মারিয়া,পর্ব:২

মারিয়া__পর্ব ০২
কলমে: সায়ীদা নুহা।

তখনও সূর্য তার আলো ছড়ায়নি। কেবল ভোরের ক্ষীণ আলো ভেসে আসছে। রাতের বৃষ্টিতে শহরের গরম আবহাওয়াটা অনেকটাই কেটেছে। ফুরফুরে হাওয়া!

কফি মেকারের টাইম আপ হয়। ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে নিচে নেমে আসে মারিয়া। ঘন দুধের মিশ্রণে কফি থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। শেষরাতে ভালো ঘুম হয়েছে, এখানের পরিবেশটা খুব শীতল!
বাড়ির পেছন দিকটা এখনও ঘুরে দেখা হয়নি। সকালে সেদিকটায় হেঁটে আসা মন্দ নয়!
নিচে নামতেই দারোয়ান চাচার সাক্ষাৎ ঘটে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“কিছু লাগবে নাকি মা?”
মারিয়া প্রফুল্ল মনে হেসে বলে,
“না চাচা! আমি এমনিই হাঁটতে বের হয়েছি।”
চাচা সায় দিলেন মারিয়ার কথায়। চেয়ার গুছিয়ে রুমে নিয়ে যাবেন, তখনই ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
“বেশি দূর যেয়ো না মা। জায়গাটা খুব..ই নির্জন!”
“আচ্ছা!”

কফির মগে চুমুক দিয়ে হাঁটা ধরে মারিয়া। বাড়ির সদর গেট থেকে কিছুটা দূরে গেলেই তার থেকে নজর সরে আসে কারো। হুডি পরা লোকটা উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। কে জানে, কী উদ্দেশ্যে সে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল!

এই বাড়ির লুকোনো এক ইতিহাস আছে। যেটা মারিয়া এখন অবধি জানে না। আরও অনেকটা সময় যেতে হবে…অনেক কিছু জানা বাকি তার!
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পিছন দিকেই চলে আসে সে। কাদায় ছড়াছড়ি। বৃষ্টি হলে এই এক সমস্যা!
মানুষের এই ব্যক্তিগত অভ্যাসটা জন্মগত; নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি ঝোঁক বেশি! চাচার কথাকে পাত্তা না দিয়ে সে পিছন দিকেই চলে আসে। এখনও তো এখানের দর্শন হয়নি!
জায়গাটা ছোটো পার্কের মতো, তবে অনেকদিন ধরে মানুষের আসা যাওয়া নেই এখানে। শুকনো পাতা দিয়ে ভরে আছে। তবে এখন সবগুলো পাতা বৃষ্টির পানিতে ভেজা। ভাঙা একটা দোলনাও ঝুলন্ত। দোলনার কাছে এসে মারিয়ার আফসোস হয়। ইশ, এটা ঠিক থাকলে যখন তখন এসে দোল খাওয়া যেত। আশেপাশে তাকায় মারিয়া, জায়গাটা খুব না অতিমাত্রায় নির্জন। দোলনার পাশেই বেঞ্চ পাতা। গাছের ভাঙা ডালের পাতা দিয়ে বেঞ্চটা মুছে বসে পড়ে সে। জামার ভেতরে লুকিয়ে আনা খয়েরী রঙের ডায়েরিটা চুপিচুপি বের করে কোলে রাখে। কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে ডায়েরিটা হাতে নেয়। মোটা একটা ডায়েরি, প্রথম পাতাতে গোটা গোটা অক্ষরে “প্রজাপতি” লিখা। লেখাটার কোণায় কোণায় আবার পেন্সিলের ডিজাইন করা। দক্ষ আর্টিস্ট আর্ট করেছে বুঝা যাচ্ছে। একদম নিখুঁত তার হস্তশিল্প! পাতা উল্টায় মারিয়া। ডায়েরির এ পাতায় আঠা দিয়ে বড়ো একটা নীল কালো মিশেলের নকল প্রজাপতি লাগানো। প্রত্যেকটা পাতা ধরে উল্টে দেয় মারিয়া। কোথায় কী আছে, একনজরে দেখার চেষ্টা। অবাক হয় সে, বিশাল কাহিনী লেখা এতে। প্রতিটা পাতায় পাতায় বিভিন্ন রঙের প্রজাপতির প্রতিরূপ। কিছু হাতে আঁকা, কিছু স্টিকার, কিছু কাগজের ছবি। আশেপাশে ভালো করে তাকায় মারিয়া। কাউকে এ ডায়েরি দেখানো যাবে না!

