছে।কারন আজ পর্যন্ত এই সাহস কেউ করেনি।অথৈ প্রথম যে আজ রুদ্রিকের কলার ধরার দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছে।রুদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,
‘ কলার ছাড়ো।’

অথৈ শক্ত কণ্ঠে বলে,
‘ যদি বলি ছাড়ব নাহ?তাহলে কি আমাকেও ওই মেয়েটার মতো পুকুরে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখাবেন?নাকি ধাক্কা দিবেন?কোনটা?’

রুদ্রিক তারপরেও বেশ শান্ত।কোনোরকম রাগের ছোঁয়া নেই ওর মুখশ্রীতে।ঘটনা আরও বিগরে যাওয়ার আগে নীল ইহানকে বলে,
‘ ইহান দ্রুত যা।তোর বোনকে সরা রুদ্রিকের সামনে থেকে।ও এখন শান্ত আছে এই না যে সবসময় থাকবে।ও রাগলে কিন্তু যা তা হয়ে যেতে পারে।’

ইহান নীলের কথায় সম্মতি প্রকাশ করল।তারপর দ্রুত চলে গেল অথৈর কাছে।অথৈকে কিছু না বলে আগেই ওকে টেনে রুদ্রিকের কাছ থেকে সরিয়ে আনল।ইহানের এমন কান্ডে অথৈ প্রচুর রেগে যায়।বলে,
‘ আমাকে টেনে এখানে আনলি কেন ভাই?ছাড় আমাকে।’

ইহান বলল,
‘ তুই ভুল বুঝছিস।একটু শান্ত হয়ে শোন আমার কথা।’
‘ আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই নাহ ভাইয়া।তোর বন্ধুই তো সব স্বিকার করল।তাহলে আমাকে আটকাচ্ছিস কেন?তার সাহস কি করে হলো এইভাবে একটা মেয়েকে ভার্সিটির মধ্যে অপমান করার।মেয়েটা প্রপোজই তো করেছিল।তোর বন্ধু এমন রিয়েক্ট করল যেন সে ভাঁজা মাছ উলটে খেতে পারে না।অথচ তলে তলে ঠিক কতো কিছু যে করে বেড়ায় তুই জানিস নাহ।’

অথৈ আবারও তেড়ে যেতে নিলে।ইহান এইবার রেগে যায়।এমন না যে ইহান অথৈকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মানা করে।এটা সে কোনোদিন করবেও নাহ।কারন অন্যায় দেখে মুখ বন্ধ করা থাকা মানুষটাও অন্যায়কারি।তাই ছোটো থেকে ও অথৈকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে।কিন্তু অথৈ যে আজ এইভাবে একটা ঘটনা নিয়ে সিনক্রিয়েট করবে ভাবতে পারেনি।যেখানে অথৈ পুরো বিষয়ে জানেও নাহ।সবকিছুর একটা লিমিট থাকে।ইহান রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সবার সামনেই সজোড়ে চ’ড় মারে অথৈর গালে।বিষ্ময়ে সবার মুখে হাত চলে যায়।আজ বহুদিন পর ভাইয়ের হাতে এইভাবে মার খেল অথৈ।তাও এতোগুলো মানুষের সামনে।অথৈর মনে আছে ও লাস্ট ইহানের হাতে এমন চড় খেয়েছিল ক্লাস সেভেন এ থাকতে।তখন একটা ছেলে ওকে রাস্তায় বাজে কথা বলেছিল।আর অথৈ কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরেছল।অথৈ৷ প্রতিবাদ কেন করেনি। কেন সেই ছেলেটাকে কষিয়ে দু ঘা দিতে পারেনি।সেই জন্যে মেরেছিল।আর আজ এতোগুলো বছর পর ইহান আবার ওকে মারল।বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছে না অথৈ।গালে হাত দিয়ে অবাক নয়নে ইহানকে দেখছে।ওর ভাই ওকে এইভাবে মারতে পারল?বুকের বা পাশটায় তীব্র ব্যথা হচ্ছে।অভিমানি অশ্রু বিন্দুরা এসে ভীড় জমিয়েছে চোখেত কোণে।
ইহান চোয়াল শক্ত করে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ ইহান নিজের রাগ আর কন্ট্রোল করতে পারেনি। তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে নিয়ে এমন কটুক্তি ওর একদম সহ্য হয়নি।তার উপর ওর বন্ধুর কোনো দোষ নেই যেখানে।ইহান ধমকে বলে উঠল,
‘ তোর সাহস কিভাবে হলো রুদ্রিকের কলার এইভাবে ধরার?সে তোর কতো বড়ো এটা জানিস তুই?এতোটা বেয়াদপ তুই কিভাবে হলি?আমি তোকে প্রতিবাদি বানিয়েছি ঠিক আছে।কিন্তু এই না যে তুই বিনা অন্যায়কারির সাথেও তুই এমন ব্যবহার করবি।তোকে আমি বার বার শিখিয়েছি।কোনো পরিস্থিতে সিনক্রিয়েট করার আগে সবটা ভালোভাবে জেনে নিবি।এই তাহলে আমার শিক্ষার নমুনা?এতোদিন তোর প্রতি প্রাউড ফিল হতো।কিন্তু আজ তো তুই আমাকে সবার সামনে নিচু করে দিল।এমন ব্যবহার তোর থেকে আশা করিনি আমি।তুই রুদ্রিকের দোষ দিচ্ছিস তাই নাহ?তাহলে শোন কে দোষী।’

