মন নিয়ে পর্ব -০৯+১০ ও শেষ

মন নিয়ে (পর্ব ৯)

খাওয়া শেষ করে পারি কাউন্টারে চলে গেল বিল দিতে। ফিরে আসতে রিক বলল
— বিলটা আমি দিতাম নাহয়।
আশ্চর্য হয়ে গেল পারি
— আমি তো আগেই বলেছি লাঞ্চ আমি খাওয়াবো।
— তা বলেছ।
গতরাতের লোকটির কথা আবার মনে পড়ে গেল রিকের। কই তখন তো বিল সেই দিয়েছিল। দুজনের বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে বোঝা যাচ্ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক দুজনের। কী সম্পর্ক এদের মধ্যে? ওর জন্যই কি পারিজার মুখে হাসি নাই?

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পিরামিডের দিকে এগুতে থাকে। রিক মনেমনে ঠিক করে ফেলল যেভাবেই হোক ও পারিজাকে হাসিয়ে দেবে। পারিজার হাসিমুখটা সত্যি খুব এট্রাকটিভ।
দুপাশে অস্থায়ী দোকান, মাঝখানে পায়েচলা পথ। সেটা ধরে ওরা এগিয়ে যেতে থাকে। জায়গাটায় বেশ গাছ। যারজন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে ওদের জন্য, কিছু বোঝার উপায় নাই। হুট করে গাছপালা শেষ হয়ে গেল, ওরা এসে পড়ল খোলা জায়গায়। সামনে রাজকীয় গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চিচেন ইতজার স্টেপ পিরামিড এল কাসটিলো।

— ওহ মাই গড! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল পারির।
হাসল রিক— টোল্ড ইউ। এজন্য আগে থেকে কিছু বলতে চাইনি। আমিও ঠিক এ কথাটাই বলেছিলাম।
— ইটস গর্জাস, রিক। আই ক্যাননট বিলিভ ইট। রিকের হাত চেপে ধরল পারি। পারির দিকে একবার তাকিয়ে দেখল রিক। পারিজার খেয়ালই নাই।
— বাতাসে একটা প্রাচীন গন্ধ। যেন যেকোনো মুহূর্তে সব টুরিস্ট উধাও হয়ে গিয়ে বহুপুরাতন কোনো দৃশ্য দেখতে পাবো।
হাসল রিক
— আর ইউ এ পোয়েট?
বাস্তবে ফিরে এল পারি।
— একেবারেই না। কিন্তু পিরামিডের বিশালত্বের কাছে সবকিছু মনে হচ্ছে তুচ্ছ। চলো কাছে যাই।

হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পারি। রিকের খুব ইচ্ছা করল এগিয়ে গিয়ে পারিজার হাতটা ধরে। কিন্তু ধরল না। পারিজা খেয়াল করে ওর হাত ধরেনি। এখন ও ধরলে পারিজা নিজেকে গুটিয়ে নেবে। যতটুকু সহজ হয়েছিল, নিমেষে বদলে যাবে।
রিক গতবারেই একটা গাইডেড ট্যুর নিয়েছিল। অনেককিছু মনে আছে ওর। হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকে ও।

— চিচেন ইতজা কিন্তু সিটির নাম। মায়া সভ্যতার এক প্রাচীন শহর। আর পিরামিডের নাম এল কাস্টিলো। এর প্রত্যেক সাইডে ৯১টা করে সিঁড়ি রয়েছে। যারজন্য একে স্টেপ পিরামিড বলা হয়ে থাকে। এর ভিতরে রেড জাগুয়ার সিংহাসন পাওয়া গিয়েছে। বলা হয়ে থাকে এখানে একসময় নরবলি দেয়া হত।
— আশ্চর্য না? কত মানুষের যে কত অদ্ভুত ধ্যান ধারণা।
— হু, একসময়ে চিচেন ইতসা থেকে লোকে বাস উঠিয়ে নিল। কারণ হিসাবে খরাকে ধরা হয়। সেটা তখন হয়ে গেল ঘোস্ট টাউন। সময়ের সাথেসাথে জঙ্গলে ঢাকা পড়ল পুরা জায়গাটা। কিন্তু শহর হয়ে গেল কিংবদন্তীর শহর।
— তারপর? মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে পারি।
— তারপর বিদেশী কিছু ট্রাভেলার একে আবিস্কার করে। তারপর এর সংস্কার হয়ে এখন এটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। আগে এর সিড়ি ধরে ওঠানামা করা যেত কিন্তু ২০০৬ এর পর থেকে অনুমতি দেয়া হয় না। এক মহিলা সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়, সে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।
— ইশ যদি আগে আসতে পারতাম। তাহলে উঠতে পারতাম। ছেলেমানুষের মতো পারি বলে উঠল।
হাসল রিক
— সেই। আমার কিন্তু পিরামিডের চাইতেও সিনোটি বেশি ইন্টারেস্টিং লেগেছে। আশেপাশে মোট চারটি সিনোটি আছে। সেখান থেকে লোকে পানি সংগ্রহ করত সেসময়ে। কারণ নদী ছিল না। তাই সিনোটিগুলি ছিল একমাত্র ভরসা। তবে যে সিনোটি সবচাইতে বিখ্যাত সেটার কিন্তু আরও একটা কাজ ছিল।

— কী কাজ?
— পিরামিড দেখা শেষ করো আগে। তারপরে চলো সিনোটির দিকে যাই। তখন বলছি।
পিরামিডের চারিদিকে পারি ঘুরে ঘুরে দেখল। সাথে আরও অনেক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। কিছু খনন কাজ তখনো চলছে। যতো দেখে, পারির বিস্ময় ততোই বেড়ে যায়। একসময়ে রিক বলতে বাধ্য হল

— এরা কিন্তু পাঁচটার সময় বন্ধ করে দেবে। তার আগে চলো সিনোটির দিকে যাই। একটু হাঁটতে হবে।
— চলো।
এ সিনোটি টা গতকালকের মতো না। এর নাম সিনোটি সাগ্রাডো। কিনার থেকে প্রায় ৯০ ফিট নীচে তাকালে পানি দেখা যায়।
— মা গো!
— বি কেয়ারফুল, পারিজা।
— আমি কেয়ারফুলই আছি। হঠাত করে নীচে তাকিয়ে চমকে গেছিলাম আরকি। এখন বলো কী বলবে বলছিলে।
— বলছি। আসলে এ সিনোটিকে পবিত্র ধরা হত। খরা যখন দেখা দিত, তখন বৃষ্টি দেবতা চাকের উদ্দেশ্যে এখানে উতসর্গ করা হত। সিনোটি সেঁচে অনেককিছু উদ্ধার করা গেছিল। সেথেকে বোঝা গেছিল।
— সত্যি? কী উদ্ধার করা গেছিল?
— সোনা, জেড পাথর, অবসিডিয়ান, হাড়িকুড়ি, গয়না, কাঠের অস্ত্র, জামাকাপড়, সুগন্ধী লোবান। এমনকি বাচ্চা আর পুরুষের কংকালও।
— বাবা রে বাবা!
— আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে। মায়াদের সবকিছুতে দেখবে নীল রঙ খুব প্রকট। অনেককিছু এরা নীল রঙে পেইন্ট করে। এর সেগুলি ফেড হয়ে যায় না সহজে। উতসর্গ করা বাসন, কাঠের জিনিসও এরা নীল রঙ পেইন্ট করে দিত। এমনকি মানুষের সারা শরীরও নীল রঙে রাঙিয়ে তারপর সিনোটিতে ফেলে দিল।

হুট করে এক ঝলক বাতাস বইতে লাগল। পারির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। রিককে প্রশ্ন করল
— তোমার এগুলি সত্য বলে মনে হয়?
— কোনটা?
— এই যে বলিদান করলে বিনিময়ে কিছু পাওয়া যায়।
— আমরা আধুনিক মানুষ, আমরা তো বিশ্বাস করি না। কিন্তু একসময়ে লোকে এমনটাই ভাবত, বিশ্বাসও করত। নাহলে পিরামিড এ বলিদান দিত কেন, বলো?
পারি আবার শিউরে উঠল। রিক ওকে খেয়াল করতে থাকে। কিন্তু পারি যেন এ দুনিয়ায় নাই। কিছু একটা গভীর ভাবনায় ও ডুবে রয়েছে। মনের সাথে যেন যুদ্ধ করছে।
রিক ওকে ওর মতো থাকতে দিল। কথা বলল না।

