মারিয়া,পর্ব:১৩

মারিয়া
পর্ব:- ১৩
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~~

খট করে একটা আওয়াজ হলো স্টোররুমের দরজায়। মারিয়া আগত শব্দের উৎস লক্ষ করে সামনে তাকায়। কেউ হয়তো গেট খুলে এই রুমেই আসবে। দরজা থেকে রুমটা ভালো দুরত্বে। অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেলেও মারিয়া নির্দিষ্ট দিকে আনমনে চেয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে জুতার শব্দ ভেসে আসে কানে। কে আসছে? তখনও তার দৃষ্টি স্থির!

লোকটা মর্গান। হাতে করে হাতুড়ির মতো দেখতে একটা যন্ত্র নিয়ে এসেছে। আস্তে ধীরে সামনে আসে সে। মারিয়া স্পষ্ট তার চেহারা দেখতে পায় না। তবুও বুঝতে পারে, এটা মর্গান ছাড়া আর কে হবে?
মর্গান এসে চেয়ারের চারদিকে ঘুরপাক খায়। হাতে থাকা লোহার যন্ত্রটা দিয়ে চেয়ারে মৃদু বাড়ি দেয়। এই মুহূর্তে চেয়ারে বাড়ি খাওয়ার শব্দ থেকে তীব্রতর মারিয়ার বুকের ধুকপুকানি। যতবার মর্গান চেয়ারে বাড়ি দিচ্ছে ততবার মারিয়ার বুকে কাঁপন ধরছে। হকচকিয়ে উঠছে বারবার! অপেক্ষা করে সে, কখন মর্গান তাকে একেবারে মেরে ফেলবে। তখনই মারিয়ার মস্তিষ্কে স্মৃতি আহরণ করে; ঐযে সেদিন! মারিয়া ছাদে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, মর্গানের মতো সাইকো লোকটা তাকে কীরূপ নিসৃংশ নির্যাতন করতে পারে। সেদিনের ভাবনা তবে কি ঠিক ছিল?

চেয়ারের পিঠে মর্গান এবার একটু জোরেই বাড়ি দিলো। মারিয়া কেঁপে উঠে। মুখ বন্ধ তবুও উ আ করে চিৎকার করার চেষ্টা করে। মর্গান পিছন থেকেই ওর ঘাড়ের কাছে এসে নাক দিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে। মারিয়ার গলার কাছটায় এসে নাক ঘষে। বিশ্রী অনুভূতি জাগ্রত হয় তার। মৃত্যুর আগে মেয়েটার সাথে একটু খেলা করে নেওয়া যাক! মর্গানের স্পর্শ পেয়েই মারিয়া এদিক ওদিক ঘাড় নাড়ায়। ছুটার উপায় নেই তবুও বৃথা চেষ্টা করে সে। বাঁধা হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করে। বিরক্তিতে মর্গান এবার মারিয়ার গাল চেপে ধরে। তাকে একদিকে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। ব্যথায় মারিয়া কুঁকড়ে যায়। চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দেয়, সে বিনতি করছে। তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক! সে তো কোনো দোষ করেনি। তার সাথে কেন এমন করা হচ্ছে?

মর্গান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সে বেপরোয়া! হিংস্র নেকড়ের মতো। কারও প্রতি মায়া দেখানোর সময় নেই তার। তার তো শুধু নিজের ক্ষুধা নিবারণ করার প্রয়োজন…

******

ভোরের আগ দিয়ে ইয়াসির মারিয়ার দেওয়া ব্যাগটা নিজের রুমে নিয়ে আসে। কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখে নিবে। বলা তো যায় না কোথায় কী থেকে যায়! ইয়াসিরের ভাবনায় আসে, মারিয়ার কাছে কোনো ফোন থাকলেও তো হতো। ওর সাথে যদি কোনোভাবে কনট্যাক্ট করা যেত? মর্গানই নিশ্চিত ওকে আটকে রেখেছে। এইটুকু কথা মস্তিষ্কে আসতেই ইয়াসিরের বুক ধরফর করে। যদি মারিয়াকে কিছু করে মর্গান? সে তো ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়!
তড়িঘড়ি করে ইয়াসির মারিয়ার ব্যাগ খুলে। ভেবে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ব্যাগ খুলতেই সবার আগে মারিয়ার শাড়ি, চুড়ি, নূপুর চোখে পড়ে তার। এগুলো তো তার মারিয়ার। তাহলে এই ব্যাগে কেন? মারিয়া কোথায় পেয়েছিল এগুলো? ইয়াসির মনে করার চেষ্টা করে, তাহলে সেই যে প্রথমদিন! সেদিন হ্যালুসনেশন হয়নি তার। সেদিন মারিয়াই এগুলো পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল! ইয়াসিরের ভ্রম হয়, তার চোখের সামনে মারিয়ার হাস্যোজ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠে। ক্ষণিক বাদেই সেটা দূর হয়ে যায়। বদলে ভেসে উঠে মারিয়ার কাতর চেহারা। মাথা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে সে। ব্যাগের ভেতরে অন্যান্য জিনিস দেখে। কাপড়চোপরের নিচেই মারিয়ার ফোন চাপা পড়ে আছে। এই ফোন এখন কোনো কাজের নয়। শিট বলে ইয়াসির ফোনটা আঁকড়ে ধরে। মারিয়ার ফোনও এদিকে। ফোনের পাওয়ার বাটন ক্লিক করতেই ডেড দেখায় ওটা। ফোনটা চার্জে লাগিয়ে দেয় ইয়াসির।

