মাতোয়ারা পর্ব ৩+৪

#মাতোয়ারা
#পর্ব_৩

আমি কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম তখন। এসব আমি কিভাবে করলাম? মারামারি করতে করতে আমি হয়তো গুন্ডাই বনে গিয়েছিলাম। নইলে রিয়াকে তো আমি আদর করতেই গিয়েছিলাম । রিয়ার এত লাগবে কেন?
সেই আদর আমার জীবনে সবথেকে বড় অনাদরের নাম হলো। আম্মা দিশেহারা হয়ে রিয়াদের বাসায় গেলেন, রিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে। আর আমি তখন ব্যাখ্যা করার মত সময়ে ছিলাম না। কিছুটা ঘোরের মাঝে অথবা কিছুটা অচেতনের মাঝে আটকে রয়ে ছিলাম। আমার স্বাভাবিক জীবন ঘুচে গেল। সব সময় বিমর্ষ আর ঘরকুনো। একসময় আম্মা বাধ্য হয়ে বললেন,
—দেশের বাইরে চলে যা বাবু, কিছু একটা করার চেষ্টা কর। কাজে থাকলে ঘোর কাটবে তোর ।
—দেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি। একটি মেয়ের জন্য পুরো দেশ আমি কিছুতেই ছাড়তে পারি না, মা ।
আম্মা খুব করে বুঝালেন।
—নিজের ভালোবাসা যদি কারো উপর বোঝা হয়, তবে সেটা ভালোবাসা থাকে নারে বাবু, সেটা তখন জবরদস্তি হয়ে যায়!
রিয়াকে ভালোবাসা শুধু রিয়ার জন্যই বোঝা নয়, তখন আমার ঘাড়েও অসহনীয় হয়ে গেলো। আমি সব ভুলে থাকার জন্য রাজনীতিতে ডুবে গেলাম পুরোদমে।
আর রিয়া? সে কি খোঁজ নিতো আমার? নিতো!
বাট আই ডিড নট কেয়ার। মাঝে মাঝে আমার চেলারা এসে কথা প্রসঙ্গে রিয়ার এটা ওটা খবর দিতো, আমি শুনতে চাইতাম না ।
ইউনিভার্সিটিতে রিয়ার ব্যাপারটা, আমার খুব কাছের কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে বুঝতে দিলাম না । এমনিতেই ওর মান রাখতে পারিনি আমি। আবার ও আমার পছন্দের জানলে পুরো ইউনিভার্সিটি এটায় মাতবে। হিড়িক পড়ে যাবে গসিপের।
আমার সাঙ্গ পাঙ্গরা বলতো,
—আপনার জন্য তো রিয়াকে হাসিল করা ওয়ান টু’র ব্যাপার; তাও বস আপনি স্টপ কেন?
আমি জবাব দিতাম না ।
আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতাম। কারণ শ্রেয়ান চৌধুরী এতটাও অথর্ব নয় যে, মেয়ে ধরে এনে প্রেম পেতে হবে।
ক্লাস, করিডোর সব জায়গায় আমার চোখে সানগ্লাস, সবসময় রাজনীতিতে ব্যস্ত। সবসময় রিয়ার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা। এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা ।
রিয়ার কাছে অপরাধী আমি, ওকে যে আমি নিজের মুখ দেখানোর যোগ্যতা হারিয়েছি, আর সাথে হারিয়েছি ওর মুখ দেখার অধিকারও।
শুধু টার্মপেপারে রেজাল্টবোর্ডে আমি রিয়ার নামটা দেখতাম, একদম টপ লিস্টে। আনন্দে মন ভরে যেতো আমার। খুশিতে চোখ ভিজে আসতো। পাক্কা একবছর আমার দৃষ্টি রিয়াবিহীন কাটালো। আর ততদিনে আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মাথা বনে গেছি। কোথাও গেলে চারজন আগে আমার চেয়ার রেডী করে । মারামারি করে এরেস্টও হয়েছি একবার । জেলে আমি খুব অপেক্ষা করেছি, রিয়া হয়তো আসবে দেখতে আমায়।
আমার খুব অবাক লাগে, যেই আমি কথায় কথায় সিনিয়রদেরও বিচার করি, চড় থাপ্পড় দিয়ে ঝামেলা মেটাই সে কিনা রিয়ার হাজার বকা লিখা খাতা বুকে করে রাত কাটাই। আমার পাঞ্জাবির পকেটে, আমার সিগারেটের প্যাকেটে, আমার ওয়ালেটে, আমার বালিশের নিচে, আর সকালে ঘুম ভেঙে যাতে আমি মুখ দেখি সেই হ্যান্ড মিররে আর আমার বুকের ভেতরটায়, মনের সব জায়গায় রিয়ার লিখা ওই গুন্ডা কথাটা বয়ে বেড়াতাম আমি। আমার মনে হতো, রিয়া আঙুল তুলে বলছে, “এই গুন্ডা” আর তাতেই কেঁপে উঠছি আমি।
একশটা মেয়ে আমায় ফোন করে, পিছু ঘুরে। এমন তো কত হয়েছে অনেক মেয়ে হাত কেটেছে আমার জন্য। এসে জামার চেইন খুলে সামনে দাঁড়িয়েছে । আর আমার সর্বস্ব আটকে ছিলো রিয়াতে। সবটাই রিয়া।

