মারিয়া,পর্ব:১১

“মারিয়া”
কলমে:- সায়ীদা নুহা
পর্ব:- ১১
~~~~~~

বিকেলের শেষ মুহূর্ত। মর্গান ভাতঘুমে বেঘোর! বাড়ির দারোয়ান চাচা আর তার বউ এখনও এখানেই সব দেখাশোনা করছে। তারা আর এ বাড়ি ছাড়ছে না। অনেক লস হয়ে যাবে তাদের। এমনিতেই এখানে যা চাহিদা তার সবটুকুই তারা পাচ্ছে। কীভাবে ইচ্ছাকৃত লাভ রেখে লস করা যায়?

দারোয়ানের স্ত্রী দিব্যি নিচতলায় তাদের রুমে বসে টিভি দেখছে। গেটের খেয়াল রাখতে বলে দারোয়ান চাচা একটু বাজারে যায়। কী দরকার নাকি আছে! মহিলার কোনো চিন্তা নেই। এই বাড়িতে কেউ আসেও না যে গেটের দিকে খুব করে নজর রাখতে হবে। তিনি তার মতো টিভি দেখতে ব্যস্ত।

*****

ইয়াসির ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। খুব সচেতনতার সাথে তারা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কোনোরকম ভুল হওয়া চলবে না। কারো চোখে পড়লে একদম সব শেষ! আগেই ইয়াসির রেড এলার্ট দিয়ে রেখেছে মারিয়াকে। দ্রুত হাতে যেন তার সব জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে আসে সে। মারিয়া সায় দেয়। কিন্তু তার ভেতরে প্রচুর নার্ভাসনেস কাজ করছে। কখনও এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি সে। কীভাবে এত কৌশলে কাজ করবে সে? ভাবতেই গা হিম হয়ে আসছে তার। তবুও তার এই উদ্বিগ্নতার জন্য সে ইয়াসির, রাফি আর রিমির জীবন রিস্কে ফেলতে পারে না। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে গেট মারিয়ে ভেতরে উঁকি দেয় রাফি। নাহ্, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবুও ভালো করে আশেপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে দু’তিনবার নজর বুলিয়ে নেয় রাফি। ধীরে সুস্থে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে তাদের। বাকি তিনজনকে ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় রাফি, তারা এখন ভেতরে ঢুকতে পারবে। এটাই মোক্ষম সুযোগ!
ইয়াসির মারিয়াকে ভেতরে ঢুকিয়ে রিমির উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই যা। গেটের সামনেই লুকিয়ে থাকবি। নজর রাখিস। যদি কিছু নজরে আসে আমার ফোনে বা রাফির ফোনে মেসেজ দিবি।”
ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রিমি মাথা নাড়ায়। ইয়াসির আবার বলল,
“ক্লিয়ার?”
রিমি খানিকটা বিব্রতবোধ করে ইয়াসিরের কথায়। মারিয়া মেয়েটা তার কাছে এমন কী গুরুত্বপূর্ণ, যে সে এত সিরিয়াস? কী এমন পাচ্ছে সে মেয়েটার থেকে? ভাবনায় ডুবে রিমি।
রিমিকে এভাবে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইয়াসির হাতে তুড়ি বাজালো। রিমির ভাবনা কাটে। কোনোরকম বলল,
“হ্যাঁ বলব। আমি কি বাচ্চা যে বুঝব না?”

ইয়াসির রিমির কাঁধে হালকা চাপর মেরে ভেতরে ঢুকে যায়। রিমিও চুপচাপ অন্যদিকে পা বাড়ায়। তার চোখে অসহায়ত্ব গাঢ় করে ফুটে উঠছে। ইয়াসির কেন এত অবুঝ? নাকি বুঝেও বুঝে না? রিমির অনুভূতি তো আজ প্রথম না। সেই কলেজ লাইফ থেকে…. তবুও কেন ইয়াসির তাকে দূরে ঠেলে দেয়?

*****

ফোনের ভাইব্রেটিং-এর কারণে মিস্টার মর্গানের ঘুম উবে যায়। ঘুমুঘুমু চোখেই তিনি বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নেন। ছোট্ট একটা টেক্সট এসেছে, নাম্বারটা পরিচিত তার। টেক্সটা হচ্ছে,
“ওরা পৌঁছেছে।”

সাথে সাথে মর্গানের মস্তিষ্ক যেন তার ঘুমকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেয়। ঘুম বলতে এখন তার কিছুই নেই। তিনি এখন পুরোপুরি সতর্ক। চুপচাপ কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন তিনি। পরিস্থিতি তাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে! মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার তাই!