একসময়ে নরম গলায় বলল
— আর থাকবে? চলো যাই এবারে? দেখো চলে যাবার জন্য ওরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে।
পারি যেন ধ্যান ভেঙে বাস্তবে ফিরে এলো
— যাব?
কৌতুক করল রিক।— যাবে না তো কি এখানেই রাত কাটাতে চাও নাকি? যদি বাচ্চাগুলি সিনোটি থেকে উঠে আসে?
হেসে ফেলল পারি।– দ্যাট উড নট বি প্লেজান্ট।
রিকও হাসল— তা তো প্লেজান্ট হবে নাইই। চলো।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল দুজনে। রিক অন্যমনস্কভাবে গাড়ি চালাতে থাকে, পারিও চুপ। খানিক বাদে সন্ধ্যা নেমে এলো। নীরবতা ভেঙে হঠাত পারি বলল
— তুমি ঠিক রাস্তায় আছ তো, না?
— হ্যাঁ, কেন?
— মনে হচ্ছে এ রাস্তা দিয়ে আসিনি। ভুলভাল কোনো রাস্তায় চলে এসেছ নাকি?
— একটু আগেই তো রোড সাইন দেখলাম। সেখানে প্লায়া ডেল কারমেন লেখা ছিল।

আরেকটু যেতেই পারির সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণিত হল। অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে। দুপাশে তেমন কোনো বসতির চিহ্ন নাই, কোনো রোড সাইন নাই। এক বিরান ভূমির মধ্য দিয়ে গাড়িটা চলেছে। আরও খানিক বাদে রাস্তা শেষ হয়ে কাঁচা রাস্তা শুরু হল। পারি ভয় পাওয়া গলায় বলল
— আই ডোন্ট লাইক ইট এট অল। ফোন বের করে দেখে নেটওয়ার্ক নাই। — কী হবে এখন, রিক?
রিকের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে।— প্লিজ ডোন্ট প্যানিক, পারিজা।
— আই এম নট প্যানিকিং। কিন্তু কেউ জানে না আমরা কোথায় আছি। সবাই দুশ্চিন্তা করবে। আমাদের বিপদও তো হতে পারে।
— পারিজা, প্লিজ। ভালোটাই ভাবো এখন।
— ভালো ভাবব? কিভাবে ভালো ভাবব আমাকে বলো দেখি। এখানে ড্রাগ ডিলিং কম হয়? যদি আমরা তাদের খপ্পরে পড়ি? যদি রাস্তা আর খুঁজে না পাই। যদি জেরিন আমার মা’কে খবর দিয়ে দেয়? পারি হিস্টেরিকাল হয়ে গেল।
— পারিজা! কুল ডাউন। দেখি কী হয়।
— রিক, গাড়ি ঘোরাও। যে রাস্তা দিয়ে এসেছি, সে রাস্তায় দিয়েই ফিরে যাও। কিছুক্ষণ আগে আমরা একটা বাড়ি পেরিয়ে এসেছিলাম। ওরা নিশ্চয় বলতে পারবে কিভাবে মেইন রোডে যাওয়া যাবে।

অন্ধকারে ঠিকভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাত করে একটা বড়ো গর্তে গাড়ির চাকা আটকে গেল। অনেক চেষ্টা করল রিক। কিন্তু এত বড়ো গর্ত থেকে কিছুতেই গাড়িটাকে তুলতে পারল না। বরং যত চেষ্টা করতে লাগল, ততোই চাকা গর্তে দেবে যেতে লাগল। অনেক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল রিক
— ড্যাম! ড্যাম! ড্যাম!
পারি হঠাত করে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ও আর এক সেকেন্ডও গাড়িতে থাকতে পারবে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। দরজা খুলে যেদিক দিয়ে আসছিল, সেদিকে দিল দৌড়। অন্ধকারেই।

— পারিজা! রিক চিৎকার করে উঠে গাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এল। আবছা আলোয় সামনে পারিজাকে দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল।
— পারিজা, আর ইউ ক্রেজি?
— আমি এখানে থাকব না। কেঁদে ফেলল পারি।— আমার খুব ভয় করছে।
— কাম ডাউন! কাম ডাউন!

ফোনের টর্চ জ্বালাল রিক। দেখে পারিজা নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর চেহারা কেমন নীল হয়ে যাচ্ছে।
— আর ইউ হ্যাভিং এ প্যানিক এটাক, পারিজা?
পারি উত্তর দিতে পারল না। দুহাতে চুল খামচে ধরেছে ও।
পারির কাঁধ শক্ত করে ধরল রিক।
— ব্রিথ, পারিজা। ব্রিথ। লম্বা লম্বা শ্বাস নাও। ইট উইল বি ওকে। আই এম হিয়ার। আমি কিছু হতে দিব না। এত ভয় পাবার কিছু নাই। ব্রিথ, পারিজা।
পারি ততক্ষণে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে।
— ব্রিথ, আই সেইড।
আস্তে আস্তে প্যানিক এটাকের প্রকোপটা কেটে গেল। পারি লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিল, চোখ মুছল।
— আর ইউ ওকে নাউ?
মাথা ঝাঁকাল পারি।
— বেটার।
— লিসেন। চল, সামনে এগিয়ে যাই। যে বাড়িটার কথা বললে, সেটাতে যাই চলো।
— আই এম সরি। আই ডিড নট মিন টু রান লাইক দিস।
— সরি কেন? তোমার প্যানিক এটাক হয়েছে, এতে সরির কী আছে? আগে এমন হয়েছে?
আবার চোখ মুছল পারি— মাঝেমাঝে হয়।
— ডাক্তার দেখিয়েছ?
— হু। কাউকে বলো না প্লিজ।
— ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। চলো এখন।

টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে একহাতে পারিকে জড়িয়ে ধরে সামনে এগোতে থাকে রিক। পারিও নিজেকে সামলে নিয়েছে। এবং প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে। নিজেকে ও একজন সাহসী মেয়ে হিসাবেই দেখাতে চায়। এখন রিকের সামনে এভাবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে, ও ভাবতেও পারেনি। ছি ছি। কী লজ্জা।
রিক ওর মনের ভাব বুঝে হালকাভাবে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল
— ইউনিভার্সিটিতে আমার যে রুমমেট ছিল, সে বডিবিল্ডিং করত, জানো? কী মাসল তার, ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিওন ছিল। নিজেকে বিরাট হি ম্যান দেখাতে চাইত সবার কাছে। শুধু আমি জানতাম আসল কথা।
— কী কথা?
— ওরও প্যানিক এটাক হত। সবসময় হি ম্যান ইমেজ দেখাতে যাবার চাপটা ও নিতে পারছিল না। প্রচন্ড স্ট্রেস হত ওর। সেথেকে প্যানিক এটাক। শুধু আমি জানতাম, ওর এটাকের সময় ওকে হেল্প করতাম।
পারি উত্তর দিল না। ও তখনো প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করছে। বিপদে পড়েছে, মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত ছিল ওর। তা না। কী বিশ্রী একটা কান্ড হল।

মিনিট বিশেক চুপচাপ হাঁটতে থাকে ওরা। সামনে টিমটিমে আলো দেখা গেল। যে বাড়ি ওরা পার হয়ে এসেছিল, সেটারই হবে।
— ওই তো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সকালে গাড়ি গর্ত থেকে ওঠানোর দেখি কী করা যায়।
— রিক, ফিরে না গেলে ওদিকে সবাই চিন্তা করবে। যদি বাসায় কল করে বলে দেয়?
— কিছু করার নাই, পারিজা। আজ আমরা ফিরতে পারব না, এটাই রিয়েলিটি। হোপফুলি ওরা কেউ একথা জানিয়ে দেবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পারি। ওর সিক্সথ সেন্স ওকে ঠিকই জানান দিয়েছিল। আজ একটা গণ্ডগোল কপালে লেখাই ছিল।

