মায়ারণ্যে পর্ব -২০

#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-২০

★ অরণ্য ঘুম থেকে উঠে দেখলো মায়া রুমে নেই। দরজা খোলা দেখে বুঝতে পারলো মায়া হয়তো বাইরে গেছে। অরণ্য ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে নিলেই টাওয়াল থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেল অরণ্য। ঘ্রাণ টা চিনতে তার সময় লাগলো না। এটা যে ওর সন্ধ্যামালতীর শরীরের ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণ ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে।মায়া হয়তো এই টাওয়াল দিয়েই তার ভেজা শরীর মুছেছে। অরণ্য টাওয়াল টা নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ টেনে নিল। মনে পড়ে গেল তার সেদিন রাতে মায়ার সাথে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা। সেদিন এই ঘ্রাণ টাতে মেতে ছিল সে। এর আগে ওই রাতটার কথা মনে পড়লে মনে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতো। তবে এখন শুধুই ভালোলাগা কাজ করছে। কারণ এখন সে জানে সে তার বৈধ স্ত্রীতেই মেতেছিল। কোন ভুল কিছু করেনি সে।

একটু পরে অরণ্য রেডি হয়ে নিচে এলো।নিচে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকে খোঁজার চেষ্টা করছে। ডাইনিং টেবিলে তনিমা বেগম, এলিসা,রাবেয়া আর ইরিন বসে আছে। অরণ্যকে এভাবে তাকাতে দেখে ওরা মুখ টিপে হাসছে। ইরিন দুষ্টু হেসে বললো।
–কিরে এদিক ওদিক তাকিয়ে কি দেখছিস? নাস্তা করে নে।

অরণ্য জোরপূর্বক হেসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি।

অরণ্য চেয়ার টেনে বসলো। তবে ওর চোখ দুটো এখনো মায়াকেই খুঁজছে। মেয়েটা রাতে না খেয়েই ঘুমিয়েছিল। এখনো খেল কিনা কে জানে? কিভাবে জানবো? তনিমা বেগম অরণ্যের প্লেটে খাবার দিয়ে বললো।
–কিরে বসে আছিস কেন? খেয়ে নে।

অরণ্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–বাসার সবাই খেয়েছে?

তনিমা বেগম ঠিকই বুঝতে পারছে অরণ্য কার কথা বলছে। তবুও সে ভনিতা করে বললো।
–হ্যাঁ তোর বাবা চাচারা খেয়ে নিয়েছে। আর আমরা এখন খাচ্ছি।

অরণ্য আবার বললো।
–ওও আর বাকি সবাই? মানে সাহিল, ও খেয়েছে?

–হ্যাঁ হ্যাঁ ওতো কখন খেয়ে বাইরে চলে গেছে। ওর নাকি কি কাজ আছে।

এবার অরণ্য কি বলবে? মায়ার খবর না জানা পর্যন্ত ও খাবার কিভাবে মুখে দিবে? তাই এবার সরাসরিই বলে উঠলো।
–না মানে বলছিলাম ওকি খেয়েছে?

ইরিন বলে উঠলো।
–ওটা আবার কে? তুই কি ওই মায়ার কথা বলছিস?

তনিমা বেগম বললেন।
–আরে ওই মেয়েটা খেল না খেল তার খোঁজ আমরা রাখতে যাবো কেন? খাক না খাক আমাদের কি?

রাবেয়া বেগমও সায় দিয়ে বললেন।
–হ্যাঁ ভাবি ঠিকই বলেছে। ওই মেয়েটার কি হলো না হলো তাতে আমাদের কি? আরে ওই আমাদের ঠকিয়েছে। আর আমরা কিনা ওর ভালো মন্দের খবর নিতে যাবো? হুহ্। আরে আমিতো ভাবছি ওই মেয়েকে দিয়ে বাসার সব কাজ করাবো। তাহলে শায়েস্তা হয়ে যাবে।

এদের কথাবার্তায় অরণ্যের চরম রাগ হচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে হাতের মাঝে থাকা কাটা চামচ টা শক্ত করে ধরে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
এবার রাবেয়া বেগম আবার বলে উঠলেন।
–এমন কালো মেয়েকে তুই কি দেখে পছন্দ করলি? রিয়া যেমনই হোক দেখতে তো ভালো ছিল। তুই এক কাজ কর এই মেয়েকে বাদ দিয়ে ওই রিয়াকেই এবার সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিয়ে আয়।

