মায়ার বাঁধন পর্ব -০৩+৪

#মায়ার_বাঁধন 🍂
০৩.
জাহানারা চৌধুরী ভীষণ চিন্তিত। বড় ছেলের বউ শহুরে উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে কিন্তু আদব কায়দার ছিটেফোঁটাও নেই। বড় ছেলে তরিক ভালবেসে রিনাকে বউ করে এনেছিলেন। যার ফল এখন ভুগতে হচ্ছে সবাইকে। তাই তো তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছোট ছেলে তুরানকে গ্রামে বিয়ে দেবেন। কিন্তু তুরান বেঁকে বসল। গ্রাম এবং গ্রামের মানুষজন সম্পর্কে তার ধারণা পুরোই ভিন্ন। সে জানে গ্রামের মেয়ে মানেই লোভী,গাইয়া, অশিক্ষিত। যা নিয়ে সমাজে চলা যায় না। এসব ভাবার যদিও যথেষ্ট কারণ আছে। তার বন্ধু সোয়াব গত বছরে বিয়ে করেছিল এক গ্রামের মেয়েকে। ফলাফল ছয় মাসের মাথায় ডিভোর্স। পরবর্তীতে কাবিনের তিন লক্ষ টাকাও কড়ায়গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল তাকে। সবই কপাল। গ্রামের মেয়ের শহুরে বাতাস গায়ে মাখলে যা হয় আরকি। মূলত এই বিশ্বাসেই সে অপছন্দ করে গ্রাম বা গ্রামের মেয়ে। সে যাই হোক সবাই কী আর সমান হয়? এই একটা কথাই ছেলেকে বোঝাতে ব্যর্থ জাহানারা চৌধুরী। তার ছেলের এক কথা সবাই যখন এক নাই হবে তাহলে সে কেন বড় ছেলের বউয়ের সঙ্গে তুলনা করে শহুরে মেয়ে ঘরে আনতে নারাজ? ছেলের প্রশ্নে নিরুত্তর থাকে জাহানারা। তবে হাল ছাড়ে না। অবশেষে নিজের কসম দিয়ে ছেলেকে নিয়ে যায় বিয়ের আসরে। সে জানে নীরা লক্ষী মন্ত মেয়ে। তার ছেলে বা সংসারের অবহেলা হবে না কখনো। নীরা তার বাবার বাড়ির গ্রামের মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। রূপবতী, গুণবতী একইসঙ্গে তেজস্ক্রিনীও বটে। সেসব কথা না হয় পরেই হবে। আপাতত এতটুকুই জানা থাকুক।

———-🍂
“কে আপনি? এখানে কী চাই?”

নীরার বক্ষে যেন পাথর চাপা পড়ে। হায় কপাল তার! বর বলছে কীনা কে আপনি? নীরা ভেতরে ভেতরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তবে প্রকাশ্যে দেওয়ার মতো উত্তর হাতড়ে পায় না। কফির মগ শক্ত করে চেপে ধরে এদিক ওদিক চোখ ঘোরায়। তুরান সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়। পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে,

-“কথা বলছেন না কেন? কে আপনি?”

নীরা অস্বস্তিতে পড়ে ভীষণ। কোনো রকমে বলে,

-“আমি নীরা।”

তুরানের কুঞ্চিত ভ্রু প্রসারিত হয়। ঠোঁট গোল করে মৃদু কন্ঠে ‘ওওও’ বলে একটা টান দেয়। বিয়ে পড়ানোর সময় শুনেছিল নামটা। তারমানে এটাই তার বউ। তুরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নীরার পানে। নীরা কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে।
লাল টুকটুকে শাড়িতে আবৃত সুন্দরীকে খারাপ লাগছে না তুরানের চোখে। তবু সে নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল। গ্রামের মেয়েকে জোর করে তার মা তার গলায় ঝুলিয়েছে ঠিকই কিন্তু সংসার তার দ্বারা হবে না। সে তার মতোই থাকবে আর এই মেয়ে নিজের মতো। মনে মনে ছক কষে নেয় তুরান। হঠাৎ কী মনে করে বলে ওঠে,

-“ওখানে দাড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।”

নীরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে। ইতস্তত করে এগিয়ে দেয় কফির মগ। মিনমিনে কন্ঠে বলে,

-“আপনার কফি।”

তুরান এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে নেয় কফি। কাঠকাঠ গলায় বলে,

-“আপনাকে এসব করতে কে বলেছে? মা কোথায়?”

