মাতোয়ারা পর্ব ১+২

#মাতোয়ারা

#পর্বঃ-০১

ইউনিভার্সিটির গেটে আমি যখন গাড়ি থেকে নামি, আমি খুব করে টের পাই, মেয়েরা আমায় দেখলে ভয়ে সেধিয়ে থাকে। আবার জানি, তাদের বুকের ভেতরটা হাহাকারও করে। বলে উঠে, ইশ্! কি রাজপুত্ররে বাবা। পাঞ্জাবি পরে আমি যেদিন আমার বিভিন্ন মিটিংগুলোতে বক্তৃতা দিই, আমি জানি সিনিয়র জুনিয়র মেয়েরা সেদিন সারাক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কত মেয়ে এর মাঝে সাহস করে আমার কাছে আসেও, সর্বস্ব এক মুহূর্তে দিতে চায়, বলে ভালোবাসি। কেউ বা আমার ক্ষমতার লোভে, কেউ বা আমায় ভালোবেসে।
কিন্তু আমি কাউকে পাত্তা দিই না, প্রয়োজন নেইও আমার। অথচ সবাই আমার পকেটে থাকে। এটাই তো চার্ম। মাতিয়ে পলিটিক্স করি, ইচ্ছেমত পয়সা খরচ করি, খানিকটা মারামারিও করি, এর ওই সমস্যা, ওর ওই সমস্যা, সব দেখি; শুধু প্রেমটা করি না।
ইউনিভার্সিটিতে প্রেম? প্রশ্নই আসেনা। আমি নয় বরং আমাকে যে ভালোবাসবে সে হবে পুরো একটা রাজ্য জয় করে আসা রাণী। আমাকে কুর্নিশে বলবে, ভালোবাসি। ঘাড় উঁচু করে তাঁকাতে বললে সে কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত ছুঁয়ে বলবে, তাঁকাই কি করে? আপনি তো আমার রাজা! তখন দু-হাতে আমি তাঁর মুখ তুলে ধরে অভয় দেবো। সে তাও চোখ খুলবে না।
আমার এত অহংকারে ঘূর্ণিঝড় এলো। ঘূর্ণিঝড়ের নাম রিয়া। সারাবছর পলিটিক্স করে, পাঙ্ক করে, ক্লাস বাঙ্ক করে, হামকি ধামকি করে, পড়াশোনা ঠিকঠাক হয় না। সেমিস্টার ফাইনালের সময় টনক নড়লো। আমার বিশাল সাঙ্গপাঙ্গ বাহিনীকে বললাম,
—ক্লাসের সবথেকে বেস্ট নোটধারী থেকে নোট নিয়ে আসো। রেজাল্ট এবারে আমার সবথেকে ভালো হওয়া চাই। বাহিনী এসে খবর দিলো,
—বস, সে তো নোট দেয়না।
—নোট দেয়না মানে? আমার কথা বলিস নি?
—আপনার কথা বলায়ই তো দিলো না। বললো, বাউন্ডুলেদের আমি নোট দিই না।
—চিজটা কোনটা? গত সেমিস্টারে যেটা ফার্স্ট হয়েছিল সেটা না?
—জি বস!
—নোটধারীকে তুলে নিয়ে আয় যা। দেখি তাঁর ঘাড়ে কয়টা মাথা! এই শ্রেয়ান চৌধুরীকে নোট দেয়না?
যেই নোটধারীকে তুলে আনা হলো, সেই আমার জীবনের ঘুর্ণিঝড়! ভারী গাল, বড় বড় চোখ, উপরে টানানো মোটা ভ্রু, পাতলা ঠোঁটের দু-পাশেই গর্তমত, শ্যামলা রঙের জাদুর মেয়ে।
এসেই বললো,
—তুমি লোক পাঠিয়েছো, আমাকে ধরে আনতে?এটা তুমি ঠিক করোনি। একটা মেয়েকে ধরে আনতে তুমি চারটা ছেলে পাঠিয়ে দিলে?
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আমার বাহিনী তখন মারমুখো হয়ে রিয়াকে দেখছে।
—তোমার সাঙ্গপাঙ্গকে বিদায় করো, নোট বিষয়ে আমি তোমার সাথে একা কথা বলতে চাই।
আমি সবগুলোকে ধমকে বিদায় করলাম।
ঘুর্ণিঝড় আমার সামনে এসে বেঞ্চিতে বসলো।
—আমি নোট সাথে আনিনি এখন। বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে। তবে আমার একটা শর্ত আছে,
—কি শর্ত?
—নোটটা তুমি শুধু একা পড়বে, আর কাউকে দেবে না। আমার অনেক কষ্ট করে তৈরি করা নোট তো।
আমি তখন নিজের ঘোর সামলাতে ব্যস্ত।
মনে মনে বললাম,
আমার নোট চাই না মেয়ে। তুমি আরেকটু আমার সামনে বসে থাকো তো। আমি তোমাকে রাণী বানাবো আমার।
রিয়া কপালের চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললো,
—কাল বিকেলে তুমি নোট পাবে, কোথায় আসতে হবে আমি তোমাকে মেসেজ করে দেবো। নাম্বার দাও।
সেই সারারাত আমি ঘুমাতে পারলাম না। এক বসায় রাত পাড় হলো, উফ্! বিকেল হতে এত দেরী কেন?