বাড়িতে শুধু এক লোক, তার বৌ আর ছয় মাসের বাচ্চা থাকে। একফোঁটা ইংরেজি জানে না। রিক বহুকষ্টে ভাঙা স্প্যানিশ আর ইঙ্গিতের মাধ্যমে ওদের দুরবস্থা বোঝাতে পারল। বুঝতে পেরে লোকটা ওদের রাত্রে থাকতে দিতে রাজি হল। ওদের কালচারে বাড়ির কর্তার কথাই শেষ কথা। বউরা কাজ করে, সংসার সামলায়, বাচ্চা পালে কিন্তু সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষেরা।
যতক্ষণ কথা চলছিল ততক্ষণ বউটা চুপ করে ছিল। কিন্তু লোকটা রাজি হতেই হাসিমুখে এগিয়ে এলো। ওদের ছোট একটা রুমে নিয়ে গেল। ইশারা করে বোঝালো এ রুমে ওরা রাত্রে থাকবে। তারপর খাবার নিয়ে এল। সামান্য আয়োজন কিন্তু ওদের পেটে তখন এত খিদে যে যা পাবে তাই সই। সেই কখন পিজ্জা খেয়েছিল।
খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ইঙ্গিত করে বউটা চলে গেল।

ছোট্ট বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল পারি।
— যাক বাবা। অন্তত রাত্রিটা গাড়িতে থাকতে হচ্ছে না আমাদের।
রিক ঢাকনা খুলে খাবার দেখছিল। এখন পারির দিকে এগিয়ে দিল।
— নাও খাও।
— তুমি?
— আমিও খাব। একটাই তো প্লেট। শেয়ার করতে হবে আমাদের।
দুজনে এক প্লেট থেকে খাবার খেতে থাকে। খেতে খেতে রিক বলে
— চিন্তার কিছু নাই, বুঝলে পারিজা? আমরা এখানে সেফ। ওদেরকে দেখে ড্রাগ ডিলার বলে মনে হচ্ছে না।
এতক্ষণে হেসে ফেলল পারি।
— সরি, আমি লাফ দিয়ে অনেককিছু ভেবে নিয়েছিলাম।
— সরির কিছু নাই। সাবধানে থাকাই ভালো। দেখলে না রাস্তায় বন্দুক হাতে পুলিশ গাড়ি চেক করছিল। আমাদেরকে চলে যেতে ইঙ্গিত করল কারণ আমরা টুরিস্ট বুঝে গেছিল। কিন্তু এখন মনে হয় না বিপদে আছি আমরা। ওরা নিরীহ লোক।
— হু।
— সকালে উঠে দেখি গাড়ি গর্ত থেকে কিভাবে তোলা যায়।
— প্লিজ সকাল সকাল কোরো কাজটা। কাল আমাদের ফ্লাইট।
— আমাদেরও। চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।
— তাই যেন হয়।
(চলবে)মন নিয়ে (পর্ব ১০)

ততক্ষণে ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। পারি উঠে বাসনটা সরিয়ে রাখল। খেয়ে একটু ভালো লাগছে। মাথা কাজ করছে মনে হয়। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। তারপরেই আঁতকে উঠে বলল
— মাই গড!
— কী হল, পারিজা?
— আই থিঙ্ক…আই থিঙ্ক…
— হোয়াট ডিড ইউ থিঙ্ক, পারিজা?
পারি উত্তর দিতে পারল না। ওকে চুপ দেখে রিক সাহায্য করল।
— ওরা ভেবেছে আমরা স্বামী স্ত্রী, এই তো?
পারি আবারও উত্তর দিল না। ওর গাল সামান্য লাল হয়ে গেল।
— ভাবুক আর না ভাবুক, ওদের ঘর বেশি নাই। এ ঘরটা যে পেয়েছি, এটাই অনেক, বুঝলে পারিজা?
রিকের গলায় যেন ঠাট্টার সুর।
— আর ইউ লাফিং এট মি, রিক?
— নট এট অল। আমি তোমাকে সহজ করতে চাইছি। এতক্ষণে তোমার খেয়াল হল যে তুমি ঘরের একমাত্র বিছানায় বসে রয়েছ? আমি দেখেই বুঝেছিলাম। কিন্তু কিছু করার নাই। এটা পাওয়া গেছে, এই অনেক। অলটার্নেটলি আমরা অন্ধকারের মধ্যে ফিরে গিয়ে গাড়িতে বসে রাত কাটাতে পারি।
— রিক, বি সিরিয়াস।
— আই এম সিরিয়াস, পারিজা। ট্রাস্ট মি, আমি তোমাকে হাসাতে চাইছি। যাতে ব্যপারটা তুমি ইজিলি নাও।
— ইজিলি তো নিচ্ছি। নানান দুশ্চিন্তায় এদিকটা আমি খেয়াল করিনি।
— এখন খেয়াল করে দুশ্চিন্তা কি বাড়ল না কমল?

পারি গম্ভীর হয়ে বলল
— অবভিয়াসলি যা পাওয়া গেছে সেটা নিয়েই আমাদের সন্তস্ট থাকতে হবে। যাই হোক, আমি শুয়ে পড়লাম। তুমি তোমার হাসি ঠাট্টা নিয়ে থাকো।
— আমি কোথায় থাকব, পারিজা?
— কোথায় আবার? এখানেই।
— আর ইউ শিওর?
— অফ কোর্স। এসব নিয়ে কথা বাড়াবারই দরকার নাই। গুড নাইট, রিক।
বিছানাটা দেয়ালের সাথে লাগানো, সে দেয়ালে খোলা জানালা। পারি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল।
রিক লাইট নিভিয়ে দিতে খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানায় এসে পড়ল। সে আলোতে ধীরেধীরে এগিয়ে বিছানায় এসে বসল। তারপরে জানালার উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে সেও শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। পারি চোখ বুজে ঘুমাতে চেষ্টা করল, রিকও। কিন্তু দুজনের একজনও ঘুমাতে পারল না। পারি নড়াচড়া করছে বুঝতে পেরে রিক প্রশ্ন করল
— তোমার অসুবিধা হচ্ছে?
— অসুবিধা হলেও কিছু করার নাই। লাইক ইউ সেইড, এ পেয়েছি, এটাই অনেক। কাল ঠিকঠাক সময়ে ফিরে গিয়ে প্লেন ধরতে পারলেই হল। নাহলে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যাবে। আজ মা’কে খবর না দিলেও কাল মিসিং থাকলে ঠিকই দেবে। তখন কী হবে ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার।
— আপাতত ঘুমাতে চেষ্টা করো। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।

আরও পাঁচ দশ মিনিট পার হয়ে গেল। হঠাত রিকের মনে হল ওর পায়ের কাছে কিছু একটা বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে দেখে পারি পিঠে বালিশ দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।
— ঘুমাতে পারছ না?
মাথা নাড়ল পারি।— এত এক্সাইটমেন্টে হাইপার হয়ে গেছি। কিছুতেই রিলাক্স করতে পারছি না। আমার ঘুম হবে না। তুমি ঘুমাও।
আরও পাঁচ মিনিট কেটে গেল। এবারে রিকও উঠে বসল। বালিশটা পারির উল্টাদিকের দেয়ালে বসিয়ে আরাম করে ঠেস দিয়ে বসল। জানালা থেকে মুখ ফেরালো পারি।
— ওকি, তুমি উঠছ কেন?
— আমারও ঘুম হবে না।