পাশের ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে হুট করেই একটা ছেলে বেরিয়ে আসে। পায়ের আওয়াজ শুনে দ্রুত ডায়েরি লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মারিয়া। তার আগেই ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। চেহারায় প্রশান্তির ছাপ! চোখ দু’টো স্থির হতে পারছে না। অনেকদিন পর প্রিয় মানুষদের দেখলে যেমন অস্থিরতা কাজ করে শরীর-মনে, ছেলেটির ঠিক সে অবস্থা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলেও বাস্তব তাকে চরমভাবে হেলা করছে। মারিয়া চোখ তুলে তাকায়। ছেলেটিকে খুব চেনা লাগে, অনুভূতির জোয়ার ভাসে তার মনে। ছেলেটিকে গতকালকেও দেখেছিল, বৃষ্টিতে ভিজে একাকার! পলকেই চোখ নামিয়ে নেয় মারিয়া। ছেলেটিই নিজ থেকে কথা বলে,
“আপনি কি এখানে নতুন?”
উঠে দাঁড়াল মারিয়া। ডায়েরিটা পিঠের পিছনে লুকোতে চাচ্ছে। স্নিগ্ধ কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, এইতো গতকাল উঠেছি।”
ছেলেটির মনে দ্বিধা, কৌতূহল, উদ্বিগ্নতা সব একসাথে জড়ো হচ্ছে। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এর আগে কখনও এখানে এসেছিলেন?”
মারিয়ার সোজা জবাব, “না!”

উৎসুক হয়ে মারিয়ার পানে চেয়েছিল ইয়াসির। মারিয়ার জবাব শুনে তার চেহারায় আঁধার ঢেকে যায়। মারিয়া চলে যেতে উদ্যত হলে ইয়াসির পথ আগলে দাঁড়ায়। মারিয়ার চোখ কুঁচকে যায়। ইয়াসির সেটা পাত্তা না দিয়ে হাতের ডায়েরিটার দিকে চোখ ইশারা করে বলল,
“এটা কি আপনার?”
মারিয়া একবার হাতে থাকা জিনিসটা দেখে। কী বলবে ভেবে পায় না। পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, এই ছেলে সত্যি না জানলেও কী?
দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো,
“না, আমার না। আমি শুধু দেখছিলাম।”
হায় হায় কী করল সে! সত্যি কথা বের হয়ে গেল কেন? আড়ালে জিভ কামড়ে ধরে মারিয়া।
ইয়াসিরের মনে তড়িৎ প্রবাহ খেলে যায়। চটজলদি মারিয়ার পথ ছেড়ে বলল,
“আপনাকে কষ্ট দিলাম। কিছু মনে করবেন না।”
বলেই যে পথ দিয়ে এসেছিল, সে পথে পা বাড়ায়। মারিয়া কিছু বলতে পারে না। যারপরনাই সে অবাক! একটা ছেলে দুম করে আসলো আর গেল…
কয়েক পা এগিয়ে ইয়াসির আবার দাঁড়ায়। মারিয়ার দিকে ফিরে বলল,
“ডায়েরিটা আমার খুব প্রিয় একজনের! আপনার পড়া শেষ হলে আমাকে দিবেন? এটা আমার খুব দরকার!”
চলে যায় সে। মারিয়া থ মেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ততক্ষণে ইয়াসির চলে গিয়েছে। সামনে তাকাতেই দারোয়ান চাচাকে এপথেই আসতে দেখে মারিয়া। চাচা কাছে এসেই বলল,
“কাজটা ভালো করলে না মা! না করেছিলাম এখানে আসতে।”
“চাচা, আমি তো এমনিই হাঁটতে হাঁটতে…”
“বাড়িতে চলেন মা। আপনার দেখা শোনার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া!”

মাথা নাড়িয়ে পা বাড়ায় মারিয়া।
নতুন একজন মহিলার সাথে পরিচিতি হয় তার। পরিচয়ে তিনি দারোয়ান চাচার স্ত্রী। বাড়ির ভেতরের সব ধরনের কাজ তিনি করেন। ঘর গোছগাছ থেকে রান্নাবান্না সব তার হাতে। মহিলাটিও খুব আন্তরিক। হেসে খেলে কথা বলছেন মারিয়ার সাথে। মারিয়াকে প্রথম দেখে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন, চোখ ভরে উঠে তার। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে মারিয়াকে আদর করে দেন।
মারিয়া অবাক হলেও তার ভালো লাগে। এখানকার মানুষরা কত্ত ভালো!

