মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -০৪

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৪

ঘড়ির কাঁটা তরতর করে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথে সাথে অবনীও পায়চারি করছে নিজের ঘরে। অপেক্ষমাণ দৃষ্টি মেইন গেটের উপরে আবদ্ধ। বাইরের আবহাওয়া বেশ বৈরী। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। কলোরাডোতে বৃষ্টি দেখার সৌভাগ্য হবে সেটা ধারনা করেনি অবনী। কারন এখন কলোরাডোতে শীতকাল চলছে। বর্ষা এখনো আসেনি। আর এই অসময়ের বৃষ্টিটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। অবনী অস্থির হয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে পড়লো বিছানায়। আবারো দৃষ্টি ফেললো সময় নির্দেশক যন্ত্রের উপরে। আজ কেন জানি সময়টা একটু তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? নাকি সময় নিজের গতিতেই চলছে। এটা শুধু অবনীর মনে হচ্ছে। নিজের ভাবনার উপরে বেশ বিরক্ত হল সে। ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দিলো। জুনায়েদকে ফোন দেবে কিনা সেটা নিয়েই মস্তিষ্ক দ্বিধায় রয়েছে। সকালের সেই ঘটনার পর জুনায়েদ রেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। নাস্তাটাও করেনি। প্রতিদিন সন্ধ্যার মধ্যেই অফিস থেকে চলে আসে। কিন্তু অনেক আগেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অথচ এখনো আসেনি। অবনীর মাঝে অপরাধবধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে তার কারনেই হয়তো জুনায়েদ বাড়িতে আসেনি। সে আসার পর থেকে বাড়িতে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেনা। আগে ঠিক কি করত সে জানে না। তবে আসার পর থেকে যতক্ষণ জুনায়েদকে বাড়িতে থাকতে দেখেছে সে ততক্ষণই ঘর থেকে বের হয়না। অবনীর মনে কিঞ্চিৎ হতাশা গ্রাস করলো। সে অধিকার আদায় করতে এসে অনধিকার চর্চা করে ফেলছে না তো? সে নিজের মতো জুনায়েদকে মানাতেই ব্যস্ত কিন্তু তার দিক থেকে একবারও ভাবছে না। হয়তো সে অবনীকে সহজভাবে নিতে পারছে না। তাহলে অবনীর এখন কি করা উচিৎ? দরজায় আওয়াজ হতেই সজাগ হয়ে উঠলো অবনী। দ্রুত দরজা খুলতেই এলেক্সকে ওপাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ইংরেজিতে বিড়বিড় করে বলল
–কিছু বলবে?

এলেক্স মাথা নাড়ল। নিজের ভাষায় বলল
–স্যার আপনাকে ডাকছে ম্যাম।

অবনী একটু ভাবল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো
–জুনায়েদ সাহেব এসেছেন?

এলেক্স মাথা নেড়ে না বলল। হতাশ অবনী মনের মাঝে অপরাধবধ নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–বাবাকে বল আমি একটু পরে আসছি।

এলেক্স চলে গেলো। অবনী গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। জায়েদ রহমানের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দুই আঙ্গুলে মৃদু আওয়াজ করলো। ভেতর থেকে গম্ভীর আওয়াজ এলো।
–ভেতরে আসো।

অবনী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। জায়েদ রহমান বই পড়ছিলেন। অবনী ভেতরে ঢুকতেই চোখ তুলে তাকালেন তার দিকে। নাকের ডগার চশমাটা ভালো করে ঠেলে দিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–এখানে বসো।

সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসে পড়লো অবনী। এদিক সেদিক তাকাল। কোনটাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হল না। কিন্তু পাশেই রাখা সাবিনা ইয়াসমিনের ছবিটাতে গিয়েই দৃষ্টি আটকে গেলো। কিছুটা চমকে গেলো সে। আগের দিনে ঘরে ঢুকেই যে ছবিটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো সেটা আজ নেই। এটা অন্য ছবি। ওটা সাদা কালো ছিল। কিন্তু এটা রঙ্গিন। সবুজ রঙের একটা শাড়ী গায়ে জড়ানো। খোলা চূলগুলো বাতাসে উড়ছিল তখন। ছবিটা দেখে সেই সময়ের পরিবেশটা আন্দাজ করে ফেললো সে। জায়েদ সাহেব বইটা বন্ধ করে অবনীর দিকে তাকালেন। তাকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন
–এই ছবিটা বাংলাদেশে তোলা। আমার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ঠিক তখন তুলেছিল আমার ছোট ভাই জুবায়ের।

নামটা শুনেই অবনী কয়েকবার পলক ফেলে বলল
–ইনি কি সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার জুবায়ের রহমান?

