মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -১৮+১৯ শেষ

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৮

খোলা চূলগুলো হাত খোপা করেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল অবনী। গ্লাসে পানি ঢেলে এক চুমুক দিতেই জায়েদ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন
–তুমি এখনো ঘুমাওনি মামনি।

নিস্তব্ধ ঘরটায় হুট করেই এমন গম্ভীর আওয়াজের ভারে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো অবনী। গ্লাস রেখে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে জায়েদ রহমানকে দেখে সস্তি পেলো। বলল
–না বাবা। আপনার ছেলে এখনো আসেনি। তাই অপেক্ষা করছিলাম।

জায়েদ রহমানের ভ্রু কুচকে এলো। চোখের পলক ফেলে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–আসেনি এখনো? কোথায় গেছে জানো?

অবনী মাথা নাড়িয়ে না বলল। জায়েদ রহমান গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলেন জুনায়েদ এতো রাত অব্দি কোথায় যেতে পারে। কিছু একটা ভেবেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মাথাটা নিচু করে ফেললেন। নরম কণ্ঠে বললেন
–জুনায়েদ কখন আসবে তার কোন ঠিক নেই। তুমি শুয়ে পড়। চিন্তার কিছু নেই। চলে আসবে।

কথা শেষ করে তিনি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অবনী পেছন থেকে ডাকল
–বাবা।

থেমে গেলেন তিনি। ঘুরে বললেন
–কিছু বলবে?

–ওনার তো অফিস ছুটি। আর ছুটির দিনে এতো রাত অব্দি বাইরে থাকেন না। দেরি করে ফেরার কারণটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় আপনি জানেন উনি কোথায় গেছেন।

অবনীর কথার জবাব দিতে নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নিলেন জায়েদ রহমান। মাথা নিচে রেখেই বললেন
–জুনায়েদের জন্মদিন আগামীকাল। ওর মা বেঁ’চে থাকতে এই দিনটা অনেক আয়োজন করে পালন করত। মা মা’রা যাবার পর থেকে এই বাড়িতে জুনায়েদের কোন জন্মদিন পালন হয়নি। সে চায়নি বলেই হয়নি। আজকের রাতটা সে সারারাত বাইরে কাটায়। আর কাল সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবে। আমার ছেলেটা খুব চাপা স্বভাবের। নিজের কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয়না। এই দিনটা সে নিজের মতো কাটায়। একদম একা। কারো সাথে কথা বলেনা। ওর মাকে খুব মিস করে এই দিনে। তাই আমিও ওকে ওর মতোই ছেড়ে দেই এই দিনে। এতো বছরে আজ অব্দি জন্মদিনের শুভেচ্ছাটাও জানাতে পারিনি।

জায়েদ রহমান আর দাঁড়াতে পারলেন না। তার নিজেরও খুব কষ্ট হয় এইদিনে। ছেলেকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে তিনি হতাশ হয়ে যান। নিজের ঘরে চলে গেলেন। অবনী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। সে জুনায়েদের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। চোখে পানি টলমল করে উঠলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরে গেলো। কয়েকবার ফোনটা হাতে তুলে নিয়েও জুনায়েদকে ফোন করা হলনা। তাকে একা থাকার সুযোগ দিলো। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিলো অবনী। রাত ২ টায় জুনায়েদ ফিরে এলো। জুনায়েদ এসে অবনীকে বিছানায় দেখে ভাবল সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু অবনী তখনও জেগে ছিল। জুনায়েদ ফ্রেশ হতে চলে গেলো ওয়াশরুমে। জুনায়েদের কষ্ট উপলব্ধি করতে গিয়ে অবনীর আজ নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে। কতোটা অসহায় লাগে নিজেকে সেটা সে বুঝতে পারছে। জুনায়েদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে অবনীকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বলল
–তুমি ঘুমাওনি?

অবনী তখন জুনায়েদকে দেখতেই ব্যস্ত। ভীষণ বিদ্ধ’স্ত আর এলোমেলো লাগছে তাকে। খুব কাছের একজন মানুষের অভাব। অবনীর চুপ করে থাকা দেখে জুনায়েদ বিছানায় বসে পড়লো। অবনীর মাথায় হাত রেখে বলল
–খারাপ লাগছে? উঠে গেলে যে?

–আপনি কোথায় ছিলেন?

কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো অবনী। জুনায়েদ হাত সরিয়ে ফেললো। আজকের দিনে তাকে কেউ প্রশ্ন করেনা। কিন্তু অবনী যেহেতু এই বাড়িতে নতুন তাই সে কিছুই জানে না। তার প্রশ্ন করা স্বাভাবিক ধরে নিয়েই বলল
–কাজ ছিল।

–কি কাজ?