উঠে পড়েন মর্গান। বিছানা সুন্দর করে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন তিনি; একদম নিঃশব্দে কাজ করছেন। এমনকি তার হাঁটার বিন্দুমাত্র কোনো শব্দ হচ্ছে না! ওয়াশরুমে গিয়ে সুন্দর করে হাতমুখ ধুয়ে বের হলেন। বড়ো করে লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন খানিকক্ষণ…

*****

বড়ো করে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো মারিয়া। ভীষণ ভয় করছে তার। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি মর্গান লোকটি তাকে দেখে ফেলবে। এরপর সে আর এখান থেকে বের হতে পারবে না। আজীবন এখানেই…

রাফির ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে পায় মারিয়া। রাফি দ্রুত পা বাড়াতে তাগাদা দিলো। মারিয়া সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ধীর পায়ে উপরে উঠে। যেন বিড়াল হেঁটে যাচ্ছে কোনো, একটুও শব্দ নেই!
রুমে পৌঁছেই মারিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচে। তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়। মনে হচ্ছে যেন, কতদিন পর সে তার নিজের ঘরেই এলো। বিছানায় বসে মারিয়া। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নেয় সে। সময় নষ্ট করা যাবে না মোটেও! তাড়াতাড়ি ব্যাগ বের করে। নিজের সবকিছু গুছিয়ে নেয় সে। ফোনটা বিছানার কোণে এখনও পড়ে আছে। সেটাও তুলে নেয় সে। এখন ফোনের কিছু দেখার সময় নেই। সাথে আনা মৃত মারিয়ার ডায়েরীটার সাথে অন্যান্য যেসব জিনিস সে নিয়ে গিয়েছিল সবসহ ব্যাগে পুরে নেয়। আবার চারপাশে চোখ বুলায় সে। কিছু কি বাদ পড়েছে? বের হওয়ার সময় মারিয়ার ভেতর কেমন টান খায়। কিছু একটা তো সে ফেলে যাচ্ছে! কী, কী? ভাবতেই আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আলমারি খুলে ভেতরের ড্রয়ার থেকে মৃত মারিয়ার সেই জিনিসগুলো বের করে, যেগুলো সে এই বাড়িতে এসে প্রথম পরেছিল। যার কাপড়ের টুকরোর সাথে মারিয়া রগে রগে মিশে গিয়েছিল। লাল রঙের কাপড় আর নূপুর জোড়া বের করতেই মারিয়ার ভেতর শান্ত হয়। বুকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। এগুলো সে তার সাথে করেই নিয়ে যাবে!

*****

নিচের যে স্টোর রুমের মতো জায়গা আছে, ওটার ভেতরে পা রাখে ইয়াসির ও রাফি। ভেতরে যেতেই বোঁটকা এক গন্ধ তাদের নাকে ছুঁয়ে যায়। ওয়াক করে উঠে দু’জনই। কী বাজে গন্ধ! পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরে। পুরো রুমে চোখ বুলায় তারা। অন্ধকার রুমে হলদে রঙের হালকা আলোর বাতি জ্বালিয়ে রাখা। ওটাতেও স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না! ধীরে সুস্থে এদিক ওদিক প্রমাণ খুঁজতে শুরু করে ইয়াসির আর রাফি। সামনে দেখতেই তাদের চোখে একটা ডিপ ফ্রিজ চোখে পড়ে। দু’জনই একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকায়। এরকম অন্ধকার রুমে ডিপ রাখা কেন? আর তো কিছু নেই এই রুমে!
সামনে এগোয়। কেন যেন তাদের উভয়েরই বুক দুরুদুরু করছে। ভেতরে অজানা এক ভয়, উত্তেজনা কাজ করছে! ইয়াসির প্রথমে হাত বাড়ায়। ডিপ- এর দরজা খুলে সে। এটা ভ্রম না বিভ্রম তার? অথবা তাদের….?

দু’জনেরই চোখ ছানাবড়া। এর জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না মোটেও। রাফির শরীর কেঁপে উঠে। ইয়াসিরের কাঁধে হাত রেখে দুর্বল গলায় বলল,
“এখান থেকে চল প্লিজ? আমার মাথা ঘুরাচ্ছে!”

ইয়াসির রাফিকে শক্ত করে ধরে রাখে। ফ্রিজের ভেতরে শুধু রক্ত আর রক্ত। রক্তের ব্যাগ সিরিয়াল করে রাখা। এমনকি ব্যাগগুলোর একেকটার উপর ডেট, বার অবধি লিখে রাখা। লাইন করে সাজিয়ে রাখা এগুলো। প্রমাণস্বরূপ ছবি তুলার জন্য ইয়াসির ফোন বের করতে চায়। রাফি আবার বলল,
“প্লিজ চল দোস্ত। আমার বমি আসছে।”

ইয়াসির আর ভাবার সময় পায় না। রাফিকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে মারিয়ার অপেক্ষা করে। একটু পরই মারিয়াকে ব্যাগ নিয়ে নামতে দেখা যায়। মারিয়া কিছুটা হাসিমুখে তাদের কাছে ছুটে আসে। ইয়াসির জিজ্ঞেস করলো,
“সব নিয়েছ তো?”
