মায়ার বাঁধন পর্ব -১৭+১৮

#মায়ার_বাঁধন
১৭.
পায়ের কাছে এক দলা কাগজ এসে আটকে আছে। নীরা তুলে নেয় সেটা। খুব সন্তপর্ণে উঠে দাড়ায়। কৌতুহলবশত খুলে ফেলে কাগজটাকে। এ কী পুরো কাগজ ফাঁকা। নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এমন ভাবে তার পায়ে এসে লেগেছিল মনে হচ্ছিল কেউ ইচ্ছে করে ফেলেছে। লাপাত্তা ভঙ্গিতে কাগজটি ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চোখ তুলল নীরা। একহাতে কাগজটি উঁচিয়ে ধরে আছে নিক্ষেপ করবে বলে। কিন্তু সে আর হলো না। সামনে তাকাতেই তার চক্ষু চড়ক গাছ। পাঁচ ছয়টা ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে আছে। ছেলে মেয়ে গুলোর ভাবভঙ্গি সুবিধার নয়। কেমন জানি বদ নজরে দেখছে তাকে। নীরা সামনে পেছনে দেখেও যাওয়ার রাস্তা পায় না। উপায়ন্তর না পেয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়। মসৃণ কন্ঠে বলে,

-“এক্সকিউজ মি! এভাবে পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকলে কীভাবে যাব বলুন তো? রাস্তা ছাড়ুন।”

শেষোক্ত কথাটিতে একটু জোর খাটায় নীরা। কিন্তু দেখা যায় তার কথায় ছেলে মেয়ে গুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অদ্ভুত হেসে ওঠে। মনে হচ্ছে ওরা খুব বড়সড় কোনো জোকস্ শুনেছে। নীরা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রয়। বোঝার চেষ্টা করে এদের মতিগতি। বেশি দেরি করতে হয় না তন্মধ্যেই ওদের মধ্যে থেকে একজন ছেলে বলে ওঠে,

-“এই তোরা পথ আটকে দাঁড়িয়েছিস কেন? দেখছিস না সোনামণি যেতে পারছে না। সরে দাড়া, সর, সর।”

ছেলেটির কথায় নীরার মস্তিষ্কে যেন অগ্নি প্রদীপ্ত হয়। হোয়াট এ ল্যাঙ্গুয়েজ? নীরা বেশ বুঝতে পারছে এদের উদ্দেশ্য অসৎ। শহরের কলেজ,ভার্সিটি গুলোতে র‍্যাগিং নামক টর্চারের প্রচলন আছে এটা শুনেছিল সে। গ্রামে এসব ঝনঝট মুক্ত। এমন পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়ল সে। নীরা বেশ বুঝল এরা সহজে তাকে ছাড়বে না। তবুও শেষ চেষ্টায় আর একবার মুখ খুলল সে। যযথেষ্ট নম্র কন্ঠেই বলল,

-“প্লিজ সরুন আপনারা। আমার লেট হচ্ছে।”

পুনরায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সকলে। নীরা দাঁত চিবিয়ে দাড়িয়ে আছে। হাসি থামিয়ে ওদের মধ্যে সবথেকে নিন্ম রুচিসম্পন্ন মেয়েটি কথা বলল। নীরা লক্ষ্য করল মেয়েটির পড়নের ড্রেসটি খুবই ছোট। শরীরের বেশিরভাগ অংশই দৃশ্যমান। নীরা অগোচরে নাক সিটকলো। এটাকে মেয়ে ভাবতেই তার শরীর ঘিনঘিন করছে। তখনই সেই মেয়েটি বলল,

-“এভাবে তো যেতে পারবে না। এটা ইউনিভার্সিটি। এখানে কিছু রুলস আছে। এই যেমন, নতুনদের জন্য ফার্স্ট অফ অল সিনিয়রদের কথা মেনে চলতে হয়। এখন তোমার কাজ হলো আমাদের কথা মেনে চলা। আমাদের কথা মেনে এখন তুমি একটা সিগারেটে সুন্দর মতো টান দিয়ে ধোঁয়া ওড়াবে। তারপর চলে যাবে।”

মেয়েটির কথায় বাকিরাও হৈহৈ করে সম্মতি জানাল। নীরা এবারেও নিজেকে সংযত করল। মৃদু আওয়াজে বলল,

-“আমি ওসব খাই না।”

-“খাও না তাতে কী এখন খাবে। আরেহ এটাই তো তোমার পরীক্ষা। সিনিয়রদের কতটা মান্য কর তুমি এর মাধ্যমেই তো তা প্রমাণ হবে।”

