মন ময়ূরী পর্ব -১৪

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

১৪.

রিসিপশন শেষ হবার পর খেয়া, ফায়েজ, ফাহিম আর আব্দুল জব্বার একই কারে রওনা হচ্ছে খেয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্য। অন্য দুই গাড়িতে সুমি,কৌশিক,রুম্পা, খেয়ার দাদি,খেয়ার বাবা এবং মা।

ফায়েজদের বাড়িতেই রিসিপশনের আয়োজন করা হয় ।খেয়া তার বাবা, মা আর দাদিকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। ফায়েজ এসে ওর শ্বশুর -শ্বাশুড়িকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে।

এরপর,ফায়েজের বাবা-মায়ের সঙ্গে খেয়ার বাবা মা হাসিমুখে বিভিন্ন আলাপচারিতা করতে থাকে।

ফটোসেশান, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি ফরম্যালিটি শেষ করে, নতুন বরকনে রওনা হয় কনের বাড়ির উদ্দেশ্য।

খাঁন বাড়িতে একে একে কারগুলো প্রবেশ করেছে।সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির বড়ো এবং ছোট সদস্যরা।

ফায়েজ আর খেয়াকে কার থেকে নামতে দিচ্ছে না সুমি, রুম্পাসহ আরোও অনেক কাজিনরা। ওদের একটাই কথা,বিয়ের দিন ওরা ওদের দুলাভাইয়ের অর্থ্যাৎ ফায়েজের জুতা চুরি করেনি তাই সেদিনের বদলে আজ তাদের মনোবাসনা পূরণ করা হোক।

সব কিছু শুনে ফায়েজের তেমন কোনো রিয়াকশন নেই,ওর চেহারা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে, ও এই বিষয়গুলো দারুন উপভোগ করছে।আর খেয়া সে তো বারবার রুম্পার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছে।

-তো ফায়েজ ভাই আপনি রেডি তো আমাদের মনোবাসনা পূরণ করতে?

-জি শালি সাহেবা,আমি রেডি।বলুন কি করতে হবে?

-বেশি কিছু না, জাস্ট আপনি এটা বলে দিন, কিভাবে আপনি এই ঠোঁটকাঁটাকে পছন্দ করছেন?

-ঠোঁটকাঁটা কে?
ফায়েজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুম্পাকে।

-কেন, আপনার বৌ!

রুম্পার কথা শুনে ফায়েজ খেয়ার দিকে তাকালো উত্তরের আশায়। ফায়েজের প্রশ্নোত্তর চাহনি দেখে খেয়া মাথা নিচু করে ফেললো।

-আপনার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। উনাকে কেন আমরা সবাই ঠোঁটকাঁটা বলি, পরে বলবো আপনাকে। আগে আপনি আপনার উত্তর দিন।

“আরে বাহ্ আমার বৌ দেখি সবার সাথে একই আচরণের জন্য বিখ্যাত!মনে মনে বললো ফায়েজ”।

-রুম্পা, প্রেম করো বা খুব পছন্দের কেউ আছে?ফায়েজ প্রশ্ন করলো রুম্পাকে।

-হু, প্রেম করি তো। কেন?

-তুমি তোমার প্রেমিক কি দেখে পছন্দ করেছো এটা কনফার্ম হয়ে বলতে পারবে?

-কি ভাবে বলবো, দুলাভাই? ওর যা অভ্যাস বা বদঅভ্যাস বলেন আমার সবই পছন্দ।

-এই যে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলে।আমিও জানি না আমি খেয়ার কি দেখে পছন্দ করেছি! ওর সম্পর্কে নিত্যনতুন যা জেনেছি বা বুঝতে পারছি আমার সবই পছন্দ বা ভালো লাগে বলতে পারো। তবে, একটা জিনিস আমি কঠোরভাবে বলতে পারি তা হলো,আমি খেয়াকে ওর ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য পছন্দ করেছি।কারণ, ও ভেতরেও যা বাইরেও তা।

ফায়েজের উত্তর শুনে সিটি বাজালো কৌশিক, সাথে পুরো কাজিনের পাল হাতে তালি দিয়ে বলে,

