মন ময়ূরী পর্ব -০৮

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_আক্তার

৮.

রিডিংটেবিলের সম্মুখে চেয়ারে বসে আছে খেয়া৷ সামনে একটি বই খোলা থাকলেও সেই বইয়ের দিকে নজর নেই খেয়ার। নজর বাম হাতের অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করা আংটির দিকে।

নীল আর সাদা পাথরের সমন্বয়ে গঠিত খেয়ার আঙুলে পরিহিত হিরার আংটি।একটি নীল পাথরকে ঘিরে আছে তিনটি সাদা ত্রিভুজকার পাথর। খেয়ার কেন যেন এই আংটির দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

হিরার আংটি বলে নয় কারণ তার বাবা তাকে হিরা, সোনা, রুপা সবকিছু দিয়েছে। কিন্তু, নায়ক সাহেবের দেয়া এই আংটিটায় নিশ্চয়ই কিছু আছে নয়তো খেয়ার চোখে এই আংটিকে দেখে মনে হচ্ছে, সে অনেক রিসার্চ করার পর প্রাচীনকালের এই দূর্লভ আংটি পেয়েছে। আর তাই এই আংটির দিকে ঘন্টাখানিক তাকিয়ে থাকার পরও ক্লান্তি আসছে না চোখে।

পরক্ষণেই,খেয়া নিজেকে ধমক দিয়ে বলে,

-খেয়া,সে তোকে একটা আংটি দিয়েছে তাই বলে এভাবে সেই আংটির দিকে তাকিয়ে থাকবি!নায়ক ফায়েজ এমন কত শত গিফট নায়িকাদের বার্থডে তে দেয়। তুই দেখছি সেই নায়িকাদের মতো, নায়ক ফায়েজের দেয়া জিনিস দেখা হাবলার মতো তাকিয়ে আছিস।

ফায়েজ খেয়াকে তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে প্রায় ঘন্টাদুয়েক হবে।সেই কথোপকথনের পর খেয়ার সাথে আর কোনো কথা বলেনি ফায়েজ৷ খেয়া গাড়ি থেকে নামার পর একটিবার ফায়েজের দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু ফায়েজ খেয়াকে একটিবার বিদায় জানালো না এমনকি চোখ তুলেও তাকায়নি, চলে গিয়েছিল তার কালো গাড়ি নিয়ে।

খেয়ার ঘরের দরজায় কেউ নক করছে, তাতেই খেয়ার মুগ্ধতা ভঙ্গ হলো।বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। খেয়ার বাবা এসেছে তারমানে সবাই ক্লাব থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছে। খেয়া তার বাবাকে বলে,

-কিছু বলবে বাবা?

-না, এমনিতেই এলাম তোকে দেখতে। ফায়েজ তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমাকে কল করে জানিয়েছে, তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। ছেলেটাকে এইজন্যই আমার খুব ভালো লাগে। সে তার প্রত্যেকটি কাজে খুবই অনেস্ট। আমি আসি তবে কাল সকালে দেখা হচ্ছে, ঘুমিয়ে পড় গিয়ে।

খেয়া তার বাবার কথায় কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে৷ খেয়ার বাবা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও খেয়ার কাছে ফিরে এসে বললেন,

-খেয়া আমি খুবই দুঃখিত। আমার লাইফে কখনো আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেইনি কিন্তু আজ যখন আমার মেয়ের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমি কাউকে না জানিয়ে চরম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল তুই মাথা পেতে নিয়েছিস।

খেয়া তার বাবার হাত ধরে বললো,

-বাবা,আমি খুব ব্যক্তিগত কারণে নায়ক-নায়িকাদের পছন্দ করি না। হয়তো আমার ভাবনায় তারা খারাপ কিন্তু এমনও হতে পারে তারা খুবই ভালো। আর রইলো ফায়েজের কথা সে খুবই ধৈর্যশীল একজন মানুষ।

খেয়ার শেষের কথা শুনে অনেকটাই অবাক হলেন খেয়ার বাবা। তাই খেয়াকে জিজ্ঞেস করেন,

-তুই কিভাবে জেনেছিস ফায়েজ ধৈর্যশীল!

খেয়া তার বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে আমতাআমতা করে বলে,

-সেটা বলা যাবে না। সে যদি আমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তবে আমি তাকে আমার মাথায় করে রাখবো।

-আর যদি না হয়?