নীরা জবাবে বলে,

-“আমাকে তিনিই পাঠিয়েছেন। বলেছেন এখন থেকে এসব দ্বায়িত্ব আমার।”

তুরানের চোয়াল শক্ত হয়। নিজেকে সংযত করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। কঠিন গলায় বলে,

-“আপনার এসব দ্বায়িত্ব পালন না করলেও চলবে। আমার থেকে সর্বদা দূরে থাকাই আপনার দ্বায়িত্ব হবে। বুঝতে পেরেছেন? আর যেন বলতে না হয়। এবার যেতে পারেন।”

নীরার বক্ষ চিড়ে আসে বেদনায়। স্বামীর মুখে এমন বানী আসলেই কী তার পাওয়া ছিল? মা-চাচিরা বলত এমন রূপবতী মেয়ের স্বামী হবে একেবারে বউ নেওটা। একেবারে চোখে হারাবে সর্বক্ষণ। এই কী তবে তার নমুনা?রূপবতী হয়েও ঠায় মিলল না স্বামীর মনে। এমন কী ঘর থেকেও আউট করে দিচ্ছে। তবে কোথায় যাবে এখন সে? গতরাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। ফ্লোরে কার্পেটের ওপর কী আর ঘুম ধরে? গ্রামের হলেও বিলাসবহুল পরিবারের মেয়ে সে। বাপ-চাচাদের বড় আদরের ছিল। মাথায় করে রাখত তাকে। আর এখন স্বামীর ঘরে এসে পেতে হচ্ছে অবহেলা। হায়রে জীবন। রাতের ঘুমটা এখন একটু বিশ্রাম নিয়ে কাটিয়ে নিতে চেয়েছিল। শ্বাশুড়ি যাও সে সুযোগ করে দিল কিন্তু স্বামী, সে তো ঘর থেকে বিচ্যুত করছে।

নীরাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুরান বিরক্ত হলো। পুনরায় নিরেট কন্ঠে বলল,

-“কী হলো এখনো দাড়িয়ে কেন? কথা কানে যায়নি নাকি?”

নীরা মুখ খোলে। শীতল কন্ঠে বলে,

-“মা বলেছেন এখন রেস্ট নিতে। বারোটার পর ডেকে নেবেন আমায়।”

তুরানের বিরক্তি বাড়ল। অধৈর্য কন্ঠে বলল,

-“তো যান না কে বাড়ন করছে।”

নীরা মুখ তুলল। তুরানের চোখে চোখ রাখল। সিনা টান মে’রে সোজা হয়ে দাড়াল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“এখন থেকে এটাই তো আমার ঘর। অনত্র যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সো আমি এখন এখানেই বিশ্রাম নিব। এটা আমার দ্বায়িত্ব নয় অধিকার। দ্বায়িত্ব টা আপনি শিখিয়ে দিলেও অধিকারটা আমি বুঝে নিতে জানি।”

কথা সম্পন্ন করেই তড়িৎ গতিতে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়ল নীরা। গায়ে কম্বল টেনে চোখ বন্ধ করে নিল। আপাততঃ তার বিশ্রাম প্রয়োজন। তুরান এখনো তব্দা খেয়ে তাকিয়ে নীরার দিকে। একটু আগেই তো কেমন মিনমিন করছিল মূহুর্তেই রুপ পাল্টে নিল। গিরগিটি একটা! তুরান চুপচাপ কফি শেষ করে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আহা তার স্বাদের ঘর,স্বাদের বিছানায় ভাগিদার বেড়ে গেল। দুঃখে তার ম’রি’ম’রি অবস্থা।