সেই রিয়াময় এবার আমার জীবনে, ভূমিকম্প এলো। ভূমিকম্পের কথা বলবার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলে নিই।
ইউনিভার্সিটিতে ছেলেরা হুট করেই নতুন একজনের যত্নপাতি নেয়া শুরু করলো খুব। সেই নতুন মানুষ এবার নতুন ভর্তি হয়েছে। ভর্তি হয়েই সবার চোখের মণি। যত্নের কারণ সে শ্রেয়ান চৌধুরীর কিছু একটা হয়! সিনিয়র ভাইরা তাঁকে স্নেহ করে, ক্লাসমেটরা সমীহ করে, সব ফাংশনে সে দাওয়াত পাচ্ছে…. রাস্তায় দাঁড়ালেই যেকোনো ভাইয়া তাঁর রিকশা ঠিক করে দিচ্ছে…. মহা ব্যাপার স্যাপার!
আমার বাহিনী সেই খবর উদ্ধার করলো। সেই আমার জীবনের ভূমিকম্প।
আমার সবচেয়ে বিশ্বস্তজন এসে জানালো,
—বস, নাম ইরিন জান্নাত। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট। চিজটা নিজেই নাকি সবাইকে বলেছে, সে আপনার…
—সে আমার কি?
আমার বিশ্বস্তজন মাথা নিচু করে ফেললো ।
—সে কি বলেছে? সে আমার গার্লফ্রেন্ড হয়?
—জি না, বস….
—বলেছে, হবু বউ। ফ্যামিলি থেকে নাকি আপনাদের বিয়ে ঠিকঠাক করা হয়েছে। হাতে আংটি দেখিয়ে বলেছে এনগেজমেন্ট শেষ… শুধু কবুল বাকি ।
আমার মাথায় বাজ, আকাশ এবং পৃথিবী একসাথে ভেঙে পড়লো।

চলবে……..

#মাতোয়ারা_
#পর্ব_৪
ইউনিভার্সিটিতে নতুন এসেই পলিটিক্স শুরু করে দিয়েছে, বাহ্। এ তো দেখি আমার চেয়েও বড় পলিটিশিয়ান।
—বস্! তুলে নিয়ে আসি মেয়েটাকে? আপনার নাম বেচে সে নিজের আরাম কিনছে কিন্তু ।
—কোনো দরকার নেই ।
—আচ্ছা ঠিক আছে, ভদ্রভাবে ডেকে আনি বস। অন্তত ফেইসটা চিনে রাখলেন।হয়তো কখনো সামনে পড়লে….
আমি দৃঢ় স্বরে বললাম,
—আমার কারোর ফেইস চিনার কোনো দরকার নেই।
—বস, হেব্বি গান গায়। ধরে এনে বলি, একটা গান শোনাতে, আপনার নাম করে আমরা শুনলাম।
—কেন এমনিতে গান গায় না?
—গায়, তবে ইউনিভার্সিটিতে মাত্র দু’বার গেয়েছে.. মাথা নষ্ট কণ্ঠ বস..
আমি রেগে গিয়ে বললাম,
—ফারদার এই মেয়ের টপিক যাতে আমার সামনে উচ্চারিত না হয়।