ব্যাস আর শুনতে পারলো না অরণ্য। ঠাস করে উঠে দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–ব্যাস অনেক হয়েছে। তোমরা সবাই একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখ। ওই নির্লজ্জ মেয়ের নামও কেউ এবাড়িতে উচ্চারণ করবে না। আর হ্যাঁ মায়া আমার অপরাধী। ও যে অন্যায় করেছে আমার সাথে করেছে। তাই ওকে শাস্তিও শুধু আমি দেব।অন্য কেও না। আশা করি তোমরা বাকিটা বুঝে গেছ।
কথাটা বলে অরণ্য না খেয়েই ওখান থেকে হনহন করে চলে গেল।

অরণ্য যেতেই সবাই ফিক করে হেঁসে দিল। রান্নাঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবই শুনছিল মায়া। অরণ্যের ওর জন্য ডিফেন্স করতে দেখে চোখ ভরে উঠলো ওর। তবে ঠোঁটে ঝুলছে প্রাপ্তির হাসি। অরণ্য যতই রাগ করে থাকুক। তার মনের কোনে যে এখনো মায়ার জন্য ভালোবাসা জমানো আছে। তা বুঝতে বাকি রইলো না মায়ার। এতটুকু জেনেই সে খুশী। বাকিটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছে মায়া। যা হয় দেখা যাবে।
____

ইরিন আর সারা বসে পাকোড়া খাচ্ছে। মায়াই সবার জন্য বানিয়েছে। সবাই খাচ্ছে আর মায়ার প্রশংসা করছে। ইরিন একটা পাকোড়া তুলে মুখে দিতে নিলেই হঠাৎ ইহান এসে ফট করে ইরিনের হাত থেকে পাকোড়া টা নিজের মুখে পুড়ে নিল। পাকোড়া খেতে খেতে ইরিনের গা ঘেঁষে বসে পড়ে বলে উঠলো।
–বাহ্ অনেক টেস্টি ছিল। থ্যাংক ইউ ইরাবতী। তুমি কত্তো সুইট।

ইরিন দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বললো।
–তোমাকে কতবার বলেছি না এসব অসভ্যতামি করবে না আমার সাথে? পাকোড়া খেতে হয় প্লেট থেকে নিয়ে খাবে। আমার হাতের টা কেন নিলে?

ইহান ইরিনের কানের দিকে ঝুঁকে বললো।
–তোমার হাতের টায় যে মজা আছে। প্লেটের টায় কি সেই মজা পাবো?
কথাটা বলে ইহান টুকুস করে একটা চোখ মেরে দিল।
ইরিন দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–তোমাকে না বলেছি নিজের মাথা ঠিক না করা পর্যন্ত এখানে আসবেনা। তারপর বারবার কেন চলে আসো?

–কি করবো ইরাবতী? তোমার এই বিউটিফুল চেহারা না দেখলে যে ঘুম হয় না। তবে আজকে কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছেই আসিনি। আমাকে আমার হবু ফুপু শাশুড়ী ডেকে পাঠিয়েছে। আই মিন রাবেয়া আন্টি ডেকেছে। বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞেস করো।

ইরিন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ফুপি তোমাকে ডেকেছে কেন?

–কিজানি??

একটু পরে রাবেয়া বেগম ওখানে এসে বসলো। ইহান বলে উঠলো।
–আন্টি আমাকে ডেকেছিলেন? কিছু বলবেন?

রাবেয়া বেগম একটু চিন্তিত সুরে বললেন।
–হ্যাঁ বাবা ডেকেছিলাম।আসলে অরণ্য নিজেই এখন পেরেশানির মাঝে আছে। তাই ওকে এখন কিছু বলতে পারছিনা। তাই তোমাকে বলছি। ইহান বাবা, তুমি একটু সাহিলের সাথে কথা বলোনা। ছেলেটা কেমন নিউইয়র্ক যাওয়ার জিদ ধরে বসে আছে। আমরা এতো করে বুঝাচ্ছি তবুও শুনছে না। একই গো ধরে বসে আছে। তুমি তো ওর বন্ধু, ওকে একটু বুঝাও না।

ইহান বলে উঠলো।
–আপনি চিন্তা করেন না আন্টি। আমি ওর কথা বলে দেখছি। কোথায় ও?

