মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -১২+১৩

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১২

সানফ্রানসিসকো মেঘের শহর। উঁচু উঁচু দালানের মাথায় মোটা মোটা বরফের আস্তরণ। গাছ পালা সবকিছু বরফে ঢেকে আছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু শুভ্র তুষার। আকাশ থেকে অনবরত নিজের খেয়াল খুশিমতো পড়ছে। অবনী বারান্দায় দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে। অন্ধকারের মাঝেও রাস্তার আলোয় শুভ্রতা বেশ নজর কাড়ছে। কিছুক্ষন আগেই তারা দুজনে এসে পৌঁছেছে সানফ্রানসিসকো। পুরো রাস্তায় অবনী জুনায়েদের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি। জুনায়েদের আচরন তার কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। কথা বার্তা কেমন অদ্ভুত। ইচ্ছা করে এমন করছে নাকি অন্যকোন কারণ আছে তার। অবনী ঠিক বুঝতে পারছেনা। জুনায়েদের কথা শুনে কখনো সে বিরক্ত হচ্ছে। কখনো আবার লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। আবার কখনো অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে। মানুষটাকে বেশ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।

–এটা খেয়ে নাও।

কাচের গ্লাসে হলদেটে কোন তরল। একদম নিচে পড়ে আছে। অবনী ভ্রু কুচকে স্বভাব বশত নাকটা এগিয়ে দিলো। উটকো গন্ধ নাকে লাগতেই গা গুলিয়ে এলো তার। দুই আঙ্গুলে নাক চেপে ধরে মুখ বেকিয়ে বলল
–এসব কি? কি বিশ্রি গন্ধ।

জুনায়েদ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–গন্ধটা একটু বিদঘুটে কিন্তু ততটাও না। এই যে কাঁপছ ঠাণ্ডায়। এটা খেলে ঠাণ্ডাটা কম লাগবে।

অবনী নাক ছেড়ে দিলো। স্বাভাবিক হয়ে বলল
–আমি ঠাণ্ডায় মরে গেলেও এটা খাবো না। একদম বাজে।

জুনায়েদ ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিলো। নিজের টাতে এক চুমুক দিয়ে বলল
–এজ ইউর উইশ।

বলেই ভেতরে সোফায় বসে পড়লো। সামনের দেয়ালে টাঙ্গানো বড় স্ক্রিনটা অন করতেই উচ্চ শব্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো ইংরেজি একটা ছবি। অবনী বারান্দাতেই দাড়িয়ে থাকলো। জুনায়েদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবারো বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। জুনায়েদ ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–ভেতরে এসো।

অবনী ভীষণ আব্দারের সুরে বলল
-একটু থাকি না?

–নাহ!

জুনায়েদের কাঠ কাঠ জবাবে সে মুখ ভার করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। জুনায়েদ সামনে তাকিয়েই কঠিন স্বরে বলল
–ক্লোজ দা ডোর।

অবনী দরজাটা শব্দ করেই বন্ধ করে সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অনেক রাত হয়েছে। আজ রাতটা তারা রেস্ট নিয়ে কাল থেকে ঘুরতে বেরোবে। অবনী একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ ভলিউমটা কমিয়ে দিয়ে অবনীর দিকে ফিরে তাকাল। ভীষণ অসহায় দৃষ্টি। মস্তিস্কে নানা রকম চিন্তা ভর করলো। এভাবে সে অবনীর কাছে কোনদিন যেতে পারবে না। কি করলে অবনীর মনে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারবে। যার উপরে অবনী নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করবে। মূলত তাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসার কারণ এটাই। বাইরে জুনায়েদকে ছাড়া অবনী আর কাউকে চেনে না। তাই প্রতিটা ক্ষেত্রে তার উপরেই ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। মোটামুটি বাধ্য হয়েই তার উপরে ভরসা করতে হবে তাকে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাবে জুনায়েদ। অবনীর সম্পূর্ণ বিশ্বাসটা সে অর্জন করে ফেলবে।

————
তৈয়বা নাজনিন অনবরত ঘামছে। আচলে নিজের মুখ আর গলা মুছে নিয়েই সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল
–বিশ্বাস করো। আমি এসবের কিছুই জানিনা। জুনায়েদ কেন এমন করলো আমি সেটাও জানিনা। আমি জানলে এমনটা কিছুতেই হতে দিতাম না।

