মায়ারণ্যে পর্ব -১৯

#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-১৯

★ অরণ্যের অগ্নিদৃষ্টি মায়ার হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মায়া ভয়ে ভয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
–আ আপনি???

অরণ্য একইভাবে থেকে রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো।
–কেন আমাকে দেখে খুশী হওনি বুঝি?
কথা বলতে বলতে অরণ্য উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে মায়ার দিকে এগিয়ে এলো। দৃষ্টি তার এখনো ধারালো। মায়া বেচারির কলিজা শুঁকিয়ে যাচ্ছে। অরণ্য মায়ার কাছে এসে হাত উঠিয়ে মায়ার কপালে থাকা চুলগুলো আলতো করে কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বললো।
–বলনা? খুশি হওনি আমাকে দেখে?

মায়া তো পুরো জমে গেছে কথা কি বলবে। শুধু শুকনো ঢোক গিলছে। অরণ্য মায়ার কানের কাছে ঝুকে বললো।
–বলনা, ও…য়া…ই…ফি…

এবার মায়ার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। কি বললো উনি? ওয়াইফি? তা তারমানে উনি সত্যি সত্যিই সব জেনে গেছে? কিন্তু কিভাবে? কে বললো উনাকে? মায়া বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরণ্যের দিকে। অরণ্যও তাকালো মায়ার দিকে। চেহারার কঠিনতা হঠাৎ আরও বাড়তে লাগলো। সাথে শক্ত হতে লাগলো মায়ার চুলের মাঝে থাকা অরণ্যের হাতের বাঁধন। মায়া ব্যাথা পেলেও তা বাইরে প্রকাশ করলো না। অরণ্য মায়ার চুল শক্ত করে ধরে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো।
–ইয়েস ওয়াইফ? তুমি কি ভেবেছিলে আমি কখনো জানতে পারবো না? সারাজীবন অন্ধকারে রেখে আমাকে ঠকাবে? কিন্তু অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, তোমার সেই প্ল্যান ফ্লপ হয়ে গেছে। হ্যাঁ আমি সব জেনে গেছি। তুমি কি ভেবেছিলে আমার কাছ থেকে এখানে পালিয়ে এসে তুমি নিস্তার পেয়ে যাবে? কখনোই না। আমার সাথে যে অন্যায় করেছ তার হিসাব তো তোমাকে দিতেই হবে।

মায়া কিছুই বলছে না। মনের আর শারীরিক কষ্টের প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুধু মায়ার চোখ দুটো বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। অরণ্য সেটা দেখে আরও রেগে গিয়ে বললো।
–একদম কাঁদবে না। তোমার এই মিথ্যে কান্না আজ আমাকে ভোলাতে পারবে না। আমার জীবনটাকে একটা হাস্যকর খেলায় পরিনত করে এখন তুমি চোখের পানি দেখাচ্ছ? আর আমার বুকে যে এতদিন রক্তক্ষরণ হয়েছে তার কি হ্যাঁ?

অরণ্য এবার মায়াকে ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো।
–তুমি জানো এতদিন আমি কিভাবে বেঁচে ছিলাম? ভুল কাওকে বিয়ে করেছি ভেবে আমার জীবন টা নরকে পরিনত হয়ে গিয়েছিল।রাতদিন শুধু একটাই আপসোস হতো আমি কেন সেদিন তোমাকে দেখতে গেলাম না। অথচ আমি জানিই না যে আমার বিয়েটা ঠিক মানুষের সাথেই হয়েছে । শুধু আমাকে দিনের পর দিন ঠকানো হয়েছে।

মায়া শুধু মাথা নিচু করে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। মুখ খুলে কিছুই বলছে না। সে চাইলেই বলতে পারে সে কিভাবে বাধ্য হয়েছে এসব করতে। তবুও সে বলবে না কিছু। যেভাবেই হোক না কেন অন্যায় তো সে করেছে। অনেক বড়ো অন্যায়। তাই অরণ্য ওকে যা খুশী তাই বলুক। ও কিচ্ছু বলবে না। অরণ্য আরও বলতে লাগলো।
–তুমি জানো তুমি কতবড় পাপকাজ করেছ? আরে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক টাকে তুমি মজা বানিয়ে দিয়েছ। নিজের স্বামীর ঘরে একটা পরনারী এসে জায়গা করে নিল। অথচ তুমি কিছুই বললে না। এতদিন একটা পরনারী আমার ঘরে ছিল। ভাবতেই আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আল্লাহ না করুক যদি আমি ওই মেয়েটার সাথে কোন শারিরীক সম্পর্ক গড়ে ফেলতাম? তখন? আমি কতবড় পাপের ভাগিদার হতাম তুমি বুঝতে পারছ তা? শুধু আমি না আমার সাথে সাথে তুমিও সমান পাপের ভাগিদার হতে। এসব জানা সত্বেও তুমি চুপ ছিলে। একটা বারও আমাকে সত্যি টা বলোনি। আচ্ছা চলো মানলাম তুমি হয়তো প্রথমে সবকিছু জানতে না। তোমার মামী তোমাকে অন্যকিছু বুঝিয়েছে। তাই তুমি চুপ থেকেছ। কিন্তু পরে যখন সবকিছু জানলে তখন কেন বললে না?