মন ভালো না থাকায় এখন অবনীর প্রশ্নগুলো জুনায়েদের খুব বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। কঠিন গলায় বলল
–সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তুমি ঘুমাও। আর হ্যা আজকের দিনে আমাকে কেউ প্রশ্ন করেনা। তুমিও করবে না।

অবনী শ্বাস ছেড়ে বলল
–এতদিন কেউ প্রশ্ন করার জন্য ছিল না তাই করেনি। এখন আমি আছি। আমার সব জানার অধিকার আছে। আমি আপনার স্ত্রী। আপনার মনের সমস্ত কষ্ট জানার অধিকার আমার আছে।

জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। কঠিন গলায় বলল
–আমার মন ভালো নেই অবনী। শুয়ে পড়। যা না জানলে নয় সেটা তুমি জানতে পারবে। বাকি আর কিছু জানতে চেও না। আমাকে বিরক্ত করো না।

অবনী নাছোড়বান্দার মতো বলল
–বাকি কিছুই থাকবে না। এতদিন আপনি নিজের ইচ্ছা মতো চলেছেন। আর না। আমাকে বলতে হবে জুনায়েদ সাহেব।

জুনায়েদ এমন জেদের কারণে রেগে গেলো। হাত ধরে বিছানা থেকে নেমে দিয়ে বলল
–এই ঘর থেকে বের হয়ে যাও। আর আমাকে আগামি ২৪ ঘণ্টা বিরক্ত করবেনা। নাহলে আমি রে’গে গেলে খুব খারাপ হবে।

অবনী একটুও রাগ করলো না। ভীষণ অসহায়ের মতো বলল
–আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। সেটা নিবারন করার ক্ষমতা হয়তো আমার নেই কিন্তু তবুও আমি আপনার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি মেনে নিতে পারছি না আপনি এভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে।

কথাটা বলতে বলতেই অবনী কেদে ফেললো। তার কান্না বাধ মানছে না। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলো। জুনায়েদ সবটা খেয়াল করলো। এমনিতেই তার কষ্টের শেষ নেই তার উপর আবার অবনী এভাবে কাঁদছে সেটা দেখেই সে অসহায়ের মতো বলল
–কেঁদো না অবনী। আমার অসহ্য য’ন্ত্রণা হচ্ছে।

অবনী জুনায়েদের পাশে দাঁড়ালো। ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখে বলল
–সারাজীবন এভাবে কষ্ট পেতেই থাকবেন? এটা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন জুনায়েদ সাহেব। জীবনটা অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকার জন্য হয়তো অনেক কিছু লাগে। কিন্তু ভালো থাকার জন্য অল্পকিছু সুন্দর মুহূর্তই যথেষ্ট। সেই মুহূর্তগুলোকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করুন। দেখবেন কষ্ট অনেকটা কমে গেছে। মা হয়তো এখন আপনার কাছে নেই। কিন্তু বাবা তো আছেন। আপনাকে এভাবে দেখে বাবা কতোটা কষ্ট পাচ্ছেন সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন না আপনি। জানেন বাবা আজ আফসোস করে বলছিলেন কত বছর আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারেন নি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল
–আমার বাবা মা কেউ নেই। তবুও যাদেরকে বাবা মা হিসেবে মেনে নিয়েছি তাদের মাঝেই সুখ খুঁজে নিয়েছি।

জুনায়েদ নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। অবনীর কোমর জড়িয়ে কেদে ফেললো। অবনী কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেও কিছুই বলল না। কারণ জুনায়েদকে কাঁদতে দিলেই তার ভেতরটা শান্ত হবে। কষ্টটা কমে যাবে। তাই অবনীও তাকে জড়িয়ে নিলো। জুনায়েদ কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে বলল
–ভালোবাসি অবনী। তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি আমাকে কখনো ছে’ড়ে যেও না প্লিজ। আমি মেনে নিতে পার’বো না।

ভালোবাসার কথা শুনে অবনী থমকে গেলো। এলোমেলো চিন্তা ধারা তার মস্তিস্ক গ্রাস করছে। এর মাঝেই জুনায়েদ তাকে ছেড়ে দিয়ে কোলে বসিয়ে নিলো। দুই হাতে গাল চেপে ধরে বলল
–আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসি অবনী। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমার শুন্য জীবনে তোমাকে খুব প্রয়োজন। তোমার ভালোবাসা প্রয়োজন। আমাকে একটু ভালোবাসো। কথা দিচ্ছি তোমাকে কোনদিন আফসোস করার সুযোগ দিব না।

অবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। জুনায়েদ তাকে ছেড়ে দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–আমি তোমাকে জোর করতে চাইনি। তুমি আমার কাছে থাকবে কিনা সেটা তোমার উপরে ছেড়ে দিলাম। তুমি চাইলেই বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারো। আমি আটকাব না।

অবনীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আজকাল এই মানুষটার কষ্ট সে একদম সহ্য করতে পারেনা। জুনায়েদ সামান্য কষ্ট পেলে অবনীর মনে হয় সে নিজেই তার থেকে বেশী কষ্ট পাচ্ছে। জুনায়েদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল
–আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না।

জুনায়েদ অবনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কিছুটা সময় ওভাবে থেকে ছেড়ে দিয়ে আলতো করে মুখটা তুলে ধরল। অবনী মুচকি হেসে বলল
–শুভ জন্মদিন জুনায়েদ সাহেব। আপনার প্রতিটা জন্মদিন শুভ হোক। সুখে ভরে উঠুক আপনার জীবন।

জুনায়েদ মুচকি হাসল। অবনীর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল
–শুধু শুভেচ্ছা? গিফট কোথায়?