মারিয়া মাথা ঝাঁকায়। তারা বের হবে তখনই সে বলল,
“এক মিনিট! আমার ফোন?”
ব্যাগ খুলে সবকিছু এলোমেলো করে দেখে মারিয়া। কিন্তু ফোন পাচ্ছে না। ফোনটা না ঢুকালো সে?”

ইয়াসির আর রাফি আবার তাগাদা দেয় তাকে। কিন্তু মারিয়া যাবে না। তার ফোন রেখে এসে পড়েছে। ফোনটা তো অনেক দরকারি! এক মিনিট দাঁড়াতে বলে মারিয়া আবার ভেতরে চলে যায়। ইয়াসিরের বুকের ভেতর অস্থিরতা বেড়ে যায় হুট করেই। ভয় লাগছে তার। চোখে নিমিষেই অস্থিরতা প্রকাশ পায়। রাফির এখনও অবস্থা খারাপ। ছেলেটা ডাক্তার হয়েও এমন রক্তের ভাগাড় দেখে ভয় পেয়ে গেল? এসব ভাবার সময় নেই এখন। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান সবসময়ই শূন্য থাকে। খুব কম মানুষ পরিস্থিতি বুঝে সামাল দিতে পারে!

সন্ধ্যা নেমেছে আরও অনেক আগেই! ইয়াসির হাতঘড়ির দিকে তাকায়। এতক্ষণ লাগে? রাফির এদিকে মাথা ঘুরাচ্ছে। একটু পরেই সে ইয়াসিরের উপর নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দেয়। এক পর্যায়ে আর পারে না সে। রিমিকে ফোন দেয়। এখানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে খুব রিস্ক হয়ে যাবে। রিমি আসতেই মারিয়ার ব্যাগপত্র সব রিমির হাতে ধরিয়ে দেয় ইয়াসির। রাফিকে নিয়ে বাসার পথ ধরে।
তার মন টানছে না। কিন্তু এমন অবস্থায় আর কী করবে সে? অগত্যা মারিয়াকে ফেলেই ইয়াসিররা চলে যায়।

*****

রুমে ফোন ছিল না। মারিয়ার মনে পড়ে, সে তো সবার আগে ফোন ব্যাগে পুরে। এজন্যেই হয়তো সে ফোনটা পায়নি। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড় দিতেই কেউ একজন এসে মারিয়ার ঘাড়ে জোরে চেপে ধরে। পেছনের চুলের থেকে একটু নিচে এত জোরে চেপে ধরে মারিয়ার মুখ নিজ থেকেই হা হয়ে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে সে পাশে তাকানোর চেষ্টা করে। মুখ থেকে আওয়াজ বের করতে চাইলেও পারে না। অলরেডি মর্গান তার ঘাড় যেন কাত করে ভেঙেই দিয়েছে। হাত দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে মারিয়া। ব্যর্থ হয়! মর্গান তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। হাতে রাখা কাপড়টা দিয়ে মারিয়ার মুখ বেঁধে ফেলে। মারিয়ার অতিরিক্ত ছুটোছুটি করাটা মর্গানকে বিরক্ত করছে ক্রমশ! তার নিজের মেয়েও এইরকম করেছিল।

রাগের বশে মর্গান পাশ থেকে চেয়ার তুলে নেয়। মারিয়ার কোমর বরাবর বাড়ি মারলো জোরে। মারিয়া চিৎকার করলো ঠিকই, কিন্তু সে চিৎকার শোনা গেল না!
ব্যথায় চোখ বুঝি কোটর থেকেই বেরিয়ে আসে। মারিয়ার পুরো শরীর ঘেমে অস্থির! কপালে সামনের চুলগুলো এসে লেপ্টে আছে। মর্গান এসে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে। তবুও তার রাগ কমে না। মেয়েটার সাথে যা ইচ্ছে করতে মন চাইছে তার। কী করবে ভেবে পায় না মর্গান। রাগের বশে মারিয়ার দুই হাত পিছনে চেপে তার কোমরের ঐ অংশের উপরেই দু’হাঁটু দিয়ে চাপ দিয়ে উঠে বসে। চুলের মুঠি আরও শক্ত করে ধরলো। মারিয়ার চোখের পাতা ধীরে ধীরে নিভে আসে…
আর নিতে পারছে না সে!

চলবে…

সুহৃদ পাঠক/ পাঠিকা অনুভূতি জানাবেন কিন্তু…!?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here