মারিয়া,পর্ব:৩

মারিয়া__পর্ব ০৩
কলমে: সায়ীদা নুহা।

অফিসের টুকটাক কাজে ব্যস্ত ইয়াসির। মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে একটু বিরতি নেয়, চা পান করে, আবার কাজে মনোযোগ দিচ্ছে। সময়কে থামিয়ে রাখতে সে নারাজ। সময়গুলো দ্রুত চলে গেলেই তার শান্তি। তার মানসিক ভার হালকা হয়!
খানিক বাদে অফিসের পিয়ন এসে সামনে দাঁড়ায়। তাকে ডেকে বলল,
“স্যার, আপনার নামে একটা খাম আর পার্সেল এসছে।”

ভ্রু কুঁচকে হাত বাড়ায় ইয়াসির। তার তো কোনো পার্সেল আসার কথা ছিল না। পিয়ন তার হাতে জিনিসগুলো ধরিয়ে দিতেই হাতের ফাইল সরিয়ে পার্সেল খোলার জন্য ব্যস্ত হয় সে। পার্সেল খুলতেই ভিতর থেকে বড়োসড়ো একটা কাঁচের ওয়ালমেট বেরিয়ে আসে। ওয়ালমেটের মূল জায়গাটা একটা কালো প্রজাপতি দখল করে রেখেছে, আশেপাশে ছোটো ছোটো প্রজাপতি। ইয়াসিরের মনে সূক্ষ্ম অনুভূতির ঢেউ খেলে। কে দিলো এটা?
একটানে খাম ছিঁড়ে ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে সে। চিঠি বললে ভুল হবে, এটা একটা চিরকুট।
সুন্দর কালিতে লেখা,
“শুভ জন্মদিন ইয়াসির সাহেব! জিনিসটা পৌঁছতে ঢের দেরি। ততদিনে আমি থাকব কী না জানি না! তাই আগেই আপনার উপহারটা দিয়ে আমার দায় কমিয়ে নিলাম।”

ব্যস! আর কিছু লিখা নেই। ইয়াসিরের ভ্রম হয়। কল্পনায় ভেসে ওঠে তার প্রেয়সীর ছবি। সে যত নিজেকে এর থেকে মুক্ত করতে চায়, তত‌ই তার স্মৃতি তাকে আঁকড়ে ধরে।
যতটুকু নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে, এই স্মৃতি এসে সব ভেঙে গুড়ে দিলো।
পার্সেলে আসা ওয়ালমেটের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইয়াসির। হাতের চিরকুটটা আবার পড়ে বুকপকেটে রেখে দেয়।
_____

দুপুরের দিকে কাজ সেরে আবার ডায়েরি নিয়ে বসে মারিয়া। বাকি পৃষ্ঠাগুলো পড়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে আছে। কেমন উদগ্রীব হয়ে ছিল সে! চাচি আপাতত বাড়িতে নেই। এরমাঝে অনেকটুকু পড়া যাবে। মারিয়া এইটুকু অন্তত বুঝেছে, এই ডায়েরিটা যার সে এই বাড়ির মালিক দম্পতির মেয়ে ছিল।
মারিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে ডায়েরির পাতা উল্টাতে থাকে। অনেক অজানা কিছু সে পড়ছে, জানছে। একটা পর্যায়ে মারিয়ার কাছে মনে হয়, সে পুরোপুরি এই মেয়েটা। এই মেয়েটা বাচ্চা ছিল না। সে বাচ্চা বেশে থাকতে পছন্দ করতো! এই বাড়ির অনেক অজানা রহস্য মারিয়ার কাছে ধরা দেয়। বুক ভেঙে আসে তার। মেয়েটা কত কষ্টে এই পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছিল! চোখের সামনে সে দৃশ্য ভাসতে শুরু করে। মারিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। ডায়েরিটা বুকের কাছে নিয়ে জড়িয়ে চুমু খায়। মনে মনে কঠিন এক প্রতিজ্ঞা করে বসে সে!
_____

বারবার ফোন বাজছে। সে খেয়াল নেই মারিয়ার। বিকেলের দিকে ঘুমিয়েছিল সে, অটাইমে বেকাজ! ফোনের রিংটোনও তার কানে যায় না।
বেশ কিছুক্ষণ পর বিধ্বস্তের মতো হুড়মুড় করে উঠে বসে মারিয়া। চোখ বন্ধ রেখেই ফোন রিসিভ করে। ওপাশ হতে মারিয়ার মায়ের ফোন।