-“যদি তাই হবে তবে দেব না আমি সেই পরীক্ষা। মনে করবেন আমি একজন ফেল্টুস স্টুডেন্ট। সো এসব আমার দ্বারা হবে না।”

আরেকটি ছেলে এবার ফোড়ন কেটে বলল,
-“তাহলে তো সিনিয়রদের কথা অমান্য করার অপরাধে তোমাকে সাজা পেতে হবে সোনামণি।”

ছেলেটি তার গালে হাত বুলাতে বুলাতে পুনরায় বলল,
-“তেমন কিছু নয় ছোট্ট করে এখানে একটা পাপ্পি দিলেই চলবে। আজকের মতো এটুকুই তোমার শাস্তি।”

সকলেই ছেলেটির কথায় হাসল। আগের সেই মেয়েটি বাঁকা হেসে বলল,

-“শুরু করো। কোনটা করবে তোমার ইচ্ছে। হয় মজা নয় সাজা। আর কাজ কম্পিলিট না হওয়া অব্দি এখান থেকে এক পা ও নড়তে পারবে না। এখন কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার।”

চরম ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে আসে নীরার। একটা মেয়ে হয়ে এতটা জঘন্য প্রস্তাব কী করে রাখছে মেয়েটি? ও নিজেও তো একটা মেয়ে। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে নীরা কিছু বলতে নেবে তখনই পরিচিত রাশভারী পুরুষালী কন্ঠে থেমে যায় তার কন্ঠনালী। কৌতুহল নিয়ে তাকায় সকলের পেছনে। অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে যায় তার মস্তিষ্ক। তুরান দাড়িয়ে। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। নীরা বিষয়াবৃত হয়ে চেয়েই থাকে। তুরান এখানে কী করে? তাহলে কী তুরান এখানকার স্টুডেন্ট ছিল? কই বাবা- মা তো কখনো ওকে বলেনি। নীরার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে তুরান পুনরায় বলল,

-“কী হচ্ছে এখানে?”

তুরানের কণ্ঠ পেয়ে ছেলে মেয়ে গুলো তড়িঘড়ি করে দুপাশে সরে দাড়াল। নতজানু হয়ে দাড়িয়ে গেল। তুরান সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ধমকে বলল,

-“জেরি, তুমি এখানে কী করছ? ক্লাস নেই?”

নীরা তুরানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। বুঝতে পারল ওই মেয়েটির নাম জেরি। সঙ্গে সঙ্গে নীরার মনে আরেক প্রশ্ন উদয় হলো। তুরান চেনে মেয়েটিকে? কীভাবে চেনে? কী সম্পর্ক ওদের মাঝে? নাকি এমনিতেই পরিচিত? এই অসভ্য মেয়েটার সঙ্গে কেন কথা বলে সে?

জেরি আমতা আমতা করছে। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নীরাকে দেখিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,

-“ওই নতুন তো তাই একটু পরিচিত হচ্ছিল।”

তুরান তির্যক দৃষ্টিতে ওদের সকলকে আগাগোড়া দেখে নেয়। অতঃপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা নীরার পাশ ঘেঁষে হেঁটে যায়। যেতে যেতে পায়ের গতি কমে নীরার ঠিক কাছে এসে। সটান সামনে তাকিয়েই চাপা কন্ঠে বলে,

-“এখানে তুমি আমি একে অপরের অপরিচিত। কথাটি যেন মাথায় থাকে।”

তুরান সেভাবেই চলে গেল। সাথে সাথে তার সাঙ্গপাঙ্গরাও। তার হাঁটার ভঙ্গি, কথাগুলো কারোরই কান অব্দি পৌঁছতে পারল না শুধু নীরা ব্যতিত। কিন্তু জেরির কিছু একটা খটকা লাগল। মনে মনে ভাবল, “তুরান কী মেয়েটিকে কিছু বলল?” পরক্ষণেই আবার মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিল ভাবনাটাকে।

সবকিছু ছাপিয়ে নীরার মস্তিষ্কে শুধু একটি কথাই আঘাত হানতে থাকল, “এখানে তুমি আমি একে অপরের অপরিচিত।” গভীর দুঃখে ছেয়ে গেল তার অন্তরিক্ষ। চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো বক্ষগহ্বরে। মনকষ্টে আড়ষ্ট হয়ে গটগটিয়ে হাঁটা ধরল সে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। জেরি ও তার দল পুনরায় ঘিরে ধরল তাকে। একটু আগে এদের কাচুমাচু ভঙ্গি দেখে নীরা ভেবেছিল আর হয়তো কিছু বলবে না। কিন্তু এরা তো নাছোড়বান্দা। পিছু ছাড়ছেই না। নীরার বিরক্ত ভঙ্গি দেখে জেরি বলল,

