মন ময়ূরী পর্ব -১৭

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

১৭.

রাতের আকাশে চাঁদের উপস্থিতি পৃথিবীর বুকে নিজের আলোর বিকিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয়ে পরিবেশে যেন আলাদা এক সৌন্দর্য চোখের নজর কাড়ছে। অদূরে থেকে রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।

মধ্যেরাত আমার সবচেয়ে প্রিয় একটি সময়। কেন যেন খুব ছোটবেলা থেকে এই সময়টা আমার খুব প্রিয়!দাদু যখন বেঁচেছিলেন তখন প্রায় রাতের এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। আমি দাদু-দাদির সাথে ঘুমাতাম বলে, দাদু ঘুম থেকে এই সময় জেগে উঠলে টের পেতাম। দাদু যখন নামাজ আদায় করতেন তখন আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশকে উপভোগ করতাম।আমাকে ভয় দেখাবার জন্য প্রায়ই দাদু বলতেন, রাতে তেনারা বের হয় যদি আমাকে কোনোদিন উনারা দেখতে পায় তবে উনাদের রাজ্য নিয়ে যাবে আর কখনো আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারবো না। দাদুর কথাগুলো শুনতে শুনতে একপ্রকার মনে কৌতূহল জেগে গেলো, সেই থেকে আমার যখনি রাতে ঘুম না আসে আমি তেনাদের অপেক্ষা করি। যদি উনাদের সাক্ষাৎ পাই কিন্তু আজও পর্যন্ত সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। দাদু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন আজ দশবছর হতে চললো কিন্তু মাঝে মাঝে এই সময়টাতে মনে হয় দাদু আমার পাশে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশকে উপভোগ করেন। আমি বড়ো হয়েছি তাই হয়তো আগের মতো দাদু আর তেনাদের কথা বলে আমাকে ভয় দেখায় না।

দরজার ঠকঠক শব্দ শিউরে উঠলাম আমি। কে এলো এতরাতে আমার ঘরে? দ্বিতীয়বার স্ব-শব্দে আবারও দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।আমার পুরো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ছি আর এগিয়ে যাচ্ছি আমার ঘরের দরজার দিকে।

দরজার কাছে যেতেই হুট করে পুরো বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো।এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে,
“লা ইলাহা ইল্লাহ আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জোয়ালামিন” বলে দরজা খুলে দিতেই আমার মায়ের চিৎকার শুনতে পেলাম।

বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ফিরে এসেছে ততক্ষণে। আমি একচোখে খুলে তাকিয়ে দেখি, আমার মা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে। বাবা দৌঁড়ে এসে মা’কে একপাশে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। দাদি অপরপাশে দিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন,

-কি রে তুই আর বৌ মা এই ভাবে চিৎকার করছিস কেন?

আমি কি বলবো ভেবে যখন দাঁত দিয়ে নখ কাটছি ঠিক তখন মা স্বাভাবিক কন্ঠে বলছে,

-হুট করে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়াতে খেয়া ভয় পেয়ে চিৎকার করে আর ওর চিৎকার শুনে আমি মনে করেছি বাড়িতে চোর-ডাকাত এসে পড়েছে হয়তো! বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি হয়তো উনারা বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য আমিও চিৎকার।

-কিন্তু, মা তুমি এত রাতে আমার ঘরে কেন এসেছো?

-কারণ, তো অবশ্যই আছে।আপাতত,বাড়িতে তুমি আর মা থাকো। আমি আর খেয়া যাচ্ছি। আমি সকালে ফিরে আসবো।

প্রথম কথাটা খেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেও দ্বিতীয় কথাটি খেয়ার মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো খেয়ার বাবা।

-কিন্তু, বাবা এত রাতে আমরা যাবো কোথায়?

-চৌধুরী বাড়িতে যাবো।যাও তৈরি হয়ে এসো।

-আমি এইভাবে ঠিক আছি। ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে বাবা?আর আজ তো ফায়েজের দেশে আসার কথা ছিল!