-দেখা যাক। বাবা, আপনি এখন ঘরে যান রাত অনেক হয়েছে। আমিও ঘুমাবো সকালে ভার্সিটিতে যেতে হবে।

-কিন্তু, আগামীকাল ফায়েজের পরিবার আসবে বিয়ের তারিখ ফিক্সড করতে। তুই থাকবি না ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?

-তাদের আমাকে বৌ হিসেবে দরকার, বিয়ের অনুষ্ঠানে পেলেই হলো। এত ঘটা করে তাদের সামনে বারবার যেতে পারবে না। এইসবের মাঝে আমি নেই আপনি সামলে নিবেন, আমি জানি।

খেয়া তার বাবাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা লাগিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়লো।কিছু একটা মনে পড়তেই,আবারও শোয়া থেকে উঠে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে রুমের লাইট অফ করে, খাটে এসে শুয়ে চোখ বুজে ফেললো।

পরদিন

সকালে ঘুম থেকে উঠে কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় খেয়া, রিকশা ডেকে তাতে চেপে রওনা হয় ভার্সিটির উদ্দেশ্য।
যদি তার মা আর দাদির চোখে পড়তো তবে আজ কোনোভাবেই খেয়া ভার্সিটিতে যেতে পারতো না। আর খেয়াও চায় না আজ কোনোভাবেই ফায়েজের চোখের সামনে যেতে।

খেয়া ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখে আজ কেউই আসেনি।মোবাইল বের করে রিমির কাছে কল করতেই রিমি জানায়, নিধি আর সে রওশানদের বাড়িতে আছে। খেয়ার যদি সময় থাকে তবে সেও যেন রওশানদের এখানে চলে আসে।

খেয়া কল কেটে সময় দেখে নিলো, সকাল নয়টা বাজে। কিছু না খেয়ে চলে এসেছে এখন পেটের ভিতর থেকে জানান দিচ্ছে, খেয়া তোর খাবারের প্রয়োজন।

খেয়া পরমূহর্তে ভাবলো, এখন যেহেতু রওশানদের বাসায় যাবে, সেখান থেকে নাহয় সকল বন্ধুরা মিলে কাছের কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নিবে। আগে রওশানদের বাসায় যাই এরপর বাকি সবকিছু।

কিছু দূর এগিয়ে এসে রিকশার অপেক্ষা করতে লাগলো।একটি রিকশাকে দেখে ডাক দিলো, এগিয়ে গিয়ে তাতে চড়ে বসলো খেয়া, উদ্দেশ্য রওশানের বাড়িতে।

খেয়া রওশানের রুমে চেয়ারে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।খেয়ার ডান কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমি আর নিধি রওশানের পাশে বসে আছে। রিমি আর নিধি তাদের বন্ধুদের সামলাতে ব্যস্ত।

খেয়া রওশানের বাসায় এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হবে। এখানে আসার পর খেয়ার খটকা লাগে কারণ রওশানের বাসায় ওর বাবা-মা, বোন কেউই নেই।দরজায় কলিং বেল বাজালে রিমি এসে দরজা খুলে দিলে খেয়া ভিতরে আসে। আর আসার পর দেখে এই অবস্থা। রিমিকে জিজ্ঞেস করলে, রিমি জানায় উনারা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। খেয়া আর কথা না বাড়িয়ে রিমির সাথে চলে গেলো রওশানের রুমে৷

রওশানের রুমের দরজা সামনে আসতেই খেয়া দেখলো, রওশান আর নিধি কি নিয়ে আলাপ করছে?নিধি রওশানকে মানাতে চাইছে কিন্তু রওশান মানতে চাইছে না।

খেয়াকে দেখতে পেয়ে নিধি আর রওশান তাদের কথা বন্ধ করে দিলো। রিমি গিয়ে বসলো নিধির পাশে আর খেয়া গিয়ে বসলো জানালার পাশে রাখা চেয়ারে।

-কি রে আজ তোরা কেউই ক্যাম্পাসে যাসনি কেন? নাকি ট্যুরের প্লান করছিস?

খেয়ার প্রশ্নে নিধি, রিমি বার রওশান কেউই উত্তর দেয় নি।

খেয়ার প্রশ্নে নিধি আর রিমি ইশারায় রওশানকে দেখালো। খেয়া রওশানের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রওশান মাথা নিচু করে বসে আছে,তাছাড়া,আজ এখানে আসার পর থেকে একটিবারের জন্য তার দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি।

-রওশান, তুই বলবি কিছু হয়েছে? দেখ সকালে আমি না খেয়ে ক্যাম্পাসে গিয়েছি। তোদের না পেয়ে রিমিকে কল দিয়ে জানতে পারি ওরা দুজন তোর বাসায়। তাই আমিও চলে এসেছি, কি হয়েছে আমাকে বল?