-আরে বাহ, খেয়া আমাদের দুলাভাই তো সেই মাইন্ডের! তোর ঠোঁটকাঁটা স্বভাব উনি পছন্দ করে।
বাহ্, দুলাভাই আপনার তুলনা হয় না! আজকের পর থেকে আমরা আপনার আরও বেশি ফ্যান হয়ে গেলাম। এতদিন আপনি আমাদের কাছে ছিলেন শুধুই সিনেমার নায়ক আর আজ থেকে আমাদের খেয়ার নায়ক।মানে আমাদের খাঁন পরিবারের সকল কাজিনদের কাছে ঠোঁটকাঁটার নায়ক সাহেব।

খেয়া নিজের কাজিনদের কাছ থেকে ফায়েজের এত প্রশংসাবাক্য শুনে সহ্য করতে না পেরে কার থেকে নেমে দ্রুতপায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।

খেয়া চলে যেতেই সকলে আরও একদফা হেঁসে উঠলো।ফায়েজ এতক্ষণে বুঝতে পারছে যে আজ খেয়া তার প্রতি আরও বেশি ক্ষেপে থাকবে।

সকলের সাথে ফায়েজ খাঁন বাড়িতে প্রবেশ করলো।

বাড়িতে ঢুকতেই শুরু হলো জামাই আদর নামক অত্যাচার। ফায়েজ হাসিমুখে সকল জামাই আদর হজম করছে আর ভাবছে বাংলাদেশে যদি অতিরিক্ত জামাই আদরের ফলে যে জামাইগুলো বেশি অত্যাচারিত হয়, তাদের যদি সরকারের কাছে বিচার চাওয়ার সুযোগ থাকতো তবে কতই-না ভালো হতো।

একের পর এক খাবার ফায়েজের পাতে তুলে দিচ্ছে খেয়ার মা আর খালা।

এমন সময় খেয়া এসে ফায়েজের পাশে চেয়ারে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ ওর মা আর খালার কান্ড দেখে বলে,

-মা, তোমাদের মেয়ের জামাই নায়ক বুঝতে পারছো। তাকে এভাবে খাওয়ালে দেখবে ইয়া মোটা হয়ে ভিলেনের খাতায় নাম লেখাবে। কেউ তোমাকে ওমুক নায়কের শ্বাশুড়ি না বলে ওমুক ভিলেনের শ্বাশুড়ি বললে নিশ্চয়ই খুশি হবে, তাই না?

-কি উল্টা পাল্টা কথা বলিস খেয়া? জামাই মানুষ প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছে তাকে কি খালি মুখে রাখা যায়!

খেয়ার খালা খেয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে দইয়ের বাটি এগিয়ে দিলো ফায়েজের দিকে। ফায়েজ মুখ ছোট করে খেয়ার দিকে তাকাতেই খেয়া ফায়েজের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,

-আপনার দই খাওয়ার দরকার নেই। আপনি আমার রুমে চলে যান আমি পরে দই নিয়ে আসবো।

ফায়েজ বোধহয় এই কথাটির অপেক্ষায় ছিল। একঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এরপর, বেসিন থেকে হাত ধুয়ে চলে গেলো খেয়ার ঘরে।

এদিকে,

ফায়েজ চলে যাবার পর খেয়ার মা কিছুক্ষণ খেয়ার সাথে রাগারাগি করে কিচেনে চলে গেলো এমনসময় খেয়ার দাদি এসে খেয়ার মাথায় হাত রেখে বলেন,

-কেমন আছিস, দাদীবু?

-আমি ভালো আছি, দাদি। তুমি কেমন আছো?

-আমি সবসময় ভালো থাকি। তা নায়ক সাহেব কেমন মানুষ?

-দাদী একদিনেই কি মানুষ চেনা যায়!কতবছর এক ছাঁদের নিচে থেকেও মানুষকে চেনা যায় না. সেখানে উনার সাথে গত একরাত কাটিয়ে কি বা বুঝবো?

-তা ঠিক৷ থাক সেসব কথা বাদ। তা কি ভেবেছিস? হানিমুনে কোথায় যাবি?

এমনসময় কাশির শব্দ শোনা গেলো। খেয়ার দাদি আর খেয়া পিছনে ঘুরে দেখল ফায়েজ এসেছে। খেয়া স্বাভাবিক কন্ঠে ফায়েজকে জিজ্ঞেস করে,

-কিছু লাগবে?