চোখের পাতা পিটপিট করে অস্থির পলক ফেললো অবনী। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি চাই আপনার?

জুনায়েদ বাকা হেসে বলল
–যা চাই তা পাবো তো?

অবনী কোন কিছু না ভেবেই চমৎকার হেসে বলল
–আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই পাবেন। বলুন কি চাই আপনার?

–আমার মন ভালো করার দায়িত্ব নিতে হবে যে।

অবনী হেসে বলল
–আপনার মন ভালো করার দায়িত্ব আজ আমি নিলাম জুনায়েদ সাহেব। আপনার মন ভালো করার জন্য আমি সব করতে প্রস্তুত। বলেই দেখুন একবার।

অবনীর চোখের মাঝে নিজের দৃষ্টি স্থির করে বলল
–ভেবে বলছ তো?

অবনী অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল। জুনায়েদের গলার স্বর আর কথা বলার ভঙ্গী সবটাই কেমন অদ্ভুত ঠেকল। কিছু বলার আগেই জুনায়েদ বলল
–আর ভাবার দরকার নাই। একবার যখন বলেই ফেলেছ তাই আর ভাবার সময় দিতে পারছি না। আমি আবার বড় নি’ষ্ঠুর।

অবনী পিটপিট করে তাকাল। জুনায়েদ আরেক হাত অবনীর গালে আলতো করে রেখে তার দিকে ঝুঁকে গেলো। অবনীর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো। বুঝতে বাকি থাকলো না জুনায়েদের ইঙ্গিত। জুনায়েদের গভীর দৃষ্টির কারণে লজ্জায় হার মেনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। অবনীর অঘোষিত সম্মতি বুঝেই জুনায়েদ মুচকি হাসল। সর্বত্র ছড়িয়ে দিলো গভীর প্রণয়ের রেশ।

————-
এয়ারকন্ডিশনের হাওয়াটা পরিবেশ শীতল করে দিলেও তীব্রভাবে ঘামছে তৈয়বা নাজনিন। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। বারবার তিনি শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। টেবিলে পড়ে থাকা ছু’রিটা তার ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। আশরাফ সাহেব বেশ শান্ত ভাবেই ছু’রিটা হাতে তুলে নিলেন। এদিক সেদিক নাড়াতে নাড়াতে বললেন
–বলেছিলাম কোনভাবে যদি আমি জানতে পারি যে আমাকে র‍্যা’বের হে’ড কোয়ার্টারে ডাকার পেছনে তোমার কোন হাত আছে তাহলে তোমার নিস্তার নেই। তারপরেও এমন সাহ’স করলে কিভাবে?

তৈয়বা কেঁপে উঠলো। এই লোকটাকে সে আর বিশ্বা’স করতে পারেনা। এক সময় এই লোকটার কথাই তার জন্য সবটা ছিল। কিন্তু এখন সে এটা অন্তত বুঝে এই মানুষটা অত্যন্ত স্বার্থপ’র। নিজেকে ছাড়া আর কারো কথা ভাবে না। এই মুহূর্তে হাতে ধরে থাকা ছু’রি তার গলায় চা’লিয়ে দিতেও দুবার ভাববে না। কিন্তু এটা ভয় পাবার সময় নয়। তার মে’য়েকে এই লোকের হাত থেকে বাঁ’চাতেই হবে। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে বলল
–তোমাকে আমি আর ভ’য় পাইনা। কি ভেবেছ এসব করে আমাকে ভ’য় দেখাবার চেষ্টা করলেই আমি তোমার ভ’য়ে সব স্বী’কার করে নেবো? অসম্ভব। হ্যা। তুমি ঠিক ধরেছ আমিই জুনায়েদকে তোমার সব কী’র্তিকলা’পের কথা জানিয়েছি। আর সেই র‍্যা’বে’র কাছে তোমার সব ই’নফর’মেশন পাঠায়।

আশরাফ উঠে এসে তৈয়বার গলা’য় ছু’রি চে’পে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন
–তোমাদের এই ষ’ড়য’ন্ত্র আমার কোন ক্ষ’তি করতে পারবে না। উপযুক্ত কোন প্রমা’ন তাদের কাছে নেই। পারেনি আমাকে আট’কে রাখতে। ছেড়ে দিয়েছে। আমি ঠিকই চলে এসেছি বাসায়।

তৈয়বা ভ’য় পেয়ে গেলো। কিন্তু আশরাফের সামনে সেটা প্রকাশ করলো না। আশরাফ তৈয়বাকে ছেড়ে দিলেন। আবার চেয়ারে এসে বসে বললেন
–ভ’য় পেও’না। আমি তোমাকে মা’রব না। বাঁ’চিয়ে’ই রাখবো। তুমিই তো আমার তু’রু’পের তাস। তোমাকে দিয়েই বাকিটা হাসি’ল করতে হবে।

ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল
–ফোন করো তোমার জামাইকে। বল মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসতে।