খেয়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলে। রওশান খেয়ার কথায় এবার চোখ তুলে তাকালো। খেয়া রওশানের চোখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। রওশানের দুচোখ লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে রওশান কেঁদেছে নয়তো চোখে উঠেছে।

-নিধি, রিমি তোরা একটু রুমের বাইরে যাবি?আমি খেয়ার সাথে একাকী কিছু কথা বলতে চাই।

রিমি, নিধি চলে গেলো আর খেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রওশানের দিকে। কারণ, তাদের চারবন্ধু যখনি একসাথে থাকে তারা কখনোই কারো কাছ থেকে কোনো কথা আড়াল করে না।যে যাই বলুক চারজন একত্রে থাকবে।

রওশান তার পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালাতেই, খেয়া কেশে উঠলো। কারণ, সিগারেটের গন্ধ খেয়ার পছন্দ নয়। খেয়া রওশানের আচরণে অবাক হচ্ছে কারণ রওশান জানে খেয়ার অপছন্দের বস্তুর মাঝে সিগারেট একটি।

-রওশান তুই কিছু বলবি না-কি আমি চলে যাবো?তাছাড়া, কি এমন কথা নিধি আর রিমির সামনে বলা যায় না!

-খেয়া, তুই কিভাবে পারলি আমার না হয়ে অন্যকারো হতে! তোকে আমি ভালোবাসি সেখানে ফায়েজের সাথে তোর এনগেজমেন্ট, বিয়ে! আমি এগুলো নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো না। প্লিজ, খেয়া তুই এই বিয়েটা ভেঙে দে!

রওশান এগিয়ে এসে খেয়ার পায়ের কাছে বসে খেয়ার হাত ধরে মিনতি করে কথাগুলো বলতে থাকে।

খেয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রওশানের দিকে। আজ হুট করে রওশান কেন এইসব কথা বলছে!আগে তো কখনোই এই কথা বলেনি।

খেয়া নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেই রওশানকে বলে,

-আজই কেন এই কথা বলছিস? কই আগে তো কখনও এই কথা বলিসনি!

-আমি জানতাম না যে তোর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হবে! আমি ভেবেছি আমাদের পড়াশোনা শেষ হলে তোকে আমার ভালোলাগার কথা জানাবো। কিন্তু,গতকাল রাতে তোর জন্মদিনের পার্টিতে আঙ্কেলের সিদ্ধান্ত শুনে আমার পুরো দুনিয়া কেঁপে উঠেছে, খেয়া। তুই প্লিজ এভাবে আমাকে মারিস না খেয়া। আমি মরে যাবো। তোর ওই লম্বাচুলে শুধু আমার হাতের স্পর্শ থাকবে আর কারো নয়। তুই শুনতে পারছিস খেয়া আমি কি বলছি?

রওশানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো খেয়া। রওশান ভেজাচোখে খেয়ার দিকে তাকালো।

খেয়া খুব জোরে রিমি আর নিধিকে ডাক দিলো। ওরা দুজনে চলে এলেই খেয়া রওশানকে বলে,

-আমি তোকে সবসময় বন্ধু ভেবেই ভালোবেসেছি। আমি যদি ঘুণাক্ষরেও তোর মনের খবর টের পেতাম, তবে আমি তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতাম না। আমি শুধুই আমার বাবা-মায়ের বাধ্যগত মেয়ে। উনাদের সিদ্ধান্ত মানে আমার সিদ্ধান্ত। আর বাকি রইলো ফায়েজের কথা, সে গতকালের পর থেকে আমার জীবনের সাথে জরিয়ে গেছে। তাকে চাইলেও আমি উপেক্ষা করতে পারবো না।

খেয়া তার কাঁধ থেকে রিমির হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো,ঘর ছেড়ে চলে যাবার আগে বলে,

-আমার বিয়েতে তুই আসবি না রওশান। আমার বাবা দাওয়াত দিলেও তুই আসবি বা। তুই যদি আসিস তবে আমি বিয়ে করতে পারবো না।

খেয়া রওশানদের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে চলে গেলো। এদিকে, কারো হৃদয় ভাঙা আর্তনাদে দেয়াল কেঁপে উঠছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here