অরণ্য মায়ার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে বললে।
–তোমাকে বলেছিলাম না আমি? বলো বলেছিলাম না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা? তারপরেও কেন আমাকে সত্যি টা বললে না? বলো? তোমার চোখের সামনে আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে তারপরও কেন কিচ্ছু বললে না?

মায়া চাইলেই বলতে পারে সেদিন ওর মামীর জন্য ও বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। কিন্তু সেটাও বললো না মায়া। শুধু চুপচাপ অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। আর অরণ্য বলতে লাগলো।
–জানো কত কষ্টে ভুগেছি আমি? নিজের স্ত্রী হওয়া সত্বেও তোমার কাছে গেলে মনের মাঝে অপরাধ বোধ কাজ করতো। সেদিন যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে জানো কি অবস্থা হয়েছিল আমার? প্রাণহীন দেহ হয়ে গিয়েছিল আমার। নিজের বৈধ স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েও মনের মাঝে অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এটা যে কতটা খারাপ ফিলিং তোমাকে ভাষায় বোঝাতে পারবোনা। তুমি সেটা কিভাবে বুঝবে। তোমার মনে তো সেই অপরাধ বোধ আসে নি। কারণ তুমি তো জানতে তুমি তোমার স্বামীর সাথেই মিশেছ। অন্যায় করেছ তুমি। অনেক বড়ো অন্যায়। যার জন্য আমি তোমাকে কোনদিন মাফ করতে পারবোনা।

কথাগুলো বলে অরণ্য মায়াকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে এসে দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। তারপরে বলে উঠলো।
–দুই মিনিট আছে তোমার কাছে নিজের ব্যাগ ঘুছিয়ে নাও।

মায়া চমকে উঠে বললো।
–মা মানে??

অরণ্য মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি নিশ্চয় হিন্দিতে বলিনি? ব্যাগ গোছাতে বলেছি। এখুনি আমার সাথে যাচ্ছ তুমি।

–কে কেন? দে দেখুন আমি….

মায়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই অরণ্য বলে উঠলো।
–আমি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করিনি। চুপচাপ যা বলেছি তাই করো। আর হ্যাঁ এটা ভেবনা আমি তোমাকে আমার বউ হিসেবে ওবাড়িতে সংসার করতে নিয়ে যাচ্ছি। মোটেও না। তুমি আমার সাথে যে অন্যায় করেছ তার জন্য তোমাকে আমি এতো সহজে রেহাই দেব ভেবেছ? শাস্তি তো তুমি পাবে। বড়ো কঠিন শাস্তি। যেটা তোমাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে। তুমি কি ভেবেছ এখানে এসে লুকিয়ে থাকলে তুমি পার পেয়ে যাবে? তোমার শাস্তি এতো ছোট না। শাস্তি তো তুমি পাবে। তবে সেটা আমি দেব তোমাকে। আমার সাথে থেকে আমার চোখের সামনে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমি তোমাকে প্রতিটা মুহূর্তে বোঝাবো আমাকে ধোঁকা দেওয়ার পরিনাম কি ভয়াবহ। এতদিন শুধু আমার ভালোবাসা দেখেছ। আজ থেকে আমার ঘৃণা দেখবে তুমি।

–দে দেখুন..

