মারিয়া,পর্ব:১

খাটের নিচ থেকে ধুলোজমা একটা মাঝারি আকারের সিন্দুক বের করল মারিয়া। এখনও পুরনো বাসা-বাড়িতে সিন্দুক পাওয়া যায় ভাবতেই অবাক লাগছে তার। রাজা-বাদশাহদের সময়ের সিন্দুকের মতো দেখতে।
সিন্দুকটির উপর ধুলো জমে একেবারে আঁধার, কোনায় কোনায় ধুল জমে আছে। ফুঁ দিয়ে উপরের আলগা ধুল সরায় মারিয়া। সাথে করে আনা পাতলা কাপড়টি দিয়ে ভালো করে সিন্দুকের উপরিভাগ মুছতে শুরু করে।
চাকরির কারণে আলাদা বাসা নেওয়া তার। পুরো পরিবারকে ছেড়ে শহরের শেষ মাথায় চলে আসা। এদিকে কোলাহল কম। আর বরাবরই মারিয়ার শোরশব্দ কম পছন্দ। পরিবারকে ছেড়ে একা থাকতে হবে ভেবেও এই এক কারণে সে জায়গাটিকে পছন্দ করেছে; ভীষণ পছন্দ! বাসা পাল্টানোর সময় সে শুনেছে, এই দিকটায় প্রায়ই ভারী বর্ষণের দেখা পাওয়া যায়। রাস্তা ঘাট পানিতে ভরে যায়। সুবিধা-অসুবিধার হিসেব মিলালে অসুবিধাটা বেশিই। তবুও এই জায়গাটা মারিয়ার মনের গহীনে বিস্তার প্রভাব ফেলেছে। সে জায়গাটাকে ছাড়তে চাচ্ছে না।
বাড়ির মালিক মালকিন আর কিছুদিন পরেই ফিরে আসবেন। তারা থাকেন নিচতলায়। মধ্যবয়সী দম্পতি। কিছুদিন আগে গ্রামে বেড়াতে গিয়েছেন। মারিয়াকে দোতলার পুরোটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। অবাক হলেও মারিয়ার কাছে এটাও ভালো লাগলো, তারা খুবই আন্তরিক, বিনয়ী! শুরুর দিন থেকে মারিয়ার সাথে নিজের সন্তানের মতো ব্যবহার করছেন। এই দিকটাও মারিয়ার ভেতরে ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করছে।

সিন্দুকটি হালকা সুরমা রঙের। ওজনে বেশ ভারী! উৎসুক হয়ে মারিয়া সিন্দুকটি খুলতে উদ্যোগ নেয়। অনেকদিন কিংবা অনেক বছর ধরে এটা হয়তো রুমে পড়ে ছিল। কেউ আর খুলেনি বোধ হয়। সিন্দুকটির ঢাকনায় জ্যাম ধরে আছে। তালা খুলতে অনেক জোরজবরদস্তি করতে হয়। একপর্যায়ে বেশ জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই ঢাকনা খুলে যায়। হাতের আঙুলে খানিক কেটে গেলেও পাত্তা দেয় না সে। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে একধরনের ভ্রম ধরেছে। এই সিন্দুকের ভিতরে কী আছে সেটা না দেখা পর্যন্ত মনের ভেতরে একরকম অস্থিরতা থেকেই যাবে।

সিন্দুকটি খুলতেই মারিয়া চমকে উঠে। ভিতরে সিঁদুরে লাল রঙের মসৃণ রেশমি শাড়ি। কাপড়টায় সযত্নে স্পর্শ করে সে। সাথে সাথেই তার শরীরে অদ্ভুত ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যায়। শরীর কেঁপে উঠে চকিত!
শাড়ির পাশেই ভারী গোছের নূপুর রাখা। নূপুরদুটি দেখে যে কেউই আন্দাজ করতে পারবে, যিনি এই নূপুরের মালিক তিনি এসব জিনিসে খুবই শৌখিন। রূপার একজোড়া নূপুরের মাঝে পিত রঙের পাথর বসানো । কত বছর আগের এ সিন্দুক, কে জানে? ভিতরের জিনিসগুলোই বা কত বছর পুরনো তা জানা নেই! ধীরে ধীরে মারিয়া সযত্নে হাত রাখে জিনিসগুলোর উপর। এই জড়পদার্থের প্রতিও তার অন্যরকম মায়া জন্মাচ্ছে। এখানে আসার পর থেকেই সে অন্যরকম সব অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এসব সে আগে থেকেই চিনে। তার খুব কাছের কেউ এগুলোর মালিক! আলতো নরম হাতে জিনিসগুলো ছুঁয়ে দেখতে থাকে মারিয়া। নিমিষেই তার মাঝে দুর্বলতা ছেয়ে যায়। খুব করে ইচ্ছে করে, এই জিনিসগুলো পরে সে আয়নার সামনে দাঁড়াবে। নিজেকে খুব গাঢ় নজরে দেখবে। মসৃণ কাপড়ের শাড়িটা বুকের কাছে জড়িয়ে নেয় মারিয়া। মুখ নিচু করে শাড়িটি থেকে ঘ্রাণ নেয় সে। ঘ্রাণটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে!
___