———-🍂
বিশাল বড় রিসিপশন পার্টি থ্রো করেছেন আলহাম চৌধুরী। বড় ছেলে নিজের মতে বিয়ে করায় তেমন কোনো আয়োজন করে ওঠা হয়নি। এখন ছোট ছেলের বিয়েতে কোনো কমতি রাখতে চান না তিনি। তার চেয়ে বড় কথা নীরাকে তার বিশেষ পছন্দ। গ্রামে যতবারই গিয়েছে নীরার কার্যকলাপ তাকে মুগ্ধ করেছে বারংবার। বন্ধুর মতো মিশেছে দুজনে। প্রাণবন্ত, চঞ্চল নীরা তার হৃদয়ের একাংশ জুড়ে মাতৃ জায়গা দখল করে আছে। এটা অবশ্য সকলেরই জানা।

রানি গোলাপি রঙে রাঙান্বিত করা হয়েছে নীরাকে। অপূর্ব জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ছে তার রুপ থেকে। এ যেন এক সদ্য ফোঁটা জীবন্ত গোলাপ রেণু। তুরান পিছলে যায় সে রুপে তবে তা প্রকাশ্য নয়। মনের সুপ্ত বাসনা মনেই ধামাচাপা দিয়ে মে’রে দেয়। শক্ত মুখভঙ্গি করে বসে থাকে নীরার পাশের সিংহাসন রুপী সোফায়। মাঝেমধ্যে আড়চোখে নীরাকে দেখলেও তা ক্ষণস্থায়ী। বেহায়া মনের বেহায়া কার্যকলাপ স্থায়িত্ব পেতে দেয় না সে। এমন একটা অবস্থা যেন, ‘ডুবেছে কী ম’রেছে।’

নীরার পাশেই হিয়া,টিয়া ছায়ার মতো লেগে আছে। নীরার বেশ লাগছে দুটোকে। নীল গাউনে দুজনকেই একেবারে ডল লাগছে। সেই সঙ্গে কী মিষ্টি হেসে পটরপটর করেই চলেছে। এরই মধ্যে ওদের কাছে আসে তুরানের আপন বোন কিয়া। কিয়া তুরানের থেকে বয়সে ছোট হলেও বৈবাহিক দিক দিয়ে এগিয়ে। কিয়ার বিয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। একটা বেবিও আছে। নাম তিয়া। কিয়া তিয়াকে কোলে করে এগিয়ে এসে নীরার কাছে দাড়ায়। হাসোজ্জল মুখে বলে,

-“কাল থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এত বিজি ছিলাম তোমার সঙ্গে একাকি আলাপ করার সুযোগই হয়নি। বাই দি ওয়ে, আমি কিয়া। মনে আছে তো তোমার ননদীনি?”

নীরার আসলেই মনে নেই। তবে সৌজন্যতায় মাথা নাড়ল। যার অর্থ হ্যাঁ মনে আছে। কিয়া খুশি হয়ে গেল। তার কোলের বাচ্চাটিকে দেখিয়ে বলল,

-“ও আমার মেয়ে তিয়া। গতকাল বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওকে নিয়ে দৌড়ঝাপ করতে করতে তোমাকে সময় দিতে পারি নি। সরি।”

নীরা কোনোরকমে বলল,’ইট’স ওকে।’ তারপর বাচ্চাটার গালে হাত রেখে আদর দিল। কিন্তু তার মন, মস্তিষ্কে ঘুরছে অন্যকিছু। এদের নামের কম্বিনেশন দেখে রীতিমতো সে শিহরিত। ‘কিয়া,তিয়া,টিয়া,হিয়া’ বাহ বাহ জোসস।