তৈয়বা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল
–আমি অবনীকে বলেছি। আসবে। সামনে সপ্তাহে।

আশরাফ গভীর ভাবে ভাবল। ভীষণ অসহায় কণ্ঠে বলল
–এতো দেরি কেন? আমি যে তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। সে কি বুঝতে পারছে না তার বাপি তাকে কতোটা মিস করছে। এখনই আসতে বল।

তৈয়বা অদ্ভুতভাবে তাকাল। আশরাফ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–ফোন করো এখনই।

পরিস্থিতি বেগতিক বুঝেই তৈয়বা একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। অপেক্ষা না করেই জুনায়েদের নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রথমবারে ফোনটা কেটে গেলো। তৈয়বা হতাশ হয়ে আবারো ফোন করলো জুনায়েদের নাম্বারে। দ্বিতীয়বার জুনায়েদ ফোনটা ধরল কিন্তু কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তৈয়বা ভীত কণ্ঠে বলল
–জুনায়েদ অবনীকে নিয়ে তুমি চলে এসো তাড়াতাড়ি।
#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৯

সকালে ঘুম ভেঙ্গেই জুনায়েদ আশেপাশে তাকাল। অবনী নেই। ঘড়ি দেখেই বুঝে গেলো সবাই এখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। বিছানা ছেড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখল অবনী আর জায়েদ রহমান টেবিলে বসে নাস্তা করছে। জুনায়েদ সিঁড়ি বেয়ে নেমে অবনীর পাশেরর চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে বলল
–গুড মর্নিং বাবা।

তার আওয়াজ শুনে অবনী আর জায়েদ রহমান হতবিহবল চোখে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। জুনায়েদ একটু অসস্তিতে পড়ে গেলো। ভ্রু কুচকে বলল
–এভাবে কি দেখছ তোমরা?

জায়েদ রহমান বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–তুমি এতো সকালে?

জুনায়েদ জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল
–আমি তো সকালেই উঠি বাবা। এতক্ষনে তো অফিসে থাকার কথা ছিল। ছুটির দিন বলেই এখনো বাসায়।

জায়েদ রহমান বিষয়টাতে অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না। ফ্যাকাশে মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করলেন। জুনায়েদ বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর শীতল কণ্ঠে বলল
–বাবা আজ আমার জন্মদিন।

জায়েদ রহমানের হাত থেমে গেলো। চোখ তুলে তাকালেন তিনি। মুহূর্তেই চোখ ভরে এলো তার। জুনায়েদ চমৎকার হাসল। কত বছর পর এইদিনে ছেলেকে এভাবে চোখের সামনে দেখেছেন তিনি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
–শুভ জন্মদিন।

জুনায়েদ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বলল
–তুমি কি আজ ফ্রি আছো?

জায়েদ রহমান একটু ভেবে বললেন
–আমার দুপুরের পর একটু কাজ আছে। কেন বলতো?

–ভাবছিলাম আজ আমরা সবাই মিলে একটু বাইরে যাবো। অনেকদিন একসাথে এভাবে টাইম স্পেন্ড করা হয়না।

জায়েদ রহমানের চোখ খুশীতে ছলছল করে উঠলো। হেসে উঠে বললেন
–তোমরা দুজন ঘুরে আসো। আমি কাজ সেরে রাতে জয়েন করবো তোমাদের সাথে।

জুনায়েদ মুচকি হেসে সম্মতি দিল। জায়েদ রহমান খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন
–আমাকে এখন যেতে হবে। আমি আসছি।

জুনায়েদ উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। বলল
–তাড়াতাড়ি এসো বাবা।

জায়েদ রহমানের চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তিনি গোপনে সেটা মুছে ফেলে বললেন
–ঠিক আছে।

জায়েদ রহমান বাইরে চলে যেতেই জুনায়েদ আবারো চেয়ারে বসে পড়লো। রোজ কফির কাপটা এনে জুনায়েদের সামনে দিয়ে চলে গেলো। জুনায়েদ কাপটা তুলে নিয়ে অবনীর দিকে তাকাল। তার মনে হল অবনী যেন গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন। চেহারাতেও কেমন মলিনতার ছাপ। তেমন কথাও বলছে না। চঞ্চলতা থেমে গেছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–কফি খাবে?

অবনী মাথা নাড়ল যার অর্থ সে খাবে না। জুনায়েদের এবার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। বুঝে গেলো সে কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে। তাই কফির কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–খাও।

অবনী মাথা নাড়িয়ে আবারো না বলল। জুনায়েদ গভীর দৃষ্টিতে পুরো মুখে দেখে নিয়ে বলল
–কফিই খাবে না নাকি আমার সাথে একই কাপে খেতে সমস্যা?

চোখ তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। জুনায়েদের গভীর দৃষ্টি অবনীর অসস্তি সৃষ্টি করলো। দৃষ্টি নামিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কফি খাবো না।

থেমে গেলো দুজনই। কয়েক মুহূর্তের নিরবতা অবনীর অসস্তি বাড়িয়ে দিলো। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্থির দৃষ্টি ফেলছে। জুনায়েদ আদুরে গলায় বলল
–অবনী?

