মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -১৬+১৭

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৬

রাতের খাবার টেবিলে জুবায়ের রহমানের সাথে অবনীর পরিচয় হল। তিনিও বেশ ভালো মানুষ। বেশ হাসি খুশী। জুবায়ের রহমান জুনায়েদকে উদ্দেশ্য করে বললেন
–ভাইজান অসুস্থ নাহলে তো তোদের সাথে আমাদের দেখাই হতোনা। তোরা ফিরে আসার আগেই আমরা চলে যেতাম।

জুনায়েদ খাবার মুখে পূরে বলল
–তোমরা বল নি কেন আসছ। তাহলেই তো প্ল্যান ক্যান্সেল করতাম।

সেলিনা ভীষণ কঠিন গলায় বলল
–প্ল্যান ক্যান্সেল করবি মানে কি? বিয়ের পর বউ নিয়ে প্রথম বেড়াতে গিয়েছিস। আর প্ল্যান ক্যান্সেল করবি বলছিস?

জুনায়েদ বেশ শান্ত চোখে তাকাল। স্বাভাবিকভাবেই বলল
–বউ যেহেতু আমার তাই আমি তাকে নিয়ে যখন ইচ্ছা তখন বেড়াতে যেতে পারি। এতে নিশ্চয় কোন শিডিউল নেই যে বিয়ের পরেই যেতে হবে। পরেও তো যেতে পারতাম। তাছাড়া বউ তো আমার কাছেই থাকছে। পালিয়ে যাচ্ছে না।

জুবায়ের রহমান হেসে উঠলেন শব্দ করে। বললেন
–তুই একদম চেঞ্জ হস নি। আগের মতোই কথা বলিস।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু অবনীর ভীষণ অসস্তি হল। লজ্জায় তার চেহারা লাল হয়ে গেলো। চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছে না। এমনকি কথা বলাতেও জড়তা কাজ করছে। এমন একটা কথা বলে এই পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য জুনায়েদের উপরে তার ভীষণ রাগ হল। জুনায়েদ অবনীর দিকে তাকিয়ে সবটা বুঝতে পেরেই মুচকি হাসল। সবার খাওয়া শেষ। টেবিল ছেড়ে সবাই উঠে গেলেও জুনায়েদ বসেই থাকলো। ফোনের দিকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ম্যালিনা টেবিল গুছিয়ে নিচ্ছে। আর অবনী তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সব। জুনায়েদ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ম্যালিনার দিকে তাকাল। চোখে চোখে কিছু একটা ইশারা করলো। বেখেয়ালি অবনী সেদিকে খেয়াল করলো না। ম্যালিনা রান্না ঘর থেকে জুস ভর্তি গ্লাস এনে অবনীকে দিলো। অবনী বেশ বিরক্ত হয়ে বলল
–প্রতিদিন এই সময় আমাকে এটা কেন দাও বলতো?

ম্যালিনা মলিন মুখে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। জুনায়েদ অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল
–কারণ আমি বলেছি তাই। এই জুস অনেক হেলদি। এটা খেলে তুমি সুস্থ থাকবে। আর না খেলে তুমি এই ওয়েদারে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন বাবা সম্পূর্ণ দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। তার উড়ে এসে জুড়ে বসা ছেলের বউয়ের অসুস্থ হওয়ার জন্য ছেলের হাত আছে। এই দোষ আমি কোনভাবেই ঘাড়ে নিতে রাজি না। তাছাড়াও বউ যেহেতু আমার দায়িত্বটাও তো আমারই।

অবনী জুসের গ্লাসটা টেবিলে রেখে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–আপনি আজকাল কেমন অদ্ভুত কথা বলছেন।

জুনায়েদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–কেমন অদ্ভুত?

অবনী চিন্তিত মস্তিস্কে বলল
–ঐ যে তখন বললেন বউ…। কিসব থাকা পালিয়ে যাওয়া। আবার এখন…।

মাঝপথেই অবনীকে থেমে দিলো জুনায়েদ। কণ্ঠে কৌতুক মিশিয়ে বলল
–বউ বলে ভুল করেছি? গার্ল ফ্রেন্ড বলা উচিৎ ছিল?

অবনী রেগে গেলো। বলল
–এমন অসভ্যের মতো উদ্ভট কথা কেন বলছেন?