ইহান একে একে সবটা বলল অথৈ।সবটা শুনে অথৈ যে আকাশ থেকে পরল।তাহলে আসলেই কি ও আজ অন্যায় করে ফেলল?রুদ্রিক তো ঠিকই ছিল।মেয়েটাকে এমন একটা শিক্ষা না দিলে পরবর্তীতে মেয়েটা আবারও রুদ্রিকের কাছে।আর এই সামান্য ভালোবাসার কারনে এতো বছর আদর যত্ন করে বড়ো করে তোলা বাবা মায়ের কথাও ভাবেনি।তাহলে এই মেয়ে যে সত্যি সত্যি রুদ্রিককে ভালোবাসে এর গ্যারান্টি কি?বুকের মাঝে তীব্র অনুশোচনা জাগ্রত হলো অথৈর।এইভাবে মানুষটাকে অপমান করা ওর ঠিক হয়নি।আজ প্রথমবার নিজের কাজে নিজে এতোটা লজ্জিত অথৈ।করুন চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।অনেক কান্না পাচ্ছে ওর।কিন্তু এইভাবে সবার সামনে কান্না করার মেয়ে অথৈ নাহ।ভেজা কণ্ঠে কিছু বলবে তার আগে ইহানের উচ্চস্বরের ধমকে থেমে গেল।
‘ জাস্ট সাট আপ।তোর মুখ থেকে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই নাহ।চলে যাহ আমার সামনে থেকে।’

অথৈ ঠোঁট ভেঙে কান্না আসতে চাইছে।তাই আর একমুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল অথৈ।অথৈ চলে যেতে ইহান রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদকে বলল,
‘ তোমরা ওর পিছু পিছু যাও।ওকে একা ছেড়ো নাহ।’

ইহানের কথামতো ওরা সবাই চলে গেল।সাফাত রুদ্রিকের কাছে এসে দাঁড়াল।রুদ্রিক ভ্রু-কুচকে তাকালে সাফাত বলে,
‘ তোর কারনে ইহান অথৈকে মারল?’

এমন একটা কথায় ইহান,নীল আর অনিক তাকাল সাফাতের দিকে।অনিক বলল,
‘ মাথা ঠিক আছে তোর?ইহান ওর বোনকে মেরেছে।এখানে রুদ্রিকের দোষ কোথায়?’

সাফাত রাগি গলায় বলে,
‘ কেন ও ইহানকে থামাতে পারেনি অথৈকে চড় মারার থেকে।’

রুদ্রিক প্যান্টের পকেটে হাত খুজে ভাবলেসহীন গলায় বলে,
‘ ওর বোন অন্যায় করেছে।তাই ইহান ওর বোনকে মেরেছে।এখানে হোয়াট ক্যান আই ডু?’

ইহানও বলল,
‘ হ্যা সাফাত।তুই আবার কি বলছিস?অথৈ অন্যায় করেছে তাই আমি ওকে মেরেছি।এখানে রুদ্রিকের কোনো দোষ তো নেই।তুই শুধু রুদ্রিককে কেন কথা শোনাচ্ছিস?’

সাফাত বিরক্তকর কণ্ঠে বলে,
‘ যা মন চায় কর তোরা।আমি যাচ্ছি।’

এই বলে সাফাত চলে গেল।ওকে এইভাবে যেতে দেখে নীল অনিকের কানে কানে বলে,
‘ এই সাফাতের আবার কি হলো?’

অনিক বলে উঠল,
‘ সাফাত অথৈকে পছন্দ করে।এইজন্যেই অথৈকে থাপ্পড় মারায় ও রেগে এইসব বলল।’

নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘ এতো সবে শুরু।আমার মনে হচ্ছে সামনে আরও ভয়ানক কিছু হতে চলেছে।’

————
চারপাশে অন্ধকার ঘিরে আছে।প্রকৃতিতে শীতল বাতাস বইছে।সেই বাতাসে কোথা থেকে যেন নাম না জানা ফুলের ঘ্রান ভেসে আসছে।রাতের আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছে।সেই সাথে গুটিগুটি মিটমিট করে জ্বলতে থাকা অসংখ্য তারা।একটু পর পর মেঘের কুন্ডলীগুলো এসে চাঁদ মামাকে ঢেকে দিচ্ছে।সেইদিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অথৈ।চোখজোড়া ভয়ানক পরিমান লাল হয়ে আছে।সেই সাথে ওর পুরো মুখশ্রীও লাল হয়ে আছে।অথৈকে এই অবস্থায় দেখে রিধি,পিহু,প্রিয়ান,আহিদ ওরা চারজন একে-অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল।তারপর চারজন একসাথে গিয়েই নিস্তব্ধে বসে পরল অথৈর পাশে।এদিকে অথৈ পাশে কারো বসার উপস্থিতি টের পেল।না দেখেই বুঝতে পেরেছে ও এরা ওর চার বন্ধু।অথৈ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
‘ তোরা এখানে কেন এসেছিস?কয়টা বাজে?বাড়ি যাসনি কেন?’