-“এই মেয়ে চলে যাচ্ছ কেন? যেতে বলেছি তোমায়? তুমি তো আচ্ছা অভদ্র মেয়ে। এই আমাদের দেখছ সিনিয়রদের কীভাবে সম্মান দিলাম। তোমারও উচিত আমাদের এভাবে সম্মান দেওয়া।”

সেই বিশ্রী ভাষী ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে জেরি পুনরায় বলল,
-“এই সোহান সিগারেট ধরা।”

বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে সিগারেট ধরালো সোহান। পরপরই দিয়ে দিল সেটা জেরির হাতে। জেরি সেটাকে হাতে নিয়ে একপল তাকালো। ঠোঁটে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল নীরার সম্মুখে। একহাতে সিগারেট আরেক হাতে নীরার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। জোর খাটিয়ে বলল,

-“নাও ধরো। ধরো বলছি। প্রমাণ করো তোমার গুরুশ্রদ্ধা।”

তুরানের কথায় এমনিতেই বি’ষি’য়ে আছে নীরার হৃদয়। তার ওপর এখন আবার এদের এই কাজ। সবকিছুই যখন এক পর্যায়ে ছিল কাল হলো জেরির নীরার হাত ধরাটা। গায়ে স্পর্শ করায় যেন নীরার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। চাপা দেওয়া প্রদীপ্ত অগ্নিটুকু প্রকাশিত হলো মুহুর্তেই। জেরি তার যে হাতটি ধরে ছিল অন্য হাতের সাহায্যে দ্বিগুণ শক্ত করে চেপে ধরল সে জেরির হাত। রীতিমতো প্রবল শক্তি দ্বারা মুচড়ে ধরল। ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল জেরি। নীরার চোখ জোড়া রক্তিম। চোয়াল শক্ত। মুহুর্তেই এক কোমলিনী অশান্ত রুপ ধারণ করেছে যেন। জেরির সাঙ্গপাঙ্গগুলো হকচকিয়ে গেল এহেন দৃশ্যে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ব্যথায় কাতর জেরি হাতটি আরেকটা মোচড় দিয়ে নীরা মনে মনে বলল,

-“আমায় ক্ষমা করো বাবা তোমার কথা রাখতে পারছি না। এরা আমায় ভালো থাকতে দিল না।”

একইভাবে প্রকাশ্যে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
-“এটা বাবা-মায়ের আদরের শহুরে ননীর পুতুল কন্যার হাত নয়। এটা গ্রাম্য দস্যি মেয়ের হাত। একবার ছুতে শতবার ভাবতে হয়।”

.#মায়ার_বাঁধন🌺
১৮.
আশেপাশে জিজ্ঞেস করে করে নিজের ডিসিপ্লিন খুঁজে নিয়েছে নীরা। অনেক স্টুডেন্টদের ভিড়। আশপাশে চোখ বুলিয়ে একটা ফাঁকা সিট দেখে এগিয়ে যায় সে। চুপটি করে বসেও পড়ে। তখনই পাশ থেকে একটি মেয়ে বলে ওঠে,

-“এই তুমি এখানে এসো।”

মেয়েটি নিজের পাশে জায়গা দেয় নীরাকে। নীরা অমত করে না এগিয়ে গিয়ে বসে তার পাশে। সেই সিটে আরও দুজন মেয়ে ছিল। নীরা বসতেই মেয়েটি হাসোজ্জল মুখে নীরার পানে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে,

-“আমি অতশী।”

নীরাও হাসিমুখে হাত মেলায়৷ নম্র কন্ঠে বলে,
-“আমি নীরা। নীরা চৌধুরী।”

অতশী তার পাশের মেয়ে দুটিকে দেখিয়ে বলে,
-“ও সীমা আর ও হলো রুহি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। চাইলে তুমিও জয়েন করতে পারো আমাদের গ্রুপে।”

নীরা হাসে। বলে,
-“অবশ্যই, কেন নয়?”

