মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -১৪+১৫

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৪

মেঘ ছুঁয়ে ভেসে আসা ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়াটা উষ্ণ পরিবেশটা শীতল করে দিয়েছে। রুম হিটারের কার্যক্ষমতাও তার কাছে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। উষ্ণ আবরণে ছেয়ে থাকা ঘরটার পরিবেশ শীতল হয়ে উঠেছে। জুনায়েদের শীতল দৃষ্টি তার থেকেও বেশী শিহরণ তৈরি করছে অবনীর জন্য। সে অসস্তিতে পড়েছে ভীষণ। এতক্ষনের কথাগুলো এক নিশ্বাসেই বলে থেমেছে অবনী। হয়তো অনধিকার চর্চা হয়ে গেলো। কিন্তু একজন মানুষ তার চোখের সামনে এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর সে চুপ করে দেখে থাকবে। হোক না অনধিকার চর্চা তবুও সে সান্ত্বনা দেবেই। জুনায়েদ যদি তার উপরে খুব রাগ করেও বসে তবুও সে চুপ করে মেনে নেবে। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলছে। অপেক্ষা করছে জুনায়েদ কখন তার তীব্র রাগ দেখাবে। সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু তার সমস্ত ধারনা মিথ্যে প্রমান করে জুনায়েদ চাহুনির থেকেও শীতল কণ্ঠে বলল
–এসব যদি তাকে বোঝাতে পারতাম তাহলে হয়তো নিজকেও বোঝাতে পারতাম জীবনটা কত সুন্দর। আমার ভালোবাসার গভীরতা যদি সে কখনো উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে আমি নিজেও শান্তি পেতাম। তার মাঝেই জীবনের সব সুখ খুঁজে নিতাম। একবার শুধু আমার হাত ধরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়ার প্রয়াশ যদি সে করে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি। পুরোটা জীবন তাকে ভালবাসায় আগলে রাখবো। এই জীবনে কোন কষ্ট তাকে ছুঁয়ে দিতেও পারবে না। আমার এই তীব্র ভালোবাসার চাদরে তাকে ঢেকে রাখবো যত্নে।

অবনী তাকাল অদ্ভুত ভাবে। মাথায় ঘোরাফেরা করা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় কৌতূহল বশত বলল
–সে টা কে?

জুনায়েদ উত্তর দিলনা। লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–দরজা খোলো। খাবার এসেছে।

অবনী কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দরজা খুলতে গেলো। সত্যিই খাবার এসেছে। জুনায়েদের আবেগের মাঝে এতটাই গভীর ভাবে ডুবে গিয়েছিল সে যে দরজায় করা সূক্ষ্ম আওয়াজটাও তার কানে আসেনি। খাবারটা নিয়ে টেবিলে রাখল। জুনায়েদ ততক্ষণে উল্টা দিকে ঘুরে গেছে। বাইরে তাকিয়ে আছে সে। অবনী সেদিকে তাকিয়ে বলল
–খাবেন না? ভেতরে আসুন।

জুনায়েদ ঠাণ্ডায় কম্পমান ভীষণ হতাশ কণ্ঠে বলল
–ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে নাও।

অবনীর মন খারাপ হল। তারা বেড়াতে এসেছিলো এখানে। কিছু আনন্দের মুহূর্ত কাটাতে। কিন্তু এসেই অবনীর এইসব কথা হয়তো জুনায়েদকে বলা উচিৎ হয়নি। তার যে খুব মন খারাপ হয়েছে সেটা আচরনেই প্রকাশ পাচ্ছে। খাবারটা পুনরায় ঢেকে রেখে বিছানায় বসে পড়লো সে। জুনায়েদ ততক্ষনে সিগারেট জ্বালিয়েছে। সম্পূর্ণ সিগারেট শেষ করে তবেই ভেতরে এলো। এসেই চোখ পড়লো বিছানায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকা অবনীর উপরে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–এভাবে বসে আছো কেন? খারাপ লাগছে?

চোখ মেলে তাকাল অবনী। মৃদু কণ্ঠে বলল
–খারাপ লাগছে না। এমনিতেই।

খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমাকে না খেতে বললাম? খাওনি কেন?

অবনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
–আমিও তো আপনাকে খেতে বলেছিলাম। আপনি খেলেন?