জানালার দিকে আবারও মুখ ফেরালো পারি, কিছু বলল না। ওর মুখের ওপরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। রিক ওকে লক্ষ করতে থাকে। একসময় প্রশ্ন করে।
— তুমি তোমার মা’কে খুব ভালোবাস, না?
আশ্চর্য হয়ে আবারও মুখ ফেরালো পারি।
— নিজের মা’কে ভালোবাসব না? তুমি বাসো না?
— তা বাসি। কিন্তু তুমি মনে হয় আমার চাইতে অনেক বেশি। আমি হারিয়ে গেলে সে কী ভাববে তা নিয়ে একটু পরপর আপডেট দিচ্ছি না।
হাসল পারি
— আমার মা একটু পাগল তো, তাই।
— সত্যি? আমার মাও কম না।
— কেমন পাগল?
— বাটিপাগল!
— হোয়াট! এটা আবার কেমন পাগল?
— ছোটবেলা থেকে আমি আর বাবা তাকে খুব টিজ করতাম এ নিয়ে। আমরা মন্ট্রিয়ালে বহুবছর ধরে আছি। বাবা ইউনিভার্সিটির টিচার। মা উইনার্সে কাজ করে। আবার সোশালি খুব এক্টিভ। পার্টিতে যেতে ভালোবাসে, বাসায় পার্টি দিতেও খুব ভালোবাসে।
— বুঝলাম। কিন্তু এর সাথে বাটিপাগল হবার কী সম্পর্ক।
— বলছি। প্রত্যেক পার্টিতে লেফট ওভার খাবার বেঁচে যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা নানান বক্সে বক্সে সবার বাসায় সাথে করে দিয়ে দেয়া হয়। তো আমার মায়ের একটা অবসেশান আছে। দুনিয়ার যত ক্রিম চিজ, ইয়োগার্টের কন্টেনার, হাবিজাবি কন্টেনার জমা করা। আমাদের প্যান্ট্রিতে ঢোকবার উপায় নাই। বলতে পারো ছাদ পর্যন্ত কন্টেনার দিয়ে ঠাসা।
হাসতে আরম্ভ করে পারি।— তারপর?
— আমাদের বাসায় পার্টি হলে এসব কন্টেনারে করে বেঁচে যাওয়া খাবার মা খুশিমনে প্যাক করে দিয়ে দেবে। কিন্তু তার কড়া নজর থাকে কন্টেনারগুলি ফেরত এলো কিনা, সেদিকে। যারা ফেরত দেয় না, তাদের সাথে রাগারাগি করে এমনকি ঘটনা এতদূর পর্যন্ত মাঝেমাঝে গড়িয়ে যায় যে সম্পর্ক পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। বাসায় থাকা আমি আর বাবাও কম সাফার করি না। কে ফেরত দিল আর কে দিল না, এনিয়ে নিয়মিত আপডেট, কমপ্লেন পেতে থাকি।

পারি হাসতে হাসতে শেষ। কন্টেনার প্রীতি অনেকেরি আছে কিন্তু এই লেভেলের অবসেশান ও প্রথম শুনল।
— কিন্তু এগুলো তো ফ্রি। আই মিন, ইয়োগার্ট কিনলে কনটেনার তো সাথে আসবেই।
— সেটা তাকে আমি কোনোদিন বোঝাতে পারলাম না। আমার বাবা সারাজীবন এত ছাত্র ছাত্রী পড়িয়েছে কিন্তু মা’র বেলায় এসে সেও ফেল। তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি। বরং এসব শুনলে মা রেগে আগুন হয়ে যায়। এবং সন্দেহ করে আমরাও এ কনসপিরেসিতে আছি।
— কোন কন্সপিরেসি?
— বাটি ফেরত না দেবার ইলাবোরেট কন্সপিরেসি। কারণ সময়ে সময়ে প্যান্ট্রি ভর্তি বক্সের কিছু অংশ ফেলে দেবার কথা আমরা সাজেস্ট করেছি। তাই আমরা বিপক্ষ দল!
— মাই গড। ফ্রি বক্স নিয়ে এত কান্ড?
— হু। আমাদের ধারণা সে আমাকে বা বাবাকে যতটা ভালোবাসে, তার বক্সদের এর চাইতে বেশি ভালোবাসে।

আবারও হাসতে থাকে পারি। সত্যি, পারিজাকে হাসলে এত ভালো লাগে। মেয়েটা আরও বেশি হাসে না কেন?
— এখন বলো তোমার মা কেন পাগল?
— আমার মায়েরও একটা বড় পরিচিত সার্কেল আছে। পার্টি, গসিপিং খুব চলে। যা হয়, ইউ নো। তো ইদানিং সে সার্কেলের অনেকেরই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে থেকে আমার মা ঘরে বাইরে মুখ দেখাতে পারছে না।
— কেন?
— আমি হাই স্কুলে ওঠার পর থেকে আমার মায়ের মেইন এইম ইন লাইফ হয়ে গেল ধুমধাম করে আমার বিয়ে দেবে। এনিয়ে তার সমস্ত প্ল্যান প্রোগ্রাম করা শেষ। কবে থেকে গয়না কিনছে, শাড়ি কিনছে। এমনকি সে কোন প্রোগ্রামে কী পরবে, সেটাও রিসেন্টলি কিনে ফেলেছে।
— কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তোমাকে রাজি করাতে পারছে না, এই তো?
— তুমি কী করে বুঝলে?
— যে মেয়ে বিয়ের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে ডাউনটাউনে পালায়…

কথাটা শেষ করল না রিক, হাসতে থাকল। পারি সিরিয়াস হয়ে গেল
— আই এম রিয়েলি সরি, রিক। এটা তুমি না, যে কেউ হলে আমি পালাতাম। মা আমাকে না জানিয়ে এ প্রোগ্রাম সেট করেছিল। এমন আগেও করেছে। কিন্তু ঐদিন আমি রিভোল্ট করেছিলাম। আমি জানি তুমি খুব ইন্সাল্টেড ফিল করেছ বাট ইট হ্যাড নাথিং টু ডু উইথ ইউ। বিলিভ মি।
— রিয়েলি? তুমি যেভাবে আমাকে ইগনোর করছ, আমি তো ভাবলাম ইউ হ্যাভ সামথিং এগেইন্সট মি।
— আই সোয়ের, রিক। নাথিং এগেইন্সট ইউ। কিন্তু মা’কে আমি বোঝাতে পারছি না যে বিয়ে এখন আমি করব না।
— এখন করবে না, নাকি কখনো করবে না?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো পারি।
— একসময় না একসময় তো করতেই হবে।
— এমনভাবে বলছ যেন তোমাকে একটা শাস্তি পেতে হবে।
— না, আমি এভাবে মিন করিনি। মানে বিয়ে তো করতেই হবে। সবাই করে। আমি এখন তৈরি না, দ্যাটস অল।
— কেন তৈরি না, জানতে পারি কি? আমি জানি পার্সোনাল কোয়েশ্চান হয়ে যাচ্ছে, উত্তর দেয়া তোমার ইচ্ছা।

পারি অনেক্ষণ চুপ করে রইল। ওর চেহারায় বেদনার ছায়া পড়ল। একসময় ফিসফিস করে বলল
— আমার মন এখনো তৈরি না।
— তৈরি না? আর ইউ ইন লাভ উইথ সামওয়ান?
— বলতে পারো।
— তাহলে তোমার মা’কে বলছ না কেন?
— সম্ভব না।
— কেন জানতে পারি?
পারি চুপ করে রইল। এবারে সে উত্তর দেবে না, বোঝা গেল। কিন্তু রিকের জেদ চেপে গেছে। ওকে এ রহস্য ভেদ করতেই হবে।
— আই স ইউ, ইউ নো।
— হোয়াট ডু ইউ মিন, রিক? চমকে গেল পারি।
— লাস্ট নাইট। আমি তোমাদের উল্টোদিকের রেস্তোরায় ছিলাম। আই স ইউ উইথ এ গাই। ইজ হি দা রিজন?
ফিসফিস করে উত্তর দিল পারি।
— ইয়েস।

রিকের বুকে অদ্ভুত একটা খালিখালি অনুভূতি হল। যতক্ষণ শিওর ছিল না, ততক্ষণ একরকম ছিল। আর এখন পারিজা যখন নিজের মুখে স্বীকার করল, তখন তো আর কোনো আশাই নেই।
আরকিছু জিজ্ঞেস করতে রিকের ইচ্ছাই করল না। একটা ম্যারিড ম্যানের সাথে পারিজা… আনবিলিভএবল!

