মন দিতে চাই পর্ব -০৩

#মন_দিতে_চাই
#৩য়_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

মামি আমার সামনে আমার মায়ের চেইনটা ছু*ড়ে দিল জানালা দিয়ে। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। কাঁদতে শুরু করে দিলাম।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,
বিয়ে ঠিক করে ওনারা ফিরে যাওয়ার পর মামি আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমিও মামির পিছন পিছন গেলাম। মামির রুমে গিয়ে বললাম, আমার মায়ের গলার চেইনটা আমায় দিয়ে দাও মামি।

কেন দেব? তুই কি আমার কথা শুনেছিস? শুনিস নি। এই চেইনও আর পাবিনা।

এসবই ঘটে গেল আমার সাথে। মামি চেইনটা জানালা দিয়ে বাইরে ছু*ড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই আমি দৌড়ে বাইরে চলে গেলাম। মামির জানালার নিচের দিকে ঝোপঝাড়। সেখান থেকে চেইনটা খুঁজে পেতে আমার অনেক অসুবিধা হচ্ছিল। অনেক কষ্ট করে খোঁজার পর অবশেষে আমি চেইনটা খুঁজে পাই।

চেইনটা গলায় পড়ে নেই। এই চেইনটা পড়লেই মায়ের কথা আমার মনে পড়ে যায়। চেইনটা পড়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। আমার চোখে তখনো জল ছিল। মামা ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল। আমাকে এভাবে দেখে বিচলিত হয়ে যায় মামা। ভ্রু কুচকে আমাকে প্রশ্ন করে, তুই কাঁদছিস কেন ঝিনু?

মামিও চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চলে আসল। ভয়ে কাপছে মামি। আজ যদি আমি মামাকে সব বলে দেই তাহলে মামা মামির বিচার করবে। মামি সেটা খুব ভালো করেই জানে। তাই চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু না বলতে। মামি আমার উপর যতই অত্যাচার করুক না কেন আমি তার খারাপ চাই না। আমি চাইনা আমার জন্য তাদের সংসারে অশান্তি হোক। তাই আমি মামাকে মিথ্যা বললাম, মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই কাঁদছিলাম।

মামা এ নিয়ে আর কিছু বললেন না। মামি আমায় ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হতে বললেন। আমি নিজের ঘরে গিয়ে ডুকরে কাঁদতে লাগলাম। মামির এইসব অত্যাচার আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি অপেক্ষায় আছি কোনদিন আমার বিয়ে হবে আর আমি এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো।

হঠাৎ করে স্নিগ্ধা আপি আমার রুমে প্রবেশ করল। আমার দিকে তার ফোন বাড়িয়ে হেসে বলল, তোর উডবি হাজবেন্ড মুক্তো কল দিয়েছে। তোর সাথে কথা বলতে চায়। নে তুই কথা বল।

আমি কাপা কাপা হাতে ফোনটা হাতে নিলাম। হ্যালো শব্দটা কানে আসতেই আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এত সুন্দর গলার স্বর কোন মানুষের হয়? যার গলার স্বর এত সুন্দর না জানি সে দেখতে আরো কত সুন্দর হবে।

হ্যালো আপনি কি মিস ঝিনুক বলছেন?

জি, আমি ঝিনুক।

আপনার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছিল তাই ফোন দিলাম কিছু মনে করেন নি তো?

না।

মমের কাছে শুনলাম আপনি নাকি আমার ওখানে না যাওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন। বিয়ের আগে থেকেই এত শাসন। আমার তো মনে হচ্ছে আমার ড্যাডের মতো আমার লাইফটাও হেল হয়ে যাবে বিয়ের পর।

হিল? হিল কেন হতে যাবে? হিল তো মানুষ পায়ে পড়ে। আপনাকে আমি মাথায় তুলে রাখব।

আপনি তো খুব ভালো ফান করতে পারেন।

ফ্যান? আমি ফ্যান তৈরি করতে পারি না। আমি তো ফ্যানের বাতাস খাই শুধু।

মুক্তো এবার উচ্চশব্দে হেসে দিল। ফোনটা স্পিকারে থাকায় স্নিগ্ধা আপি সব শুনতে পেয়েছে। আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল, আপনি কিছু মনে করবেব না৷ আসলে ঝিনুক গ্রামের মেয়ে তো তাই এত ইংরেজি বোঝে না।গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছে তো ওখানে ভালো ইংরেজি শেখায় না। বিয়ের পর আপনি ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন।