এই ইরিন নামক ভূমিকম্পের ব্যাপারটা আমি একদম পাত্তা দিলাম না। পাত্তা দিতে গেলেই মেয়েটা হয়তো প্রমোশন পেয়ে যাবে। জগতে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা মানুষকে হাসায় অথবা কাঁদায় তা হলো প্রমোশন। আর এদিকে ইরিন জান্নাত নামক ভূমিকম্প আমার নাম নিয়ে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে বেশ পরিচিতি পেয়ে গেল। অবস্থা এমন যে, কখনো কখনো আমি খুবই বিব্রত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগলাম এবং তা এড়িয়ে যেতে আমার ঘাম ঝরতো। পুরো ইউনিভার্সিটিতে ব্যাপারটা মসলাদার খবর হিসেবে আলোচিত হতে থাকলো। আমি ও হালকাভাবেই নিলাম, একদম জুনিয়র মেয়ে প্রথম প্রথম হয়তো সবাইকে একটু ঢপ খাওয়াচ্ছে, খাওয়াক। আমার কাছে এসে আমাকে তো আর জ্বালাচ্ছে না ।
এর মাঝে হুট করেই আমার অফিসে, (অফিস বলতে, ক্যান্টিনে একটা জায়গা ছোট্টো পরিসরে আমার মিটিং এ বসার জন্য নির্ধারিত ছিলো, আর এমনিতে যেকোনো ডিপার্টমেন্টের যেকোনো ক্লাসরুম আমি আমার মিটিং এর জন্য দখলে নিতে পারতাম) যে কথা বলছিলাম, রিয়া হুট করে আমার অফিসে চলে এলো ।
আমি কিছু একটা ঝামেলা নিয়ে কথা বলছি।
রিয়া এসেই বললো,
—তোমার জাতীয় সংসদ অধিবেশন কি একটু পাঁচ মিনিটের জন্য বন্ধ করা যায়?
আমি কথা বলতাম একটু। আমি শক্ত গলায় বললাম,
—বলে ফেলো, এখানে সবাই আমার নিজের ভাই।
—এ লিটল বিট পারসোনাল ফর ইউ। কথাটা এদের সামনে বললে লজ্জা পাবে তুমি…
আমি মনে মনে হাসলাম, শ্রেয়ান চৌধুরী লজ্জা পাবার মত কোনো কাজই করে না কখনো। সে তোমার কাছে একবার ভুল হয়ে গেছিলো রিয়া, সে জন্য আজও অনুতপ্ত আমি। কিন্তু মুখে বললাম,
—অনেক দিন ধরে লজ্জিত হচ্ছি না, আজ তুমি কথা বলে একটু লজ্জা দাও তো….
রিয়া ভীষণ রেগে গেলো তাতে।
—তুমি যদি পাঁচ মিনিটের মাঝে এদের যেতে না বলো, আমি কিন্তু….
পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে আমি ইশারায় সবাইকে বাইরে যেতে বললাম।
রিয়া আমার কাছে এগিয়ে এসে বসলো, কিছুটা কাছাকাছি আর কিছুটা গাঢ় হয়ে। সেই বসাটা কেনো জানি আমার কাছে খুব অশোভন লাগলো ।
রিয়া এবার ওড়নাটা গলায় তুলে নিলো। এটা কি সে বেখেয়ালি হয়ে করলো না খেয়ালি হয়ে… আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম ।
—তোমার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে শ্রেয়ান, আর তুমি কিনা তাঁকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। সারা ইউনিভার্সিটিতে ছি ছি পড়ে গেছে, আমারই নিজের কাছেই কি নোংরা লাগছে ব্যাপারটা….. তুমি আমার পেছনে পাগলের মত ঘুরো, এটা নাহয় মানা যায়… আমি ইউনিভার্সিটি টপার, একটা লেভেল তো আছে। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে একটা নতুন মেয়ে মানা যায়?
আমি নড়েচড়ে বসলাম। রিয়া তাহলে নিজের ইগোর ফাউন্ডেশন তৈরিতে এসেছে ।