আশরাফ উদ্দিন টেবিলে জোরে শব্দ করলো হাত দিয়ে। এতে তিনি খানিকটা ব্যাথা পেলেন। কিন্তু তার রাগটা এখন এতই বেশী যে পারলে তৈয়বাকে খুন করে বসেন। নিজের রাগটা সামলে নিয়ে বললেন
–বিশ্বাস করলাম তোমার কথা। কিন্তু কোনভাবে যদি আমি জানতে পারি এর সাথে তোমার কোন যোগসূত্র আছে। তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবো মনে রেখো।

তৈয়বা কেঁপে উঠলো। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আশরাফ উদ্দিন চলে গেলেন। কিন্তু তৈয়বার ভয়টা কিছুতেই কমলো না। ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ১১ টা মানে এখনো জুনায়েদ ঘুমিয়ে পড়েনি। তাকে ফোন দেয়া যেতে পারে। সাত পাচ না ভেবে ফোন লাগাল। কয়েকবার রিং হতেই জুনায়েদ ধরে ফেললো। তার গম্ভীর আওয়াজের বিপরীতে তৈয়বা ভীত কণ্ঠে বলল
–জুনায়েদ আমাকে বাঁচাও।

এমন কথা শুনে জুনায়েদ কয়েক মুহূর্ত ভাবল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–আপনাকে বাঁচাব মানে? কি হয়েছে?

তৈয়বা শুকনো ঢোক গিলে বললেন
–আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য র‍্যাবের অফিসে ডেকেছে। সে জেনে গেছে তুমি সব করেছো। আমাকে সন্দেহ করছে। বলেছে কোনভাবে এর সাথে আমার যোগসূত্র পেলে মেরে ফেলবে।

জুনায়েদ ভীষণ সস্তির কণ্ঠে বলল
–এতো ভাববেন না আনটি। আমি আছি তো। কথা দিয়েছি আপনার কোন ক্ষতি হতে দেবো না। আপনি আমার উপরে ভরসা রাখুন। আর হ্যা আঙ্কেল কে জানানোর ব্যবস্থা আমিই করে দিয়েছি। উনি তেমন কিছুই করতে পারবেন না।

তৈয়বা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন
–অবনী কেমন আছে?

জুনায়েদ অবনীর পাশেই শুয়ে ছিল। তাকে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে। সে এখন কোনভাবেই জেগে যাবে না। তাই তার পাশে কথা বলতেও কোন সমস্যা নেই। মাথায় হাত দিয়ে আদরের ভঙ্গীতে বলল
–ভালো আছে।

–ওর ট্রিটমেন্ট কেমন চলছে? সবকিছু ঠিক আছে তো?

জুনায়েদ অবনীর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–ঠিক আছে।

তৈয়বা আকুলতা নিয়ে বলল
–একটু কথা বলা যাবে? যদি তুমি অনুমতি দাও।

জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এখন ঘুমাচ্ছে। কাল আমি সময় করে অবশ্যই কথা বলার ব্যাবস্থা করে দেবো। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন। অবনী যেন কিছুই না জানতে পারে। এতে ওর ক্ষতি হবে।

তৈয়বা কেদে ফেললো। মুখে আচল চেপে আটকানোর চেষ্টা করলো। বলল
–আমি ওকে আমার সন্তানের মতো মানুষ করেছি। ওর ক্ষতি চাওয়ার সাহস আমার নেই। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। আমি ওকে আমার নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসি।

জুনায়েদ মৃদু হেসে বলল
–আমি জানি। আপনি ভাববেন না। আমি ওর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবো।