-আসলে, মোবাইল রেখে গিয়েছি।

খেয়া ডাইনিং টেবিলের উপর তাকিয়ে দেখো সত্যিই ফায়েজের মোবাইল রেখে গেছে।খেয়া মোবাইল হাতে নিতে যাবে এমনসময় খেয়ার দাদি মোবাইল হাতে নিয়ে ফায়েজকে বলে,

-ফায়েজ, ড্রইরুমে চলো। খেয়া তুইও আয়।

খেয়া আর ফায়েজ একে অপরের দিকে তাকিয়ে খেয়ার দাদির পিছু পিছু ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো।

-তা হানিমুনে কোথায় যাবে, কিছু ঠিক করেছো?
ফায়েজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন খেয়ার দাদী।

-দাদি,তুমিও কি সব প্রশ্ন করছো?উনি যাবেন হানিমুনে!দেখা যাবে নায়ক সাহেব হানিমুনে যাবেন উনার এসিস্ট্যান্ট আব্দুল জব্বারকে নিয়ে, সাথে উনার দুজন দেহরক্ষী তো আছেই । দু’জন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এসিস্ট্যান্ট, আর দেহরক্ষী থাকলে হানিমুন হবে না দাদি হবে চোর-পুলিশ খেলা।দেখা যাবে আমি হোটেল রুমে ঢোকার আগে উনার দেহরক্ষীরা বলবে,ম্যাম আপনাকে চেক করতে হবে নয়তো আপনি আমাদের স্যারের রুমে বোম নিয়ে ঢুকে পড়বেন। এত সিকিউরিটি নিয়ে কোথাও না যেয়ে তারচেয়ে, বরং কাছে কোথাও দুই পরিবার গিয়ে ঘুরে আসবো এটাই ভালো হবে।

খেয়ার কথা শুনে ফায়েজ আর কথাই বলেনি। খেয়ার দাদি হেঁসে বললেন,

-খেয়া তুই যে এতদূর পর্যন্ত ভেবেছিস আমি ভাবতেই পারছি না। ফায়েজ তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলো। আমি চলি ইদানীং খেয়া বড্ড কথা বলে,উনার সাথে কথায় পেরে উঠি না।

খেয়ার দাদি চলে যেতেই ফায়েজ নিচু কন্ঠে খেয়াকে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় কি বলতে হয়, আপনি জানেন না খেয়া?দাদির সামনে আপনি… মানে কি যে বলব?তাছাড়া, আপনি তো আমার সাথে সত্যি সত্যি হানিমুনে যাবেন না। তাহলে, আমার বডিগার্ড কি করবে না করবে, আপনি এতদূর ভেবে ফেলেছেন! তারমানে,সামথিং ইজ ফিশি।

-কিসের ফিশি! আমি এমনি বলেছি। আপনি এমনিতেই বডিগার্ড আর এসিস্ট্যান্ট ছাড়া চলতে পারেন না, তার আবার হানিমুন কীসের?স

ফায়েজকে রাগ দেখিয়ে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলো খেয়া,পিছু ফিরে ফায়েজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আপনি কতদিন থাকবেন এখানে?কথা তো ছিল আপনার সাথে আমি দু’দিন পর্যন্ত থাকবো।এরপর,আপনি আর আমি আলাদা।

ফায়েজ খেয়ার প্রশ্ন শুনে মলিন হেঁসে বলে,

-আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম, আপনি ঠিক কখন এই প্রশ্নটা করবেন?চিন্তা করবেন না আমি আগামীকাল সকালে চলে যাবো আপনাদের বাড়ি থেকে। আপনার কথার মান রাখতে গেলে আপনার বাবার কথার মান রাখতে পারবো না আমি। চিন্তা করবেন না গতকাল রাত ঠিক যেভাবে কেটেছে আজ রাত ঠিক সেভাবে কেটে যাবে।

খেয়া ফায়েজের কথা শেষ হলে ড্রইংরুম ত্যাগ করে।

ফায়েজ একা বসে থাকে আর ভাবতে থাকে, কখন খেয়া তাদের এই সম্পর্ক মন থেকে সাদরে গ্রহণ করবে? না-কি ফায়েজের এই অপেক্ষা শুধু মনে আড়ালে রয়ে যাবে, খেয়া কখনোই ফিরতে চাইবে না তার কাছে!

-হ্যালো,জি শামসুল ভাই আমি আগামীকাল দুপুরে রওনা হবো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here