প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে শহরে। পানি উঠছে রাস্তায়। অলিগলি কাঁদা পানিতে ভরপুর। ভেজা শরীর নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা দোতলা বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় ইয়াসির।
দাঁড়িয়েই হাত ঝেড়ে চুলের পানি ঝাড়তে থাকে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে পানি চেপে আনে হাতের মুঠোয়। পিছনে তাকিয়ে একবার বাড়ির ভিতরে দেখার চেষ্টা করে সে। সদর দরজা খোলা থাকলেও ভিতরের কালো রঙের দরজাটা বন্ধ। বাতাসে দরজার সামনের ঝুলন্ত ডিংডং বেলটা জোরে ঝুলছে। কানে বাজছে ওটার তীব্র শব্দ।

কিছুক্ষণ বাদেই বৃষ্টি কমে আসে। ইয়াসির সামনে পা বাড়ায়। কাঁদায় পিছলে যেতে নেয়, পাশের দেয়াল ধরে ভার সামলাতে সক্ষম হয় সে। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে বাড়িটির দোতলায়। একটা মেয়ে সিঁদুরে লাল রঙের শাড়ি পরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত ভর্তি কাঁচের রেশমি লাল চুড়ি। চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ইয়াসির চমকে তাকায়। এক পলকেই সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়! কিন্তু মেয়েটি তাকে দেখছে না; চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে না ইয়াসির। নিজে থেকেই সামনে পা বাড়ায়। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে সামলে হাঁটতে শুরু করে। মন চাইলেও দ্বিতীয়বার আর পিছন ঘুরে মেয়েটাকে দেখে না। কেন যেন তাকে আর দেখতে ইচ্ছে করছে না!

ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে মারিয়া। ঠোঁটে মুচকি হাসি লেগে আছে তার… বারান্দায় আরেকটা ঝুলন্ত ডিংডং বেল আছে। মারিয়া সেটায় একবার বাড়ি দিয়ে বৃষ্টি শেষ হয়ে যাওয়া আবহাওয়া উপভোগ করে। বাহিরে এখনও মৃদু শীতল বাতাস বইছে!
আশেপাশে লোকমুখে শোনা কথা তবে সত্যিই! এ শহরে হুটহাট ঝুম বৃষ্টি নামে। শহর তলিয়ে যায়। বাড়ির গেটের কাছেই পানি জমে গিয়েছে। দারোয়ান চাচা সন্ধায় আসবেন। তখন হয়তো তিনি সামনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিবেন। মারিয়া আর কিছু ভাবে না। ছেলেটাকে দেখার পর থেকেই তার মধ্যে অন্য এক সত্তা জাগ্রত হচ্ছে। মনে উথাল পাতাল ঢেউ খেলছে!

আর অল্প কিছু মুহূর্ত থেকে ভেতরে চলে যায় মারিয়া।
_____

হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে শেষ টান দেয় ইয়াসির। মাথা ভন ভন করছে, চোখ তুমুল পরিমাণে জ্বলছে। তবুও মস্তিষ্ক থেকে গত হ‌ওয়া স্মৃতি সরছে না। সে দৃশ্য গায়েব হচ্ছে না। কী করলে সে সব ভুলতে পারবে? বিড়বিড় করে উঠে ইয়াসির। অন্য কাজে মন দিতে চায় সে। তবুও পারে না…

পাগলের মতো নিজের রুম থেকে দৌড়ে ছুটে আসে। উদভ্রান্তের মতো রুমের এ মাথায় ও মাথায় ছুটতে থাকল। দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে রেখেছে। সব ছেড়ে দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এটা আদৌ সম্ভব না! সে স্বার্থপর হতে পারে না… এ শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে মারিয়ার স্মৃতি আছে। ইয়াসিরের প্রতি মুহূর্তের নিঃশ্বাসের সাথে মারিয়ার স্মৃতি ভাসমান হয়!
মাটিতে আছড়ে পড়ে ইয়াসির। চোখদু’টো টকটকে লাল হয়ে আছে। হাঁপিয়ে উঠছে সে। ক্লান্ত শরীর ভার ছাড়তে প্রস্তুত। চোখ বন্ধ করার শেষ মুহূর্তেও ইয়াসিরের কল্পনায় লাল শাড়ি পরা নারীমূর্তিটির চেহারা ভেসে উঠে।
_____