“কী’রে? সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি?”
ঘুমঘুম চোখে বিরক্তি প্রকাশ পায়। হামি দিয়ে জবাব দেয়,
“ঘুমাচ্ছিলাম।”
“এটা ঘুমানোর সময়? এই অসময়ে ঘুমালি কেন?”
“উফ্ মা! ঘুম পেয়েছে ঘুমিয়েছি। বলো কী বলবে?”
“মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
মারিয়া চুপ করে থাকে। না মায়ের অবস্থান সে বুঝছে আর না মা তার অবস্থান বুঝছেন। ঘুম থেকে উঠে মারিয়ার মুড ফ্রেশ হতে আধা ঘণ্টা লেগে যায়। সে জানে, মা তাকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় ভুগছে। বাড়ির বড়ো মেয়ে কোনোদিনও এভাবে বাড়ির বাইরে একা একা থাকেনি। এই চাকরিটা আজকে প্রয়োজনহীন হলে মেয়েকে কখনো দূরে থাকতে দিতেন না সুরাইয়া সাহেবা; মারিয়ার মা।
ওপাশ থেকে সুরাইয়া সাহেবার কণ্ঠের গরম ভাবটা কমে আসে। শান্ত কণ্ঠেই বললেন,
“কাছে থাকিস না বলে তো তোকে দেখতে পারি না, কখন কী করছিস, কী খাচ্ছিস কিছুই জানতে পারছি না। নিজের খেয়াল রাখবি!”
“আচ্ছা! মা, বাবা কেমন আছে? আসার পর একবারও আমার সাথে কথা বলেনি!”

“আছে ভালো আছে!” বলেই ফোন কেটে দিলেন সুরাইয়া সাহেবা। মারিয়া কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। মা এমন হুট করে ফোন রেখে দিলো? বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই?
খারাপ কিছু ভাবতে চায় না সে। বাবার কিছু হলে মা অবশ্যই তাকে বলতো। এমনও হতে পারে তার কোনো কাজ পড়েছে, তাই ফোন রেখে দিলো।

উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় মারিয়া। নিচে নেমে আসতেই চাচির সাথে দেখা হয়। তাকে দেখেই মহিলা বললেন,
“ঘুম ভাঙলো তাইলে?”
মারিয়া মুচকি হেসে পাশে বসে।

দারোয়ান চাচা আর চাচির কথাবার্তা খুব সুন্দর। এখানের মানুষগুলো মার্জিত ভাষায় কথা বলে। তাদের কথার মধ্যে আলাদা টোন আছে। মধুর লাগে শুনতে! স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও মনে হয়, খুব শিক্ষিত একজন মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।

চায়ের সাথে চাচির সাথেও গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মারিয়া।
_____

সুরাইয়া সাহেবা ফোন রেখেই উঠে যান। মেয়েকে তার বাবার কথা ভুলেও বলা যাবে না। হাজার চেষ্টা করে সে এই চাকরি পেয়েছে। এখন যদি তার বাবার কথা তাকে জানায়, সব ছেড়ে চলে আসবে। আর সুরাইয়া সাহেবা এটা মোটেই চান না। তাদের পুরো ভার মারিয়ার চাকরির উপর। এই চাকরি হাত থেকে ছুটে গেলে তাদেরকে পথে বসতে হবে। দু’দুটো সন্তান নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন?

নিজের রুমে এসে বিছানায় বসলেন সুরাইয়া সাহেবা। পাশে তার স্বামী ঘুমন্ত অবস্থায়। মারিয়া যেদিন চলে যায় সেদিন তাকে বাস স্ট্যান্ডে দিয়ে, ফিরে আসার সময় রোড এক্সিডেন্ট করেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে অনেক টাকা যাবে। এত টাকা তার মেয়ে কোথা থেকে জোগাড় করবে? না আছে তার স্বামীর কোনো সঞ্চয়। ফার্মেসি থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে এনে খাবারের সাথে গুলিয়ে তিনবেলা করে খাওয়াচ্ছেন তিনি। তার ধারণা, ঘুমিয়ে থাকলেই ব্যথা চলে যাবে!
ছোটো ছেলেটা বারবার বলার পরও তিনি একটাবারের জন্য স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে যাননি।
_____