তৈয়বা সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলো। ভেতরটা তার চৌচির হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র বোন মারা যাওয়ার পর তার বোনের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নেন। সংসারে আসে সৎ মা। সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচাতেই নিঃসন্তান তৈয়বা বোনের মেয়েকে নিয়ে আসেন সংসার পূর্ণ করতে। তার স্বামী আশরাফও তাকে নিজের মেয়ের মতোই মেনে নেয়। ভরন পোষণে কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু অবনী যতো বড় হতে থাকে তৈয়বা ওর আচরনে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। বিষয়টা ধিরে ধিরে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে অবনী আশরাফের সাথে কথা বললে তিনি বলেন বিষয়টা দেখবেন। কিন্তু অবনীর আচরনের কোন পরিবর্তন হয়না। তাই কারো সাথে কথা না বলে নিজের ডাক্তারি পেশার বদৌলতে নিজেই মেয়ের পরীক্ষা করান। জানতে পারেন ওর ব্লাডে মারাত্মক শক্তিশালী ড্রাগ পাওয়া যায়। কিন্তু এই ড্রাগ শরীরে কিভাবে যায় সেটাই তার মাথায় ঢুকল না। তিনি দেরি না করে বিষয়টা তৎক্ষণাৎ জানান আশরাফকে। কিন্তু তারপরেই ঘটে যায় আসল ঘটনা। আশরাফের সমস্ত মুখোশের উন্মোচন ঘটে। আশরাফ একজন ড্রাগ ডিলার। শহরের নামিদামি একজন ব্যবসায়ি তিনি। কিন্তু তার এই ব্যবসার মূল বিষয় অবৈধ ভাবে ড্রাগ বাংলাদেশে আনা। উচ্চ পদস্থ লোকজনের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় বিষয়টা আরও সহজ হয়ে যায়। আর সে প্রতিদিন কোন না কোনভাবে অবনীর খাবারের সাথে ড্রাগ মিশিয়ে দিত। তার কারণ অবনীর নানা তার মায়ের সম্পত্তির সব অংশ তার নামে লিখে দেয়। আর অবনীকে পাগল বানিয়ে সেটা আত্মসাৎ করার প্ল্যান করেন আশরাফ। পুরো ঘটনা জানার পরে তৈয়বা বিশ্বাস করতে পারেনি। এতদিন ধরে যে মানুষটার সাথে সংসার করে এসেছে সে যে এমন হবে সেটা ধারনাতেও ছিল না। তারপর শুরু হয় অবনীকে বাচানর যুদ্ধ। দ্রুত ঐ বাড়ি থেকে তাকে বের করার চেষ্টা করে তৈয়বা। অবনীকে তার নানার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আশরাফ বারবার তাকে ফিরিয়ে আনে। অবনীও আশরাফকে নিজের বাবার থেকেও বেশী ভালবাসে আর বিশ্বাস করে। আশরাফের ভয়ে তৈয়বা এসব কিছুই কাউকে বলতে পারেনি। কিন্তু অবনীকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময় জায়েদ রহমান বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। আর এক পর্যায়ে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে তৈয়বার শরণাপন্ন হন। ট্রিটমেন্টের বদৌলতে তৈয়বার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় জায়েদ সাহেবের। বাবাকে দেখতেই দেশে আসে জুনায়েদ। তখনই পরিচয় হয় অবনীর সাথে। জুনায়েদের তাকে খুব ভালো লেগে যায়। জায়েদ রহমান বিষয়টা নিয়ে তৈয়বার সাথে আলোচনা করেন। তৈয়বা মনে মনে ভীষণ খুশী হয়। বিয়ে করে হলেও অবনীকে ঐ বাড়ি থেকে সরানো যাবে। কিন্তু এই কথা আশরাফ জানার পর কোনভাবেই রাজি হয় না। এমন কি অবনিকে সে বিয়ে না দেয়ার কথা জানিয়ে দেন। তাদের রাজি না হওয়ায় জুনায়েদ ভীষণ কষ্ট পায়। সে অবনীকে খুব ভালবেসে ফেলে। তাই তৈয়বার কাছে নিজে গিয়ে কথা বলে। জুনায়েদের কাছে প্রথমে কিছু না বললেও তৈয়বা তার কথায় বুঝে যায় জুনায়েদ অবনীকে কতোটা ভালয়াসে। আর সে যে তাকে ভালো রাখবে সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বাধ্য হয়ে জুনায়েদকে সবটা খুলে বলে। জুনায়েদ সব শুনে তার বাবার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। অতঃপর জায়েদ রহমান তার নিজের বুদ্ধি প্রয়গ করেই এমন কিছু করে যাতে অবনী নিজেই বিয়ে করতে রাজি হয়। পুরোটা তার প্ল্যান অনুযায়ী হয়। আর এতে আশরাফ সাহেব জুনায়েদ আর তার বাবার উপরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। প্রতিশধ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। এই লোকটা ভীষণ ভয়ংকর। যে কোন বিপদ ঘটাতে পারে। তৈয়বা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো। ভয়ে ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। না জানি তার মেয়েটার কপালে শেষ পর্যন্ত কি আছে?
#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৩