মারিয়া আবার বারান্দায় আসে। নিচে দারোয়ান চাচা বাড়ির সামনের রাস্তা পরিষ্কার করছেন। মারিয়া তাকে দেখেই নিচে নেমে আসে। গায়ে ভালো করে পাতলা শাল জড়িয়ে চাচার সামনে এসে দাঁড়ায়।
দারোয়ান চাচা এক পলক মারিয়াকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে তোলেন চেহারায়। মারিয়াও ফিরতি হাসি দেয়। চাচা নিজেই কথা বললেন,
“নতুন জায়গা কেমন লাগছে মা?”
মারিয়া আশেপাশের অন্ধকার পরিবেশে নজর বুলিয়ে বলে,
“খুব ভালো!”
“বেশ, ভালো লাগলেই হয়। সামনে আরও ভালো লাগবে!”
“কেমন?”
“এই বাড়ির মালিক খুব ভালো। তাদের সাথে সময় কাটালেই বুঝতে পারবে।”
হাতের কাজ থামিয়ে এক মুহূর্ত মারিয়াকে পরখ করলেন চাচা। চাপা কণ্ঠে বললেন,
“যদি মেয়েটা থাকতো, আরও ভালো লাগতো তোমার।”
চমকে উঠে মারিয়া। চাচা কার কথা বলছেন? কোন মেয়ে?
“কে চাচা?”
চাচা চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। উত্তর দিবেন তখনই মারিয়ার হাতের ফোন বেজে উঠে। মা কল দিয়েছেন। তড়িঘড়ি করে উপরে চলে যায় সে।
চাচা আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেন। কাজ শেষে সব গুছিয়ে বাড়ির সদর গেট ভালো করে লাগিয়ে দিলেন। মিহি বাতাস বইছে, ঠান্ডা আবহাওয়া। আবার বৃষ্টি নামে কী না!
দারোয়ান চাচার জন্য একপাশে আলাদা রুম বরাদ্দ আছে। সেখানে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখা। চাচা বই পড়তে পছন্দ করেন। যেটা এ বাড়ির মালিকের খুব পছন্দ। তাই, বই কেনার সময় তিনি দু’টো বই বেশি কেনেন। চাচার অবসর সময়ের জন্য!
হাত মুখ ধুয়ে চাচা নিজের ঘরের চুলোয় পানি বসালেন। চার/পাঁচ কাপ রং চা বানালেন। সারারাত এই চা খেয়েই তিনি সজাগ থাকেন আর বাড়ি পাহারা দেন। চা হতেই এককাপ চা নিয়ে তিনি বাহিরে খোলা জায়গায় চেয়ার পেতে আরাম করে বসলেন। একটা বই নিয়ে এসেছেন সাথে। নাম, “অমাবস্যার চাঁদ”।
_____

মাত্রই মায়ের সাথে কথা বলা শেষ হয়েছে মারিয়ার। ফোনটা বিছানায় রেখে ফ্রেশ হতে যায়।

ওপাশে মারিয়ার মাকে উদ্বিগ্ন দেখায়। তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে আছে।

সারাটাদিন কাজ করেছে মারিয়া। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

রাত ঠিক বারোটা।
হুট করেই মারিয়ার কাচা ঘুম ভেঙে যায়। মাত্রই চোখ বুজেছিল সে। এপাশ ওপাশ ঘুরেও কাজ হলো না। অগত্যা উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ফুরফুরে হাওয়ায় নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায়। এদিকে ওদিকে চোখ বুলায় মারিয়া। হঠাৎ করেই বাড়ির ঠিক সামনেই অন্ধকারে একটা আবছায়া দেখতে পেল সে। ভালো করে সেখানে উঁকি দিতেই আবছায়াটি দৌড়ে চলে যায়। রাতের এ প্রহরে এসে মারিয়ার ভেতর ভয় জড়ো হয়। চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কাঁথা টেনে গুটিসুটি হয়ে পড়ে রইলো!
কপাল জুড়ে ঘাম জায়গা করে নিয়েছে।

“মারিয়া”
পর্ব_০১
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here