–এখন তো বাইরে আছে। আসলে কথা বইলো। আমি তোমার জন্য ততক্ষণে চা নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে রাবেয়া বেগম উঠে গেলেন।

ইরিন চিন্তিত সুরে বলে উঠলো।
–এই সাহিল টার আবার কি হলো? হঠাৎ আবার নিউইয়র্ক যাওয়ার ভুত চেপেছে কেন?

এতক্ষণে জনাবা সারা বলে উঠলো।
–কেন আবার আপু। তোমার লুচু ভাইটা বিদেশি মেয়েগুলোকে ছাড়া থাকতে পারছেনা। তাইতো লুচুগিরি করতে যাচ্ছে ওখানে।

ইহান একটু হেঁসে বললো।
–আরে নারে পিচ্চি। তুই হয়তো সাহিলের ব্যাপারে ভুল ধারণা পেয়েছিস। সাহিল মোটেও ওমন ছেলে না।অরণ্য, সাহিল আর আমি। আমাদের তিনজনই একজন আরেকজন কে অনেক ভালো করে চিনি।তাই বলছি, সাহিল আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে কোনরকমের সম্পর্ক তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে অন্য রকম দৃষ্টিতেও তাকায় নি। হ্যাঁ মেয়েরা ওর প্রতি আকৃষ্ট হতো। আসলে সাহিল হ্যান্ডসাম এন্ড গুড লুকিং ছেলে। তাই মেয়েরা ওর পিছে পিছে ঘুরতো। আর সাহিল কখনো কোন মেয়ের অসম্মান করতে পারে না। তাই তাদের মন রক্ষার্থে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতো। এর চেয়ে বেশি আর কিছুই না।আরে ওতো আজপর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে কফি খেতেও কখনো যায়নি। আর ওর তো নিউইয়র্ক থাকাও পছন্দ ছিল না। কবে দেশে ফিরবে সেই অপেক্ষায় শুধু থাকতো। কিন্তু হঠাৎ করে কি হয়েছে কে জানে?

ইহানের কথায় সারা চমকে গেল। ও কি তাহলে সাহিল ভাইয়াকে ভুল বুঝেছে? এখন কি হবে? আমিতো সাহিল ভাইয়াকে কতো পঁচা পঁচা কথা শুনেয়েছি। সারা তুই আসলেই একটা গাধা। না না গাধা না তুই একটা গাঁধি। শুধু গাঁধি না টপ ক্লাস গাঁধি। কোনো কিছু না ভেবেই সাহিল ভাইয়াকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলি। সেই জন্যই বুঝি সাহিল ভাইয়া আমার ওপর এতো রাগ করে আছে। এখন কি করবো? সাহিল ভাইয়াকে সরি বলতে হবে। কিন্তু কিভাবে বলবো? আমাকে তো ওনার সামনেই যেতে মানা করেছে। বলেছে খুন করে ফেলবে। কিন্তু সরি তো বলতেই হবে। এতে যদি মরে শহিদ হয়ে যেতে হয় যাবো। ইতিহাসে আমার নামতো লেখা থাকবে। সরি বলতে গিয়ে শহিদ সারা।
__

মায়া ট্রেতে করে এক প্লেট পাকোড়া আর এক গ্লাস জুস নিয়ে রুমে ঢুকলো। অরণ্য তখন নাস্তা করেনি তাই তনিমা বেগমই মায়ার হাতে এই নাস্তা পাঠিয়েছে। যদিও মায়ার মনে মনে ভয় করছে অরণ্য আদৌও ওর আনা খাবার খাবে কিনা। তবুও শাশুড়ী মায়ের কথা রাখতে নিয়ে এসেছে। আর এমনিতেও অরণ্য না খেয়ে থাকলে মায়ার মনেও শান্তি পাবে না। সে নিজেও এখনো খাইনি। তনিমা বেগম অনেক বার বলেছে খেতে। কিন্তু অরণ্য না খাওয়া পর্যন্ত মায়ার গলায় কিভাবে খাবার নামবে। তাইতো সে এখনো না খেয়েই বসে আছে।

অরণ্য বেডের ওপর বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। মায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে অরণ্যের পাশে ট্রেটা রেখে ভয়ে ভয়ে বললো।
–খে খেয়ে নিন। মা পাঠিয়েছে।

অরণ্যের কোন ভাবান্তর নেই। সে একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মায়া আবারও বলে উঠলো।
–খেয়ে নিন না প্লিজ?