অরণ্য এবার রেগে গিয়ে মায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কপালের রগ ফুলিয়ে বললো।
–ব্যাস তোমার টাইম শেষ। দরকার নেই তোমার কিছু গোছানোর। আমার এতটাকা অন্তত আছে যে তোমার মতো একটা মেয়ের প্রয়োজনীয় সবকিছুই এনে দিতে পারবো। যেমন আছ তেমনই চলো।
কথাটা বলে মায়ার হাত ধরে একপ্রকার টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এলো। অরণ্য হাতটা এতটাই শক্ত করে ধরেছে যে মায়ার হাতের রক্ত প্রায় জমে যাচ্ছে। তবুও মায়া মুখ দিয়ে কোন টু শব্দও বের করছে না। হোক কষ্ট। এটাতো ওর প্রাপ্য ছিল। স্বামীর দেওয়া সব শাস্তিই সে মাথা পেতে নিবে। স্বামীর দেওয়া শাস্তিও যে তার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।

অরণ্য মায়ার হাত ধরে আগে আগে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আর মায়া শুধু অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে দেখছে অরণ্যকে। শাস্তি ভোগ করার জন্য হলেও সে যে তার স্বামীর সামনে থাকতে পারবে এটাই বা কম কিসের। এতটুকু খুশিও যে তার ভাগ্যে আসবে সেটাই তো সে ভাবেনি।

অরণ্য মায়াকে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। সারা রাস্তায় আর কেউ কারোর সাথে কোন কথা বললো না। অরণ্য মায়ার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। তবে মায়া কয়েকবার আরচোখে অরণ্যকে দেখছে।
____

বাসার সবাই টেনশনে বসে আছে ড্রয়িং রুমে। অরণ্য যেভাবে রেগে বের হয়েছে বাসা থেকে। নাজানি কি করে বসে। সে ফিরে না আসা পর্যন্ত এদের টেনশন দূর হবে না। অনেক বার করে ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ফোনও ধরছে না অরণ্য।

একটু পরেই অরণ্য মায়াকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। বাসার দরজা খোলাই ছিল। অরণ্য একই ভাবে মায়ার হাত ধরে এক প্রকার টানতে টানতে বাসার ভেতর নিয়ে এলো।বাসার সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তবে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কারণ জানে রাগের মাথায় অরণ্যের এখন কোন হুঁশ নেই। অরণ্য কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা মায়াকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগলো। মায়া একবার অপরাধী চোখে সবার দিকে তাকালো। তবে নিজের অপরাধ বোধের জন্য বেশিক্ষণ তাকতে পারলো না। চোখ নামিয়ে নিয়ে অরণ্যের সাথে সাথে যেতে লাগলো।

বেচারি মায়ার জন্য সবার অনেক মায়া লাগছে। অরণ্য যে পরিমাণে রেগে আছে, নাজানি বেচারির কি হাল করে।

অরণ্য মায়াকে নিয়ে অন্য একটা রুমে এলো।রুমে এসে মায়াকে টান দিয়ে বেডের ওপর ফেলে দিলো।মায়া ওভাবেই মাথা নিচু করে বসে রইলো।অরণ্য হাতটা এতো শক্ত করে ধরেছিল যে হাতটা কেমন অবস লাগছে ওর। মায়া একটু চোখ ঘুরিয়ে দেখলো এটা অরণ্যের রুম না। কিন্তু অরণ্যকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। ভাবলো হয়তো ওকে এই রুমেই থাকতে দিবে। অরণ্য তখন উচ্চস্বরে বাসার কাজের মেয়েটাকে ডেকে উঠলো। একটু পরে মেয়েটা দৌড়ে এসে বললো।
–জ্বি ভাইজান কিছু বলবেন?

–হ্যাঁ শোন,আমার আগের রুম থেকে আমার সব জিনিসপত্র এই রুমে আন। আমি এখন থেকে এই রুমেই থাকবো।

মেয়েটা মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–জ্বি ভাইজান এখুনি আনছি ।

অরণ্যের কথায় মায়া একটু অবাক চোখে অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্য মায়ার চাহুনি বুঝতে পেরে বললো।
–এতো অবাক হচ্ছো কেন? তোমার হয়তো কিছু যায় আসে না। তবে আমার বাঁধে। যে ঘরে ওই নির্লজ্জ মেয়েটা এতদিন আমার বউয়ের অধিকারে থেকেছে। সেখানে আমি এক সেকেন্ডের জন্যেও থাকতে পারবো না।

অরণ্যের কথায় মায়ার অপরাধ বোধ আরও বেশি জেগে উঠলো। সে আর তাকাতে পারলোনা। আবারও মাথা নুইয়ে ফেললো। একটু পরে কাজের মেয়েটা এক এক করে সব জিনিসপত্র আনতে লাগলো। অরণ্য ধীরে ধীরে সব সেট করতে লাগলো।মায়া একবার উঠে গিয়ে অরণ্যের কাজে হেল্প করতে চাইলো।কিন্তু অরণ্য হাত উঠিয়ে তাকে মানা করে দিল। অগত্যা মায়া শুধু এককোনায় জড়সড় হয়ে বসে রইলো।