আচমকা এমন ধমকে জুনায়েদ ভড়কে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। ভীষণ অপরাধীর মতো বলল
–সরি। আসো। খাবে।

————
সানফ্রানসিসকোর তাপমাত্রা এখন মাইনাসে। ভীষণ শীত সেখানে। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা। হিম শীতল হাওয়াটা শরীরে এসে লাগতেই পুরো শরীর যেন টনটন করে উঠছে। সাথে হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। জুনায়েদ অবনীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর অবনীর শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই তারা একটু দেরিতেই বের হয়। দুপুরে লাঞ্চ করে বেরিয়েছে তারা। তাই ঠাণ্ডাটা এখন একটু বেশীই। ভারী শীতের কাপড় আর গাড়িতে রুম হিটারের ব্যবস্থা থাকায় তেমন ঠাণ্ডা এখনো লাগছে না। অবনী আর জুনায়েদ একটা ট্যাক্সি হায়ার করেছে। তারা বে ব্রিজ দেখতে যাবে। পেছনে বসে অবনী জানালা দিয়ে উঁকি ঝুকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। কিছু একটা চোখে পড়তেই কৌতূহল বশত জুনায়েদের দিকে তাকাল জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু তার থমথমে মুখ দেখেই থেমে গেলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। খুব একটা কথাও বলছে না সে। আনমনেই কিছু একটা ভাবছে। সেই সকাল থেকেই এমন করছে। জুনায়েদের মুখ দেখেই অবনীর সকল প্রশ্ন করার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে দিলো মন। তাই আবারো জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। তৎক্ষণাৎ কানে এলো ভারী গম্ভীর কণ্ঠ
–কিছু বলবে?

অবনী ঘুরে তাকাল। জুনায়েদ ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। অবনী বেশ অবাক হল। সে যে তার দিকে তাকিয়েছিল সেটা তো জুনায়েদ দেখেনি। কিভাবে বুঝল অবনী কিছু বলতে চায়? প্রথম প্রশ্নটা মাথায় আসতে করেই ফেললো
–আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলতে চাই কিনা?

জুনায়েদ চোখ তুলে তাকাল। অবনীর কৌতূহলী চঞ্চল দৃষ্টির মাঝে নিজের গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল
–আমার চোখ আছে। মস্তিষ্কও বেশ সচল। সব থেকে বড় কথা আমার অনুভূতি অনেক গভীর। এই গভীরতা আমার পাশের মানুষটার ছোট ছোট আহ্বান জানিয়ে দেয়।

অবনী বিস্মিত চোখে তাকাল। জুনায়েদের কথার অর্থ তার মস্তিস্ক ধরতে পারলো না। জুনায়েদ ওভাবেই তাকিয়ে থেকে বলল
–কি বলতে চেয়েছিলে?

অবনী ঘোর থেকে বের হল। বলল
–কিছুনা।

জুনায়েদ হতাশ হয়ে ফোনের দিকে তাকাল। এই মেয়ে কি তার কথা কোনদিনও বুঝবে না। তার মনের অনুভূতি গুলো কি কখনো অবনীকে জানাতে পারবে না। ভেতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অবনী বুঝে গেলো জুনায়েদের মনের অবস্থা ভালো না। তাই আর তাকে বিরক্ত করলো না। সেও চুপচাপ হয়ে গেলো। কিন্তু অবনীর এমন চুপ থাকাটাই জুনায়েদের পছন্দ না। কিভাবে অবনীকে বোঝাবে সে। ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে স্ক্রিনটা বন্ধ করে দিলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–মনের কথা জমা রাখতে নেই। যা বলতে ইচ্ছা করে বলে দিতে হয়। এতে নিজের মনের বোঝা হালকা হয়।

অবনী ঘুরে তাকাল। মৃদু স্বরে বলল
–তেমন কিছু বলার ছিল না।

অবনীর কেমন মন খারাপ। বিষয়টা জুনায়েদ বুঝতে পেরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল
–ঠিক আছে। তবে অন্যকিছু তো বলতে পারো। কেমন লাগছে বেড়াতে এসে সেটা নিয়ে কিছু বলো।

অবনী কিছুটা সময় নিয়েই উত্তর দিলো। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে বলল
–এতো সুন্দর ওয়েদার। এতো সুন্দর জায়গা আর আপনার মতো ভ্রমন সঙ্গী থাকলে খারাপ লাগার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। সঙ্গী হিসেবে আপনি খারাপ না জুনায়েদ সাহেব।

জুনায়েদ সরু চোখে তাকাল। বলল
–ফ্লার্ট করছ আমার সাথে?

