মারিয়া,পর্ব:১২

“মারিয়া”
পর্ব:- ১২
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~~

রাফিকে ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দেয় ইয়াসির। রিমিকে বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“ওকে দেখ একটু, অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
রিমিকেও খানিক চিন্তিত দেখালো। রাফির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। অথচ ও কখনও-ই রাফিকে বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসেনি। শুধু দায়িত্বের চাপে পড়ে সংসার করেছে। কিন্তু আজকে রাফিকে এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে রিমির বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। কেন? সে জানে না!
রিমিকে কিছু বলতে না দেখে ইয়াসির হালকা ধাক্কা দিলো,
“কিরে? কী বলছি?”
রিমির হুঁশ ফিরে। ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে সায় দেয়। সে খেয়াল রাখবে।
ইয়াসির আবার বাসা থেকে বের হয়ে যায়। হন্তদন্ত হয়ে মর্গানের বাড়ির দিকে ছুটে যায়। নাহ্, আশেপাশে কোথাও মারিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কোথায়? কোনো বিপদ হলো না তো? ফোনও তো নাই। কীভাবে এখন তাকে খুঁজে পাবে?
গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। মুখ হা করে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ইয়াসির। তার মাথায় কোনো কিছুই আসছে না।
তবুও আশেপাশে আরও ভালো করে তাকায় ইয়াসির। আরেকটু ভেতরে গিয়ে পরখ করে। নাহ্! মারিয়া কোথাও নেই! শুধু ঘন জঙ্গল দেখা যায়।

******

হলরুমের ফ্লোরে লেপ্টে থাকা রক্তের দাগ কিছুটা শুকিয়ে গেছে। দারোয়ান আর তার স্ত্রী মিলে ফ্লোর পরিষ্কার করছে। তার স্ত্রীর তো কোনো খবরই ছিল না এইদিকের। নিজের মতো হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে টিভি দেখায় মগ্ন ছিল সে। কাজ শেষ করে দারোয়ান এসে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে। তখন মারিয়ার অবশ শরীর কাঁধে তুলে মর্গান স্টোর রুমের দিকে যাচ্ছিল। দারোয়ানকে দেখেই বলল,
“জলদি দু’জন মিলে জায়গাটা সাফ করো।”
মাথা দুলিয়ে দারোয়ান কাজ করতে উদ্যত হয়। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়ার চেহারাটা দেখে সে। ভেতরে কেমন বিজলীর স্পর্শের মতো লাগে, মেয়েটার চেহারা রক্তাক্ত হয়ে আছে। পুরো শরীর ছেড়ে দিয়েছে সে।

মাঝে মাঝে দারোয়ানের ভেতর উপলব্ধি হয়, মর্গানের মতো বিকৃত মস্তিষ্কের লোকের সাথে থেকে কি সে নিজেও বিকৃত হচ্ছে? এত সুন্দর মেয়েগুলোকে এনে মর্গান কী নিসৃংশভাবেই না মেরে ফেলে। এরকম মানুষ তো সে কোনোদিনও দেখেনি!

ফ্লোর মুছতে মুছতে দারোয়ানের স্ত্রী বিড়বিড় করে বলল,
“কী সুন্দর নাটক দেখতাসিলাম। এখনই এই মেয়েরে ধরা লাগতো?”
দারোয়ান অবাক হয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকালো, তবে কি সত্যি তাদের ভেতর থেকে সব মায়া মমতা চলে যাচ্ছে? ধীরে ধীরে তারাও কি হিংস্র পশুতে পরিণত হচ্ছে?

মহিলা আবার বললেন,
“আচ্ছা, এই মেয়েরে পাইলো কই? এতদিন তো কোনো খবর ছিল না।”
তার চোখের ভ্রু কুঁচকে আছে। চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় প্রশ্নের উত্তর জানতে সে খুবই উৎসুক।
দারোয়ান বিরক্তির সাথে বলল,
“জানি না আমি। কাজ শেষ কর জলদি!”
মহিলাও মুখ ভেংচে নোংরা পানি ভর্তি বালতি নিয়ে চলে যায়।

******

মর্গানের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ইয়াসির। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবছে, ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না? গিয়ে কি সরাসরি মারিয়ার কথা জিজ্ঞেস করবে? আগপিছ চিন্তা না করেই ইয়াসির বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। দারোয়ান সবে মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইয়াসিরকে দেখা মাত্রই জিজ্ঞেস করলো,
“কী চাই? কে আপনি?”
আমতা আমতা করে ইয়াসির উত্তর দেয়,
“এখানে কি মারিয়া নামের কেউ থাকে?”