ব্যাগ গুছিয়ে আলমারির ভেতরে রেখে দেয় সে। তার এখন মারিয়াকে খোঁজা দরকার। উঠে রুম থেকে বের হয় ইয়াসির। রাফিদের রুমে নক্ করে আস্তে। সাথে সাথেই গেট খুলে যায়,
“ঘুমাসনি?”
রাফি রুম থেকে বের হয়ে আস্তে করে গেট চাপিয়ে দিলো। মুখে হুস শব্দ করে ইয়াসিরকে আস্তে কথা বলতে বলে। নিজেই ক্লিয়ার করে বলল,
“মাত্র ঘুমিয়েছে। জেগে যাবে।”
ইয়াসির মুচকি হাসে। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালোবাসে তাকে। ইয়াসির ড্রয়িং রুমের দিকে যায়। নিয়ন আলোর বাতিতেও রাফি স্পষ্ট ইয়াসিরের চিন্তাগ্রস্ত চেহারা অবলোকন করতে সক্ষম হয়। কাছে এসে বলল,
“ভেবেছিস কিছু?”
“আমি আবার ঐ বাড়িতে যাব। আমি নিশ্চিত মারিয়া বের হওয়ার সময় মর্গানের কাছে ধরা পড়ে যায়। আর মর্গান ওকে স্টোররুমেই আটকে রেখেছে।”
রাফি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,
“তুই কি আবার ঐ রুমে যাবি?”
“হুঁ!”
রাফি চুপসে যায়। ইয়াসির কি তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে? ঐ ভ্যাপসা নোংরা রুমে রাফি আর যাবে না। জীবনেও না! রাফির উদ্বিগ্নতা লক্ষ করে ইয়াসির। বুঝতে পেরে রাফিকে ভরসা দিয়ে বলল,
“তোকে আর নিয়ে যাব না। ভয় পাস না!”
“তুই একা যাবি?”
বলেও রাফি চুপ যায়। এরকম একটা মুহূর্ত, যে সে রাফিকে একাও যেতে দিতে চাইছে না। আবার, ও নিজেও সাথে যাবে না। ইয়াসির উঠে দাঁড়িয়ে রাফির কাঁধ চাপড়ে বলল,
“এখনই বের হবো। আর তোকে আপডেট দিব চিন্তা করিস না। তোরা সাবধানে থাকিস।”
ইয়াসির গেট খুলে বাইরে দাঁড়ায়। রাফি তখনও দ্বিধায়! ইয়াসির এবার রাফির পেটে হালকা ঘুষি দিয়ে বলল,
“আরে ব্যাটা! এত ভয় পাস কেন তুই? তুই না ডাক্তার? মানুষ কাটিস কীভাবে?”
“ইয়াসির, মজা করিস না। ঐটা আর এটা এক বিষয়?”
“না হোক। তবুও একই। শুধু তোরা মানুষকে সুস্থ করার জন্য কাটাকুটি করিস আর মর্গানের মতো লোকেরা খাওয়ার জন্য!”
রাফির চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ইয়াসির সিঁড়ি দিয়ে নামছে। রাফি পিছন থেকে আবার ডাক দিলো তাকে,
“তুই কি ওকে ভালোবাসিস ইয়াসির?”
ইয়াসির থমকে দাঁড়ায়। তার কানে বারবার রাফির বলা কথাটা বাজছে; “ভালোবাসিস?”
ঠোঁটে কোনাচে হাসি দিয়ে ইয়াসির রাফির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বলল,
“দ্বিতীয়বার ভালোবাসা সম্ভব না আমার পক্ষে! হয়তো একই চেহারার মানুষ যে। তাই মাঝে মাঝে মারিয়াকে খুব করে মনে পড়ে। হয়তো এটা ক্ষণিকের মায়া….”
বলেই সে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে যায়। রাফি আর কিছু বলতে পারলো না। দরজা লাগিয়ে রুমে চলে যায়।
রুমে যেতেই রিমিকে সজাগ পায় রাফি। রিমি দরজার কাছেই পায়চারি করছে।
“ঘুমাওনি?”
“ইয়াসির কোথায়?” রিমির কণ্ঠে উত্তেজনা ঠিকড়ে পড়ছে। সে চিন্তিত বুঝাই যাচ্ছে। রাফি অবাক হয়নি। সে জানে, রিমি ইয়াসিরের প্রতি দুর্বল। তবে জানে, শুধু বন্ধু হিসেবেই!
রাফি উত্তর দিলো,
“মর্গানের বাড়িতে গেছে।”
রাফির কথায় রিমি তেড়ে আসে। কলার চেপে ধরে বলল,
“পাগল তুমি? ওকে একা কেন যেতে দিলে? তুমি জানো না মর্গান কেমন লোক?”
রিমির চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। রাফি বেশ খানিকটা অবাক হয়। রিমির চোখে এই পানি কীসের… রাফির কাছে স্পষ্ট নয়! বন্ধু হারানোর নাকি অন্য কিছু?
রাফি পলকহীনভাবে রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি যেতে পারলে না ওর সাথে। ডেম ইট!”
বিষয়টা বরাবরই রাফিকে ধাক্কা দেয়। সে চুপচাপ রিমির থেকে একটু দূরে সরে আসে। রিমিও তার কলার ছেড়ে দেয়। দু’হাত কাছে এনে রাফির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি জানো, মর্গান কী না কী করতে পারে? আমি এত কষ্ট করে মারিয়ার থেকে ওর পিছু ছুটিয়েছি। এরা আসে কোথা থেকে? আসে তো আসে আমার ইয়াসিরের কাছেই কেন আসে? দুনিয়ায় ছেলেদের অভাব ছিল? আমি যখনই ইয়াসিরকে সবকিছু থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি তখনই একজনের পর একজন আসে। প্রথমে মারিয়া, এবার দ্বিতীয় মারিয়া।”
রিমি একদম ভেঙে পড়েছে। বাস্তবে না থেকে সে গড়গড় করে এতদিন মনে চেপে রাখা কথাগুলো রাফির সামনে বের করে দিচ্ছে। ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো সে। মাথার এলোমেলো খোলা চুলগুলো দু’হাতে আকড়ে ধরে চিল্লিয়ে বলল,
“ইয়াসিরের কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব? আমিই তো মর্গানকে মারিয়ার কথা বলেছিলাম। এখন যদি সে ইয়াসিরকে কিছু করে ফেলে, আমি কোথায় যাব?”

