মন নিয়ে পর্ব -০৫

মন নিয়ে (পর্ব ৫)

ভোরের প্লেন ধরতে গিয়ে রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হোটেলে ফিরে দুই বান্ধবী ছোট একটা ভাতঘুম দিয়ে বিকেলে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ল। এক অলিখিত চুক্তিতে দুজনের একজনও সাফাত বা রিকের প্রসঙ্গ ওঠাল না। ম্যাপ অনুযায়ী দুই ব্লক পার হয়ে গেলেই পড়বে ফিফথ এভেনিউ, মেইন টুরিস্ট স্পট। তার কাছাকাছি বিচ।

ফিফথ এভিনিউ মূলত বিদেশীদের টার্গেট করে গড়ে উঠেছে। ইট বিছানো রাস্তার দুধারে সারি সারি দোকানপাট, রেস্তোরা, বার। ছোটখাট হোটেলও কম নাই। একটু পরপর বসবার জন্য বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে, তাকে ঘিরে বিশাল টবে ফুলের সমাহার। ঝমঝমে মিউজিক ভেসে আসছে। চারিদিকে চাকচিক্যের অভাব নাই। দোকানগুলিও ব্র্যান্ড নেমের দোকান।
খানিক হেঁটে পারির কাছে ব্যপারটা একটু হাস্যকরই ঠেকল। মানে টরোন্টো থেকে এসে যদি টরোন্টোরই আরেক রূপ দেখতে হয়, তবে এত দূরে আসা কেন? এসব ব্র্যান্ডের দোকান তো টরোন্টোর অলিগলিতে।
মুখ ফিরিয়ে জেরিনকে কিছু বলতে যাবে, দেখে জেরিন ইতোমধ্যে এক দোকানে ঢুকে পড়ে মনোযোগ দিয়ে মেক্সিকান হ্যান্ডিক্র্যাফটস দেখছে। পিছে পিছে পারিও গিয়ে ঢুকল। এ দোকানে অবশ্য খাঁটি মেক্সিকান হাতে তৈরী জিনিস রয়েছে। নারিকেলের মালাই এর ওপরে কারুকাজ করা ল্যাম্প শেড, ঝিনুক দিয়ে তৈরী নানান ঘর সাজানোর জিনিস, মেক্সিকান ডিজাইনের সূচি কর্ম করা পোশাক। জেরিন একসাইটেড হয়ে কয়েকটা হাতে কাজ করা টপ্স তুলতেই পারি সাবধানে কথা আরম্ভ করল। জেরিন একটা শপাহলিক। ওকে ঠেকিয়ে না রাখলে ও গোটা দোকানই তুলে নেবে। দুই চার দোকান ঘুরে যাচাই বাছাইও করবে না। তাছাড়া পারির কাছে জিনিসগুলির মাত্রাতিরিক্ত দাম বলে মনে হচ্ছে। আসবার আগে ও মেক্সিকো নিয়ে একটু পড়ে এসেছিল, জেনেছিল লোকাল মার্কেটে অনেক কম দামে সেম জিনিস পাওয়া যায়। যে দেশ ঘুরতে এসেছে, সে দেশের লোকাল জায়গা না দেখে মিনি বিদেশ দেখার ওর তেমন ইচ্ছা নাই।

— জেরিন, চলো বের হই। সমুদ্র খুব কাছে, সি বিচে যাওয়া যাক। এত সুন্দর কালারের সমুদ্র প্লেন থেকে দেখলাম।
সমুদ্রের কথায় জেরিনের মনোযোগ ঘুরে গেল। হাতের জিনিস নামিয়ে রেখে বলল
— ইউ আর রাইট। এখন কিনে শপিং ব্যাগ নিয়ে ঘোরার কোনো মানে হয় না। ফেরার পথে কিনলেই হবে।
নিশ্বাস ফেলে পারি মনেমনে ঠিক করল ফেরার পথে অন্য রাস্তা ধরতে হবে। এ জায়গাটা জেরিনের মতো টুরিস্টের জন্য একটা ট্র্যাপ। সেও যে শপিং করবে না, তা না। কিন্তু দেখেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা না।