কিয়া আলাপচারিতা শেষ করে তিয়াকে নিয়ে চলে যায়। হিয়া,টিয়াও যেন হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে যায়। নীরা পড়ে বিপাকে। একা একা আনইজি লাগছে তার। যদিও একা নয় তুরান সঙ্গে বসে। তবে তুরান আর কলাগাছ দুটোই সমান। আশেপাশ থেকে কত লোকজন আসছে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে নীরা কোনো মতে উত্তর দিচ্ছে। তুরান বসে ফোন ঘাটছে। যেন দিন দুনিয়ায় কোনো খেয়ালই নেই তার। নীরা যখন ছটফট করতে ব্যস্ত তখনই পাশ থেকে তার হাত চেপে ধরল কেউ। নীরা চমকে উঠে পাশ ফিরতেই দ্বিগুণ চমকালো সে। মুখশ্রী পুলকিত হলো।
#মায়ার_বাঁধন🍂
০৪.
বাপ-চাচাকে কাছে পেয়ে আনন্দের আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে নীরা। গতকাল বাড়ি ছাড়ার পর থেকে মনটা অস্থির হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো অচেনা রাজ্যে হারিয়ে গেছে সে। অবশেষে বাবা এবং ছোট চাচাকে কাছে পেয়ে বক্ষ শীতল হয় তার। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে ভাসায়। তুরান এগিয়ে দিয়ে শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরের সঙ্গে আলাপ করে। তুরানের বিয়েতে অমতের বিষয়টা তারা কেউই জানেন না। একমাত্র নীরা জানে। নীরাকে জাহানারা চৌধুরী বিয়ের আগেই সবটা জানিয়েছিলেন সেই সঙ্গে অনুরোধ করেছিলেন তার ছেলেটির দ্বায়িত্ব নিতে। মাতৃসমা জাহানারার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। নীরা অগত্যা রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। কিন্তু তার পরিবারকে এ বিষয়ে অবগত করতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। জাহানারা তাতেই রাজি হয়। তুরান যখন গতকাল বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই সেখান থেকে গায়েব হয়ে যায় জাহানারা তখন সকলকে ভুলভাল বুঝ দিয়ে সামলায়। বলে ছেলের জরুরি কাজ পড়ে গেছে শহরে যাওয়ার আগে তার অনুমতি নিয়ে গেছে। অগত্যা সকলেই বিশ্বাস করে নেয় তার কথাকে।

সদ্য বিয়ে হওয়া বাড়িতে মেহমানে ভরপুর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রিসিপশনে মেয়ে বাড়ির সকলের নিমন্ত্রণ থাকলেও মহিলা সদস্যরা আসতে পারলেন না। গ্রামের বাড়িতে মেহমান বোঝাই সবাইকে ফেলে কী করে আসবে? আবার সকলকে নিয়ে আসাও সম্ভব হলো না। কেউ বলে যাব তো কেউ বলে যাব না। অতঃপর সিদ্ধান্তঃ নেওয়া হয় বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে পুরুষ সদস্যরা আসবেন। মহিলারা থেকে যাবেন মেহমান আপ্যায়নে। সেই মোতাবেক বাড়ির পুরুষ সদস্য বলতে নীরার বাবা হাশিম শিকদার, চাচা রশিদ শিকদার এবং চাচাত ভাই নয়ন ও সুমন এসেছে। বাকিরা সকলে গ্রামে। সুমন ও নয়ন দু বছরের ছোট বড়। সুমন এবারে ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্র আর নয়ন ক্লাস নিউ টেন। দুই ভাই-ই নীরার কলিজা। তেমনই ওদের কাছেও নীরা প্রাণভোমরার ন্যায়৷ প্রিয় বোনের থেকে বিচ্যুত হয়ে এই একটা দিন অনেক কষ্টে কেটেছে ওদের। তাই তো সকাল সকাল বাবা-চাচাকে তারা দিয়ে নিয়ে এসেছে।