রিমির ধারণা নেই, সে রাফিকে কতটা হার্ট করছে। তার ভালোবাসার অসম্মান করছে! রিমি কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই পড়ে রইলো। রাফি আস্তে করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বাহিরে এসে সোফায় বসে পড়ে। এক এক করে তার সামনে সবকিছু স্পষ্ট হয়! অথচ এতদিন সে অন্ধবিশ্বাস করতো রিমিকে। রিমির প্রতি কী পরিমাণের দুর্বল সে, এটা হয়তো রিমি ছাড়া পুরো দুনিয়া জানে!
মানুষ বলে, ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু বুকের এই তীব্র ব্যথা রাফিকে চিৎকার করে কাঁদতে বলছে, এ ব্যথা সহ্য হওয়ার মতো না। প্রিয় মানুষগুলো যখন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাদের সাথে থাকা স্মৃতিগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রতিমুহূর্ত!
রাফি বোবা হয়ে গেছে। অজান্তেই তার চোখ বেয়ে অজস্র নোনাজল চুইয়ে পড়ছে। নিঃশ্বাসের শব্দও যেন রিমির কানে না পৌঁছে, রাফি নিজের হাত মুখে চেপে ধরে। কেউ কিছু না জানুক! তার রিমি শুধু ভালো থাকুক! ভালো থাকুক সে। সোফায় কাত হয়ে শুয়ে কুশন দাঁতে চেপে ধরে রাফি! এ সে কাকে ভালোবাসলো? এতদিন কেন তার চোখে এসব ধরা পড়েনি?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here