সি বিচে গিয়ে প্রথম দর্শনে সমুদ্র দেখে খানিকটা হতাশই হয়ে গেল দুজনে। সমুদ্রের রঙ ধুসর, কোথায় সেই নীল সবুজ রঙের চোখ জুড়ানো রূপ। বিচের ধার ঘেঁষে একের পর এক রেস্তোরা, হোটেল। কান ফাটানো ঝমঝমে মিউজিক। বিচে এত মানুষ, হাঁটাই মুশকিল। খেয়াল রেখে হাঁটতে হচ্ছে কখন আবার কার গায়ের ওপরে পা দিয়ে দেয়া হয়। জায়গাটা মূলত পার্টি করতে আসা ক্রাউডের জন্য। চারিদিকে হাসি, গান, গল্প, খেলা চলছে।

হঠাত থেমে পড়ল জেরিন।
— আই ডোন্ট বিলিভ ইট!
জেরিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে পারিও থমকে গেল। উলটা দিক থেকে দুই ঢ্যাঙা মূর্তি এগিয়ে আসছে। যাদের সাথে দেখা হোক, দুজনের একজনও চায় না।
পারি ঠিকমতো ব্যপারটা হজমই করতে পারল না, তার আগেই জেরিন ঘুরে গিয়ে দ্রুতপদে চলে যেতে আরম্ভ করল। সে দেখে সাফাত ছুটল ওর পিছে। তীরবেগে পারিকে পাশ কাটিয়ে বলতে বলতে গেল
— জেরিন, ওয়েট, ওয়েট।
জেরিন হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। সাফাত দৌড়ে গিয়ে কনুই ধরে জেরিনকে থামিয়ে দিল

— লিসেন টু মি, জেরিন।
ঝাঁকি দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল জেরিন। সরে যেতে যেতে বলতে থাকল
— শুনব না আমি। স্টে এওয়ে ফ্রম মি।
এতক্ষণে সাফাতের গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। স্রেফ জেরিনের জন্য সে পড়িমড়ি এতদূর ছুটে এসেছে, এখন জেরিন ওকে পাত্তা দেয়া দূরে থাক, দেখলেই পারে তো দূর দূর করে খেঁদায়ে দেয়। এটা একটা কথা হল? পিছেপিছে গিয়ে জেরিনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে কড়া গলায় বলে ফেলল
— আই এম ওয়ার্নিং ইউ, জেরিন। আই টোল্ড ইউ টু লিসেন টু মি।

আর যায় কোথায়! একে তো মেয়ে হ্যারাস করছে, তার ওপরে তাকে হুমকিও দেয়া সারা। মাটি ফুড়ে দুজন টুরিস্ট পুলিশ উদয় হল।
— স্যার, হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক ইউ আর ডুইং?
জেরিন ব্যপারটা লক্ষ করেনি। সে তখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুতপদে চলে যেতে ব্যস্ত। এদিকে বিপদ দেখে পারি আর রিক দৌড়াতে দৌড়াতে উপস্থিত। পারি চিৎকার করে উঠল
— জেরিন! স্টপ! স্টপ!
জেরিন না তাকিয়েই হাত উঁচিয়ে বলল
— আমি হোটেলে ফিরে গেলাম, পারি। আই ডু নট ওয়ান্ট টু ডিল উইথ দিস।
সাফাতের মুখ কালো হয়ে গেল, পুলিশের চেহারায় ঘোর সন্দেহ। রিক ঢোঁক গিলে কোনোমতে বলল
— ইট ইজ নট হোয়াট ইউ আর থিংকিং।