দারোয়ানের পিছন থেকে তখনই গম্ভীর গলায় কেউ বলল,
“হু আর ইউ?”
অন্ধকারে লোকটির চেহারা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও ইয়াসির নিশ্চিত হয়, এই সে মর্গান। তার ভেতর উত্তেজনা বাড়ে। দু’কদম সামনে বাড়িয়ে বলল,
“হাই, ইজ মারিয়া লিভ হেয়ার?”
মর্গান অন্ধকারে থেকেই বলল,
“নো। অনেকদিন ধরে সে বাড়িতে নেই।”
ইয়াসিরের সন্দেহ হয় কেন যেন। তবুও সে বলল,
“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”

মর্গান দাঁতে দাঁত ঘেঁষে। এই ছেলেকে সে খুব ভালো করেই জানে। এর আগাগোড়া সব জানে সে। কোনোমতেই তাকে ভেতরে আসতে দেওয়া যাবে না। মর্গান মাথা উঁচিয়ে বলল,
“নো। আই কান্ট অ্যালাউ!”
বলেই সে ভেতরে চলে যায়। পিছনে ইয়াসিরও পা বাড়ায়। কিন্তু দারোয়ান তাকে চেপে ধরে। আটকে রাখে তাকে, যেতে দেওয়া হবে না। ইয়াসির চিল্লিয়ে‌ বলে,
“হেই মিস্টার। মিস্টার, জাস্ট লিসেন টু মি!”
দারোয়ান ধাক্কিয়ে তাকে বাড়ির গেট থেকে বের করে দেয়। গেট লাগাতে লাগাতে বলল,
“কোথা থেকে শুধু আপদ জুটে!”
ইয়াসিরের মনে হয়, একবার তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? কিন্তু ভেবেও আর সে অনুযায়ী কাজ করে না। বাসার পথ ধরে সে।

******

বাসায় আসতেই ইয়াসির রাফিকে কিছুটা সুস্থ দেখতে পায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে সে। রাফির কাছে আসতেই রাফি বলল,
“কী দেখলাম এইসব? আমার এখনও মাথা ঘুরাচ্ছে ইয়াসির!”
ইয়াসির নিজের ভাবনায় মশগুল। রাফি হালকা করে ঝাঁকি দেয় তাকে। আবার বলল,
“মারিয়া?”
“জানি না। খুঁজে পাচ্ছি না।”
“মানে?”
ইয়াসির চুপ থাকে। খানিক পর বলল,
“ডেম ইট, শি’জ মিসিং!”
আবার বলল,
“তোর কি মনে হয়, আমাদের পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত?”
রাফি ভেবে বলল,
“এই বিষয়ে পুলিশ তোকে কোনো হেল্প এখন করবে না। চব্বিশ ঘণ্টা না হলে তারা মিসিং ডায়েরি করে না। আর এখন তো মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে এত কিছু হয়ে গেল!”
ইয়াসির হুম বলে চুপচাপ রাফির বরাবর বসে রইলো। কী করবে সে? কিছুই মাথায় আসছে না। এরই মাঝে রিমি রুমে আসে। ইয়াসিরকে চায়ের প্রস্তাব দিলেই সে বলল,
“না, শাওয়ারে যাব। তোরা খেলে খা!”

সেরাতে আর কারও ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া হলো না। রিমি রাফি দু’জনেই কিছুটা চমকিত! কারণ, এই ইয়াসিরকে তারা এর আগে কখনই দেখেনি। এত চিন্তিত সে কোনোদিনও ছিল না!

******

নিজ থেকেই মারিয়ার হুঁশ আসে। শরীরে বশ আসতেই ব্যথা রিরি করে উঠে। চোখ মুখ কুঁচকে সে কেঁদে দেয়। পিটপিট করে তাকায়। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার একটা রুম! চিৎকার করার চেষ্টা করলেও লাভ হয় না। চেয়ারের সাথে তার হাত, পা, মুখ সব বাঁধা। কোমরে বাড়ি খাওয়ার কারণে সোজা হয়ে বসতেও কষ্ট হচ্ছে। বাঁকা হয়ে পড়ে থাকে সে। মনে হয় কোমরের হাড় ভেঙেই গেল!

ফের এদিক ওদিক তাকায় মারিয়া। উ আ করে ডাক দেওয়ার চেষ্টা করে, পারে না। আলো, বাতাস কিছুই নেই এরুমে। নেয়ে ঘেমে অস্থির সে, সব চুল ভিজে ঘাড়ে লেপ্টে আছে। বিব্রত অবস্থা! এর উপর তীব্র ব্যথা।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here