তারপর চারজনে টুকটাক পরিচিত হয়। কুশল বিনিময় করে। তারমধ্যেই ক্লাসে প্রফেসর হাজির। নীরা খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। তবে তার মনোযোগ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছিল সকালের ঘটনা মনে করে। তুরানের ব্যবহার কষ্ট দিচ্ছে তাকে।প্রকাশ্যে এমন হর্ষপূর্ণ,স্ট্রং পারসোনালিটি সম্পন্ন মেয়েটি ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

—-
হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাবে এসে উপস্থিত অয়ন। হাবভাব এমন মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করে এসেছে। সেভাবেই তুরানের সম্মুখে দাড়িয়ে গেল সে। কিছুটা স্বাভাবিক হলেও নিশ্বাস ঘন। হাঁটুতে দু’হাতের ভর দিয়ে থেমে থেমে বলল,

-“ভাই ভাই… কাজ শেষ।”

তুরানের ওষ্ঠে ক্রুর হাসি। নিরেট কন্ঠে সে বলে,
-“গুড। তুরান চৌধুরীর জিনিসে হাত দেওয়ার পরিণতি মোটেই সুবিধাজনক নয়।”

-“ভাই আরও একটি খবর আছে।”

তুরান ভ্রু উল্টে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অয়ন ইশারা পেয়ে বলে,
-“ঘটনা না তো পুরোপুরি উল্টো। ভাবি তো সেইইই কাজ করেছে।”

তুরানের কুঞ্চিত ভ্রু দ্বিগুণ কুঞ্চিত হয়। বিচলিত কন্ঠে বলে,

-“কী করেছে?”

অয়ন তখনকার পুরো ঘটনা খুলে বলে। তুরান চলে আসার পর কী কী হয়েছে সমস্ত কিছু ভেঙে ভেঙে বর্ণনা দিয়েছে। তুরান নিরুদ্বেগ চাহনিতে শ্রবণ করে সবকিছু। তার ভাবাবেগ বোঝা দায়। অয়ন কিছুক্ষণ অবলোকন করে। কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসে,

-“ভাই, কিছু তো বলেন। এখন কী করণীয়?”

তুরান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অকপটে জবাব দেয়,
-“কিচ্ছু না। আপাততঃ ক্লাবের কাজে মন দে আর সেই সঙ্গে ফ্রেশার’স পার্টির জন্য তৈরি হ, প্রিন্সিপালের কাছে যেতে হবে তো।”

অয়ন নিজের দ্বায়িত্ব বুঝে নিয়ে চলে যায়। তুরান পায়ের ওপর পা তুলে বসে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়। সিগারেটকে সঙ্গী করতে ভুলে না একদম।

—-
হসপিটালের করিডোরে বসে পুরো জেরি’স গ্যাং। সকলেই বেশ চিন্তিত। জেরির মুখটাও চুপসে আছে। এর একমাত্র কারণ সোহান। কারা যেন তাকে মে’রে হাড্ডি গুড্ডি আলাদা করে ফেলেছে। অবস্থা বেগতিক। ক্লাস চলাকালীন ওয়াশরুমে গিয়েছিল ছেলেটা। ফিরে আর আসেনি। ক্লাস শেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভার্সিটির পেছনের বাগান থেকে ওরা ওর আ’হ’ত শরীর উদ্ধার করে। আপাততঃ চিকিৎসা চলছে ভেতরে। ওরা সকলে করিডোরে অপেক্ষারত। শ্বাসরুদ্ধকর গুমোট পরিস্থিতি। নিরবতা ভেঙে জেরির ফ্রেন্ড নেহা বলে ওঠে,

-“কে করল ওর এই অবস্থা? আগে তো কখনো এমন হয়নি।”

জেরি তেঁতে উঠল। চিবুক শক্ত করে বলল,
-“যে-ই করুক পরিচয় পেলে আস্ত রাখব না একদম।”

ওদের কথায় মনির বিরক্তি পোষণ করে বলে,
-“আরেহ বাপ, আগে ওকে সুস্থ তো হতে দে। তারপর না হয় ওর মুখ থেকেই শুনে নেওয়া যাবে কাল’প্রিট কে?”

বাপ্পি বলল, “হুমমমম, ঠিক বলেছিস। এখন ভালোই ভালোই ও সুস্থ হয়ে ফিরলেই বাঁচি।”

আবারও নিশ্চুপতা বিরাজমান। প্রায় ঘন্টা খানেক পার করে ডক্টর বেড়িয়ে আসেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। ডক্টরকে দেখতেই ওরা সকলে দৌড়ে যায়। জেরি উদ্বীগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে,

-“ডক্টর, কেমন আছে সোহান? ও ঠিক হয়ে যাবে তো?”

জেরির কথার সঙ্গে সবাই মত মেলায়। সকলেই উদগ্রীবতার সঙ্গে ডক্টরের মুখপানে চেয়ে। ডক্টর মাহাতাব চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন,

-“আপাতত কিছুটা ঠিক আছে। তবে পুরোপুরি সেরে উঠতে দুই – তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে। ইন’জুরি মা’রা’ত্ম’ক
প্রচুর বেড রেস্ট প্রয়োজন সেই সঙ্গে চিকিৎসা।”

-“আমরা কী ওর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?”