প্রিয়ান বলে উঠল,
‘ এটা তুই কি বললি দোস্ত?তোর মনে এতো দুঃখ।সেই দুঃখে তুই এখানে এসে শোক পালন করছিস।তোর এই অবস্থায় তোকে একা রেখে আমরা যাই কিভাবে বল?তোকে সঙ্গ দিতেই এলাম।চারজন নাহয় একসাথেই শোক পালন করলাম।’

অথৈ চুপ করে আছে।ওর মাঝে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই।পিহু চোখ রাঙিয়ে তাকাল প্রিয়ানের দিকে।কটমট করে বলে,
‘ এই ফালতু কথা বলার চেয়ে।তুই তোর মুখটা বন্ধ রাখ।’
‘ এই ফকিন্নি! তোর কথাতেই কি আমি চুপ করব নাকি?’

প্রিয়ানের কথায় পিহু ওর দিকে তেড়েমেড়ে আসতে আসতে বলে,
‘ তোকে আজ আমি এই ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে যদি না ফালাইছি।শয়তান কোথাকার।’
‘ তিন ফুইট্টা মাইয়া। এই বাঁশের কঞ্চির মতো শরীর নিয়া তুই আসছোস আমাকে ছাদ থেকে ফেলার জন্যে।’

প্রিয়ানের কথায় পিহু রেগে বলল,
‘ তুই আবার….আবার আমাকে এইসব বলে ইনসাল্ট করছিস?দেখিস কুত্তা তোর কপালে আমার থেকেও খাটো আর চিকন মেয়ে জুটবে।এটা বলছি কেন আমি।তোর কপালে কোনো মেয়েই জুটবে নাহ।’

প্রিয়ান কিছু বলবে তার আগে আহিদ ওর মুখ চেপে ধরল।রিধিও পিহুকে টেনে নিয়ে আসল।রিধি হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,
‘ তোরা এখানে অথৈর মন ভালো করতে এসেছিস? না-কি নিজেরা নিজেরা কুত্তার মতো ঝগরা করতে এসেছিস?সারাটাদিন শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া।’
‘ ওই তো শুরু করল।’
‘ চুপ থাক পিহু।’

রিধির কথায় পিহু চুপ হয়ে গেল।আহিদও প্রিয়ানকে বলল পিহুর সাথে আর ঝগড়া না করতে।এরপর আহিদ গিয়ে অথৈর বাসে বসল। অথৈর কাধে হাত রেখে বলে,
‘ তুই রাগ করবি জানি।তবুও বলব আজ তুই যা করেছিস একটু না অনেকটাই বাড়াবাড়ি করেছিস।’

প্রিয়ানও আহিদের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে,
‘ হুম আহিদ ঠিক বলছে অথৈ।আমি আগেই বলেছিলাম এক হাতে তালি বাজে নাহ।আগে সম্পূর্ণ ঘটনা জেনে তারপর যা করার করতে বলেছিলাম।আর তোর আগে ভাগে এমনটা করা একদম ঠিক হয়নি।প্রথমে গিয়ে তোর ইহান ভাইয়ার সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত ছিল।রুদ্রিক ভাইয়া আমাদের অনেক বড়।আজ তুই যা করেছিস এটা বেয়াদ’বি হয়ে গিয়েছে।বন্ধু হয়ে যেমন তোর প্রতিটা ভালো কাজে তোর সাপোর্ট করা আমাদের উচিত।তোর পাশে থাকা উচিত।ঠিক তেমনই তুই ভুল করলে তোকে সঠিক পথে আনাটাও আমাদের দায়িত্ব।এমনকি সেটা শুধু তোর ক্ষেত্রে না আমাদের সবার ক্ষেত্রে।’

অথৈ ছলছল চোখে তাকাল ওদের দিকে।ধরা গলায় বলল,
‘ আজ আমি ভাইয়াকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।ভাইয়া আমাকে সবসময় সাপোর্ট করে এসেছে।আমার প্রতিটা কাজে।আজ আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি।এইজন্যেই ভাইয়া আজ এতোগুলো বছর পর আমার গায়ে হাত তুলল।আমি কিভাবে ভাইয়ার সামনে যাবো?ওর বন্ধুদের সামনেও ওকে ছোটো করে দিয়েছি।’

অথৈর চোখে জল দেখে ওরা সবাই গিয়ে অথৈকে জড়িয়ে ধরল।অথৈও ওদের সবাইকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।বন্ধুদের ভরসাস্থলে হৃদয়ের দুঃখগুলো উজাড় করে দিল।

#চলবে________
?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here