আচমকা এমন আওয়াজে অবনী চমকে উঠলো। জুনায়েদের দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে বলল
–বাং’লা’দে’শে যাবে?

অবনী অদ্ভুতভাবে তাকাল। অস্থিরভাবে শ্বাস টেনে পলক ফেলে বলল
–যাবো।

জুনায়েদ মুচকি হেসেই বলল
–পরশু যাবো। সব গুছিয়ে রে’ডি হ’য়ে নাও।

অবনীর চেহারা হুট করেই পরিবর্তন হয়ে গেলো। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল
–প’রশু? আপনি যাবেন?

জুনায়েদ হেসে ফেলে বলল
–যাবো।

অবনী কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো। উঠে যেতে নিলেই জুনায়েদ আটকে দিলো। বলল
–কোথায় যাচ্ছ?

অবনী মলিন হেসে বলল
–রে’ডি হতে।

–তোমার মন ভালো করে দেয়ার বিনিময়ে আমার কিছু পাওয়া উচিৎ বলে মনে হয়না তোমার?

অবনী সরু চোখে তাকাল। বলল
–সব সময় আপনার কেন পাওয়া উচিৎ জুনায়েদ সাহেব? আমারও তো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে।

জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ল। বলল
–ঠিক বলেছ।

অপেক্ষা না করেই অবনীর ঠোঁটের কোণে গা’ড় চু’মু খেয়ে বলল
–হয়েছে? নাকি আরও কিছু লাগবে?

অবনী লাজুক হাসল। বলল
–আমি আসছি।

জুনায়েদ মুচকি হাসল। অবনী চলে যেতেই ডুবে গেলো গভির ভাবনায়। বাং’লা’দে’শে ফিরে যা হতে যাচ্ছে সেটা খুবই চি’ন্তার বিষয়। আশরাফ সাহেবের সব স’ত্যিটা যখন অবনী জা’নতে পা’রবে তখন ওকে কি’ভাবে সা’মলাবে।

—————
বৃষ্টি মুখোর পরিবেশ। রাত থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এয়া’রপো’র্ট থেকে বেরিয়েই অবনী আকাশের দিকে তাকাল। প্রিয় শহর। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে দেখা হওয়ার জন্য যতটা অ’স্থির হয়ে থাকার কথা ছিল তার তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জুনায়েদ এক পলক অবনীর দিকে তাকাল তার চেহারা বেশ গম্ভীর। জুনায়েদ সবটাই খেয়াল করেছে। এতক্ষন এই বিষয়ে কিছু না বললেও এখন অবনীর চেহারা আরও গম্ভীর দেখে বলল
–অবনী তোমার কি শরীর খারাপ?

অবনী মলিন মুখে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে না বলল। জুনায়েদ তেমন কিছু বলল না। ট্যাক্সি ডেকে বলল
–এখন কি মামনির বাসায় যাবে?

অবনী মাথা নেড়ে বলল
–নানুর বাসায় যাবো।

জুনায়েদ অবাক হল। বলল
–কিন্তু তোমার মামনি যে অসু’স্থ। তোমাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর আমি বলেছিলাম আমরা ওখানেই আগে যাবো।

অবনী ট্যাক্সিতে উঠে বসেই সামনে তাকিয়ে বলল
–মামনির সাথে আমার কথা হয়েছে। আগে নানু বাসাতেই যেতে হবে। তারপর মামনির বাসায় যাবো।

জুনায়েদ কোন কথা না বলেই উঠে বসল। অবনীর নানু বাসায় পৌছাতে অনেকটা সময় লেগে গেলো জ্যামের কারণে। অবনী এর মাঝে একটা কথাও বলেনি। জুনায়েদ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো অবনীর এমন আচরণে। হুট করেই মেয়েটার কি হল এমন। গাড়ি থেকে নেমে অবনী সোজা বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। জুনায়েদ লা’গেজ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে অবনী তার নানাকে জড়িয়ে ধরে কা’ন্নাকাটি করছে। জুনায়েদকে দেখে থেমে গেলো। বিয়ের পর জুনায়েদ প্রথমবার এই বাড়িতে এসেছে। তাই আপ্যায়নের শেষ নেই। অবনীকে রেখে তারা জুনায়েদকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এক এক করে সবাই জুনায়েদের সাথে কথা বলছে। তার ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। এদিকে অবনী জুনায়েদকে রেখে বাইরে গেছে। বলে গেছে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। জুনায়েদকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়েই তার বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে জুনায়েদের বিস্ময়ের শেষ নেই। কিন্তু তখন কিছুই বলেনি। এখনো না আসায় জুনায়েদ বিরক্ত হয়ে অবনীকে ফোন করলো। কিন্তু সে ফোনটা রিসিভ করলো না। এবার জুনায়েদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। রাতের খাবারের সময় হতেই অবনী চলে এলো। তাদের জন্য যে ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে জুনায়েদ সেই ঘরে চোখ বন্ধ করে রেস্ট নিচ্ছিল। অবনী দ্রুত ঘরে ঢুকে বলল
–ঘুমাচ্ছেন? খাবেন না?

