মন নিয়ে পর্ব -০৪

মন নিয়ে (পর্ব ৪)

ক্যানকুন এয়ারপোর্টের শীতল এ সি থেকে বের হতেই এক ঝলক গরম বাতাসের ঝাপ্টা খেল যেন চারজন। গরমের সাথে সাথে হিউমিডিটিও কম না। ডিসেম্বার মাস চলছে। টরোন্টোতে এ সময়ে জাকিয়ে শীত পড়েছে। সে হিসাবে ওরা সোয়েটার, জ্যাকেট, উইন্টার বুট পরে প্লেনে উঠেছিল। এখন গরমে সবার সেদ্ধ হবার অবস্থা। তাড়াতাড়ি জ্যাকেট, সোয়েটার খুলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সবাই। ঝটপট হোটেলের শাটল বাসে উঠে পড়ল। আসবার পথে প্লেন থেকে পেঁজা পেঁজা তুলার মতো মেঘের ফাঁকে দিয়ে নানা সবুজের শেডের ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের প্রথম ঝলক দেখে সবাই মুগ্ধ। পানির এত সুন্দর রঙ না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পারি নানান ট্রাভেল ম্যাগাজিনে সমুদ্রের চোখ ধাঁধানো রঙ দেখে সবসময় ভেবে এসেছে যে সেগুলি কালার এনহান্স করা। কিন্তু এখন বুঝল প্রকৃতির রূপের ওপর মানুষের সাধ্য নাই কোনো কেরামতি করে। সমুদ্রের পানি আসলেই দুস্প্রাপ্য কোনো নীল সবুজ পাথরের রঙে রাঙানো।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ছোট্ট শহর প্লায়া ডেল কারমেন এ। এখানেই ওদের হোটেল। এত অল্প সময়ের মধ্যে হোটেল বুক করতে গিয়ে দেখে ক্যানকুনে হোটেলের ভাড়া আকাশচুম্বী পড়বে। তারচাইতে কাছের শহর প্লায়া ডেল কারমেন অনেকটা হাতের নাগালের মধ্যে, এটিও টুরিস্ট শহর। মাহা আর জামিল ভাই থাকবে হাঁটার দূরত্বে একটু বড়ো হোটেলে, জামিল ভাই বৌকে খুশি করতে হানিমুন সুইট বুক করেছে। পারি আর জেরিনের জন্য জামিল ভাই বুক করেছে হোটেল লা কাসা ডে লা ফ্লোরেস।

এক বছর ধরে বড় বৌ হিসাবে বিবাহিত জীবন যাপন করছে বলেই কিনা কে জানে ওদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে মাহা অভিভাবকসুলভ কন্ঠে বলে দিল
— জিনিসপত্র রেখে গোসল করে নাও। তারপরে একসাথে লাঞ্চ করতে যাই চলো।
— মাহা! ইটস ইয়োর হানিমুন! ফরগেট এবাউট আস, ওকে?
— আহা। প্রথম লাঞ্চ একসাথে করতে তো আর অসুবিধা নাই কোনো।
ওরা দুজনেই তীব্র আপত্তি জানাতে থাকে। কিন্তু ওদের আশ্চর্য করে দিয়ে জামিল ভাইও বৌয়ের সুরে সুর মেলালো।
— হ্যাঁ, একটা লাঞ্চ আমরা একসাথে খেতেই পারি। তারপরে নাহয় আলাদা আলাদা থাকলাম। চলো চলো, ইট উইল বি মাই ট্রিট।
দুজনের পীড়াপীড়িতে ওদের রাজি হতেই হল। মাহা খুবি সফট হার্টেড আর জামিল ভাইও কম ভালোমানুষ না বলতে বলতে ওরা হোটেলে গিয়ে ঢুকল।