পারি মরিয়ার মতো আবার চিতকার করে উঠল
— জেরিন, স্টপ! সাফাত ইজ ইন ট্রাবল!
এতক্ষণে জেরিন থমকে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সাফাতের দুইপাশে দুই পুলিশ দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। ছুটতে ছুটতে ফিরে এলো।
— মিস, ইজ দিস গাই বদারিং ইউ?
রাগতমুখে জেরিন উত্তর দিল
— ইয়েস, হি ইজ। আই মিন নো, হি ইজ নট।
পুলিশগুলি পুরাই কনফিউজড।
—প্লিজ মেক আপ ইয়োর মাইন্ড, মিস। ইজ হি হ্যারাসিং ইউ?
এতক্ষণে যেন সাফাতের বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারল জেরিন।
— হি ইজ নট হ্যারাসিং মি। হি ইজ মাই ফিয়াসে।
— আর ইউ শিওর, মিস?
— অফ কোর্স আই এম। উই হ্যাড এ ফাইট, দ্যাটস অল। নাথিং সিরিয়াস।

পুলিশ মনে হয় এ ধরণের ড্রামায় অভ্যস্ত। তারাও আর বেশি ঘাঁটাল না।
— অল রাইট, মিস। টেক কেয়ার।
পুলিশ চলে যেতেই পারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
— শখ মিটেছে, জেরিন? কেমন ফিল্মি হল না ব্যপারটা? আর একটু হলেই সাফাত জেল হাজতে চলে যেত।
জেরিন সাফাতের দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখেমুখে রাগ আর অনুতাপ খেলা করছে। রিক এতক্ষণে মুখ খুলল
— তোমাদের ঠান্ডা মাথায় কথা বলা দরকার। লিসেন জেরিন, আমি তোমাকে চিনি না। কিন্তু সাফাত আমার ফ্রেন্ড। হি ওয়েন্ট থ্রু এ লট অফ ট্রাবল জাস্ট ফর ইউ। ওকে একটা চান্স দাও নিজের দিকটা বলবার জন্য। দেখো কী বলে। এভাবে ড্রামা করলে দুজনেই বিপদে পড়বে যেকোনো সময়। শুনেছি মেক্সিকান পুলিশ ডেঞ্জারাস হয়।
জেরিন থমকে গেল, চেহারা থেকে রাগ মুছে গিয়ে অনুতাপ রয়ে গেল।

সাফাত চেহারায় করুণভাব ফুটিয়ে তুলল
— প্লিজ জেরিন।
— ঠিক আছে, ঠিক আছে। পাঁচ মিনিট দিচ্ছি তোমাকে, সাফাত। তারপরে আমি ফিরে যাচ্ছি।
সাফাত কথাটি না বলে জেরিনের হাত নিজের মুঠায় নিয়ে ভীড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। রিক আর পারি অপ্রস্তুতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কথা শুরু করল রিক
— লিসেন, পাড়িজাত।
— মাই নেম ইজ পারিজাত।
আবার চেষ্টা করল রিক
— পাড়িজাত।
— বললাম না তোমাকে আমার নাম পারিজাত। সফট “আর” হবে। পা-রি-জা-ত।
— পাড়িজাত।

প্রচন্ড বিরক্ত হল পারি।
— নেভার মাইন্ড। গুড বাই।
ফুঁসতে ফুঁসতে হোটেলের দিকে রওনা দিল। পথে অথেনটিক মেক্সিকান রেস্তোরা পড়ল। ঢুকে গিয়ে রাতের খাবারটা সেরে নিল ও। জেরিনের দেখা কতক্ষণে পাবে, কে জানে। খিদে চেপে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না। তবে খেতে খেতে এটাও মনেমনে স্বীকার করল যে জেরিনকে সুন্দরভাবে কনভিন্স করে ফেলল রিক। হয়ত ছেলেটা এতো খারাপ না। আবার সাফাতকে মেন্টালি সাপোর্ট দিতে এতদূরে চলেও এসেছে। এ জামানায় কে এসব করে?
তবে পাড়িজাত বললে ওর কপালে দুঃখ আছে এটা ঠিক!
(চলবে)

ফিফথ এভিনিউ।
সমুদ্র দেখে হতাশ।
প্লেন থেকে দেখা অপরূপ সমুদ্র।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here