-“এখনো জ্ঞা’ন ফেরেনি। জ্ঞা’ন ফিরলে একজন একজন করে দেখা করে নেবেন।”

-“ওকে থ্যাংকিউ, ডক্টর।”

-“মাই প্লেজার।”

—-
গাড়ি আসতেই অতশী, সীমা ও রুহির থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয় নীরা। ওদের সঙ্গে দিনটা বেশ ভালোই কেটেছে। ওরা সবাই ভীষণ মিশুকে প্রকৃতির। স্বভাবে মিল হওয়ায় সখ্যতা হয়েছে অতি দ্রুত। গাড়িতে বসতেই আলহাম চৌধুরীর কল আসে নীরার ফোনে। নীরা চটজলদি রিসিভ করে নেয়। আলহাম চৌধুরী গমগমে কন্ঠে বলেন,

-“নীরা, গাড়ি পাঠিয়েছি। বাড়িতে পৌঁছে আমাকে একটা কল করিস কেমন। নয়তো বাবার টেনশন হবে তো।”

নীরার অন্তঃকোণে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। লোকটা তাকে ঠিক কতটা স্নেহ করেন প্রতিটি পদে পদে সেই প্রমাণ তিনি দিয়ে চলেছেন। বাবাকে ছেড়ে এসে আরেক বাবা পেয়েছে সে। আনন্দে বুক ভার হয়ে আসে তার। কন্ঠ ধরে আসে। কোনো রকমে ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দেয়। পরপরই কিছু নিরব অশ্রু বিসর্জন দেয় গোপনে। মানসপটে ভেসে ওঠে হাশিম শিকদারের মুখশ্রী। তিনিও ঠিক এভাবেই সর্বক্ষণ মেয়ের খেয়াল রাখতেন। বিয়ে হয়েছে বলে পর করে দিয়েছে এমন কিন্তু নয় এখনো রোজ নিয়ম করে দু বেলা ফোন করেন নীরাকে। গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু টুকু সন্তর্পণে মুছে নেয় নীরা। মনোযোগী হয় প্রকৃতির মনোহারিতায়।

—-
নীরা বাড়িতে ফিরে জাহানারা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে সোজা চলে যায় ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তুরান এখনো ফেরেনি। নীরা আজ ক্যান্টিনেই লাঞ্চ করেছে। তাই আর এখনো খেতে যায়নি। জাহানারা চৌধুরী অনেকবার বলা সত্ত্বেও নাকচ করে দিয়েছে। মন ভালো না থাকলে কিছুই ভালো লাগে না।

ঘরে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নীরা চলে যায় ছাদে। ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে পড়ে। পথিমধ্যে একবার রিনার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল। রিনা আলগোছে মুখ ভেংচি কেটেছে সেই দৃশ্য দৃষ্টি এড়ায়নি নীরার। তবু সে নিশ্চুপ। নীরার এই নিশ্চুপতা রিনাকে বেশি ক্রোধান্বিত করে। যার যেমন স্বভাব আরকি। রিনা চায় সর্বদা কোমরে দড়ি বেঁধে ঝগড়া করতে কিন্তু নীরা সে চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।

পুরো অপরাহ্ন ছাদে কেটে যায় নীরার। ক্ষণে ক্ষণে বি’ষা’ক্ত স্মৃতিচারণ মনে করে পেয়েছে কষ্ট তো ক্ষণে ক্ষণে হর্ষপূর্ণ স্মৃতিচারণ করে হয়েছে পুলকিত। করেছে ফুলেদের সঙ্গে গল্প। দোলনায় ভাসিয়েছে সর্বাঙ্গ। গুণগুণিয়ে গেয়েছে গান। কখনো বা দেখেছে নিসর্গ মনোহারিত্ব। এভাবেই চেষ্টা চালিয়ে গেছে নিজেকে খুশি রাখার। আনন্দে রাখার।

সময় বহমান। নীরা যখন নিজেকে নিয়ে পুরোপুরি ব্যস্ত তখনই ভেসে আসে এক গগনবিদারী চিৎকার। স্তব্ধ বনে ছাদের দরজায় তাকায় নীরা। তাকে ডাকছে। হ্যাঁ, তুরান তাকে ডাকছে। কিন্তু এভাবে কেন ডাকছে? সকালের ব্যবহার কী কম ছিল এখন নিশ্চয়ই পুরোপুরি পুষিয়ে দিতে এসেছে।

.
চলবে,
®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here