জুনায়েদ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কোথায় গিয়েছিলে?

অবনী জুনায়েদের সামনে বসে পড়লো। মুচকি হেসে গালে হাত রেখে বলল
–একটা গুরু’ত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়েছিলাম।

জুনায়েদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি এমন গুরু’ত্বপূর্ণ কাজ যা আমাকে জানানো যাবে না?

–আমি তো বলিনি আপনাকে জানানো যাবে না। তবে আপনিও তো সবকিছু আমাকে জানান নি। সে হিসেবে একদম ঠিক আছে।

জুনায়েদ অবনীর কথায় কিছুটা অবাক হয়েই বলল
–আমি কি জানাই নি?

অবনী চমৎকার হেসে বলল
–ঐ যে আপনার গা’র্ল ফ্রে’ন্ডের কথা জানান নি।

জুনায়েদ অবনীর চুল টেনে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–আমার কোন গা’র্ল ফ্রে’ন্ড ছিল না।

–তাহলে কি ছিল?

–কিছুই ছিল না।

অবনী জুনায়েদের হাত থেকে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
–কিছুই ছিল না? কিন্তু আমি তো অন্যকিছু জেনেছি।

জুনায়েদ অবনীকে কাছে টেনে এনে বলল
–স্পষ্ট করে কথা বল। কি বলতে চাও তুমি?

অবনী অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো। বলল
–আপনাকে খেতে ডাকছে। খেয়ে তারপর কথা বলি?

জুনায়েদকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই অবনী উঠে বাইরে চলে গেলো। জুনায়েদ বেশ অবাক হল। অবনীর এমন আচরনের কারণ বুঝতে পারলো না। তাই সেও চলে গেলো বাইরে।

————–
সারারাত জুনায়েদের ঘুম হয়নি ওয়েদার সিক’নেসের কারণে। এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে। অবনী যেহেতু ঘু’মের ঔষধ খেয়েছে তাই সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সকাল বেলা অবনী ঘুম ভেঙ্গে দেখল জুনায়েদ তখন ঘুমাচ্ছে কেবল। তাই আর তাকে ডাকল না। খুব সাবধানে বেরিয়ে গেলো যাতে জুনায়েদের ঘুম না ভেঙ্গে যায়। বাইরে বেরিয়েই সবাইকে বলে দিলো জুনায়েদকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। কিন্তু বেশীক্ষণ ঘুমানো হল না জুনায়েদের। ফোনের শব্দে উঠে গেলো। বি’রক্তি’তে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফোনটা ধরল। জুনায়েদ কোন কথা না বলতেই ওপাশ থেকে জায়েদ রহমান বললেন
–জুনায়েদ তুমি কোথায় এখন?

জুনায়েদ উঠে বসে পড়লো। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক বাবার কথা বুঝতে কিছুটা সময় নিলো। মস্তিস্ক সজাগ হতেই বলল
–অবনীর নানু বাড়িতে। ঘুমাচ্ছিলাম বাবা।

জায়েদ রহমান গম্ভীর গলায় বললেন
–খ’বর শু’নেছ?

জুনায়েদ অস্থির পলক ফেলে মৃদু আওয়াজে বলল
–কিসের খব’র?

–তার মানে তুমি এখনো কিছুই জানো না?

জুনায়েদ বুঝতে পারলো না জায়েদ রহমানের কথা। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি জানার কথা বলছ তুমি?

জায়েদ রহমান একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন
–তৈয়বা নাজনিনের হা’সপাতা’ল সি-ল করে দে’য়া হ’য়েছে। অ’বৈধ ভাবে অ-র্গা-ন সা-প্লা-ই ক’রার জ’ন্য তা’র লা-ই-সে-ন্স’ বাতিল করে এ’রে’স্ট’ করেছে র‍্যা’ব। সাথে আশরাফ সাহেবের সমস্ত কুকীর্তির প্রমান পেয়ে তাকেও এরেস্ট করেছে।

জুনায়েদ থমকে গেলো। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই মাথায় ঢুকল না। বিস্মিত কণ্ঠে বলল
–কি বলছ বাবা? কিভাবে এসব হল?

জায়েদ রহমান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–ঐ বাড়িতে থেকেও তুমি কিছুই জা’নতে পা’রলে না। আর গো’টা বি’শ্ব জে’নে যাচ্ছে।

জুনায়েদ মাথায় হাত দিয়ে বলল
–এটা কিভাবে সম্ভব? সমস্ত প্র’মা’নসহ ফা’ইল গুলো তো আমার কাছে। আর আমি এখনো ওগুলো হ্যা’ন্ড ও’ভার করিনি। এসব কারো হা’তে যা’ওয়া’রও কথা নয়। ই’ন’ফ্যা’ক্ট শামিম আঙ্কেলের সাথে আমার এখনো কথাই হয়নি।

জায়েদ রহমান একটু ভেবে বললেন
–এ ধরনের লোকের তো শ’ত্রু’র কোন অ’ভাব নেই। দেখো হয়তো এম’ন কে’উ আছে যে তোমার ম’তোই ওদের বি’রু’দ্ধে প্র’মান জো’গা’ড় করে ফেলেছে। তোমার আগেই হ’য়তো ব্য’ব’স্থা নি’য়েছে।

জায়েদ রহমান থেমে যেতেই জুনায়েদ গভীর চি’ন্তায় ডুবে গেলো। জায়েদ রহমান কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারন করলেন
–অবনী কোথায়?