অরণ্য ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো।
–ক্ষিদে নেই আমার। সরাও এগুলো।

মায়া অসহায় কন্ঠে বললো।
–খেয়ে নিন না প্লিজ? আমার রাগ খাবারের ওপর কেন দেখাচ্ছেন? যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দিন। নিজেকে কেন শাস্তি দিচ্ছেন? খেয়ে নিন না প্লিজ?

এতক্ষণের চাপা রাগ টা এবার বিস্ফোরক হয়ে বেড়িয়ে এলো অরণ্যের। অরণ্য এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে ট্রে টা উঠিয়ে ঠাস করে সজোরে নিচে ছুড়ে মারলো। ভয়ে মায়া কেঁপে উঠে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। অরণ্য মায়ার বাহু চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–এসব করে কি প্রমাণ করতে চাইছ তুমি হ্যাঁ? খুব চিন্তা হচ্ছে আমার তাইনা? তা আগে কোথায় গিয়েছিল তোমার এই সো কল্ড চিন্তা? যখন আমাকে তিলতিল মরতে দেখছিলে,তখন আমার জন্য চিন্তা হয়নি? একটা বারও আমাকে সত্যি টা বলে আমাকে ওই যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলে? আমি না জানলে তুমি তো সারাজীবনই আমাকে অন্ধকারে রাখার প্ল্যান করে রেখেছিলে। তাহলে এখন আমার জন্য এতো দরদ উতলে উঠছে কেন তোমার? আমি খাই না খাই, বাচি মরি ইটস নান অফ ইউর বিজনেস। মিথ্যে সহানুভূতি দেখাতে আসবেনা আমাকে।

কথাগুলো বলে অরণ্য ঝটকা মেরে মায়ার হাত ছেড়ে দিল। মায়া বরাবরের মতোই কোন কিছু না বলে নীরব মূর্তির মতো মাথা নিচু করে ফ্লোরের খাবার আর কাচের টুকরো গুলো তুলতে লাগলো। চোখের অশ্রুগুলো যথেষ্ট ভাবে লুকানোর চেষ্টা করছে মায়া। মায়ার এই চুপ থাকা অরণ্যকে আরও রাগিয়ে তুলছে। কেন চুপচাপ সব সহ্য করছ? একবার কি আমাকে নিজের পক্ষ থেকে কোন এক্সপ্লেনেশন দেওয়া যায় না? একটি বার আমাকে সব বুঝিয়ে বলে সরি বলে দেখ। আমি কি এতটাই নিষ্ঠুর? কিন্তু তা কেন করবে তুমি? আমাকে দহনে পোড়াতে তো তোমার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু এবার আমি একা জ্বলবো না। সাথে তোমাকেউ জ্বলতে হবে।

অরণ্য নিচের তাকাতেই দেখলো মায়া কাচের টুকরো তুলতে গিয়ে আঙ্গুলে লেগে হালকা রক্তে বের হচ্ছে। এটা দেখে অরণ্যের রাগের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–মায়া যাও এখান থেকে। এসব তোমাকে করতে হবে না। এর জন্য লোক আছে অনেক। তুমি ছাড় এসব।

কিন্তু মায়া ওর মতো কাজ করেই যাচ্ছে। অরণ্য আবারও বললো।
–মায়া আমি যেতে বলেছি তোমাকে।

মায়া তবুও কাজ করেই যাচ্ছে। অরণ্যে ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো এবার। অরণ্য অতিরিক্ত রেগে টেবিলের ওপরে রাখা ফুলদানি টা তুলে আছাড় মেরে রাগী কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–আই সেড লিভ ইট ড্যাম ইট..

এবার ভয়ে কেঁপে উঠল মায়া। অরণ্যের চিল্লানিতে ইরিন দৌড়ে এলো। অরণ্য ইরিনকে দেখে বললো।
–আপু ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ।

ইরিন ব্যাপার টা আন্দাজ করতে পারলো। তাই আর কিছু না বলে মায়াকে ধরে ওখান থেকে নিয়ে যেতে লাগলো।মায়া এখনো ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে। অরণ্য পেছন থেকে ইরিনের উদ্দেশ্যে বললো।
–আপু ওর হাত কেটে গেছে। একটু এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিও।