খানিক বাদে পারি আপনা থেকে বলতে আরম্ভ করল
— এন্ড্রু আমার বস ছিল। ডাইরেক্ট বস না, আমি তখন নতুন কাজে ঢুকেছি। প্রথম প্রোজেক্ট ছিল ম্যানেজমেন্ট লেভেলের কয়েকজনকে নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশান তৈরি করে দেয়া। বোর্ড মিটিং এর জন্য। সে সূত্রে এন্ড্রুর সাথে কাজ করতে শুরু করলাম। ও ছিল কোম্পানির মিডিয়া ম্যানেজার। আমি ওর কাজ নিয়ে ইনফর্মেশান জোগাড় করতে ওরসাথে নানান মিটিং এটেন্ড করতাম, কখনো কখনো অন্য অফিসে যেতাম ওরসাথে। হয়ত প্রয়োজনের চাইতে বেশিই গেছি। কিন্তু নিজেকে থামাতে পারিনি। এন্ড্রু এত ভালো, এত কেয়ারিং ছিল। একসময় কাজ শেষ হয়ে গেল কিন্তু আমাদের যোগাযোগটা বজায় রইল। দুই মাস পরে আমরা আবিস্কার করলাম উই লাভ ইচ আদার। আমি আগে কখনো প্রেমে পড়িনি। এখন এন্ড্রুর মাঝে ডুবে গেলাম। এন্ড্রুও ইকোয়ালি সিরিয়াস। ছয়মাসের এনিভার্সারিতে ও আমাকে প্রপোজ করল। আমার মাথায় তখনি আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি আসলে তখন ভেসে গেছি কিন্তু এ সম্পর্কের পরিণতি কী হতে পারে এনিয়ে কখনো ভাবিনি।
— অসুবিধা কী ছিল বিয়ে করতে? এমন বিয়ে তো আনকমন না। অনেকেই বিদেশি ছেলে বিয়ে করছে।
ম্লান হাসল পারি।
— হ্যাঁ, অনেকে করছে। অনেকে আমাদের কালচার খুব পছন্দ করে, চেষ্টা করে এর সাথে মিশে যেতে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি কখনো সম্ভব হয় না।
— সে তো হবেই না। একটা বিদেশি ছেলের কাছ থেকে এতটা এক্সপেক্ট করাও ঠিক না। এমনকি আমরাও কি পুরোপুরি বাঙালি? এখানে জন্মেছি, এখানে বড়ো হয়েছি। আমরাও তো মিক্সড হয়ে গেছি।
— তুমি আমার মা’কে জানো না, রিক। বাবা ইজিগোয়িং, সে হয়ত মেনে নিত একসময়। কিন্তু মা! সে কিছুতেই আরেকটা এমন বিয়ে মেনে নিত না।
— আরেকটা?
— আমার এক বড়ো ভাই আছে। সে তার কিছুদিন আগে এক চাইনিজ মেয়েকে বিয়ে করল। সেনিয়ে বাড়িতে তুলকালাম। ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে মার প্ল্যান সব শেষ। মাও চেষ্টা করেছিল কিন্তু কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারল না। ভাইয়া এখন ভ্যানকুভারে আছে। মাঝেসাঝে আসে কিন্তু সম্পর্কটা আর সহজ নাই। কেমন ভাসাভাসা, নেহাত যতটুকু না করলেই নয়, ততোটুকু করে দুপক্ষ।
— তাই বলে তুমি নিজের প্রতি এমন অবিচার করবে? জাস্ট বিকজ হি ইজ নট ফ্রম দা সেম কমিউনিটি? আর কোনো কারণ ছিল কি? ইজ হি ম্যারিড?
— না না। এন্ড্রু ম্যারিড ছিল না। হি নেভার ওয়ান্টেড টু গেট ম্যারিড টিল হি মেট মি। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম এ বিয়েতে একসময় কেউ হয়ত সুখী হব না। বিয়ে এমনিতেই অনেক কমপ্লিকেটেড রিলেশানশিপ। তারমধ্যে ও আমাদের কালচার বুঝবে না, আমাদের ফ্যামিলির সাথে মিশে যেতে পারবে না। মাও একটা বড়ো ধাক্কা কেবলি খেয়েছে। আমিও যদি তাকে আরেকটা ধাক্কা দেই… তাছাড়া…

একটু চুপ করে থাকে পারি। কিন্তু আজ যেন কথায় পেয়েছে ওকে।
— তাছাড়া আমাদের বয়সের ডিফারেন্সও ছিল। এটাও একটা ইস্যু হত। সেটা নাহয় কোনোমতে ম্যানেজ করে ফেলতাম কিন্তু ও সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন কমিউনিটির লোক। একধরণের জীবনে এতদিন ধরে অভ্যস্ত। যে জীবনের সাথে আমাদের কমিউনিটির ছিটেফোঁটাও মিল নাই। আমি এত বড়ো স্টেপ নিতে তাই পিছিয়ে এলাম। টাইমিং টাও খারাপ ছিল তখন।
— এ ব্যাপারে সে কী বলল?
— অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। হি ওয়াজ রিয়েলি সিরিয়াস এবাউট মি। আমিও ছিলাম। কিন্তু সেটা সবসময় এনাফ হয় না। লাস্টবার যখন আমাদের দেখা হল তখন উই হ্যাড এ টেরিবল ফাইট। উই ব্রোপ আপ দ্যাট ডে ইন এ বিটার ওয়ে। ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেক্সিকো চলে এল। বিয়ে করেছে কিছুদিন আগে।
— তুমি কি ওর সাথে দেখা করতে মেক্সিকোতে এলে তাহলে।
— না, এ ট্রিপ মাহার আইডিয়া ছিল। টু চিয়ার আপ জেরিন। কিন্তু আমি জানতাম ও মেক্সিকোতে আছে। ওরসাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও আমি ওকে ব্লক করিনি। সেও আমাকে ব্লক করেনি কিন্তু আমাদের মধ্যে ঐ দিনের পরে আর কোনোই কমিউনিকেশান ছিল না।
— তাহলে এখন যোগাযোগ করছ কেন? তুমি কি আবার ওর সাথে সম্পর্কে যেতে চাও?
— না, আমি ওকে ভুলে যেতে চাই। বাট আই নিড ক্লোজার। ওরসাথে এত তিক্ততার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক ভেঙেছে যে আমি এ থেকে বের হয়ে আসতেই পারছি না। এতদিনে আমি বুঝেছি ওরসাথে শেষবারের মতো দেখা করে বিদায় নিতে হবে আমাকে। ভালোমনে। ওরদিক থেকেও তো আপত্তি হবার কথা না। বিয়ে করেছে, নতুন জীবন আরম্ভ করেছে। ও নিশ্চয় পুরানো কথা ধরে নাই। কিন্তু আমি মুভ অন করতে পারছিলাম না। সেজন্য গতরাতে ওকে কল দিয়ে দেখা করতে বললাম।
— দেখা তো হল, এখন মুভ অন করতে পারবে, পারিজা? প্রশ্নটা করে রিক নিশ্বাস বন্ধ করে রইল জবাবের অপেক্ষায়।

জানালা দিয়ে ভোর উঁকি দিচ্ছে। নতুন দিনের লাল সূর্যের অল্প আলো এসে পড়েছে পারির মুখের ওপরে। ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
— পারব। বাট আই নিড টাইম। মাই হার্ট ইজ স্টিল উন্ডেড। এ ক্ষত সারবার জন্য সময় চাই আমার। কিন্তু মা এরমধ্যেই এমন চাপাচাপি শুরু করে দিয়েছে যে মাঝেমাঝে মনে হয় আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, ডুবে যাচ্ছি। সে থেকেই কিছুদিন আগে শুরু হল প্যানিক এটাক।
— পারিজা! উঠে পারির সামনে এসে বসল রিক। দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরল
— অফ কোর্স ইউ নিড টাইম। তোমার মা’কে বুঝিয়ে বলো।
— বুঝবে না। সে আমাকে বড়ো বলেই ভাবে না। ভাবে ছোটবেলার মতো আমাকে চালাতে পারবে।
— কিন্তু না বললে তো হবে না, পারিজা। তুমি অনর্থক সাফার করছ। জোর করলে যে উলটা ফল হতে পারে তাকে বুঝতে হবে। তার ইচ্ছাই তো সবকিছু না। তোমারও একটা দিক আছে। অন্যের কথা এত ভেবো না, পারিজা। নিজের কথাও একটু ভাবো। একাই বার্ডেন ক্যারি কোরো না।
পারির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। রিক নিজেকে সামলাতে পারল না। আস্তে পারির ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করল। তারপরে ছেড়ে দিল।