জুনায়েদের মস্তিস্ক সজাগ হল। অস্থির হয়ে বলল
–আমি দেখছি বাবা অবনীকে।

ফোনটা কেটে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। অবনী নিশ্চুপ টেবিলে বসে খাচ্ছে। জুনায়েদ অস্থির হয়ে অবনীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বলল
–অবনী।

অবনী ভীষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। অবাক হয়ে বলল
–ঘুম ভেঙ্গে গেলো?

জুনায়েদ লম্বা শ্বাস ছেড়ে তাকাল। বলল
–তুমি ঠিক আছো?

অবনী কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে অদ্ভুতভাবে হাসল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
–আমি ঠিক আছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবেন।

জুনায়েদ অবনীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। বের হয়ে এসে দেখল অবনী কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। জুনায়েদকে দেখতে পেয়েই বলল
–আমি বাসায় আছি আঙ্কেল। আপনার সময় মতো চলে আসবেন।

জুনায়েদ অবনীর পাশে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে অবনী।

অবনী মুচকি হেসে বলল
–কথা তো হবে জুনায়েদ সাহেব। আগে খাবারটা শেষ করুন।

জুনায়েদ কোন কথা বলল না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো। তাদের খাওয়া শেষ হতেই অবনীর নানু বলল
–অবনী তোমার আঙ্কেল এসেছে।

অবনী জুনায়েদের দিকে এক পলক দেখে বলল
–আমরা আসছি।

জুনায়েদকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো বসার ঘরে। সেখানে গিয়েই জুনায়েদ অবাক হয়ে গেলো শামিম সাহেব কে দেখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল
–আঙ্কেল আ’পনি এখানে?

শামিম সাহেব মাথা নেড়ে বলল
–আমি অবনীর সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। খুব বেশী দেরি করবো না।

জুনায়েদ অবনীর দিকে তাকাল। অবনী শামিম সাহেবের সাথে কথা বলছেন। তার সব প্র’শ্নে’র উ’ত্তর অবনী ভীষণ গুছিয়ে দিলো। কথা শেষ করেই তিনি চলে গেলেন। জুনায়েদ অবনীর সামনে দাঁড়ালো। বলল
–তুমি সব জানতে?

অবনী মলিন হেসে বলল
–আপনার ফো’নে মা’মনির কল এসেছিলো সেদিন সকালে। মামনির নাম্বার দেখেই ফোনটা আমি রিসিভ করি। আর আপনাকে ভেবেই মামনি অনেক কথাই বলে। তারপর আমি না’নুকে ফোন করি। নানু প্রথমে বলতে রাজি নাহলেও আমার জে’দের কারণে সব বলে দেয়। তারপর আমি শামিম আঙ্কেল কে ফোন করে যখন সব বলি তখন তিনি আপনার কথা আমাকে জানান। আপনার কাছে যে সব প্র’মা’ন আছে সেগুলো বলে দেন আমাকে। আর আপনি সেগুলো আঙ্কেল কে দি’তে’ই সাথে করে দেশে আনছেন। আমি আপনাকে না জানিয়েই ব্যা’গ থেকে ফা’ই’ল গুলো বের করে আঙ্কেল কে দি’য়ে আসি কাল রাতেই।

সব কথা শুনে জুনায়েদ অবাক চোখে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে ভয় তৈরি হয়। অবনীকে নিয়ে সে খুব চি’ন্তায় ছিল। সবটা জানার পর অবনী কিভাবে নেবে বিষয়টা। কিন্তু পুরো ঘট’নাই এখানে উ’ল্টা। অবনী প্রশস্ত হেসে বলল
–জুনায়েদ সাহেব আপনি ভেবেছিলেন আমি সব জানার পর কিভাবে নেবো। কিন্তু আপনি এটা ভুলে গেছেন যে জীবনে অনেক কিছুই আমি দেখেছি। আমার মা মা’রা যাওয়ার পর বাবা যেদিন বিয়ে করে বাসায় আসলো সেদিনই আমি ভে’ঙ্গে পড়ি। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনি। সৎ মায়ের অ’ত্যাচা’র সহ্য করতাম। কাউকে কিছুই বলিনি। মামনি যখন সব জেনে গেলো তখন আমার উপরে দ’য়া দেখাতেই নিয়ে গেলো আমাকে। বাপিও খুব ভালোবাসতো। ধীরে ধীরে আমার শরী’র খারা’প হতে শুরু করে। মামনি অনেক চেষ্টা করে আমাকে সু’স্থ করে তুলতে। কিন্তু লাভ হয়না। আর আমার ট্রি’ট’মেন্ট নিয়ে যে মামনি আর বাপির ঝগ’ড়া হতো সেগুলো কিন্তু আমার চোখ এড়া’য় নি। তখন সেগুলোর কারণ না জানলেও এখন আমি জেনে গেছি। আপনি চাইলেই স’বটা আমাকে বলতে পারতেন। আমি খুব ভালো প’রিস্থি’তির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। এই যে দেখুন আমি এক’দম ঠিক আছি।