হোটেলটা খুব যে আহামরি বলা যাবে না কিন্তু বেশ একটা আপন আপন ভাব রয়েছে। রট আয়রনের গেট ঠেলে ঢুকতে হাতের ডানদিকে ছোট রিসেপশান ডেস্ক আর বাদিকে ডাইনিং হল পড়ল। প্রতি সকালে এখানে এসে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিতে হবে। রিসেপশানে প্রয়োজনীয় ফর্মালিটিজ সেরে ঘরের চাবি হাতে নিয়ে ওরা রওনা দিল রুমের উদ্দেশ্যে। রিসেপশান এরিয়া পার হয়ে তিন ধাপ সিড়ি নামতেই পড়ল প্রশস্ত খোলা জায়গা। বাদিকে চেয়ার টেবিল পাতা, পরে টের পেয়েছিল এখানেও অনেকে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসে বসে। আর ডানদিকে ছোটখাট একটা সুইমিং পুল। সুইমিং পুল পার হয়ে দুধারে রুম। একপাশে দেয়াল ধরে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। বাকি দেয়ালে ফ্রিডা কাহলোর ছবি আঁকা। আসতে আসতে ওরা খেয়াল করেছিল পুরা শহর জুড়েই ফ্রিডার অসংখ্য ছবি দেয়াল আর্ট হিসাবে রয়েছে।

ওদের রুম নাম্বার ২২। এমনকিছু আহামরি না। কিন্তু ঘরোয়া, বিছানায় ফ্রেশ চাদর, বাথরুম পরিস্কার। ঘরে চা কফি খাবার ব্যবস্থা রয়েছে, একটা ছোট ইস্ত্রিও রয়েছে কাপড় ইস্ত্রি করবার জন্য। আর কী চাই। দুজনে বেশিদিন হয়নি চাকরি করছে, এর বেশি আশাও করে না।
গরমে দুজনেরই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল। ঝটপট গোসল করে রেডি হতে না হতে মাহা আর জামিল ভাই চলে এলো। জামিল ভাইয়ের কথামতো কাছে এক ভেনেজুয়েলান রেস্তোরা রয়েছে। সেখানকার রিভিউ ভালো দেখে এসেছে। সবাই গল্প করতে করতে চলল সেদিকে।

রেস্তোরাটা মাঝারি সাইজের কিন্তু বেশ ভিড়। ওরা টেবিল নিয়ে বসতে সার্ভার এসে মেনু দিয়ে গেল। অর্ডার দিয়ে দিল ওরা। জামিল ভাইয়েরই পরামর্শে। তার এক কো ওয়ার্কার ভেনেজুয়েলান। সেখান থেকে তাদের খাবার সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা রাখে। খেতে খেতে গল্প চলছিল। মাহার চেহারায় খুশির ঝলক দেখে পারির সত্যি খুব ভালো লাগে। জামিল ভাইয়ের সাথে একা বেড়াতে এসে আনন্দ ওর চোখেমুখে ফেটে পড়ছে। এদিকে জেরিনের নিভে যাওয়া মুখ দেখে খারাপ লাগছে। যা দেখছে তাতেই সাফাতের নাম টেনে আনছে। তারপরেই রাগত মুখে বলছে।
— আই ডোন্ট কেয়ার। আই উইল ফরগেট হিম!

খাওয়া শেষ করে ওরা বসেবসে গল্প করছিল, রেস্তোরায় দুজন ঢুকতে জেরিন বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। দেখাদেখি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে পারির চোখও কম বিস্ফারিত হল না।
এরা এখানে! এ কেমন করে সম্ভব!
এদের থেকে দূরে থাকতেই তো ওরা এতদূর চলে এলো। আবার এখানেও দেখা হয়ে গেল!
মানে ফাজলামির একটা সীমা তো থাকবে!