অবনী শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–কেন ভয় পাচ্ছেন? ফ্লার্ট করলে প্রেমে পড়ে যাবেন বুঝি?

–যদি পড়ে যাই?

জুনায়েদের ভীষণ আবেগি কণ্ঠ শুনে অবনী আবারো স্থির হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল
–কারো প্রেমে পড়া কি এতটাই সহজ? বললেই প্রেম হয়ে যায়?

জুনায়েদ সামনে তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–সহজ কি কঠিন জানিনা। তবে প্রেমের বিষয়টা অনেক জটিল। প্রেমে না পড়া অব্দি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়না। এই যে আমি সারাজীবন প্রেম বিষয়টাকে ইগনোর করে এসেছি। অথচ কখন কোথায় কিভাবে প্রেমে পড়লাম সেটা নিজেও জানিনা। প্রেমে পড়ে তবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি।

অবনী মুগ্ধ হয়ে জুনায়েদের কথা শুনছিল। জুনায়েদ বাইরে তাকিয়ে আছে আর অবনী তার দিকে। মানুষটাকে প্রথম যেমন ভেবেছিলো ঠিক তার উল্টা। ভীষণ বদমেজাজি একজন মানুষের মধ্যে এতো নরম মনের বসবাস থাকতে পারে সেটা হয়তো জুনায়েদ কে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। অবনীর মনে হল জুনায়েদ যাকে ভালবেসেছে সে সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। তার ভালোবাসা গ্রহন না করার অপরাধে সেই নারীকে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম ভাগ্যের অধিকারী হিসেবে আখ্যা দিলেও কিছুই ভুল হবে না। #মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৫

অবনী খুব তাড়াহুড়ো করে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা কলোরাডোর পথে রওনা হবে। তিনদিন হল অবনীরা সানফ্রানসিসকো এসেছে। এই তিনদিনে আশেপাশের মোটামুটি দর্শনীয় স্থান গুলো দেখে ফেলেছে তারা। দূরের গুলোতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি এখনো। কথা ছিল ১ সপ্তাহ থাকবে। কিন্তু আজই তাদেরকে এমারজেন্সি কলোরাডোতে ফিরে যেতে হচ্ছে। কারণ জায়েদ রহমান হুট করেই অসুস্থ হয়ে জান কাল রাতে। ওনার ভাই জুবায়ের রহমান তার পরিবার নিয়ে দুইদিন আগেই তাদের বাড়িতে এসেছে। তিনিই ফোন করে জুনায়েদকে খবর দিয়েছেন। তখন থেকেই সে ভীষণ চিন্তিত। আর তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবনী সব গুছে নিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকাল। সে ভীষণ চিন্তিত হয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। অনেক্ষন ধরেই কথা বলছে সে। অবনী সেদিকেই তাকিয়ে আছে। কোন সিরিয়াস কিছু কিনা বুঝতে চেষ্টা করছে। জুনায়েদের কথা শেষ হতেই সে ভেতরে চলে আসলো। অবনী অস্থির হয়ে বলল
–সিরিয়াস কিছু হয়েছে কি? বাবা ঠিক আছে তো?

জুনায়েদ শ্বাস ছেড়ে ছোট্ট করে বলল
–আছে।

অবনী যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। জুনায়েদের চেহারায় চিন্তার ছাপ। জুনায়েদ ফোনটা পকেটে রেখে বলল
–তুমি রেডি? চলো।

অবনী মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। দুজনে সবকিছু নিয়ে বের হয়ে গেলো হোটেল থেকে। পুরো রাস্তায় জুনায়েদ খুব প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলল না। অবনীও আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারলো না। বাসায় ফিরলে তো জানতেই পারবে সবটা। ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সে। এমনিতেই জুনায়েদ অনেক টেনশনে আছে। সে আর তাকে বিরক্ত করবে না। তাই নিজের সমস্ত কৌতূহল দমিয়ে রাখতে বাধ্য হল।