বাইরের শীতের তীব্রতার চেয়ে ঘরের তাপমাত্রা আরামদায়ক। রুম হিটারের তাপমাত্রায় সকালের ঘুমটা অতুলনীয়। ভীষণ আদুরে এই ঘুমটা ভেঙ্গে কিছুতেই বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না অবনীর। চোখটা বন্ধ রেখেই মুখটা আরও গুঁজে দিলো। মুহূর্তেই আধা জাগ্রত মস্তিস্ক তীব্র সুগন্ধির ঘ্রাণ বুঝে নিতে সক্ষম হয়ে উঠলো। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই থাকলো। ঘ্রাণ আরও তীব্রতর হতেই অবনীর চোখ খুলে গেলো। পুরো মুখটা কম্বলের নিচে থাকায় অন্ধকারে তেমন কিছুই দৃষ্টি গোচর হল না। দ্রুত গতিতে মুখটা তুলে তাকাল বাইরে। পুরুষালী চেহারা দৃশ্যমান হতেই ঝটকা খেলো। কয়েক সেকেন্ড ভাবার সময় নিলো। বুঝে উঠতেই জুনায়েদের হাতের বাধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো নিজেকে। নড়াচড়ার মাঝে গভীর ঘুমে ডুবে থাকা জুনায়েদের ঘুম নষ্ট হতেই বিরক্ত হয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–বিরক্ত করো না প্লিজ। আর একটু ঘুমাতে দাও। আমি অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছি।

অবনী অবাক হয়ে তাকাল। জুনায়েদ আরও ঘনিস্ট হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসতেই অবনী দুই হাতে তাকে ঠেলে দিয়ে বলল
–ছাড়ুন।

আবারো ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় জুনায়েদ বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ফেললো। অবনীর দিকে তাকাতেই সে মৃদু স্বরে বলল
–আমাকে ছাড়ুন।

জুনায়েদের মাথায় ঢুকতেই সে ছেড়ে দিলো। মৃদু স্বরে বলল
–সরি! ঘুমের মাঝে বুঝতে পারিনি। মাঝখানে বালিশ দিয়েছিলাম। সেটা কোথায়?

অবনী তার পাশ ফিরে তাকাল। ঘুমের মাঝে বালিশ সে নিজেই সরিয়ে ফেলেছে। পুরো দোষটা তার। তাই কোন কথা না বলে উঠে গেলো ওয়াশ রুমে। জুনায়েদ সেদিকে তাকিয়ে অবনীর অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো। এই বিষয়টাকে সে ঠিক কিভাবে নেবে সেটাই বুঝতে চাইল। জুনায়েদ চাইলেই রাতে সোফায় শুয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু সে ইচ্ছা করেই সেটা করেনি। ধিরে ধিরে সে অবনীর সাথে দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে চায়। তাই যতটা পারে অবনীর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে। ঠোঁট চেপে হাসল জুনায়েদ। অবনী বালিশটা সরিয়ে ফেলেনি। সে নিজেই ওভাবে রেখেছে যাতে অবনী সেটা তার কাজ ভেবে ভুল করে। নিজের ফোনটা খুঁজে বের করলো। সেটাতেই ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। অবনী বের হয়েই তার দিকে চোখ পড়লো। কিছুক্ষন আগের ঘটনার জন্য ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে লাগলো। জুনায়েদ অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার মামনির সাথে কথা বলবে?

অবনী পেছন ফিরে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হেসে বলল
–মামনি?

জুনায়েদ উঠে বসল। মুচকি হেসে বলল
–বলবে? কল দেবো বাংলাদেশে?

অবনী জুনায়েদের পাশে এসে বসল। ভীষণ অসহায়ের মতো বলল
–মামনি কথা বলবে? বাপি যে…

পুরো কথা শেষ করার আগেই জুনায়েদ অবনীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল
–অনেকদিন হল এখানে এসেছ। তোমার বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছা করে না?

অবনী হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–করে। কিন্তু গিয়ে কি করবো? বাপি তো রাগ করে আছে। কার কাছে যাবো?

জুনায়েদ একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল
–নাও। কথা বল তোমার মামনির সাথে। আমি আসছি।

বলেই চলে গেলো জুনায়েদ। আগেই তৈয়বার নাম্বার ডায়াল করে দিয়েছে সে। দুইবার রিং হতেই তৈয়বা ফোনটা ধরেই ফিস ফিসিয়ে বলল
–জুনায়েদ আমি…।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অবনী বলে উঠলো
–মামনি। মামনি তুমি কেমন আছো?