-সেখানে গেলে দেখতে পাবে কি হয়েছে? এখন এসো আমার সঙ্গে।

কথাটি সম্পূর্ন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন খেয়ার বাবা। খেয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে ওর মা এবং দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো।

বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে এলেই খেয়া দেখতে পেলো ওর বাবা আর ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে৷ খেয়া চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। এরপর, খেয়ার বাবা আর ড্রাইভার গাড়িতে উঠেই রওনা হলো চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য।

রাতে ঢাকার পথে খুব একটা জ্যাম না থাকায় দ্রুত পৌঁছে যায় চৌধুরী বাড়িতে।
গেটের কাছে আসতেই বিনাপ্রশ্নে গেট খুলে দেয় দারোয়ান। যেন তিনি জানতেন এতরাতে উনারা আসবেন।

গাড়ি থেকে ধীরপায়ে নেমে পড়লো খেয়া অপরপাশ দিয়ে খেয়ার বাবা। খেয়ার বাবা এসে খেয়ার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির মুল ফটকের সামনে। দরজা খোলা থাকায় খুব সহজে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছে খেয়া এবং খেয়ার বাবা।

ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বামপাশের দ্বিতীয় ঘরটিতে প্রবেশ করলেন দু’জন। প্রবেশ করতেই চারজন মানুষের চিন্তিত মুখ দেখতে পেলো খেয়া। ফায়েজের বাবা-মা, ফাহিম এবং ফায়েজের এসিস্ট্যান্টকে।

খেয়াকে দেখতে পেয়ে ফাহিম একপাশে সরে দাঁড়ালো। ফাহিম একপাশে সরে আসতেই খেয়া দেখলো, খাটে ফায়েজ শুয়ে আছে আর ওকে কেউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হয়তো তিনি ডক্টর!

খেয়ার অনুমান সঠিক ইনি ডক্টর। ফায়েজকে দেখা শেষ হলে তিনি জানান,

-বিপি অনেক হাই সেই সাথে তীব্র জ্বরের কারণে ফায়েজ অনেকটাই অসুস্থ। ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছি আশা করছি আগামীকাল সকালের মধ্যে ওর প্রেশার ঠিক হয়ে যাবে।আর জ্বরের জন্য আপাতত কোনো ঔষধ আমি সাজেস্ট করছি না। কারণ, আগে ওর প্রেশার স্বাভাবিক আনা জরুরি তাছাড়া, আমি সকাল সাতটায় আসবো তখন জ্বরের ঔষধ দিয়ে যাবো। আপনারা এই সময়টাতে ওর গা মুছিয়ে রাখবেন তাহলে ওর শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমবে। আসছি আমি যদি কোনো সমস্যা দেখতে পান তবে আমাকে তৎক্ষনাৎ কল করবেন।

-জি, ডক্টর। অনেক অনেক ধন্যবাদ এত রাতে এসে আমার ছেলের চিকিৎসা করার জন্য।

-কি যে বলেন মি.মাহমুদ! ফায়েজ আমার ছেলের সমবয়সী, তাছাড়া, ওকে আমার পার্সোনালি খুব পছন্দ করি। ও এত অসুস্থ শুনে আমি না এসে থাকি কি করে? ফায়েজের খেয়াল রাখবেন আর পুরো শরীর মুছে দিবেন একটু পর পর।

-জি, খেয়াল রাখবো। ফাহিম যাও তোমার আঙ্কেলকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো।

-জি বাবা, আসুন আঙ্কেল।

ফাহিম আর ডক্টর চলে গেলেন। মাহমুদ চৌধুরী এগিয়ে এসে খেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

-এত রাতে তুমি এসেছো কেন?সকালে এলেও পারতে।

-ফায়েজের তো আজ ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসার কথা ছিল। হুট করে ওর এমন অবস্থা হলো কি করে?