————-
অবনীরা যখন কলোরাডোতে পৌছায় তখন দুপুর। এতক্ষন জুনায়েদ সবকিছু অবনীর কাছ থেকে চেপে রাখলেও বাসায় এসে সে সবটা বুঝতে পারলো। জায়েদ রহমানের মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এসব কিছুই জুনায়েদ তাকে জানায়নি। এসেই সে চলে গেছে হাসপাতালে। অবনী জুবায়ের রহমানের স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাসায় আছে। জুবায়ের এর স্ত্রী সেলিনা বাঙালী মহিলা। ভীষণ সুন্দরী। অবনী এসেই নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। ফ্রেশ হয়ে একদম নিচে এসে রান্না ঘরের দিকে গেলো। সেখানে সেলিনা বেগম কে দেখেই দাড়িয়ে গেলো। সেলিনা অবনীকে দেখে চমৎকার হেসে বললেন
–ওখানে কেন দাড়িয়ে আছো? এখানে আসো।

অবনী এগিয়ে গেলো। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–জার্নি করে এসেছ। টায়ার্ড লাগছে? চা দেই তোমাকে?

অবনী মহিলার ব্যবহারে বেশ অবাক হল। প্রথমবার তার সাথে দেখা অথচ এমন ভাবে কথা বলছে যেন অনেকদিনের পরিচয়। অবনী মৃদু হেসে বলল
–আমি ঠিক আছি চাচি। চিন্তা করবেন না।

সেলিনা বেগম বেশ হাস্যজ্জল মুখে বললেন
–জুনায়েদ আমাকে ছোট মা ডাকে। তুমিও ডাকবে।

অবনী হেসে ফেললো। বলল
–ঠিক আছে ছোট মা।

কথা শেষ হতেই সেলিনার মুখ মলিন হয়ে গেলো। চিন্তিত চেহারায় বলল
–সেদিন রাতে খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভাইজান এখন একটু সুস্থ আছে সেটা জেনে ভালো লাগছে। কিন্তু চিন্তা মুক্তো হতে পারছি না। জুনায়েদ ভীষণ একা। যতই আমরা থাকি না কেন। মা বাবার সাথে কারো তুলনা হয়? ভাবী মারা যাওয়ার পর ছেলেটা ভীষণ একা হয়ে যায়। আমরাও অতদুর থেকে এসে সময় দিতে পারিনা। ভাইজান খুব চেষ্টা করেছে ওর একাকীত্ব দূর করতে। ছেলেটা না ভীষণ চাপা জানো। নিজের কষ্ট কারো কাছেই বলেনা। মনের কথাগুলো কাউকেই জানায় না সে।

অবনীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এমন একটা মানুষ নিজের মধ্যে এতো কষ্ট চেপে রাখে অথচ কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। মানুষটা ভীষণ অদ্ভুত! তার মধ্যে কখন কি চলে কেউই বুঝতে পারে না। অবনী বেশ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো
–বাবা এখন কেমন আছে ছোট মা?

–জুনায়েদ কে একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করলে হতো না? আমি তো তোমার ছোট বাবাকে ফোন করার সুযোগই পাইনি। সেই সকালে শুনেছি আগের থেকে সুস্থ।

অবনী মাথা নেড়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এলো। ফোনটা নিয়ে জুনায়েদের নাম্বারে কল দিতেই অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে ফোনটা রিসিভ হল। ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–হ্যালো।

অবনী নরম কণ্ঠে বলল
–বাবা কেমন আছে?

–ভালো আছে।

জুনায়েদ সময় না নিয়েই উত্তর দিলো। অবনী আবারো জিজ্ঞেস করলো
–জ্ঞান ফিরেছে।

–হুম।

থেমে গেলো অবনী। ওপাশ থেকে ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো কয়েক সেকেন্ড। আবারো বলল
–আপনি খেয়েছেন?

–নাহ।

জুনায়েদের এরকম ছোট ছোট উত্তর অবনীর পছন্দ হল না। হুট করেই রেগে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
–এভাবে কেন কথা বলছেন? কথা বলতে ইচ্ছা না হলে রেখে দেন।

জুনায়েদ থমকাল। রাগ করার কারণ না বুঝেও ভীষণ নরম কণ্ঠে বলল
–আমি কখন বললাম কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। যা জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিলাম তো। তবুও রাগ করছ কেন?