সকালে নাস্তার টেবিলে মারিয়ার সাথে‌ আলাপে মগ্ন হোন মহিলাটি। কী ডাকবে জিজ্ঞেস করতেই মহিলাটি ধীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে চাচিই ডাকো। আমার স্বামীকে তো চাচা ডাকলা, নাইলে বলতাম খালা আম্মা ডাকতে!”
দু’জনেই একসাথে হেসে উঠে। নাস্তা সেরে উঠতেই মারিয়ার গতরাতের কথা মনে পড়ে। দারোয়ান চাচা বাগানের গাছে পানি ঢালছেন। তার সাথে মারিয়ার কথা আছে। গত রাতের প্রসঙ্গে!
_____

“চাচা, কালকে রাতে আপনি কি এখানে কাউকে দেখেছিলেন?”
হাতের পানির পাত্রটা নিচে নামিয়ে রাখেন চাচা। নতুন গাছের টবটা ধাক্কা দিয়ে আরেকটু পিছিয়ে দেন। সোজা করে বসিয়ে বললেন,
“না তো! রাতে তো এদিকে কেউ আসে না।”

মারিয়া চিন্তিত হয়। তবে কে ছিল কাল রাতে?
সে চলে যেতেই চাচা আড়চোখে তাকায়।

রুমে এসে কাপড়গুলো গুছিয়ে নেয় মারিয়া। ফোন হাতে নিয়ে ভালো করে অফিস থেকে আসা মেসেজটা দেখে রাখে। কাল থেকে নতুন অফিসে জয়েনিং। নতুন জায়গা, নতুন বাড়িতে তো মানিয়ে নিয়েছে সে। নতুন অফিসের নতুন পরিবেশে কীভাবে চলবে, সেখানে গেলেই দেখা যাবে।
চাচি কাজ করছেন। মারিয়া একবার তাকে উঁকি দিয়ে দেখে আসে। রুমে এসে ভালো করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে লুকিয়ে রাখা ডায়েরিটা খুলে। বিছানায় আরাম করে বসে পড়তে শুরু করে।

ডায়েরিতে…
“এর আগে এখানে কখনও আসিনি আমরা। পরিবেশটা নতুন। আব্বু আম্মু বলছে, খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারব। দেখা যাক, এরপর কী হয়। তবে জায়গাটা বেশ ছিমছাম। ভয়ংকর সুন্দর শহর!
আজকেই শিফট হলাম এখানে। আগামীকাল আশেপাশে ঘুরে দেখব। কোথায় কী আছে!”

পৃষ্ঠা উল্টায় মারিয়া। ডায়েরিটা একটা বাচ্চার না যুবতী বা কিশোরীর, এখনই বুঝা যাচ্ছে না। গভীর মনোযোগ দেয় পড়ায়।

পরের পৃষ্ঠায়…
“এ শহরটা খুব আবেগী। যখন তখন কান্না করে। এইতো একটু আগেও ঝুম বৃষ্টি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি কান্নার সময়? আমি বের হবো তো এখন। ওমা! আমার কোনো কথাই শুনলো না। ইচ্ছে মতো কান্না করল। এখন নাকের বিচ্ছিরি সর্দি দিয়ে রাস্তা ভরে রেখেছে। আমি বের হবো কীভাবে?”

আপনমনে হেসে উঠে মারিয়া। এই ডায়েরিটা নিতান্তই একটা বাচ্চা মেয়ের। হাতের লেখা বড়োদের মতো হলেও তার লেখা কথাগুলো বাচ্চাদের মতো।

“আজকে খুব মাথা ঘুরাচ্ছে। গত তিনদিন ধরে মাথা ব্যথা, মাথার ভেতর জ্বলে। এই তিনদিন একটুও লেখার সুযোগ পাইনি। আশেপাশে খুব অন্ধকার দেখছিলাম। আব্বু আম্মুকে বললাম, তারা পাত্তাই দিলো না। যে যার কাজে ব্যস্ত! আমাকে বলল, ঠিক মতো না খাওয়ার জন্যে এই অবস্থা। কোথায়? এই বাড়িতে আমিই সবথেকে বেশি খাই! কেউ আমার ব্যথা অনুভব করে না…”

আচমকা মারিয়ার খারাপ লাগে। ডায়েরির পাতায় লেগে থাকা অক্ষরগুলো সে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। কেমন জীবন্ত মনে হয় তার কাছে। মেয়েটা কে?
_____

দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়াসির। সকালে দেখে আসা মেয়েটা দেখতে একদম তার প্রজাপতির মতো। হলদে রাঙা প্রজাপতি!
ক্যানভাসে আলতো আঙুল ছুঁয়ে দেয় ইয়াসির। নিজের হাতে আঁকা এ ছবিটা তার ভীষণ প্রিয়! হয়তো মেয়েটারও খুব প্রিয় ছিল…

“চলবে”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here