জুনায়েদ অসহায়ের মতো তাকাল। অবনী নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করলেও তার ভেতরে কষ্ট হচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে। অবনীকে এই মুহূর্তে বিদ্ধস্ত লাগছে। আর কোন কথা না বলেই অবনী নিজের ঘরে চলে গেলো। জুনায়েদ কি করবে বুঝতে পারছে না। অবনীকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা তার নেই। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে কিভাবে সামলাবে সে। নিজেকে অসহায় লাগছে তার। হতাশ শ্বাস ছেড়ে ঘরে গেলো। অবনী বিছানায় উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। তার শরীর কেঁপে উঠছে। জুনায়েদ বুঝে গেলো সে কাঁদছে। ধির পায়ে বিছানায় গিয়ে বসল। অবনী বুঝতে পেরেও ঘুরে তাকাল না। জুনায়েদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–অবনী তোমার মামনিকে বাঁ’চানো’র যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করবো। ওনার কোন দো’ষ নেই। উনি পরি’স্থিতি’র স্বীকার। আমি সব ব্যাবস্থা করে ফেলেছি।

জুনায়েদের গলার আওয়াজ শুনে অবনী নিজেকে সামলাতে পারলো না। জুনায়েদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। জুনায়েদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চুলের ভাজে হাত দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কেঁদো না। শান্ত হও। ঠিক হয়ে যাবে।

অবনী শান্ত হল না। কাদতেই লাগল। জুনায়েদের নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। সে চুপচাপ অবনীর কান্না সহ্য করেই যাচ্ছে। এক সময় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো অবনী। জুনায়েদের বুকের মাঝে মাথা রেখেই বলল
–এই জীবনে আমি যাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁ’চতে চেয়েছি সেই আমাকে ছে’ড়ে গেছে।

জুনায়েদ শক্ত করে ধরে বলল
–আমি কখনো যাবো না অবনী। বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে সব সময় ভালো রাখার চেষ্টা করবো।

————
কেটে গেছে অনেকদিন। কলোরাডোর পাহাড় ঘেরা সেই বাড়িটাতে নিস্তব্ধ রাত। অফিসের কাজে কয়েকদিন যাবত জুনায়েদ খুব ব্যস্ত। খুব বেশী সময় সে পাচ্ছে না। কিন্তু অবনীর শরীর খারাপ তাই ডক্টর শাহেরকে এসে একবার দেখে যেতে বলেছে। তিনি এসে অবনীকে দেখে গেছেন। অফিস থেকে সমস্ত ক্লাস শেষ করে ফিরতে জুনায়েদের বেশ রাত হয়ে গেলো। বাসায় ফিরে সোজা নিজের ঘরে গেলো। কিন্তু অবনীকে কোথাও দেখতে পেলো না। এপাশ ওপাশ দৃষ্টি ফিরিয়েও কোথাও দেখতে পেলো না তাকে। এখন জুনায়েদের চিন্তা হচ্ছে। অবনীকে সে অসুস্থ দেখেছে। এপাশ ওপাশ তাকাতেই চোখে পড়লো টেবিলের উপরে একটা খাম। উপরে বড় বড় করে লেখা “মেঘপিয়ন”। জুনায়েদ কৌতূহল বশত সেটা হাতে তুলে নিলো। খামটা নাড়াচাড়া করে খুলে ফেললো। ভেতরের কাগজটা বের করতেই পেছন থেকে মেয়েলী মিষ্টি আওয়াজ কানে আসলো।
–মেঘপিয়নের_ডাকে আপনার চিঠি এসেছে জুনায়েদ সাহেব।

জুনায়েদ কৌতূহলী হয়ে তাকাল। অবনীকে দেখে নিয়ে বলল
–কোথায় ছিলে?

অবনী এগিয়ে এলো। মুচকি হেসে বলল
–খুলবেন না?

জুনায়েদ একটু বিরক্ত হয়েই কাগজটা খুলল। কাগজটা পড়েই থমকে গেলো। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অবনীর দিকে তাকাল। অবনী লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেললো। জুনায়েদ অবনীকে দুই হাতে ধরে বলল
–এটা কি সত্যি? তুমি প্রেগন্যান্ট!

অবনী হেসে মাথা নাড়ল। জুনায়েদ তাকে জড়িয়ে ধরল। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। অবনীকে জড়িয়ে ধরে বলল
–মেঘপিয়নের_ডাকে এতো বড় একটা খুশীর খবর আসবে সেটা আমার ধারনা ছিল না অবনী। আমার জীবনের সবথেকে সুখের মুহূর্ত আমি পেয়ে গেছি।

দুজন নীরবে দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। মেঘ ডেকে উঠছে থেমে থেমে। আকাশ কাঁপিয়ে চলছে প্রেম বর্ষণ।

সমাপ্ত
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here