মন ময়ূরী পর্ব -০২

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

২.

-দেখলে দাদি, তোমাদের নায়ক সাহেব এই যে দেখো মডেলের কোমড় জরিয়ে ধরে ফটোশুট করছে৷

খেয়া টিভি চ্যানেল রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে চেঞ্জ করে ওর দাদিকে দেখাতে লাগলো।

জয়নাব বেগম টিভির দিকে না তাকিয়ে খেয়াকে দিলেন এক রামধমক। দাদির কাছ থেকে রামধমক খেয়ে খেয়া চুপ করে বসে আছে।

-ছেলেটাকে বিয়ে করবে না ঠিক না আছে। কিন্তু, বারবার, তার কাজ নিয়ে কথা বলে তাকে হেনস্তা করার তোমার অধিকার নেই, খেয়া।

-জি, জি;আলহামদুলিল্লাহ.

আলহামদুলিল্লাহ বাক্য শুনে খেয়া আর ওর দাদি পিছনে ফিরে দেখলো, খেয়ার মা নিলিমা হাসিমুখে মোবাইলে কথা বলছে। এবার, খেয়া আর ওর দাদি বুঝতে পেরেছে হয়তো মোবাইলে কাউকে বলেছে।

কথা শেষ করে নিলিমা এসে উনার শ্বাশুড়ি পাশে বসে উৎসাহী কন্ঠে বলে,

-মা, আজ না-কি ফায়েজ চৌধুরীর বাবা মাহমুদ চৌধুরী আমাদের বাড়িতে আসবে। আজ কতবছর পর উনি এই
বাড়িতে আসবে!

জয়নাব বেগম অত্যন্ত খুশি হয়ে গেলেন কারণ মাহমুদ চৌধুরী হচ্ছেন উনার ভাইয়ের ছেলে। নিজের ভাতিজাকে চোখের সামনে দেখবেন ভেবে খুশিতে আটখানা জয়নাব বেগম।

-উনি বাড়িতে আসবে কেন, মা? উনার ছেলেকে তো আমি বিয়ে করবো না!

মেয়ের কথায় বিরক্তবোধ করেন নিলিমা। মেয়ের কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে বলেন,

-মাহমুদ ভাই আসবে তোর সাথে দেখা করতে। গতকাল তো সবাই এলো, উনি আসতে পারেননি।

-কিহহহহ

খেয়ার চিৎকারে কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন খেয়ার মা আর দাদি।

খেয়ার কান্ডে ওর মা আর দাদি চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। কান থেকে হাত সরিয়ে নিলিমা এসে খেয়ার কান টেনে ধরে বলে,

-ফাজিল মেয়ে, এমন করে চিৎকার দেয়ার মানে কি? উনি তোর চাচা হয়, সেটা কি ভুলে গিয়েছিস? উনি আসার পর যদি দেখেছি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছিস বা করেছিস, তবে তোর একদিন কি আমার একদিন।
এখন ভার্সিটি থেকে ঘুরে আয়, মাহমুদ ভাই বিকেলে আসবে।

নিলিমা আর জয়নাব বেগম ড্রইংরুম ছেড়ে চলে গেলো। খেয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো,নিজের চুল কিছুক্ষণ টেনেটুনে সোফা ছেড়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করলো।

ঘরে যাবার পর পড়নের ফতুয়া আর স্কার্ট চেঞ্জ করে গোলাপি রঙের সুতি শাড়ি পড়ে নিলো সাথে কালো রঙের ব্লাউজ।চোখে হালকা কাজল রেখা টেনে, লম্বা কেশরাশি ছেড়ে দিলো খেয়া।

আয়নায় নিজের দিকে খুব ভালো করে পরখ করে দেখলো সব ঠিকঠাক আছে কি না। এরপর,লেডিস ব্যাগে নিজের মোবাইল রেখে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো খেয়া।

ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পর খেয়া আজ ওর কোনো ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করেনি।ক্লাসরুমে চুপচাপ বসে আছে। হুট করে নিজের দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো, এক সুপুরুষের অবয়ব।

ধূসর পাঞ্জাবি পড়া এক পুরুষ, তার কথা শুনে সেই পুরুষের চোখে আকাশসম রাগ-অবাক মিশ্রিত চাহনি, জুস মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে যাওয়া সেই মূহুর্ত, সর্বশেষ রাগ দেখিয়ে বের হয়ে যাবার মুহূর্ত।সেই অতীত হওয়া দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে খেয়ার চোখের সামনে বারংবার দৃশ্যমান হচ্ছে।

খেয়ার নিজের প্রতি নিজের চরম বিরক্ত লাগছে। নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে খেয়া বলে,

-ছিহ্, খেয়া তুই দেখি ভারি অসভ্য। নায়ক সাহেবের কথা মনে করে তুই দেখি কল্পনাবিলাসী হয়ে যাচ্ছিস। তুই ওই যে নিরু আন্টির বড় ছেলে আছে না যেটার মাথায় চুল নেই, টাক। তাকে মনের কল্পনায় আনিস তবুও ওই নায়কের কল্পনা করিস না। নায়করা কখনো একজনের থাকে না এরা বহু নারীর স্বপ্নের পুরুষ। এক নারী চলে গেলে এদের জন্য অন্য নারীর অভাব হবে না।

নিজের চুলে কারো স্পর্শ পেতেই ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলো খেয়া। দেখলো ওর ফ্রেন্ড রিমি,রওশান, নিধি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ খেয়া রাগী দৃষ্টি নিয়ে রওশানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আমার চুলে একমাত্র তুই ছাড়া আর কেউ হাত দিতে পারেনি। কারণ, আমার চুলে কেউ হাত দিক এটা আমার পছন্দ না। তোর কপাল ভালো তুই আমার ফ্রেন্ড নয়তো তোর কপালে মাইর লেখা থাকতো আমার হাতের।

রওশান হেঁসে ফেললো, নিধি খেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তুই আজ আমাদের সাথে দেখা না করে ক্লাসরুমে বসে আছিস, কিছু হয়েছে খেয়া?