চলবে…

#তৃধা_আনিকা

#মাতোয়ারা
#পর্বঃ- ০২

বিকেলে রিয়া আসার দু-ঘন্টা আগে থেকেই আমি সেখানে গিয়ে ওয়েট করতে থাকলাম। অপেক্ষা মাঝে মাঝে কতটা গবেষণা কাজের মত মনোযোগ দিয়ে করতে হয়, সেদিন আমি টের পেলাম। কারণ আমি কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করিনা। মনে আছে, ইউনিভার্সিটির এক প্রোগ্রামে অর্থমন্ত্রী স্যার এসেছিলেন, আমাকে না দেখে ফোন করেছিলেন। আমি তখন ছোট একটা গ্রুপের ঝামেলা মেটাচ্ছি। স্যারের এসিস্ট্যান্ট ফোন দিলেন।
অর্থমন্ত্রী স্যার নিজে বললেন,
—বাবা শ্রেয়ান, অপেক্ষা করছি তো আমি। স্টেজে উঠে শুরু করো আগে।
সেই আমার কিনা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমার সব থেকে বিশ্বস্ত চেলা বললো,
—বস, উঠাই নিয়া আসি আবার। ক্লাসরুমে ঢুকাইয়া বাইরে দিয়া তালা মাইরা দিবো। আপনে যা খুশি নোট করেন।
আমি শান্ত গলায় বললাম,
—না, আমি রিয়ার জন্য অপেক্ষা করবো।
সেই মূহুর্তে, সেই বিকেলে, সেই পৃথিবীতে আমার একটা কঠিন অসুখ করে গেলো আমি জানি, আর কেউ জানে না।
রিয়া কিন্তু একা এলোনা। সাথে আরেকজন বান্ধবী নিয়ে এলো। আমার খুব রাগ হলো। আমি ভেবেছিলাম, সারারাত আমার বুক জ্বলেছে ওর জন্য। একটু আদর করবো। নাহ্, সেই সুযোগ কই?
রিয়া কঠিন মুখ করে নোট দিয়ে বললো,
—একা পড়বে। ডোন্ট শেয়ার। আই হোপ ইউ উইল কিপ ইওর প্রমিস।
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
—অবশ্যই, অবশ্যই।
—তোমাকে যে আমি নোট দিয়েছি, দেখা করেছি ভার্সিটিতে কেউ যেনো না জানে।
আমি আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
রিয়া চলে গেলো। নোটের প্যাকেট হাতে নিয়ে আমি তখন হাজারটা চুমু খেলাম। আমার রিয়ার দেয়া জিনিস।
বাসায় এসে প্যাকেট খুলে দেখি, নোট নয়। এটা একটা খাতা। খাতার শুরুতেই লিখা,