পারির দিকে চোখ পড়তেই রিক থমকে দাঁড়িয়ে গেল
— ইউ! তুমি এখানেও?
— সে কথা তো আমিও তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারি। কী মতলবে তুমি এখানে এসেছ?
— ডেফিনিটলি নট ফর ইউ। আমি এসেছি আমার বন্ধু সাফাতের মোরাল সাপোর্ট হিসাবে। কিন্তু তার গার্লফ্রেন্ডের লেজ হিসাবে তুমিও যে বোনাস থাকবে, ভাবিনি।
উঠে দাঁড়াল পারি।
— থাকছি না আর। আই এম লিভিং।
— আবার মাথা ধরল নাকি?
শ্লেষের সাথে প্রশ্ন করল রিক। পারি জবাব দেবার দরকার মনে করল না।
দেখাদেখি জেরিনও উঠে দাঁড়াল।
— আই এম কামিং টু। ওয়েট ফর মি, পারি।

পারিকে অনুসরণ করে জেরিনও উঠে পড়ল। সাফাত বাধা দিল
— ওয়েট, জেরিন। আই নিড টু টক টু ইউ।
— দেয়ার ইজ নাথিং টু টক এবাউট।
— জেরিন প্লিজ! আমি এত ঝামেলা করে ছুটি ম্যানেজ করে চলে এলাম, তুমি আমার দিকটা দেখবে না?
রাগে নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠতে থাকে জেরিনের।
— ঝামেলা! ঝামেলা! ঝামেলা তো আসতে কে বলেছে তোমাকে? আমি এখানে দিব্যি আছি। তোমার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি। দ্যাট প্রুভস দ্যাট আই ডু নট বিলং টু ইউ এন্ড ইউ ডু নট বিলং টু মি। ইউ আর ব্রোকেন আপ এন্ড দ্যাট ইজ ফাইনাল!

কথা শেষ করে জেরিন পারির পিছেপিছে গ্যাটগ্যাট করে চলে যেতে থাকে। রিক এতক্ষণ পারিকে রাগতমুখে লক্ষ করছিল, সাফাতের কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে বন্ধুর দিকে মুখ ফেরালো।
— কী হয়েছে?
— হয়েছে তোমার মাথা আর মুন্ডু!। খুব তো এডভাইস দিলে জেরিনের পিছেপিছে যাও, জেরিন তোমার রোমান্টিক জেশ্চার দেখে আইসক্রিমের মতো গলে যাবে। তো এইটা কী হল?
কাঁধ ঝাঁকাল রিক
— তার আমি কী জানি? মেয়েরা এসবে ফ্ল্যাটার্ড হয় বলেই তো জানতাম। এখন তোমার গার্লফ্রেন্ড যদি না হয়, আমি কিছু করতে পারব? তোমার গার্লফ্রেন্ডকে তোমারি ভালো চেনার কথা!
— তোমার মাথা ফাটাব আমি!
— তার আগে তোমারি মাথা ফাটাবো আমি। কেন বলোনি যে এ ট্রিপে ঐ মেয়েটাও আছে? শি ইজ জাস্ট ট্রাবল। আমার ধারণা শি ইজ এ উইচ। সব জায়গায় একটা ব্যাড ভাইব ক্রিয়েট করে।
— ও আসবে আমি জানি নাকি? দুনিয়ার মেয়েদের খবর রাখি আমি, কেমন? জামিল ভাইকে জিজ্ঞেস করো কেন সে এখানে!

জামিল এতক্ষণে খুব মনোযোগ দিয়ে উলটা করে মেনু পড়ছিল, নিজের বৌয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে। এবারে ডিফেন্সিভ মোডে চলে গেল
— গাইজ গাইজ! দিস ইজ মাই হানিমুন। তোমাদের রোমান্টিক প্রবলেমে আমাকে ইনভল্ভ করবে না প্লিজ। আমি এখানে আমার বউয়ের সাথে রোমান্স করতে এসেছি!
মাহা জ্বলন্ত মনোযোগে সাফাত আর রিকের কথা শুনছিল, এবারে জামিলকে তেড়ে ধরল
— তুমি ওদের বলেছ যে জেরিন আর পারি এখানে থাকবে?
চিপায় পড়ে জামিল স্বীকার করতে বাধ্য হল
— রিক আমাকে ধরেছিল সাফাতের রোমান্টিক প্রবলেম কিভাবে সল্ভ করবে, আমি শুধু সাফাতকে বলেছি যে জেরিন এ কয়দিন এখানে থাকবে। মেবি সে একটা ট্রাই করতে পারে। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।