খেয়া তার বন্ধুদের কি জবাব দিবে খুঁজে পাচ্ছে না। একবার ভাবছে ফায়েজের কথা বলে দিবে কিন্তু আবার ভাবছে ফায়েজের কথা ওদের সাথে বললে, বরং ওদের দুষ্ট কথা বেড়ে যাবে।তারচেয়ে, বরং না বলাই শ্রেয়।

****************

শুটিং সেটে বসে আছে ফায়েজ চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগে একটি সিনেমার শট শেষ করতে না পেরে এখন রেস্ট নিচ্ছে।

দু’বছরের ক্যারিয়ারে ফায়েজের কখনো এমন হয়নি কিন্তু আজ সেই অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গেলো।

ওর সিনেমার পার্শ্বচরিত্র নওশিনের সাথে আজ রোমান্টিক সিনের শট ছিল। সব ঠিক ছিল, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো, ফায়েজের বেলায়। ও কোনোভাবেই নওশিনের চোখে চোখ রেখে শট দিতে পারছে না। নওশিনের চোখের দিকে তাকাতে গেলেই খেয়ার বলা কথাগুলো মনে পড়ছে।

প্রথমবার ডিরেক্টর বিরক্ত না হয়ে বলেছিলেন,

-ফায়েজ, তুমি বরং আরেকটু সময় নেও। দশমিনিট পর নাহয় আবারও শট নিবো।

ফায়েজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর জন্য বরাদ্দকৃত রুমে গিয়ে বসে আছে।

বসে থাকতে থাকতেই কখন যেন চোখ লেগে এলো ফায়েজের। ফায়েজ ঘুমের ঘোরে ওর অদৃশ্য কল্পনায় দেখলো,

সবুজ শাড়ি পরিহিতা এক অপরূপা মেয়ে, তার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে চেয়ে আছে। মেয়েটির এই বিরক্তির চাহনি ছিল তারজন্য সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার। কেন জানেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অপরিষ্কার কুকুরকে দেখলেও হয়তো একটি মানুষের চোখে এতটা বিরক্তি থাকে না যতটা তাকে দেখে এই মেয়েটির চাহনিতে প্রকাশ পেয়েছিল।
তার বলা এক একটি কথা তো আরও ভয়ানক।

ফায়েজর ঘুমের ঘোরে মনে হলো এই কক্ষে খেয়া এসেছে, এবং তারদিকে রাগীদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে,

-দেখলেন, নায়ক সাহেব। গতকাল আপনাকে কথাগুলো বলতে না বলতে আপনি আজ হিরোইনদের সাথে ঘেঁষাঘেষি করতে চলে এসেছেন৷এই জন্য আমি হিরোদের ঘৃনা করি।

চট করে চোখ খুলে তাকালো ফায়েজ, পুরো ঘরে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো, কেউ নেই এই ঘরে।

দরজা খুলে কে যেন প্রবেশ করলো, ফায়েজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ওর এসিস্ট্যান্ট জব্বার উদ্দিন এসেছে।

জব্বার ফায়েজের সামনে এসে দাড়িয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-স্যার,বেয়াদবি না নিলে একটা প্রশ্ন করি?

ফায়েজ জানে এখন যদি জব্বারকে হাজার বারণ করে তবুও সে তার প্রশ্ন করবেই।

ফায়েজ ইশারা দিয়ে বললো, প্রশ্ন করতে পারো।

-আসলে,স্যার গতকাল যে আপনার হবু স্ত্রীকে দেখতে গেলাম। উনি কি স্টুডেন্ট নাকি টিচার,স্যার?

-না, ও টিচার নয় স্টুডেন্ট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্ট্যাডিজ বিভাগে, তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

-তারমানে স্যার, আপনার হবু স্ত্রী বাংলাদেশের ভবিষ্যত একজন সাংবাদিক।

ফায়েজ মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে শুয়ে রইলো চোখ বুঁজে। কিন্তু, জব্বারের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কারণ জব্বার উদ্দিন বলেছে,

-স্যার, তাইলে আপনি যদি খেয়া ভাবিকে বিয়ে করেন তবে আপনার কপাল খুলে যাবে৷ আপনি হচ্ছেন এদেশের একজন সফল নায়ক আর আপনার স্ত্রী হবে একজন সাংবাদিক। আপনার সব সফলতার খবর আপনার স্ত্রী নিজ হাতে ফলাও করে ছাপাবে পত্রিকার পাতায়। বাহ্, স্বামী হবে নায়ক আর স্ত্রী হবে সাংবাদিক।

-জাস্ট শাট আপ জব্বার। তুমি মাঝে মাঝে কি বলো তুমি নিজেও জানো না। তুমি কি আমার সাথে মশকরা করার চেষ্টা করতে চাইছো। তুমি জানো যে, খেয়া আমাকে বিয়ে করতে রাজি নয় সেই হিসেবে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে কি আবোলতাবোল বকছো?

জব্বারের সাথে রাগারাগি করে শুটিংসেট থেকে বের হয়ে গেলো।

ফায়েজ কিছু না বলে চলে যাওয়াতে ডিরেক্টর বেশ কিছুক্ষণ চেচামেচি করলো।

জব্বার মাথা চুলকিয়ে ভাবছে কি এমন বললো সে, তার জন্য তার স্যার এভাবে রেগেমেগে সেট থেকে চলে গেলো!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here