স্নিগ্ধা আপির কথায় আমি অপমানিত বোধ করলাম। চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলাম না। আমাকে কাঁদতে দেখে স্নিগ্ধা আপি বলল, সরি ঝিনুক। আমি বুঝতে পারিনি তুই কষ্ট পাবি।

আমি জানি আমি ভালো ইংরেজি জানি না। তাই বলে তুমি ওনার কাছে আমাকে এভাবে বলবে। তোমার মতো ইংরেজি হয়তো জানিনা কিন্তু আমি মূর্খ নই। এসএসসি ও এইচএসসিতে পাস করেছি।

স্নিগ্ধা আপি আমায় জড়িয়ে ধরল। আমি আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। মুক্তো কল রেখে দিয়েছে। আমার খুব অভিমান হলো তার উপর। একটু নাহয় ইংরেজি বুঝতে পারিনি সেই জন্য আমার সাথে কথা বলবে না।

❤️
মামি রাতে আমায় দুটো শুকনো রুটি আর বাসি ডাল খেতে দিল। আমি সেটুকুই খেয়ে নিলাম। অথচ কত ভালো ভালো রান্না হয়েছিল বাড়িতে। পোলাও, মুরগীর মাংস, খাশির মাংস, হাঁসের মাংস, চিকেন কাটলেট, চিকেন বিরিয়ানি, ফিশ ফ্রাই, ইলিশ মাছ, ছোট মাছ, চিংড়ি মাছ, ভুনা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, দই, মিষ্টি,সিঙারা আরো কত কি। সেসবের কিছুই আমি পেলাম না। শুধু গন্ধ শুনেই পেট ভরাতে হলো।

খাওয়া শেষ করে রাতে ঘুমোতে গেলাম। ঘুমানোর আগে ভাবতে লাগলাম বিয়েটা যে কবে হবে। মামির এইসব অন্যায় আর আমার সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে নিয়ে অনেক সুন্দর স্বপ্ন আমার। সেইসব স্বপ্ন নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

আজ বুধবার। এই দিন মামি তার বাপের বাড়ি যায়। আজ অব্দি কোনদিন আমাকে নিয়ে যায়নি। আজ কি যেন মনে করে আমাকে নিয়ে যেতে চাইল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম তার সাথে যেতে।

মামির বাড়িতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম সে কেন আমায় নিয়ে এসেছে। নিজের পরিবারের সবার সামনে অপমান করতে। যখন মামির ভাইয়ের বউ জিজ্ঞাসা করল আমি কে মামি বললো আমি নাকি কাজের মেয়ে।

নিজের চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলাম না। শেষপর্যন্ত কিনা মামি আমায় কাজের লোক বানিয়ে দিল। এত খারাপ কিছু ছিল আমার ভাগ্যে। মামি এতটুকুতেই শান্তি পেল না। সবার সামনে আমাকে নিজের জুতা পরিস্কার করতে বলল। আমি চোখভরা জল নিয়েই মামির জুতা পরিস্কার করে দিলাম।

মামির বাড়ির কাজের লোক নাকি আজকে আসে নি। সেইজন্য সব রান্নাবান্না আমাকে একা হাতে করতে হলো। রান্নার লিস্ট কিন্তু ছোট না। আমার প্রায় ৫ ঘন্টা লাগল সব রান্না করতে। রান্না শেষ করে একটু ঘুমাতে যাব কিন্তু মামি আমায় বলল, এই বাড়ির কোন ঘরে ঢুকবি না। যদি কিছু চুরি করিস।

আমি কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর মামি আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলল। আমায় বলল, ঐ নবাবের বেটি। এভাবে ঘুমাচ্ছিস কেন? তোকে কি এখানে ঘুমানোর জন্য নিয়ে আসছি? যা প্লেটগুলো মেঝে আয়। গায়ে গতরে খাট।

আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।মামির আদেশমতো সব কাজ করলাম। সব কাজ করার পর মামি আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়িতে এসে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। মামা আর স্নিগ্ধা আপি বাড়িতে থাকায় মামি আমাকে কিছু বলতে পারবে না।

ঘুম থেকে উঠে খুব খারাপ একটা খবর পাই। নানি নাকি খুব অসুস্থ তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি আর অপেক্ষা না করে চলে গেলাম মেডিকেলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম নানিও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। নানি আমাকে খুব ভালোবাসতো। মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে আগলে রেখেছিল। কয়েক মাস আগে থেকে নানি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। তখন থেকেই মামির অত্যাচার শুরু। এখন নানিকে হারিয়ে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here