নীরা সুমন-নয়নকে বুকে চেপে কেঁদেই চলেছে। তুরান হাশিম শিকদার ও রশিদ শিকদারের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে আবার আড়চোখে নীরাকে পর্যবেক্ষণ করছে আর মনে মনে ফুঁসছে। মেয়েটা এমন ভাবে কাঁদছে মনে হচ্ছে এখানে সবাই মিলে ওর ওপর হা’ম’লা চালিয়েছে। বাড়ির লোকের থেকে সিমপ্যাথি পেতে চাইছে। মূহুর্তেই তুরানের চোয়াল শক্ত হয়। হাশিম শিকদার ও রশিদ শিকদারকে তার বাবার কব্জায় ঝুলিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যায়। নীরা সেদিক পানে একপল দেখে পুনরায় ভাইদের নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে। আপাততঃ ভাইদের সময় দেয়া তার দ্বায়িত্ব।

———🍂
খাবার খেয়ে হাত ধুতে যাওয়ার সময় অকস্মাৎ কারোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায় টিয়ার। বিরক্ত হয়ে ওপরে তাকায়। একটা ছেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে সে। ভাবতেই বিরক্তি রাগে পূর্ণতা পায়। তেড়ে গিয়ে বলে,

-“এই চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি মেয়ে দেখলেই ধাক্কা খেতে মন চায়?”

নয়ন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেই কোমর বেঁধে ঝগড়া করছে। অদ্ভুত। নয়ন নম্র কন্ঠেই বলে,

-“ধাক্কা টা তো আপনি দিলেন মিস. এখানে আমার কী দোষ?”

টিয়ার ক্রোধ আকাশচুম্বী। সে পারে তো ছেলেটাকে চিবি’য়ে খা’য়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,

-“একদম মিথ্যে বলবেন না। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা মে’রেছেন।”

নয়নের রাগ হয় এবার। কুটুম বাড়িতে ঝামেলা করা তার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু এই মেয়ে তো নাছোড়বান্দা। না পেরে তেঁতে ওঠে নয়ন। সমান তালে তেড়ে গিয়ে বলে,

-“আর একবার উল্টো পাল্টা কথা বললে ভুলে যাব আপনি আমার কুটুম।”

-“কী করবেন হ্যাঁ কী করবেন আপনি?”

নয়ন এগোতে গেলেই পেছন থেকে সুমন তাকে বাঁধা দেয়। জিজ্ঞেস করে,

-“কী হচ্ছে এখানে?”

নয়ন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,

-“দেখ না ভাইয়া মেয়েটা ধাক্কা দিয়ে এখন আমাকেই দোষারোপ করছে।”

টিয়া বিরোধিতা করে। বলে,

-“মোটেই না। আমি ধাক্কা দেইনি উনিই ধাক্কা দিয়েছেন আমায়।”

ততক্ষণে হিয়াও সেখানে উপস্থিত হয়। টিয়াকে রাগান্বিত দেখে প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে।”

টিয়া সব বললে হিয়া একপল সুমন, নয়নের দিকে তাকায়। অগত্যা টিয়াকে পাশে টেনে নিয়ে যায়। ধমকের সুরে বলে,

-“কী করছিস এটা? কুটুম হন ওনারা আমাদের। ভদ্রতা রেখে কথা বল।”

-“কিন্তু…।

-“আর একটা কথাও নয়। এখনি চল গিয়ে সরি বলবি নয়তো আম্মুকে বলে দেব কিন্তু।”

টিয়া উপায়ন্তর না পেয়ে হিয়ার সঙ্গে যায়। হিয়া ওদেরকে নম্র কন্ঠে বলে,

-“আসলে আমরা ভীষণ ভাবে দুঃখিত। এখানে কারোরই দোষ নেই। ইট’স এ্যান এ’ক্সি’ডে’ন্ট। সো আমাদের উচিত এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা।”