স্তম্ভিত গলায় পারি জানতে চাইল
— হোয়াই ডিড ইউ কিস মি, রিক?
স্পস্ট করে রিক জানালো
— কুডন্ট হেল্প মাইসেলফ। তোমাকে কাঁদতে দেখে ভালো লাগেনি আমার।
চোখ মুছল পারি। রিক আবার বলল
— আই এম নট সরি, ইউ নো। আমার মনে হয়েছে তোমাকে কেয়ার করা দরকার, প্যাম্পার করা দরকার, তাই। আই হ্যাভ নো আদার এজেন্ডা।
— আই নো, রিক। তুমি একটা পার্ফেক্ট জেন্টেলম্যানের মতো বিহেভ করেছ পুরাটা সময়। বরং আমিই প্যানিক করে কী বিশ্রী একটা কান্ড করলাম।
— ডোন্ট বি এম্বারাসড, পারিজা। এতদিন ধরে এতখানি ভার বয়ে বেরিয়েছ বলেই এমনটা হচ্ছে।
— তোমাকে বলে অনেক হাল্কা লাগছে, রিক। এতদিন কাউকে বলিনি। নোবোডি নোজ।
— গ্ল্যাড আই কুড হেল্প।
উঠে পড়ল রিক। আড়মোড়া ভেঙে বলল
— যাই। তোমাকে ফিক্স করে দিলাম, সাফাতকেও করলাম। এখন গাড়িটাকে ফিক্স করতে পারি কিনা দেখি। নাহলে আমার রেপুটেশান টিকবে না!।
হেসে ফেলল পারি। রিক মুগ্ধ হয়ে গেল।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)

ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র রেড রোজ বলুন বা বসন্তের এক ছড়া গাঁদা ফুলই বলুন একজন লেখকের কাছে এমন এফর্টের কোনো তুলনা নেই।

আজমিরি আপু, ভোরবেলায় এ ছবি পেয়ে আপনি আমার দিনটাই সুন্দর করে দিলেন। অনেক ভালোবাসা রইল।মন নিয়ে (শেষ পর্ব)

গাড়িটা নিয়ে যখন ওরা পারিদের হোটেলের সামনে এসে থামল, তখন হাতে সময় একেবারেই নাই। ফ্লাইট ধরতে হলে ওদের তখনি বেরিয়ে পড়তে হবে। ওরা গাড়ি থেকে নামতেই মাহা, জেরিন, সাফাত আর জামিল রিসেপশান থেকে দৌড়ে এল। জেরিন আর মাহা পারিকে জড়িয়ে ধরল। মাহা তো কেঁদেই ফেলল
— কই ছিলে তোমরা? কী হয়েছিল? আমরা দুশ্চিন্তা করে করে শেষ। পুলিশের কাছে যাব না কী করব, কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

রিককে ছেঁকে ধরল জামিল আর সাফাত।
— হোয়াট হ্যাপেন্ড, ম্যান? ডিড ইউ গাইজ ফল ইন্টু সাম সর্ট অফ ট্রাবল?
রিক সংক্ষেপে বলল
— রাস্তা ভুলে লোকালয়ের বাইরে চলে গেছিলাম। তারপরে গাড়ি পড়ে গেল এক গর্তে। নেটওয়ার্ক নাই। যা তা অবস্থা হয়েছিল।
জেরিন শিউরে উঠল
— মাই গড! তোমরা রাত্রে ছিলে কোথায়
— এক মায়া পরিবারের সাথে। ভাগ্যিস তার বাড়ি আশেপাশে ছিল, নাহলে গাড়িতেই বসে থাকতে হত আমাদের। গাড়িটাকেও গর্ত থেকে তুলতে পারতাম না। সেই আরও লোক জোগাড় করে হেল্প করল।

শুনে মাহা পারিকে আরও জোরে আকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
— ওহ! ইউ পুওর সোল। কতটা সাফার করলে। আমি হলে তো ভয়েই মরে যেতাম।
জামিল সিচুয়েশান কন্ট্রোলে আনতে চাইল তাড়াতাড়ি।
— ওকে গাইজ। পরে এনিয়ে কথা হবে। তোমরা দুজনে ঠিকমতো ফিরে এসেছ, আমরা বিশাল এক দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। কিন্তু এখন হাতে একদমই সময় নাই। প্লেন ধরতে হলে আমাদের এখনি বের হয়ে পড়তে হবে। আমাদের প্লেন অবশ্য একটু পরে। কিন্তু রিক আর সাফাতের ফ্লাইট মাত্র দেড় ঘন্টা পরে। লেটস গো গাইজ।
রিক বলল
— আমাকে জিনিসপত্র নিতে হোটেলে যেতে হবে একবার।
— ডোন্ট ওয়ারি, রিক। তোমার জিনিস আমি প্যাক করে হোটেল থেকে চেক আউট করেছি। আমার সাথেই আছে।
— থ্যাঙ্কস ম্যান।

পারি বলল
— আমি তাহলে রুমে যাই আমার জিনিসগুলি গুছিয়ে নিতে।
— নো নিড, পারি। আমিও তোমার জিনিস প্যাক করে চেক আউট করে ফেলেছি। বুঝছিলাম না কী করব। ভেবেছি লাস্ট মোমেন্টেও যদি এসে পড়ো তো সাথেসাথে এয়ারপোর্টে রওনা দিব। আর যদি না আসো, তো পুলিশের কাছে যাব।
হাসল পারি
— থ্যাঙ্ক ইউ, জেরিন।
— চলো চলো, থ্যাঙ্কস পরে দিও। গাড়ি লোড করে চলো রওনা দেই।

মাহা বলল
— কিন্তু জামিল, ছয়জন মানুষ আমরা, গাড়িতে ফিট করব কিভাবে? আর একটা গাড়ি লাগবে তো।
— সময় নাই, মাহা। যেভাবেই হোক ফিট করতে হবে। সাফাত চালাক, আমি পাশে বসে থাকব, তুমিও আমার সাথে বসবে। বাকি তিনজন পিছে।
মাহা পুরাই শকড
— জামিল! সামনে তিনজন? পুলিশ ধরবে আমাদের।
— ধরলে তখন দেখা যাবে, মাহা। তুমি নাহয় মাথা নীচু করে থেকো যাতে দেখা না যায়। তাছাড়া এটা কানাডা না, এটা মেক্সিকো। এখানে আইন এত কড়া না।
মাহা তাও কিছু বলার জন্য মুখ খুলবার চেষ্টা করতেই জামিল দিল এক ধমক
— মাহা! এত পেসিমিস্টিক হয়ো না তো। বি রোমান ইন রোম। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি সামনে আমার সাথে মাথা লুকিয়ে বসো তো কথা দিচ্ছি কানাডায় ফিরে গিয়ে তোমাকে কচ্ছপের ডিম পাড়া দেখাতে নিয়ে যাব। কচ্ছপ না পেলে যারা ডিম পাড়বে, তাকেই দেখতে যাব আমরা।
এরপরে মাহা আর আপত্তি করার মতো কোনো কারণ খুঁজে পেল না।

সবাই ঝটপট গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ঝড়ের বেগে চালিয়ে দিল সাফাত।
পারির পাশে বসে রিক খুব আলতোভাবে ওর দুই আঙুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে নিল। ইচ্ছা থাকলেও পারি হাতটা সরিয়ে নিতে পারল না।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে গাড়ি জমা দিয়ে রিক আর সাফাতের হাতে তেমন সময়ই আর ছিল না। পারিদের ফ্লাইট অবশ্য এক ঘন্টা পরে। ওরা আধা ঘন্টা পরে গেট দিয়ে ঢুকবে কিন্তু রিকদের এখনি ঢুকে পড়তে হবে।

সাফাত জেরিরেন কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। চেষ্টা করছিল রোমান্টিক হতে। কতটা সফল হয়েছিল, জানা যায় নি। তবে জেরিন এমনভাবে কেঁদে ভাসিয়েছিল যেন তাদের আর দেখা নাও হতে পারে!