ইরিন মুচকি হেসে মাথা নেড়ে মায়াকে নিয়ে চলে গেল। অরণ্যের নজর গেল ফ্লোরে কাচের টুকরোর সাথে লেগে থাকা মায়ার রক্তের কনা। অরণ্য নিচে এক হাঁটু গেড়ে বসে কাচের টুকরো টা হাতে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো।
–আমার সন্ধ্যামালতীকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার শুধু আমার আছে। আর কারোর না। তোদের সাহস কি করে হলো ওর শরীর থেকে রক্ত ঝড়ানোর?
অরণ্য চোয়াল শক্ত করে কাচের টুকরো টা নিজের হাতের মুঠোয় সজোরে চেপে ধরলো। কাচের টুকরো হাতে বিঁধে রক্ত বের হয়ে ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সেতো তার সন্ধ্যামালতীর কষ্টের প্রতিশোধ নিচ্ছে।
____

সারা আস্তে করে সাহিলের রুমের দরজা হালকা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো সাহিল আছে কিনা। একটু আগেই শুনেছে সাহিল নাকি বাসায় এসেছে। তাইতো মনে একবস্তা সাহস খেয়ে নিয়ে সরি বলার জন্য এসেছে সারা। সাহিলকে রুমে দেখতে পেল না। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। সারা মনে মনে যতো দোয়া দরুদ জানে সব পড়ে নিয়ে পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকলো। উপর দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বিড়বিড় করে বললো।
–হে আল্লাহ তোমার এই মাছুম বান্দাকে রক্ষা করো। আমার নিজের জন্য বলছি না। আমার মা বাবার আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই তাই বলছিলাম আর কি। আর এই বয়সে তো আরেক টা বাচ্চা কাচ্চাও হবে না তাইনা? তাই একটু দেইখো। বাকি তোমার ইচ্ছা।

সারা মনে মনে একটু সাহস যুগিয়ে বেডের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে সাহিলের অপেক্ষা করতে লাগলো। সাহিল বের হলেই ফট করে সরি বলেই চলে যাবে। সেই মনস্তাপ নিয়ে বসে রইলো। তখনই সারার নজর গেল বালিশের পাশে রাখা সেই ডাইরিটার দিকে। আর ভেতর থেকে বের হয়ে থাকা সেই ছবিটার দিকে। সারার কৌতুহল বাড়ছে। আজকে তো সে এই ছবিটা দেখেই ছাড়বে। সারা একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো। তারপর ফট করে ডায়রিটা হাতে নিয়ে আগে ছবিটা বের করলো। ছবিটি দেখে সারার ভ্রু কুঁচকে এলো। ছবিটা একটা পিচ্চি মেয়ের। হয়তো এক বছরের পিচ্চি হবে। পরনে জন্মদিনের হোয়াইট কালারের বারবিডল ড্রেস। মাথায় সাদা মুকুট। দেখতে একদম কিউটের ডিব্বা লাগছে। হঠাৎ সারার মনে হলো এই ছবিটা কেমন পরিচিত। এটা আগেও কোথাও দেখেছে। সারা মাথা খাটিয়ে মনে করার চেষ্টা করতেই ওর মনে পড়লো এই ছবি তো ওর নিজেরই। হ্যাঁ এটা ওর প্রথম জন্মদিনের ছবি। সারা ওর ফ্যামিলি অ্যালবামে অনেক বার এই ছবি দেখেছে। কিন্তু সাহিল ভাইয়া এই ছবি দিয়ে কি করে? আর এতো যত্ন করে এই ডাইরিতেই বা কেন রেখেছে? সারার কৌতুহল আরও শতগুণ বেড়ে গেল। এবারতো ডাইরিটা পড়তেই হবে। কিন্তু সাহিল ভাইয়া জানলে কখনোই পড়তে দিবে না। তাই সারা ডাইরিয়াটা নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। নিজের রুমে এসে দরজা আটকে ডাইরি খুলে পড়া শুরু করলো।

ডাইরির প্রথম পেইজ,
“১২-৩-২০০৫,
এই দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল দিন। আজ আমার জীবনে এক পরীর আগমন হয়েছে। এক ফুটফুটে মিষ্টি পরী। যার আলোর ঝলকানিতে আমার ছোট্ট হৃদয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। সে আমার পরী। আমার পিচ্চি পরী।”