টিয়া কিছু বলছে না দেখে হিয়া টিয়াকে টেনে সামনে এনে দাড় করাল। আদেশ করে বলল,”কী হলো সরি বল।”

টিয়া জোরজবরদস্তি সরি বলল। হিয়া স্বস্তি পেল। এদিকে সুমন নয়নকে বলল,

-“তোরও সরি বলা উচিত। সরি বল।”

নয়ন ভনিতা ছাড়াই সরি বলল। সকলে প্রসন্ন হলেও অপ্রসন্ন থেকে গেল টিয়া। মনে মনে শপথ নিল সুযোগ পেলে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে নয়নকে।

———🍂
সন্ধ্যার পরপরই নীরার বাড়ির লোকজন রওনা হয়ে গেছে গ্রামে। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে রাত নয়টা নাগাদ। দশ মিনিট হলো নীরা ছাড়া পেয়েছে এসব থেকে। বসে থাকতে থাকতে মাজা-পিঠ এক হয়ে গেছে তার। ব্যথায় টনটন করছে। ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে নিল সে। পরিধান করল কালো রঙের জামদানী শাড়ি।

ওয়াশরুম থেকে বেড়তেই মুখোমুখি হতে হলো তুরানের। সে বিরক্তি দৃষ্টিতে নীরার পানে চেয়ে। হাতে টাওয়াল সহ প্রয়োজনীয় পোশাক। নীরা বুঝল তার জন্য সাহেবের শাওয়ার নিতে দেড়ি হওয়ায় রেগে আছে। সে কিছু বলল না চুপচাপ তুরানের পাশ ঘেঁষে সরে গেল। তখনই পেছন থেকে তুরানের কটমট কন্ঠে ভেসে এলো,

-“তখন বাড়ির লোকদের সামনে এমন কাঁদছিলে যেন তোমাকে আমরা একরাতে মে’রে ধরে প্যাকেট করে রেখে দিয়েছিলাম ফ্রিজে। সিমপ্যাথি চাই তোমার তাই না?”

নীরা পেছন ঘুরে। বিষয়ান্বিত তার চাহনি। তুরান তার সম্পর্কে এটা ভাবছে? অথচ সে কী জানে একটা মেয়ের নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য পরিবারে মানিয়ে নিতে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? আপনজনদের ছেড়ে থাকতে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? জানবে কী করে তাকে তো আর কিছু হারাতে হয়নি যা হারানোর হারিয়েছে নীরা। তাই তো তুরান এত সহজে তার অনূভুতি গুলোকে সিমপ্যাথির কাতারে ফেলছে। নীরা এগিয়ে আসে। মুখোমুখি হয় তুরানের। শীতল তবু দৃঢ় কন্ঠে বলে,

-“ফার্স্ট অফ অল, আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার আগে আমার পারমিশন নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আর আমি সিমপ্যাথি চাই বা না চাই আপনার সেদিকে না দেখলেও চলবে। পরিবার হারানোর মর্ম বোঝার সাধ্য আপনার কখনোই হবে না।”

নীরা গটগট পায়ে হেঁটে বেলকনিতে চলে যায়। উদ্দেশ্য ভেজা টাওয়াল শুকতে দেওয়া। তুরান সেদিক তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

-“পিচ্চি মেয়ে কী ভেবেছ তোমাকে সারাজীবন আপনি বলে সম্বোধন করব? কখনোই না। আর আসছে পারমিশনের কথা তবে বলব আমি আমার অধিকারের জোরেই বলছি এবং ভবিষ্যতেও বলব। খুব তো সকালে আমাকে অধিকার শেখালে। তা অধিকার বোধ কী তোমার একারই আছে আমার নেই?”

তুরান গায়ে টাওয়াল চেয়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। বেলকনি থেকে তুরানের বানী শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নীরা। এই ছেলেকে সোজা করতে তার একটু বেশিই কাঠখড় পোহাতে হবে।

চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here