জায়েদ সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। অবনীর চোখ খুশীতে চকচক করে উঠলো। ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি টেনে বললেন
–আমি ওনার বড় ফ্যান। ওনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছা আমার। সত্যি উনি অনেক ভালো একজন ফটোগ্রাফার।

জায়েদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন
–জুবায়ের ওর পরিবারের সাথে ম্যানহাটনে থাকে। মাঝে মাঝে ছুটি পেলে চলে আসে। কিছুদিন থেকে আবার চলে যায়। সামনে মাসেই চলে আসবে হয়তো। আমি তোমার কথা বলবো।

অবনী হেসে মাথা নাড়ল। অবশেষে তার ইচ্ছা পুরন হতে যাচ্ছে। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করলেও ফটোগ্রাফির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে তার। নিজেও বেশ ভালো ছবি তুলে। আর সেই দুর্বলতা থেকেই জুবায়ের রহমানের সাথে দেখা করার ইচ্ছা জাগে মনের মাঝে। জায়েদ রহমান নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন
–তোমার কি শরীর খারাপ? ম্যালিনা বলল সন্ধ্যা থেকে ঘরেই ছিলে। রাতে ডিনারও করলে না।

অবনী সৌজন্য হেসে বলল
–না বাবা। সব ঠিক আছে। বিকেলে একটু ভারী নাস্তা খেয়েছিলাম তো তাই আর ক্ষুদা পায়নি। এলেক্সকে আমি খাবার রেখে দিতে বলেছি। ক্ষুদা পেলে খেয়ে নেবো।

জায়েদ রহমান অন্যমনস্ক হয়ে বললেন
–জুনায়েদ আজ রাতে আসবে না। ওর একটা জরুরী কাজ আছে। কাল ঠিক কখন আসতে পারবে সেটাও বলতে পারছে না।

অবনীর মুখটা ফ্যকাশে হয়ে গেলো। অপরাধবধ টা আরও বেশ করে আঁকড়ে ধরল। কাজ তো শুধু বাহানা মাত্র। সে জানে তার কারনেই জুনায়েদ বাসায় আসছে না। বাবাকে জানতে না দেয়ার কারনেই এমনটা বলেছে। অবনীর এমন মুখভঙ্গি দেখে জায়েদ রহমান বললেন
–তোমার কি এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে মামনি? হলে বলতে পারো। আমি সর্বচ্চ চেষ্টা করবো তোমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত করার।

অবনী মুচকি হেসে বলল
–আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না বাবা। বরং আমার কারনে আপনার ছেলের অসুবিধা হচ্ছে। এসব কাজ শুধুই বাহানা। এই বাড়ি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা। আমার এখানে আসাটা সহজভাবে নিতে পারছেন না উনি। আমি আসার পর থেকে একদিনও সকালের নাস্তা করে বের হন না।

জায়েদ রহমান অবনীর বলা প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। নিজের মনেই প্রতিটার বিপরিতে একটা করে যুক্তি দাঁড় করালেন। গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–বাসায় খাচ্ছে না ঠিক কিন্তু না খেয়ে তো নেই। বাইরে ঠিকই খাচ্ছে। আর আমার মনে হয়না বাসায় না আসার পেছনের কারণটা তুমি। কারন তুমি আসার আগেও এমন কাজের কারনে রাতে বাইরে থাকতো জুনায়েদ। এটা নতুন কিছু না।

থেমে গেলেন তিনি। কথা গুলো মস্তিষ্ক ধারন করে ফেললেও মন তেমন ভরসাযোগ্য ব্যাপার খুঁজে পেলো না। তাই অবনী চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো। জায়েদ রহমান নিজের বিচক্ষণতায় ব্যাপারটা ধরতে সক্ষম হলেন। পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে তাই বললেন
–দেখো মামনি আমার মনে হচ্ছে তুমি একটু দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছ।

কথার অর্থ ধরতে না পেরে অবনী কৌতূহলী দৃষ্টি ফেললো জায়েদ সাহেবের দিকে। তিনি দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বললেন
–আসলে বিয়েটা যে অবস্থায় হয়েছে তাতে তোমরা দুজনের কেউই ভাবার সময় পাওনি। তাই ভাবার জন্য হলেও তো কিছুটা সময় দরকার। এখন তুমি সেটা বলতেই পারো যে ৪ মাস অনেক সময়। কিন্তু এই ৪ মাস তো তোমরা আলাদা ছিলে। দুজন দুই দেশে। কিন্তু এখন একই বাসায় থাকছ। একটু সময় দাও ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে এখানে নিয়ে আসার মুলত এটাই কারন। যাতে তোমরা নিজেদের চোখের সামনে থাকতে পারো।