তৈয়বা থমকে গেলেন। এতদিন পর মেয়ের কথা শুনতে পেয়ে ভীষণ এলোমেলো হয়ে গেলেন। ভেতর থেকে বের হয়ে আসা কান্নাটা আটকাতে পারলো না। আচল চেপে কেদে ফেলে বললেন
–কেমন আছিস মা?

অবনীও নিজের কান্না জড়িত ভারী কণ্ঠটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল
–ভালো আছি মামনি। তুমি কেমন আছো?

–ভালো আছি মা। তুই এখন কোথায় আছিস?

অবনী হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–সানফ্রানসিসকো মামনি। গতকাল রাতেই এসেছি।

তৈয়বা কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–সানফ্রানসিসকো কেন?

–জুনায়েদ আর আমি বেড়াতে এসেছি।

অবনীর কথা শুনে তৈয়বা কিছুটা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কণ্ঠ একটু নরম করে বললেন
–জুনায়েদ খুব ভালো ছেলে মা। তোকে খুব ভালো রাখবে।

অবনীর মনটা উদাসীন হয়ে গেলো। আরও কিছুক্ষন কথা বলে রেখে দিলো ফোনটা। জুনায়েদ এতক্ষন বাইরে গিয়েছিল। অবনীর কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে এলো। ঘরে ঢুকেই দেখল অবনী উদাসীন মনে কি যেন ভাবছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–ব্রেকফাস্ট করবে চলো।

অবনী চমকে তাকাল। কয়েকবার পলক ফেলে চূলগুলো সযত্নে কানের পেছনে গুঁজে দিলো। মায়ের কথাটা কয়েকবার মনে মনে আওড়াল। জুনায়েদ তো তাকে ভালবাসেনা তাহলে কিভাবে ভালো রাখবে। জুনায়েদ অবনীকে ভাবতে দেখে বলল
–শরীর খারাপ লাগছে? বাইরে যেতে না চাইলে ঘরেই ব্রেকফাস্ট আনতে বলি?

অবনী তবুও কোন উত্তর দিলো না। তার দৃষ্টি বাইরে স্থির। জুনায়েদ কথা বাড়াল না। ফোন করে ব্রেকফাস্ট ঘরে দিয়ে যেতে বলল। কিন্তু অবনীর এমন অস্বাভাবিক আচরন দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেলো। তৈয়বা নাজনিনের সাথে ঠিক কি কথা হয়েছে সেটা জানতে হবে। কারণ কথা বলার পর থেকেই অবনী কেমন অন্যমনস্ক। জুনায়েদ অবনীর পাশে বসল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–মামনিকে আমার নামে কি অভিযোগ করলে?

গভীর ভাবনায় ডুবে থাকায় অবনী কিছুটা চমকে উঠলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
–অভিযোগ অভিমান এসব কিন্তু ভালোবাসা থেকে সৃষ্টি হয় জুনায়েদ সাহেব। তার মানে কি আপনি ধরে নিচ্ছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি?

জুনায়েদ গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ভেতর থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি বেরিয়ে এলো তার। কারণ সে জানে অবনী তাকে ভালবাসে না। তাই ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল
–ভালোবাসা? নাটক বন্ধ করো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না সেটা আমি জানি।

বলেই উঠে দাঁড়ালো। ধির পায়ে বারান্দার দরজাটা খুলে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–কে জানে আদৌ কখনো ভালবাসতে পারবে কি না।

অবনী বিস্ময় নিয়ে তাকাল। তার মানে জুনায়েদ বুঝে গেছে অবনী তাকে ভালবাসেনা। সে যে জুনায়েদ কে বিয়েতে বাধ্য করতে সবার সামনে বলেছিল সে জুনায়েদকে ভালবাসে। আর তার সাথে বিয়ে না হলে অবনী আত্মহত্যা করবে। তার সেই ভয়াবহ পাগলামির ফল আজ তাদের এই অনিশ্চিত বৈবাহিক জীবন। ভীষণ এলোমেলো আর জটিলতায় ভরপুর। জুনায়েদের কথার ধরনেই অবনী বুঝে গেলো সে সবটা জানে। তাই সে আর জুনায়েদ কে অন্ধকারে রাখতে চায় না। আজ সব সত্যি বলে দেবে। এতে হয়তো জুনায়েদ তার উপরে খুব রাগ করবে। খারাপ ব্যবহার করবে। কৈফিয়ত চাইবে যে ভালো না বেসেও কেন এমন বাধ্য করলো তাকে এমন একটা সম্পর্কে জড়াতে। জুনায়েদ যা খুশী করুক। তবুও অবনী আজ বলবেই। সাহস করে উঠে দাঁড়ালো। জুনায়েদ দূরে বড় বিল্ডিং গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী অপরাধীর মতো বলল
–জুনায়েদ সাহেব আমি…আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