অবনী কঠিন গলায় বলল
–থাক আর উত্তর দিতে হবে না। আমি রাখছি।

রাখছি বলেও ফোনটা রাখা হলনা অবনীর। ওপাশ থেকে জুনায়েদর আকুল কণ্ঠ কানে আসতেই থেমে গেলো
–প্লিজ রাগ করো না। তুমিও খাওনি তাই না? আমার আসতে লেট হবে। খেয়ে নাও প্লিজ।

অবনী মুচকি হেসে বলল
–ঠিক আছে। আপনিও খেয়ে নেবেন।

ফোনটা কেটেই অবনী রান্না ঘরে গেলো। সেলিনার পাশে দাড়িয়ে বলল
–ছোট মা বাবার জ্ঞান ফিরেছে।

সেলিনা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ততক্ষণে তার রান্না শেষ। অবনীর হাত ধরে বললেন
–চলো। আমরা একসাথে খাবো।

অবনী সেলিনার সাথে টেবিলে আসলো। এলেক্স আর রোজ এক এক করে সমস্ত খাবার এনে টেবিলে রাখল। অবনীকে বসতে বলে সেলিনা হাক ছেড়ে ডাকল
–সিয়া, সারা খেতে এসো।

অবনী পেছন ঘুরে তাকাল কৌতূহল নিয়ে। বাসায় আসার পর থেকে সেলিনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। এই দুটো নাম প্রথম শুনছে সে। দুজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো। একজন একটু বড়। আর আরেকজন ছোট। অবনী তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারাও আগ্রহ নিয়ে অবনীকে দেখছে। সেলিনা এভাবে একে অপরকে দেখতে দেখে বলল
–আমার দুই মেয়ে।

অবনী বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জা পেলো। সেলিনাকে একবারও বাচ্চার বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। অথচ তার জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল বাচ্চারা এসেছে কিনা। অবনী নিজের লজ্জাটা লুকিয়ে ফেলে মুখ ভর্তি হেসে বলল
–কেমন আছো তোমরা?

সারা ভীষণ মিষ্টি হেসে বলল
–ভালো আছি। তুমি ভাবী?

অবনী হেসে মাথা নাড়ল। সিয়া তখনও ছোট ছোট চোখে অবনীকে সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছে। অবনী তার হাত ধরে কাছে টেনে বলল
–কেন কথা বলছ না? আমাকে ভালো লাগেনি?

অবনী তাকে কোলে তুলে নিতেই সে থমথমে মুখে বলল
–ভালো লেগেছে। কিন্তু তুমি তো অপরিচিত। অপরিচিতদের সাথে আমি বেশী কথা বলিনা।

ছোট্ট সিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। টেবিলে বসেই সবার সাথে ভালভাবে পরিচয় পর্বের সাথে দুপুরের খাবারটা শেষ করে ফেললো অবনী। তারপর বসে সবাই মিলে অনেক গল্প করলো। কেটে গেলো অনেকটা সময়। বিকেলের দিকে খবর এলো জায়েদ রহমান এখন সুস্থ। কালকের মধ্যেই হয়তো বাসায় আনতে পারবেন। সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেললো। সন্ধ্যা হতেই অবনী বাড়ির যোগ্য বউয়ের মতো চলে গেলো রান্না ঘরে। সবার জন্য চা নাস্তা বানাতে লাগলো। এখানে আসার পর অবনী একটা বিষয় খেয়াল করেছে এই দুই পরিবার এতো বছর ধরে বিদেশে থাকলেও বাঙালী সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে একনিষ্ঠ ভাবে ধারন করেছে। এমনকি বিদেশে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের মাঝেও সেই সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। তাই তাদের খাবারের ধরনেও পুরো বাঙ্গালিয়ানা দেখা যায়। এই পরিবারের প্রতিটা মানুষ অনেক আন্তরিক। তাদের ব্যবহারে অবনী মুগ্ধ। খুব ভাল লেগেছে এই পরিবারকে তার। বেশ আয়োজন করে সন্ধ্যার চা নাস্তাটা তারা খেলো। খাওয়া শেষ করেই অবনী রাতের রান্নার আয়োজন করতে রান্না ঘরে গেলো। সেলিনা অনেকবার রান্না ঘরে যেতে চাইলেও অবনী তাকে ঢুকতে দিলো না। বাড়ির বউ হিসেবে সে তার সব দায়িত্ব পালন করবে। রাতের রান্না শেষ করে রান্না ঘর থেকে বেরিয়েছে অবনী। বাইরে সোফায় সারা বসে মোবাইলে গেম খেলছে। অবনীকে দেখে বলল
–ওহ! ভাবী ভাইয়া উপরে যাওয়ার সময় কফি দিতে বলেছে তোমাকে। আমি বলতে ভুলেই গেছি।