তনিমা বেগম একবার অরণ্যের রুমে যেতে চাইলো। কিন্তু ইরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো। –থাক মা। এখন অরণ্যের কাছে না যাওয়াই ভালো। ও একটু শান্ত হোক। কাল আমরা ওর সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো। এখন রাত অনেক হয়েছে সবাই গিয়ে শুয়ে পড়ো।
ইরিনের কথামতো সবাই যারযার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

অরণ্যের সবকিছু গোছাতে গোছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। সব গোছানো শেষে অরণ্য ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে অরণ্য দেখলো মায়া রুমে নেই। ভ্রু কুঁচকে এলো অরণ্যের। হাতের তোয়ালে টা নেড়ে দেওয়ার জন্য ব্যালকনিতে আসতেই দেখলো মায়া নিচে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। এটা দেখে অরণ্যের রাগ আরও বেড়ে গেল। অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের সুরে বললো।
–কি হচ্ছে এখানে??

অরণ্যের কথায় মায়া ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। অরণ্য আবারও বললো।
–তুমি এখানে কি করছ?

মায়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আপনি নিশ্চয় এখন ঘুমাবেন। তা তাই আমি এখানে এসেছি। রুমে থাকলে আপনি নিশ্চয় ডিসটার্ব হবেন। আপনি চিন্তা করবেন না আমি আপনাকে একদম বিরক্ত করবোনা। আমি এখানেই চুপচাপ শুয়ে থাকবো।

মায়ার এমন অতিরিক্ত চারলাইন বেশি বোঝা দেখে জাস্ট শরীর জ্বলে যাচ্ছে অরণ্যের। অরণ্য দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–এখানে কোন টিভি সিরিয়াল চলছে? এসব ফালতু আইডিয়া তোমার মতো ইডিয়টের মাথায়ই আসতে পারে। এসব শারীরিক কষ্ট তোমার জন্য অনেক ছোট শাস্তি। তোমার শাস্তি এর থেকেও অনেক বড়ো হবে। তাই এখন চুপচাপ গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ো। আমি চাইনা আমার দেওয়া শাস্তি ভোগ করার আগেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকো। তোমাকে যে এখনো অনেক কিছু ভোগ করতে হবে। তাই এইমুহূর্তেই বেডে গিয়ে শুয়ে পড়বে।

মায়াও আর কথা না বাড়িয়ে মাথা ঝাকিয়ে উঠে রুমে গেল।রুমে এসে বেডের একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো। অরণ্যও রুমে এসে মায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিনের ক্লান্তির কারণে মায়ার চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এলো। তবে ঘুম নেই অরণ্যের চোখে। অরণ্য মাথা ঘুরিয়ে মায়ার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো। কতো শতো মায়া নেমে এসেছে ওই মাছুম মুখটাতে। অরণ্য যতই রেগে থাকুক মায়ার মায়াবী মুখটার দিকে তাকালে যে তার সব রাগ পানি হয়ে যায়। অরণ্যের খুব ইচ্ছে করছে মায়াকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাতে।

অরণ্য আস্তে করে উঠে এসে বেডের কাছে মায়ার মুখোমুখি হয়ে নিচে হাঁটু গেড়ে বসলো। ডান হাতটা উঠিয়ে আলতো করে মায়ার গালে রাখলো। মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো।
–কেন করলে এমনটা সন্ধ্যামালতী? আজ তোমাকে এতো কাছে পেয়েও বুকে টেনে নিতে পারছিনা। আমি চেয়েও তোমাকে মাফ করতে পারছিনা। আর না পারছি তোমার থেকে দূরে থাকতে। জানিনা কতদিন নিজেকে শক্ত রেখে তোমার থেকে দূরে থাকতে পারবো। তবে এবার কিছু শাস্তি তোমাকেও পেতে হবে। কিছুদিন আমার দহনে জ্বলতে হবে। তারপর তো তোমাকে আমার বাহুডোরেই আসতে হবে।