জুনায়েদ চট করেই ঘুরে তাকাল। হাত গুঁজে পাশে দেয়ালে হেলানি দিয়ে অবনীর দিকে মনোযোগ স্থির করলো। বলল
–বলো।

অবনী বেশ অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। এভাবে জুনায়েদের তাকানোয় দৃঢ় মনোবল ভেঙ্গে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। জুনায়েদ পুরো বিষয়টা বুঝতে পারলো। সে তো সবটাই জানে তবুও অবনীর কাছ থেকে শুনতে চায় আরও একবার। সম্পর্কের এই জটিলতা আর অবনীর অপরাধবধ সবটাই শেষ করে দিতে চায়। তাই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
–আমি অপেক্ষা করছি অবনী। বলো।

অবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আপনাকে ভালবাসি না।

অবনী থেমে গেলো। জুনায়েদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে জানে কিন্তু তবুও অবনীর মুখে এই কথাটা শুনে কষ্টটা কেন বেড়ে গেলো? আহত চোখে তাকাল। অবনী নিচের দিকেই তাকিয়ে বলল
–আমি মিথ্যে কথা বলে আপনাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলাম। বিশ্বাস করুন আমি বলতে চাইনি। কিন্তু আপনার বাবা যখন আপনার পুরো ঘটনা আমাকে জানালো তখন আমি ভাবলাম আপনাকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই। তাই মিথ্যে বলে বিয়ে করতে বাধ্য করি আপনাকে। যাতে সবাই আমার কথা ভেবে আপনাকে প্রেসারাইজ করে।

জুনায়েদের ভ্রু কুচকে এলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি বলেছে বাবা?

অবনী তাকাল পিটপিট করে। বলল
–আপনি যাকে ভালবাসতেন সে অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলে। তাই আপনি হতাশায় বারবার সুইসাইড করতে চান। আপনাকে সেখান থেকে বাঁচাতেই আপনার বাবা একজন দায়িত্বশীল মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চান। আর আমাকে দেখে ওনার একদম সেরকম মনে হয়েছে। উনি আমার হাত ধরে কান্নাকাটি করেন। আমি সহ্য করতে না পেরে ওনার কথায় মিথ্যে বলি।

জুনায়েদ ভীষণ বিরক্ত হল তার বাবার উপরে। আর কোন গল্প পেলো না? এমনিতেই সে অবনীকে ভালবাসে সেটা বলতে পারছে না। তার উপর আবার এমন একটা গল্প। এখন কিভাবে তার ভালোবাসা অবনীকে বোঝাবে। যা আশা ছিল বাবার এই গল্প সেটাও ভেস্তে দিলো। জুনায়েদ হতাশ শ্বাস ছাড়ল। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। তার এই অসহায় চেহারা অবনীর দৃষ্টি গোচর হতেই সে ধরেই নিলো পুরাতন কথা ভেবে জুনায়েদ কষ্ট পাচ্ছে। অবনী নরম স্বরে বলল
–এসব নিয়ে কষ্ট পাবেন না। আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আপনাকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করেছে তাই বলে আপনি কেন নিজেকে কষ্ট দেবেন। জীবনটা অনেক সুন্দর জুনায়েদ সাহেব। নিজের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করুন দেখবেন খুব ভালো লাগবে। আপনার ভালোবাসা তো মিথ্যা নয়। আপনি তো তাকে মন থেকে ভালবাসেন তাহলে আপনার তো কোন অপরাধ নেই। ব্যর্থতা তার যে আপনার মতো প্রেমিকের ভালোবাসা বুঝতে পারলো না। এমন ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে চোখ বন্ধ করেও পুরোটা জীবন কাটানো যায়। আপনার রাগটা একটু বেশী কিন্তু মনটা খুব ভালো। আপনি খুব ভালো মানুষ।
চলবে……
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here