অবনী জুনায়েদের রুমের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার ভাইয়া এসেছে?

সারা মাথা নাড়িয়ে বলল
–একটু আগেই এলো।

অবনী জুনায়েদের জন্য কফি বানিয়ে উপরে গেলো। ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল পুরো ঘর অন্ধকার। কিছুটা সময় স্থির হয়ে এদিক সেদিক তাকাল। বারান্দার আলো দিয়েই ভেতরে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। কানে এলো জুনায়েদের গলা। বারান্দায় দাড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। অবনী কফি নিয়ে সেদিকে গেলো। জুনায়েদ চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে। অবনী টেবিলে কফিটা রেখে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জুনায়েদ তার হাত ধরে ফেলে। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় অবনী। জুনায়েদ তখনও ফোনে কথা বলছে। অবনী হাতের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদ কথা শেষ করা পর্যন্ত হাত ধরেই থাকলো। কথা শেষ করে টেবিলে ফোনটা রেখেই ঘুরে তাকাল। অবনীকে হাতের দিকে অমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত ছেড়ে দিলো। বলল
–সরি। আসলে ফোনে কথা বলছিলাম তো তাই তোমাকে দাঁড়াতে বলতে পারছিলাম না। একটু কথা ছিল তোমার সাথে।

অবনী শান্ত হল। বলল
–কি কথা?

জুনায়েদ ভীষণ শান্ত কণ্ঠে বলল
–এখন থেকে এই রুমে থাকবে। তোমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই রুমে নিয়ে আসো।

দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা হাওয়াটা শরীরে লাগতেই শিরশির করে উঠলো। বাড়িতে প্রতিটা ঘরে রুম হিটারের স্বাভাবিক তাপমাত্রা আর ফায়ার প্লেসের কারনে ভেতরে তেমন ঠাণ্ডা অনুভুত হয়নি। তাই অবনী খেয়াল করেনি ঠাণ্ডাটা এতো তীব্র। শীতের কাপড়ও পরেনি তেমন। বারান্দার হাওয়াটা লাগতেই মস্তিস্ক তীব্র ঠাণ্ডার আভাস জানিয়ে দিলো। অবনী কিছুটা কেঁপে উঠতেই জুনায়েদ বলল
–শীতের কাপড় পরনি কেন? ঠাণ্ডা লাগছে তো।

অবনী উত্তর দিলনা। জুনায়েদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আসলে বাসায় গেস্ট এসেছে। তাদের সামনে এভাবে আলাদা ঘরে থাকলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়। বাবা সবটাই জানে। তাই তার কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও আর সবার কাছে…।

জুনায়েদকে কথা শেষ করতে দিলো না অবনী। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠলো
–আমিও এটা ভেবেছি। এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি না বললেও আমি চলে আসতাম।

জুনায়েদ বেশ অবাক হল। মনে মনে খুশীও হল। অবনী আবারো চলে যেতে চাইলে জুনায়েদ বলল
–থ্যাঙ্কস অবনী।

অবনী থেমে গেলো। ঘুরে তাকিয়ে বলল
–বাড়ির বউ হিসেবে আপনার থেকে ভাবনা আর দায়িত্বটা আমার একটু বেশীই জুনায়েদ সাহেব। এসব ছোট বিষয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে।

অবনী চলে যেতেই জুনায়েদ হেসে ফেললো। অবনী সেই হাসি দেখলে হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করে ফেলত। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত সেই হাসি তার চোখেই পড়লো না।

চলবে…

(
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here