তিনি থেমে গেলেন। কিছু একটা ভেবে বেশ আবেগি কণ্ঠে বললেন
–জুনায়েদের মা মারা যাবার পর ছেলেটা খুব একা হয়ে যায়। আমিও ওকে যথেষ্ট সময় দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু মায়ের অভাব তো একজন মাই পুরন করতে পারে। আমার চঞ্চল ছেলেটা তারপর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। আমি নিজের দায়িত্ব কমিয়ে দেই। পুরো সময়টা ছেলের পেছনে দেই। তাকে হাসি খুশী রাখার চেষ্টা করি। তাই নিজের দিকে তেমন খেয়াল রাখতে পারিনি। সময় অসময়ে নানান রকম অসুখ বাসা বাধে শরীরে। আর এসব জুনায়েদ খুব ভালভাবে খেয়াল করে। এই কারনেই তার মনে আমার জন্য একটা সফট কর্নার তৈরি হয়। সেদিক থেকেই আমার সিধান্ত মানার জন্য কিছুটা বাধ্য হয়। কোন প্রতিউত্তর করেনা। আর এটাও জানে যে বাবা কখনো তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না। সেদিক থেকেই বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কোন কথা বলেনি। কিন্তু বিয়েটা তো ছোট কোন বিষয় নয় মামনি। কাউকে ভালো লাগার জন্য হলেও কিছুটা সময় প্রয়োজন। সেই সময়টা তোমরা দুজন দুজনকে দাও। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কথা গুলো শুনে অবনীর খুব মায়া হল জুনায়েদের উপরে। ছোটবেলা থেকে কষ্ট পেয়েছে বলেই হয়তো এতো রাগ জেদ। নিজের মনে চেপে রাখা কষ্ট গুলো বলার মতো কেউ নেই হয়তো। এই মানুষ গুলো যে ভেতর থেকে বড় একা হয়। এতো সহজে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তাকে এই মানুষটার মনে জায়গা করে নিতেই হবে। আর কিছু না হোক একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। যাতে নিজের মনের জমানো কথা গুলো অনায়াসেই বলে দিতে পারে। গভীর ভাবনায় ডুবে থাকা অবনীকে দেখে জায়েদ রহমান বললেন
–এসে থেকেই বাসায় বসে আছো। বাইরে থেকে ঘুরে আসলেও তো পারো। মনটা ভালো লাগবে।

অবনী উত্তর দিলনা। তবে মৃদু হাসির মাধ্যমে সম্মতি জানালো। তার মার্কেটে যাওয়া দরকার। কিছু কেনাকাটা আছে। কিন্তু একা কিভাবে যাবে সেটা নিয়েই ভাবছিল। জায়েদ রহমান আবারো বললেন
–আমি কাল একটু ব্যস্ত থাকব। তুমি রোজকে নিয়ে চলে যাবে কাল। যেখানে যেখানে ঘুরতে মন চায় ঘুরে এসো কেমন?

অবনী হেসে মাথা নাড়ল। বলল
–ঠিক আছে বাবা। আমি রোজকে নিয়ে কাল সকাল সকাল রওনা দেবো। অনেক রাত হয়েছে। আপনি এখন রেস্ট নিন। আমি আসছি।

জায়েদ রহমান সম্মতি জানালেন। অবনী বের হয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। জায়েদ রহমান গভীর ভাবে ভাবলেন কিছু একটা। তারপর পাশ থেকে ফোনটা তুলে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে ফোন করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হল। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–বাবা তুমি এখনো ঘুমাওনি? সব ঠিক আছে তো?

জায়েদ রহমানের মুখ বেশ থমথমে। ফোনের ওপাশ থেকে বিষয়টা জুনায়েদের বোধগম্য হল না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো বাবার কথা শোনার জন্য। জায়েদ রহমান কঠিন গলায় বললেন
–কাজের পরিমাণটা এবার কমাও। মেয়েটা বড়ই অধৈর্য। আর বোধহয় খুব বেশী সময় নেয়া ঠিক হবে না। মেয়েটার মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর মনোবল ভেঙ্গে গেলেই মস্তিস্কে নানানরকম প্রশ্নের উদয় হবে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া বেশ কঠিন কিন্তু। তোমার এবার বিষয়টা ভেবে দেখা উচিৎ জুনায়েদ। আজ রাতে তোমার বাড়ির বাইরে থাকাটা উচিৎ হয়নি। তোমার বাইরে থাকার কারন হিসেবে অবনী নিজেকে দায়ী করছে। আমি আগেই বলেছিলাম অবনী আসার পর পরিস্থিতি কিন্তু বদলে যাবে। আর বেশী বদলাতে দিওনা। তাতে কিন্তু ক্ষতির পরিমান বেড়ে যাবে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here