—জনতা ব্যাংকের পিয়নের মেয়ে। এডমিশন টেস্টে হয়তো কোয়ালিফাই করে গেছে… স্ট্যাটাস তো আর বদলে যায়নি। আমি জানি, হুট করে ছেলেদের মাথায় কমবয়সী মেয়েদের ঝোঁকে পেয়ে বসে কিন্তু সেটাকে পারমানেন্ট করার ঘোষণা দেবার কি দরকার আছে?
আমি এবারও কিছু বললাম না।
রিয়া কথা বলতেই থাকলো,
—নিজের স্ট্যাটাসটা তো একবার ভাববে। ফ্যামিলির একমাত্র ছেলে তুমি। বাবার রেখে যাওয়া বিশাল বিজনেসের একমাত্র ওনার। তুখোড় রাজনীতি করা ছেলে, আর ইউনিভার্সিটির সবাই কি বলছে?
এস এন টেক্সটাইলের ওনারের বউ কিনা একটা পিয়নের মেয়ে? জানি তোমার মেয়েদের দোষ আছে, যখন ঝোঁক আসে নিজেকে সামলাতে পারো না তুমি। আমার সাথে তো কি ধ্বস্তাধস্তিটাই না করতে চেয়েছিলে।
এটুকু বলে রিয়া মুচকি হাসলো ।
—-অবশ্য গায়ে জোর আছে তোমার ।(রিয়া চোখ টিপলো।)। হয়তো একটু শুয়েছো টুয়েছো.. তাই বলে সারাজীবনের জন্য স্ত্রী? জুনিয়র একটা মেয়ে; দুবার ধমক দিয়ে বলে দেবে, এই মেয়ে আমার কাছে কিন্তু ভিডিও ক্লিপ আছে। ব্যস মুখ বন্ধ হয় গেল। ইউনিভার্সিটি লাইফে তো কত মেয়ে, কত ছেলের সাথে শোয়। শোয়া এক জিনিস আর সংসার অন্য জিনিস। বুঝলে?
আমার অনেক বদ অভ্যাসের মাঝে সেরা বদঅভ্যেস হলো, হুট করে রেগে যাওয়া এবং সেটাই ঘটলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং ধমকে বললাম,
—রিয়া, তুমি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাবে.. যদি না যাও, আমি তোমাকে চড় দিয়ে বের করে দেবো।
রিয়াও উঠে দাঁড়ালো,
—দেখি চড় দাও, তোমার কত সাহস আমিও দেখতে চাই। আমার পেছনে পাগলা কুত্তার মত দৌঁড়াবে, আমাকে রিজার্ভে রেখে অন্য মেয়ে নিয়ে ফুর্তি… আমি বুঝি না ভেবেছো, আমি শুইনি বলে তোমার সাথে? তুমি তো বলোনি যে শুতে চাও…
আমার হঠাৎ করেই মাথা ঘুরতে লাগলো খুব। শরীর ঘামতে লাগলো… শরীর যেনো থেমে গিয়েছিল।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় হাত জোর করে বললাম,
—তুমি চলে যাও রিয়া। পায়ে ধরি তোমার, পায়ে ধরি । প্লিজ….
রিয়া গেলোনা। সে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
—শ্রেয়ান, তুমি বললে আমরা এক্ষুণি হোটেলে যেতে পারি। আই এম এনিটাইম ফর ইউ। আই’ল গিভ ইউ দ্য বেস্ট *****। তুমি প্লিজ পাগলামি ছেড়ে দাও। হেলথ রিপোর্ট না দেখে যেকোনো মেয়ের টেস্টে যাওয়া মানে তো বুঝোই, কখন কোন অসুখে ফেঁসে যাবে।
আমি শুধু ঝটকা মেরে রিয়াকে ঠেলে ফেলে দিয়ে কোনোমতে টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এসে আমার সিরিয়াসলি মনে হলো, ইরিন জান্নাতের সাথে একবার আমার দেখা করা দরকার। সত্যিই বড্ড দরকার…..
রিয়ার ভেতরের ডাস্টবিনটা শুধু তাঁর জন্যই আমি দেখতে পেলাম যে….

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

ডোন্ট কপি দিস।বাট ইউ কেন শেয়ার।
শেয়ারিং মিনস কেয়ারিং 😋😋

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here