এই গুন্ডা,
তুই কি ভেবেছিস? ছাত্র নেতা বলে তোকে আমি ভয় পাবো? মন্ত্রীদের সাথে তোর লিংক আছে বলে যা ইচ্ছে তাই করবি? পারবি না, এই রিয়া তোকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে।
পুরো খাতা জুড়ে হাজার রকমের গালি লিখেছে আমাকে। কখনো এই গুন্ডা, কখনো বা এই ডাকু। আমি সেই খাতা বুকে করে খাই, ঘুমাই, বাথরুমে যাই। ইউনিভার্সিটি যাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলাম। আমার বিশাল বাহিনী আমার খোঁজে বাসায় আসতে লাগলো। আমি তাদের সাথে দেখা করা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলাম।
মা ব্যাপারটা টের পেলেন। বললেন,
—গাধারে… খাতাওয়ালীরে গিয়া বল্। দরকার হইলে পা ধইরা বল্। যেইভাবে খাতাওয়ালীর জন্য পাগল হইছস, না বলতে পারলে তো তুই মইরা যাবি।

উনিশ দিনের মাথায় রিয়া নিজে থেকে আমাদের বাসায় এলো, মায়ের সাথে কথা বললো। আমি তখন দরজা বন্ধ করে, দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে অজানা উত্তেজনায় কাঁপছি। আমি আজও জানি না, আমার মতো তুখোড় ছাত্রনেতা কিভাবে একেবারে মিইয়ে গিয়ে রিয়ার জন্য শিশু বনে গেলো? এই পরিবর্তনের পেছনের শক্তিটার নামই কি ভালোবাসা?
আম্মা এসে ডাকলেন,
—বাবুরে, তোর খাতাওয়ালী আসছে দরজা খোল্।
আমি দরজা না খুলে আনন্দে ভেসে যেতে থাকলাম। একসময় রিয়া নিজে ডাকলো,
—দেখো, তুমি যদি আর পাঁচমিনিটের মাঝে দরজা না খুলো আমি চলে যাবো।
আমি সাথে সাথে দরজা খুললাম।
এবং রিয়া ভেতরে আসার আগে দরজার মাঝেই আমি তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
রিয়া, ও আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। আমি তাঁর মুখ চেপে ধরলাম। পা দিয়ে দরজা বন্ধ করলাম, দরজার পিঠেই তাঁকে চেপে ধরে বললাম,
—তোমাকে আমি এক্ষুণি বিয়ে করবো। তোমাকে ছাড়া আর একটা রাতও আমি ঘুমাতে পারবোনা। একটা মূহুর্তও আমি থাকতে পারবোনা। আমি সারাক্ষণ তোমাকে আদর করতে চাই। পাগলের মতো তোমাকে চাই।
আমার মাথার ঠিক ছিলনা। আমি এলোপাথাড়ি চুমু খেতে লাগলাম তাকে। রিয়া নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো। পাগল আমি, মূর্খ আমি, গুন্ডা আমি সেই খেয়ালই করলাম না। এক পর্যায়ে টের পেলাম, রিয়া কাঁদছে। আমি তাঁর মুখ থেকে হাত সরালাম। রিয়া দরজা ঘেঁষেই মেঝেতে বসে পড়লো।
তাঁর চুলের ক্লিপ ভেঙে গেছে। ওড়না পিন করা ছিলো, ছিঁড়ে গেছে। হাতের প্লাস্টিক ব্রেসলেট ভেঙ্গে গিয়ে হাত কেঁটে গেছে। ঘাড়, গলা লাল হয়ে গেছে।
আমি পাগলের মতো তাঁর সাথে কি ব্যাপারটাই না করে ফেলেছি। অথচ? অথচ?
রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—আমি বাসায় যাবো, আমি বাসায় যাবো।

চলবে…

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here