হঠাৎ অরণ্যের নজর পড়লো মায়ার হাতের ওপর। হাতের ওপর আঙুলের ছাপ কেমন কালো হয়ে গেছে। বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো অরণ্যের। ওর বুঝতে বাকি রইলো না যে এই জখম ওরই দেওয়া। নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো ওর। রাগের মাথায় ওর সন্ধ্যামালতীকে কিভাবে পারলো এমন আঘাত করতে। অরণ্য দ্রুত গিয়ে কাবার্ড থেকে অয়েন্টমেন্ট নিয়ে এলো। তারপর সযত্নে সেটা মায়ার হাতে লাগিয়ে দিল। অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষে মায়ার কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিল। মায়া একটু নড়েচড়ে উঠলো। সেটা দেখে অরণ্য দ্রুত উঠে গিয়ে আবারও ডিভানে শুয়ে পড়লো। মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়লো।
_____

সকাল ৭ টা
তনিমা বেগম সহ বাসার বাকি মহিলারা মিলে সকালের নাস্তার তৈয়ারি করছে। তখনই রান্নাঘরের দরজায় ধীর পায়ে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল মায়া। মায়াকে দেখে সবাই সেদিকে তাকালো। তনিমা বেগম বলে উঠলেন।
–তুমি এখানে? কোন দরকার ছিল?

মায়া ধরা গলায় বলে উঠলো।
–আ আপনারাও নিশ্চয় আমার ওপর রেগে আছেন। রাগারই কথা। আমি কাজই এমন করেছি। আপনারাও চাইলে আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। আমি সব শাস্তি মাথা পেতে নিবো আন্টি।

তনিমা বেগম বলে উঠলেন।
–হ্যাঁ রেগে তো আছিই। অনেক রেগে আছি। মাকে আন্টি বলে ডাকলে তো রাগ হবেই।

তনিমা বেগমের কথায় মায়া ছলছল চোখে তাকালো। তনিমা বেগম মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে মায়াকে কাছে ডাকলেন। মায়াও এক সেকেন্ড দেরি না করে তনিমা বেগমের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলো। এই প্রথম কেউ ওকে মায়ের ভালোবাসা দিতে চাইছে। এর চেয়ে খুশির আর কি আছে ওর কাছে।মায়া কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–সরি মা ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন ভুল হবে না।

তনিমা বেগম মায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–এমন করে কেউ কাঁদে। লোকে বলবে আমি নিশ্চয় ছেলের বউয়ের ওপর অত্যাচার করি। আর কাঁদে না।তুমি জানো তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়েই আমি এবাড়ির বউ হিসেবে চাইতাম। আর সৌভাগ্যক্রমে আমি সেটা পেয়েও গেছি। তাহলে রাগ করার তো প্রশ্নই আসে না। আর তুমি চিন্তা করোনা। ছেলেটা হয়তো একটু রেগে আছে এখন। তবে তোমার মতো এমন মিষ্টি বউয়ের সামনে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারবেনা।

তনিমা বেগমের কথায় মায়া লজ্জায় পড়ে গেল।ইরিন তখন দুষ্টুমি করে বললো।
–আরেব্বাস তুমিতো দেখছি শুনেই লাল লাল হয়ে যাচ্ছ। ব্যাস তোমার এই লাজুক রাঙা মুখখানি আমার ভাইটাকে দেখালে সেতো ওখানেই কুপোকাত হয়ে যাবে।

এদের কথাবার্তায় বেচারি মায়া লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এলিসা বেগম তখন বলে উঠলেন
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আর তাছাড়া অরণ্যের চেন(মন) অনেক খোলা। সে দেশিক্ষণ( বেশিক্ষণ) কারোর ওপর হেগে( রেগে) থাকতে পারে না।

এলিসার বাণী শুনে বেচারি মায়া তব্দা খেয়ে গেল। কনফিউজড চোখে তাকিয়ে রইলো। ইরিন সেটা বুঝতে পেরে বললো।
–আরে অবাক হয়ও না। এখন থেকে অভ্যাস করে নাও। আমাদের ফিরাঙ্গি চাচীর কথার মাঝে মাঝেই এমন দু চারটা এক্সিডেন্ট হয়েই থাকে।

ইরিনের কথায় মায়া হেঁসে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও সবার সাথে মিশে গেল মায়া। তবে এবারের মিশে যাওয়ার মাঝে আলাদা একটা খুশী আছে। কারণ এবার ওরা সবাই ওকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে আপন করে নিয়েছে। যেটা মায়া সবসময় চাইতো। তবে এই খুশিটাও অসম্পূর্ণ। যতদিন না অরণ্য ওকে মাফ করে দিয়ে নিজের বউ হিসেবে কাছে টেনে নিচ্ছে। সেই দিন টা কখনো আসবে কিনা তা জানা নেই মায়ার। জানা নেই ও কখনো ওর স্বামীর সান্নিধ্যে পাবে কিনা।

চলবে…..

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here