রিক পারির হাত ধরে ওকে একটু আড়ালে নিয়ে এল।
— যাচ্ছি আমি, পারিজা।
— গুডবাই রিক। থ্যাঙ্কস ফর এভ্রিথিং।
অসহিষ্ণু শোনাল রিকের গলা।
— ক্যান ইউ স্টপ বিয়িং ফর্মাল ফর ওয়ান সেকেন্ড, পারিজা? আমরা যার মধ্যে দিয়ে গেলাম, এরপরে কি ফর্মাল হবার দরকার আছে আর?
হাসল পারি।
— না, নাই। তবে একটা ধন্যবাদ তো দিতেই পারি।
— দরকার নাই।
— আচ্ছা ধন্যবাদ তুলে নিলাম তাহলে।
এবারে রিকও হেসে ফেলেল
— সেন্স অফ হিউমার কম নাই দেখি।
— সেন্স অফ হিউমার শুধু তোমারি থাকবে এমন বাজে ধারণা তোমার হল কেমন করে বুঝলাম না তো আমি।

রিকের চোখে ভোরবেলার মতোই মুগ্ধতা ফুটে উঠল।
— তাহলে ফিরে গিয়ে কবে দেখা হচ্ছে আমাদের?
— আমাদের?
— হু, আমাদের। কবে দেখা করছি আমরা?
— আমরা, আমাদের বলে কিছু নাই, বুঝলে। এখানেই আমাদের দেখাশোনা শেষ।
— শিওর?
— ১০০%। ফিরে গিয়ে আমি তোমার বাটিপাগল মায়ের সাথে ডিল করতে চাই না। তোমাকেও আমার বিয়েপাগল মায়ের সাথে ডিল করতে হবে না, রিক।
— আবারও জিজ্ঞেস করছি আমি, পারিজা। তুমি শিওর তো? ধরো, ৫০-৫০ চান্স নাই?
— এবসোলিউটলি নট!
— ৬০-৪০?
— শাট আপ!
— এই তো তুমি হেসে ফেললে! তাতে ১০% বেড়ে গেল কিন্তু।
— কার বাড়ল?
— আমার! ৭০-৩০ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আমার লাকটা ফেভার করছে।
— ঐ আশাতেই থাকো!
— তা আছি। অসুবিধা নাই। বাকি ৩০% নাহয় নেক্সট ট্রিপের জন্য রেখে দিলাম!
— নেক্সট ট্রিপ? সেটা আবার কবে হল?
— হল না, হবে। হানিমুনে যেতে হবে না?
— হানিমুন! ইন ইয়োর ড্রিমস!

রিক অবলীলাক্রমে বলে ফেলে
— ড্রিম তো করতে শুরু করে দিয়েছি! গতরাতে একঘরে থাকার পর মনে হল ব্যাপারটা খারাপ হবে না!
— শাট আপ!
— পারিজা, তোমাকে কখনো বলেছি যে হাসলে তোমাকে সুন্দর লাগে?
— বলো নি, বলার দরকারও নাই।
লম্বা শ্বাস ফেলল রিক।
— তুমি এত আনরোমান্টিক কেন, বলো তো। তোমাকে ট্রেনিং দিতে হবে যা বুঝতে পারছি। সাফাতকে যেমন দিয়েছিলাম।
—রিক, তুমি যাবে এখান থেকে? প্লেন মিস করবে তুমি।
— ফিরে গিয়ে দেখা করবে তো?
— আগে ফিরে যাও তো। তারপরে দেখা যাবে।
— একটু হাসলে মনে হয়। তারমানে ১০০%, তাই না?

রিককে এক ধাক্কা দিল পারি।
— জাস্ট গো, রিক।
— ওকে। সি ইউ ইন টরোন্টো।
হাসতে হাসতে চলে গেল রিক। যেতে যেতে বলল
— ইউ টেক এজ মাচ টাইম এজ ইউ ওয়ান্ট, পারিজা। আই উইল বি ওয়েটিং ফর ইউ। দেয়ার ইজ নো এস্কেপিং মি, ইউ নো!
— তাহলে সারাজীবন অপেক্ষা করতে হচ্ছে তোমাকে।
— সারাজীবন লাগবে না, এই অল্প কিছুদিন!
— তোমার কনফিডেন্সের দেখি অভাব নাই!
— আমার পিছে কিন্তু অনেক মেয়ে ইন্টারেস্টেড, পারিজা। ভেবে দেখো, হাতছাড়া করতে চাও নাকি!
হাত নেড়ে গেট দিয়ে ঢুকে গেল রিক।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলল পারি। মুখে বলল
— ইম্পসিবল ম্যান!
কিন্তু ওর ঠোঁটে খুব হাল্কা একটা হাসি ফুটে উঠল।

পরিশিষ্ট

টরোন্টোতে ল্যান্ড করে বেরিয়ে আসতেই দেখে এরাইভালে দুই বান্দা রিক আর সাফাত দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুজনের মুখেই ১০০ ওয়াটের বাতির হাসি।

শ্বাস ফেলে মাহা বলল
— আই ডোন্ট বিলিভ ইট। এরা দুজন দেখি লাভ ক্রেজি হয়ে গেছে!
পাশে থাকা জামিলের হাতে থাপ্পড় মারল।
— দেখেছ? তুমি কোনোদিন এভাবে আমার জন্য ওয়েট করেছ?
— মাহা! এইমাত্র তোমার আবদার রাখতে হানিমুনে নিয়ে গেলাম। তারপরেও বেছে বেছে কী কী করিনি খুঁজে বের করছ? আবার তো ডিম পাড়াও দেখাতে নিয়ে যাব বললাম।
— এমনভাবে বলছ যেন আমি তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কথা আদায় করে নিয়েছি। আচ্ছা যাও, যাবো না আমি দেখতে। এত অনিচ্ছা যখন।
— আহ মাহা। আমি বলেছি একবারও যে যাব না?
— সব কিছু মুখ ফুটে বলার দরকার হয় না। সামান্য একটা জিনিস চাইলাম, তাও কতো অনিচ্ছা। যাও তুমি, আর কোনোদিন যদি কিছু চাই তোমার কাছে।
— মাহা, আই এম সরি। আমার একদম অনিচ্ছা নাই। তুমি চেয়েছ, আমি কখনো না বলেছি?
দুজনে মান অভিমান পর্ব চালাতে চালাতে পার্কিং এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ওরা চলে যেতেই সাফাত দুহাত এরোপ্লেনের ডানার মতো নাড়তে নাড়তে জেরিনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। হাত নাড়াবার কারণ ওর দুহাতের এক হাতে একটা মাঝারি সাইজের টেডি বিয়ার রয়েছে। সাদা রঙ এর টেডি বিয়ারের বুকে লাল রঙের হার্ট, সেখানে লেখা
উইল ইউ ম্যারি মি?
অন্য হাতে এক বক্স চকলেট!