সারা চমকে গেল। কারণ এটা তো ওর জন্মতারিখ। সারা এবার দ্রুত আরেক পেইজ উল্টালো।
“আজ আমার পরিটা তার কমল হাত দিয়ে আমার আঙ্গুল টা আঁকড়ে ধরেছে। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেঁসেছে। আমার যে কতটা আনন্দ হচ্ছে তা বলার ভাষা নেই। আজকে সারাদিন আমি পরিটার সামনে বসেছিলাম। একটুর জন্যেও সরিনি। ”

সারার বুকের ভেতর কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সারা দ্রুত আরেক পেইজ উল্টালো।
“এখন আমার পিচ্চি পরিটা হাঁটতে শিখেছে। তার ছোট্ট মোলায়েম পায়ে এক পা দুপা করে হাঁটে। আমার স্কুলের পকেট মানির টাকা জমিয়ে আমার পরিটার জন্য এক জোড়া নুপুর কিনে এনেছি আমি। পরিকে যখন পরিয়ে দিলাম তখন পরিটা কি খুশে হয়েছে। রুনুঝুনু শব্দ তুলে সারাবাড়ি হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার পদচারণে সারাবাড়ি যেন মুখরিত হয়ে উঠেছে। সাথে আমার হৃদয় টাও।”

সারার মনে পড়লো। ওর ছোট বেলায় এক জোড়া নুপুর ছিল।সারার খুব পছন্দ ছিল নূপুর জোড়া। বড়ো হওয়ার পর আর পায়ে লাগতো না তাই রেখে দিয়েছিল। সারা দৌড়ে গিয়ে কাবার্ড খুলে পুরাণ জিনিস পত্রের মধ্যে থেকে সেই নূপুর জোড়া খুঁজে বের করলো। নূপুর জোড়া বের করে তাকিয়ে রইলো। এই নূপুর জোড়াই সাহিল ভাইয়া ওকে দিয়েছিল। সারা চোখে অজান্তেই নোনাজল জমে গেল। সারা আবারও ডাইরির আরেক পেইজ খুললো।

“আজ আমার পরিটার জ্বর এসেছে। আমি কি করবো? কি করলে পরিটার কষ্ট কমবে? ওর কষ্ট যে আমার সহ্য হয়না। ওর সব কষ্ট আল্লাহ আমাকে দিয়ে দিক। ওর সব অসুস্থতা আমার হয়ে যাক।”

সারা এবার মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠলো। ডাইরির প্রতিটা পেইজ জুড়ে শুধু এই পরির কাহিনী। আর এই পরিটা যে সারা নিজেই তা বুঝতে বাকি নেই সারার। সাহিল ভাইয়া ওকে এতো ভালোবাসে ও কিনা জানেই না। আর আমি কিনা সেদিন বোকার মতো কতো কি বলে ফেললাম সাহিল ভাইয়াকে। এতো বোকা কেন আমি? সাহিল ভাইয়া নিশ্চয় কতো আঘাত পেয়েছেন আমার কথায়। তাই তো উনি আবার নিউইয়র্ক চলে যেতে চাচ্ছেন। সারা এবার ডাইরির শেষ লেখাটা দেখলো। সেখানে একটা কবিতা লেখা আছে।

“মন ভাঙা পরি,

কতোটা কাছাকাছি এসেছিলে তুমি
সেখানে দুরত্তের মাপটা দিতে পারিনি আমি
কতোটাই বা ভালোবেসে ছিলে তুমি
যে ভালোবাসায় পূর্ণ না হয়ে
আজ অপূর্ণ তে ভুগি আমি
না এসোনা এসোনা আর ফিরে তুমি
তারচেয়ে বরং দুরেই থাকো
তাতেই খুশি আমি
প্রভাত শেষে এক আলোর রশ্নির মতো
তোমাকে না পাওয়ার এক আজন্ম তৃষ্ণায়
সারা জীবন পুড়বো আমি
অপেক্ষার অবসান টা নাহয় এই জন্মে না’ই হলো
তবে দ্রুত অতিবাহিত সময়টা ভালো ছিলো
হ্যা যাক কেটে সে সময়
তোমাকে না পাওয়ার এক আজন্ম তৃষ্ণায়”

কবিতাটিতে সাহিলের মনের জমানো অভিমানের পাহাড় দেখতে পাচ্ছে সারা। দুই চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে সারার। সারা ডাইরিটা দুই হাতে নিজের চেপে ধরে বললো।
–আই অ্যাম সরি সাহিল ভাইয়া। অনেক অনেক সরি। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা। কোথাও না।

চলবে……
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here