রিক মাহাকে উদ্দেশ্য করে বলল
— হাই। আমি রিক। তোমার সাথে পরিচয় হয়নি আগে। আমি জামিলের প্রতিবেশী ছিলাম ছোটবেলায়। তখন সব প্রবলেমে ওর কাছ থেকে এডভাইস নিতাম। তারপরে অটোয়া চলে গেছিলাম, এখন আবার টরোন্টতে ব্যাক করেছি।
— হাই রিক, নাইস টু মিট ইউ।
সাফাত অসহিষ্ণু হয়ে গেল
— এসব হাই রিক মাই রিক ছাড়ো তো! আমার কী হবে এখন?

জবাবে জামিল উলটা করে মেনু পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল
— ইউ আর এ গ্রোন ম্যান, সাফাত। সল্ভ ইয়োর ওন প্রবলেমস। তোমাকে জেরিনের হোয়েরএবাউটস জানিয়েছি। বাকি তুমি কী করবে, তুমিই জানো। মেবি রিক মাইট হেল্প ইউ।
— আমার হেল্প করার এখন কোনো ইচ্ছাই নাই। ঐ মেয়েটার বান্ধবী মেয়েটার মতোই হবে। জেরিনের কাছ থেকে দূরে থাকো, সাফাত। দ্যাট ইজ মাই ওনলি এডভাইস এট দিস মোমেন্ট।
রিক সাফাতের প্রবলেম থেকে পুরাপুরি হাত তুলে নিল। জামিল বউয়ের কনুই ধরে যেতে যেতে বলল
— তাহলে তো প্রবলেম সল্ভড হয়ে গেল। এখন এ কয়টা দিন মেক্সিকোতে ঘুরে বেড়াও, পিরামিড দেখো। আমাকে জ্বালিও না। আমি এ মুহূর্ত থেকে আমার বউয়ের গোলাম।
ঠাস করে জামিলের হাতে থাপ্পড় মারল মাহা
— ডেকে নিয়ে এসে এখন পিছলে বেরিয়ে যেতে চাইছ, না? তোমার উচিতই হয়নি জেরিনের হোয়েরএবাউটস জানানো। জানিয়ে যখন ফেলেছ, তখন প্রবলেম সল্ভ করাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
— আমাদের? হু ইজ আমরা? প্লিজ ডু নট গেট ইনভল্ভড, মাহা। হানিমুন হানিমুন করে মাথা খারাপ করে দিয়েছিলে। এখন হানিমুনে এসে অন্যের লাভ লাইভ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর ফিরে গিয়ে আমাকে বলবে হানিমুনের কিছুই হয়নি। ওকে ফাইন, করো যা খুশি। আমি রুম থেকে বের হচ্ছি না, পুরাটা সময় লম্বা একটা ঘুম দিব।
— ঘুম! তোমার ঘুম বার করছি আমি। আমার লম্বা লিস্ট করা আছে কোথায় কোথায় যাব, কী কী দেখব। সব করতে হবে, নাহলে এখান থেকে ফিরছি না আমি।
— ও গড! তুমি কি আমার ঘুম হারাম করতে এতদূরে টেনে নিয়ে এলে?
মাহা আর জামিল তর্ক করতে করতে নিজেদের হোটেলের দিকে হাঁটতে থাকে। পিছনে পড়ে রইল রিক আর সাফাত। দুজনেই এ মুহূর্তে দুজনের ওপরে চরম বিরক্ত। কিন্তু কিছু করার নাই। কারণ একটা রুম বুক করেছে ওরা। না চাইলেও রুম শেয়ার করে পরস্পরের চোখের সামনে থাকতে হবে!
(চলবে)

সোনিয়া আপুর কাছ থেকে পাওয়া ছবি।
পেন্সিল স্টল ৩০০ তে পাওয়া যাবে বইগুলি।
অনলাইনে রকমারি, বইপরী থেকে পাওয়া যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here