সাফাতের মুখে রাজ্যজয়ের হাসি। যেন সে রোমান্সের শাহরুখ খান! যদিও এতে ওর কোনোই ক্রেডিট নাই। রিক নিজের ফোনে “হাউ টু প্রপোজ ইন এ রোমান্টিক ওয়ে” লিখে সার্চ দিয়ে এ তরিকা খুঁজে পেয়ে সাফাতকে জানিয়েছে। পাশেই ছিল গিফট শপ। তাই জেরিন আসবার আগেই সব ম্যানেজ হয়ে গেছে।
কিন্তু জেরিন এতকিছু বুঝতে পারেনি। সে সাফাতের ইমপ্রুভমেন্টে রীতিমত ইম্প্রেসড। সাফাতের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর দুই গলা জড়িয়ে ধরল
— সাফাত, আর ইউ সিরিয়াস?
— প্লিজ সে ইয়েস, জেরিন। ডোন্ট কিপ মি ইন সাসপেন্স।
— অফ কোর্স আই উইল ম্যারি ইউ, সাফাত।
ইমোশানের আতিশয্যে জেরিন সাফাতকে বাকি দুজনের সামনেই কিস করে ফেলল। দুজনে কলকল করে গল্প করতে করতে সাফাতের গাড়ির দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
পিছে যে পারি আর রিক থেকে গেল, ওরা খেয়ালও করল না।

— পারিজা।
— রিক, তুমি এখানে কেনো? বাড়ি যাওনি কেন?
— বিকজ আই ওয়ান্টেড টু গিভ ইউ সামথিং।
রিক পিছনে রাখা হাত সামনে এগিয়ে আনল। সেহাতে বারোটা গোলাপ। হলুদ রঙের। দেখে পারি কেবলি শুরু করতে যাচ্ছিল
— রিক, আমার মনে হয় না…
— প্লিজ ডোন্ট সে নো, পারিজা।
হাত বাড়িয়ে গোলাপগুলি নিল পারি।
— আচ্ছা নিচ্ছি। হলুদ গোলাপ যখন দিচ্ছ, অসুবিধা কি?
রিকের চেহারায় কনফিউশান ফুটে উঠল।
— গোলাপ হলুদ হলে কোনো অসুবিধা আছে?
ঠোঁট টিপে হাসল পারি রিকের অজ্ঞতায়।
— হলুদ কালার বন্ধুত্বের কালার। আমাকে হলুদ গোলাপ দেয়া মানে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাও তুমি।
— সত্যি? হলুদ গোলাপ বন্ধুত্ব মিন করে? মুখ গোমড়া হয়ে গেল রিকের।

মনেমনে নিজেকে স্টুপিড, ইডিয়ট ও অন্যান্য ছাপার অযোগ্য গালি দিল।
— তাই তো মিন করে। রিকের ঝুলে পড়া মুখ দেখে পারির হাসিই পাচ্ছে। বহুকষ্টে চেহারা স্বাভাবিক রাখল ও।
— ড্যাম! আই ডোন্ট বিলিভ ইট! সাফাতকে এত টিপস দিলাম আর নিজের বেলায় কিনা ডাহা ফেল।
পরমুহুর্তেই চেহারা উৎসুক হয়ে গেল
— তো প্রপোজ করতে চাইলে কী কালার দিতে হবে?
— রিক!
— আই নো! আই নো! ইটস টু সুন। কিন্তু আমি আগে থেকেই আমার ইন্টেনশানস ক্লিয়ার রাখতে চাই, পারিজা।
পারির হাত থেকে গোলাপগুলি কেড়ে নিল রিক। পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিল।
— হু ওয়ান্টস ফ্রেন্ডশিপ ফ্রম ইউ! আমার অনেক বন্ধু আছে। আই ওয়ান্ট সামথিং এলস।
— রিক! আবার!
কাচুমুচু হয়ে গেল রিকের চেহারা
— সরি এগেইন। বাট আই ওয়ান্ট টু মেক ইট ক্লিয়ার দ্যাট ফ্রেন্ডশিপ ইজ এবসোলুটলি নট পসিবল ফ্রম মাই সাইড।

হাল ছেড়ে দিল পারি। বুঝল রিককে ঠেকানো যাবে না। তাও শেষ চেষ্টা করল
— তুমি লাকি যে সাদা গোলাপ অফার করো নি।
— কেন? সাদা কী মিন করে? আতংকিত হয়ে গেল রিক।
— হোয়াইট মিনস সরো। কেউ মারা টারা গেলে সাদা গোলাপ দেয়। শোকের রঙ!
শুনে অসম্ভব মেজাজ খারাপ হল রিকের
— আই ডোণ্ট লাইক দিস! আই ডোন্ট লাইক দিস এট অল। কোন ইডিয়ট এগুলি আবিস্কার করেছে? রিকের গলায় উস্মা।
— প্রবাবলি ফ্লাওয়ার শপের মালিকেরা। ওদেরও তো বিজনেস করতে হবে! ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে পারি।
— আই হেট দেম ফ্রম দা বটম অফ মাই হার্ট! চলো তোমাকে রেড রোজ কিনে দেই। এখন মনে পড়েছে রেড রোজ কী মিন করে!
— রিক! এগেইন? তুমি আমাকে বাসা পর্যন্ত নামিয়ে দিতে পারবে। আপাতত এতটুকু ইজ এলাউড। এর বাইরে কিছু না।

নাছোড়বান্দা রিক বলল
— ক্যান আই কাম ইনসাইড টু সে হাই টু ইয়োর মম?
— রিক! আমার মায়ের খপ্পরে পড়েছ তো গেছ তুমি বলে দিলাম কিন্তু!
— শোনো, সেরাত্রে আসিনি, তারজন্য সরি বলতে হবে না?
স্তম্ভিত হয়ে গেল পারি
— তুমি সেরাতে আসোনি?
— তুমি যখন নিচে নামলে না তখন মা আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমি তখন রাস্তায়। সাথেসাথে প্ল্যান ক্যান্সেল করে গাড়ি ঘুরিয়ে ডাউনটাউনে চলে এসেছিলাম।
— এজন্য! আমি সবসময় আশ্চর্য হতাম তুমি দাওয়াত ছেড়ে ডাউনটাউনে কী কর!
— তারপরে এক রেস্টুরান্টে দুজনের দেখা হয়ে গেল। দিস ইজ এ সাইন, পারিজা।
— সাইন না কচু। আমি একদম সুপারস্টিসাশ না, রিক।
— ঠিক আছে, এগুলি নিয়ে পরেও ডিসকাস করা যাবে। এখন চলো ফ্লাওয়ার শপে। ওদের বিজনেস আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া যাক।
রিকের কনুই ধরে ওকে থামিয়ে দিল পারি। টানতে টানতে বাইরে বের করে আনল।
— রিক! চলো তো, চলো এখন।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কার পার্কের দিকে যেতে থাকে
— পারিজা, ক্যান ইউ ডু মি এ ফেভার?
— কী ফেভার?
— এক সেট বাটি কিনে মন্ট্রিয়ালে মা’র কাছে পাঠাতে পারবে?
পারি হাঁ হয়ে গেল আব্দারের নমুনা শুনে।
— কেন?
— মানে বলছিলাম কী, সেদিন তুমি এলে না দেখে মা’র একটু রাগ রাগ ভাব দেখেছিলাম আরকি। নাথিং সিরিয়াস। বাটি গিফট করলেই সেটা চলে যাবে। তারপর বাকিটা আমি দেখছি!
হাসতে হাসতে শেষ হয়ে গেল পারি।
— আই ডোণ্ট বিলিভ দিস।
— প্লিজ পারিজা।
হাসতে থাকে পারি।
— আপাতত বাড়ি পৌঁছে দাও রিক, তারপর দেখি কী করা যায়! তুমি একটা নাছোড়বান্দা দেখি।
মুচকি হাসল রিক
— দ্যাট ইজ দা সিক্রেট টু মাই সাকসেস!
দুজনে গল্প করতে করতে কার পার্কের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

(সমাপ্ত)

বি দ্র— নানান দেশের পৌরাণিক রূপকথা আজ থেকে স্টলে পাওয়া যাবে। জাগৃতি প্রকাশনী, স্টল নাম্বার ৪৮০, ৪৮১, ৪৮২।

ঋভুকেও পাওয়া যাবে আজ নয়া উদ্যোগ এর স্টলে। স্টল নাম্বার ৪৪৮।

একদিনে দুইটা সুসংবাদ পেয়ে আমি আপাতত বেহুশ আছি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here