-ফায়েজ সেখানে যাবার পর জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রথমে আমরা সকলেই ভেবেছি দুএকদিন ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু গতকাল ওর অবস্থা অবনতি হলে ফায়েজের এসিস্ট্যান্ট আব্দুল জব্বার ওকে নিয়ে আজ দুপুরের ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসে। আমার ছেলেটার কি হলো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। জ্বর না হয় বুঝলাম কিন্তু এত বিপি হাই!

মাহমুদ চৌধুরী কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। খেয়ার বাবা উনার কাঁধে হাত রেখে আস্বস্ত করতে লাগলেন।

খেয়া কোনো কথা না বলে ফায়েজের পায়ের কাছে বসে পড়লো। ফায়েজের মা ছেলের শিউরের কাছে বসে শরীর মুছিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদছেন। খেয়া ফায়েজের মায়ের হাতের উপর হাত রাখতেই, উনি চমকে উঠলেন।চোখ ঘুরে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন খেয়া উনার হাতের উপর হাত রেখেছে।

-চাচি, আপনি কান্না করবেন না প্লিজ। ফায়েজ নিশ্চয়ই আপনার কান্না পছন্দ করে না।

-হটাৎ করে আমার ছেলেটা এত অসুস্থ হলো কি করে আমি এটাই বুঝতে পারছি না!খেয়া আমার ফায়েজ সুস্থ হবে তো?

-হুম, ফায়েজ সুস্থ হয়ে যাবে। চাচি, আপনি ঘরে চলে যান আমি ফায়েজের গা মুছিয়ে দিবো।

-না, তুমি পারবে না। আমি থাকবো আমার ছেলের কাছে।

-রেহনুমা, তুমিও ফায়েজের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়বে। খেয়া ফায়েজের খেয়াল রাখতে পারবে।

ফায়েজের বাবার অনুরোধ ফায়েজের মা ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন। এই ঘরটায় এখন খেয়ার বাবা, খেয়া আর মাহমুদ চৌধুরী আছে। খেয়া ওর শ্বশুর এবং বাবাকে অনুরোধ করলো শুয়ে পরতে কারণ রাত প্রায় শেষভাগে।

-কিন্তু, তুমি একা পারবে ফায়েজের খেয়াল রাখতে?

-আমি পারবো। আর যদি না পারি তবে আপনাদের ডাক দিব আমি। এখন আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন।

খেয়ার কথায় উনারা ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন।

খেয়া উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ফায়েজের পাশে বসে পড়লো। ফায়েজের গা থেকে কাঁথা সরিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে খেয়া গা মুছিয়ে দিচ্ছে।

ফায়েজের বুক মুছে দেয়ার সময় খেয়ার হাত কাঁপতে লাগলো।এসবের তোয়াক্কা না করে খেয়া মনের উপর জোর খাটিয়ে মুছে দিতে লাগলো।

একসময় ফায়েজের শরীরের তাপমাত্রা অনেকটা কমে এলো।খেয়া উঠে গিয়ে ফ্যান অন করে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফায়েজের পাশে বসে পড়লো।

-এতটা অসুস্থতা নিয়ে আমার কাছে কল করে ঠিকই হাসিমুখে কথা বলছিলেন। একটিবার বলতেন আপনি জ্বরে কাতর হয়ে যাচ্ছেন। আপনি কি মুখ ফুটে বলতে পারেন না? আপনার কি হয়েছে?আপনার জীবনে কি প্রয়োজন?এই পর্যন্ত আপনাকে আমি যত কথা বলেছি আপনি চুপ করে সায় জানিয়ে দিয়েছেন। কেন, আপনার নিজের ইচ্ছে বলতে কিছু নেই? কেন?এমন করছেন আপনি? নিজেকে কষ্ট দিয়ে আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন,নায়ক সাহেব?

ফায়েজের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট সুরে কথাগুলো বলছে খেয়া।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here