গল্পে মশগুল থাকা অবস্থাতেই মারিয়া চাচির কাছে এই বাড়ি সম্পর্কে জানতে চায়। চাচি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। পরমুহূর্তেই মারিয়া মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি এমনিই জানতে চাচ্ছিলাম।”

মহিলাটি তার দিকে কেন এভাবে তাকিয়ে ছিল সে বুঝলো না। এক পর্যায়ে আবার বলল,
“আচ্ছা, এই বাড়িতে কি কোনো মেয়ে থাকতো?”
সামনে বসা মহিলাটির চেহারায় এবার একটু বিষণ্ণতার ছাপ দেখা গেল! মুখ ভার করে বললেন,
“ছিল! খুব মিষ্টি একটা পরী ছিল এই বাড়িতে।”

কোথা থেকে দারোয়ান চাচা ছুটে আসলেন। এসেই স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“সাহেব নিষেধ করেছিল না, এই বাড়িতে যেন এই বিষয়ে কোনো কথা না উঠে?”

সাথে সাথে মহিলাটি নিশ্চুপ হয়ে যায়। মাঝে বসে মারিয়া শুধু এপাশ ওপাশ দু’জনের দিকে হাবাগোবা চেহারায় তাকিয়ে থাকে। পরিস্থিতি তার বুঝের না! দারোয়ান চাচা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“মারিয়া মা, শুধু জেনে রাখো এই বাড়িতে তার নামও উচ্চারণ করার অনুমতি নেই। আপনার কাছে অনুরোধ আপনি এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন আর করবেন না। আমরা আমাদের মালিকের অবাধ্য হতে পারি না!”
“কিন্তু এখন তো তারা বাড়িতে নেই!”
“উপস্থিতিতে হোক বা অনুপস্থিতিতে, আমরা তাদের গোলাম।”

মারিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। যা জানার তাকেই জানতে হবে! তারা দু’জন চলে যেতেই মারিয়া হল রুম ছেড়ে বাহিরে আসে। বাড়ির সামনে হলদে বাতি জ্বলছে। আবছা অন্ধকারে আশপাশ ঢাকা। সুদূর অবধি মারিয়া তাকায়। ছেলেটার কাছ থেকেও তার কিছু জানার আছে!

হাতে থাকা ফোনে ভাইব্রেট হয়। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ছোট্ট একটা মেসেজ এসেছে, “তোমার প্রিয়জন বিপদের মুখে!”
মারিয়া একপলক ঘাবড়ে উঠে। আবার শান্ত হয়ে যায়। তার এমন স্পেসিফিক কোনো মানুষ নেই! হয়তো রং নাম্বারে মেসেজ এসেছে। ফোন রেখে দেয় মারিয়া। সে ব্যস্ত বাড়ির রহস্য উদঘাটন করতে।

আমাদের সমস্যা এটাই! প্রিয়জন বলতে আমরা আমাদের পরিবার বুঝি না, বুঝি একজনকেই। সে হোক প্রেমিক কী প্রেমিকা!

দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে মারিয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইয়াসিরের অপেক্ষা করবে সে! বের হওয়ার আগমুহূর্তে একবার দারোয়ানের দিকে তাকায় সে। বাড়ির একপাশে গিয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। বের হয়েই মারিয়া বাড়ির থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে। কী আশ্চর্য! মারিয়া জানে না, ইয়াসির এখানে এই সময়েই আসবে কী না! তবুও তার অবচেতন মন তাকে জানান দিচ্ছে, এখানে ঠিক, রাস্তার এইপাশে দাঁড়িয়েই সে ইয়াসিরের জন্য বহু সন্ধ্যা অপেক্ষা করেছে!

গায়ের পাতলা চাদরটা টেনে দেয়ালে পথ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সময় গুনে মারিয়া। আর কিছুক্ষণ বাদেই হয়তো ইয়াসির আসবে। তাকে দেখে চমকে উঠবে! কিন্তু, এভাবে ইয়াসিরের জন্য মনে কিছু একটা অনুভব করার কারণ কী? সে তো তাকে ভালো করে চিনেও না!
ফোনে সময় দেখে মারিয়া। আর ২০/২৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। ঠিক ৭.৩১ বাজলে ইয়াসির এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসে। তাকে তখন অস্থির দেখায়! উদভ্রান্তের মতো সে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে। উদ্ভ্রান্ত!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here