–আমি যথেষ্ট সভ্য। এই তিনদিনে আমার সাথে থেকে নিশ্চয় এটা ভালো করেই বুঝতে পেরেছ। অসভ্য হলে সেটার প্রমাণও এই কয়দিনেই পেয়ে যেতে। তখন এই কথাটা বললে আমি মেনে নিতাম। আর শুনতেও ভালো লাগতো যে বিয়ে করা বউ তার হাসবেন্ড কে কোন এক বিচিত্র কারনে অসভ্য উপাধি দিচ্ছে। এখন এটা অপবাদ। আর এই অপবাদ আমি কিছুতেই মানতে পারছি না।

অবনীর মুখ হা হয়ে গেলো। তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই জুনায়েদ কথা শুরু করেছে। যেন সে জানত অবনী কি বলবে আর ঠোঁটের আগায় সেটার উত্তর গুছিয়েও রেখেছিল। ম্যালিনা এতদিন এই বাঙালী বাড়িতে থাকার সুবাদে বাংলা ভাষা ভালভাবে আয়ত্ত করতে না পারলেও সবটাই বুঝতে পারে। তাই জুনায়েদের এমন কথা শুনে সে ঠোঁট চেপে হাসল। অবনী তার দিকে রক্তিম চোখে তাকাতেই মুখে হাত দিয়ে হাসিটা লুকিয়ে ফেললো। অবনী বিড়বিড় করে বাংলায় বলল
–এমন ভাবে হাসছে যেন সব বুঝে গেছে। পাগল কোথাকার।

ম্যালিনা কথাটা শুনতে পেলো আর বুঝতেও পারলো। তাই ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ উচ্চারন করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলো
–পাগল না। আমি বুঝেছি। বউ।

অবনী বোকা চোখে তাকাল। জুনায়েদ ঠোঁট চেপে হেসে ফেললো। অবনী তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেরাতেই সে উঠে চলে গেলো ঘরে। যেতে যেতে বলল
–জুসটা শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘরে আসো।

অবনী সব কাজ করে ঘরে গিয়ে দেখে জুনায়েদ শুয়ে পড়েছে। ভারী নিশ্বাস ফেলার শব্দ শুনেই বুঝতে পারলো ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনে অনেক ক্লান্ত। অনেক ধকল গেছে তার। তাই কোন আওয়াজ না করে সাবধানে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। দুজনের মাঝে একটা বালিশ রেখে দিলো। জুসের মধ্যে ঘুমের ঔষধ মেশানোয় দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো অবনী। অবনী ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরেই জুনায়েদ পাশ ফিরে শুয়ে গভীর ভাবে তাকাল তার দিকে। ঘুমন্ত মুখটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল। তারপর পাশ থেকে বালিশ সরিয়ে ফেলে অবনীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

————–
কলোরাডোতে আজ দুপুরে রোদের দেখা মিলেছে। খুব সুন্দর রোদ। কিছুক্ষন আগেই দুপুরের খাওয়া শেষ করে অবনী তার রুমে এসেছে। একটু রেস্ট নেবে। কিন্তু বাইরের আবহাওয়া এতো সুন্দর যে এখন আর ঘুমানোর কোন ইচ্ছা নেই। অবনী ঘরের সামনেই রোদের মাঝে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। ভীষণ মিষ্টি রোদটা গায়ে লাগতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো। বেশ লাগছে ওর। জুনায়েদ জুবায়ের রহমানকে নিয়ে অনেক সকালে বের হয়ে গেছে। আজ তার বাবাকে বাসায় আনবে। তিনি এখন একদম সুস্থ। অবনী ঘুম থেকে উঠে জুনায়েদকে দেখতে পায়নি। কখন আসবে সেটা জেনে নেয়া দরকার। তাই ফোন করবে বলে সেটা হাতে নিতেই মেইন গেটে চোখ পড়লো। জুনায়েদের গাড়ি আসছে। মুচকি হাসল অবনী। তার মানে তারা চলে এসেছে। দ্রুত নিচে নেমে এলো। ওরা দরজায় দাঁড়ানো মাত্র দরজা খুলে গেলো। সবাই অবাক হয়ে গেলো। অবনী মুচকি হেসে জায়েদ রহমানকে বলল
–কেমন আছেন বাবা?

জায়েদ রহমান হেসে উঠলেন। বললেন
–ভালো আছি মামনি। তুমি কেমন আছো?

অবনী দরজা থেকে সোরে যেতে যেতে বলল
–ভালো আছি বাবা।

সবাই একে একে ভেতরে ঢুকল। জুনায়েদ সবার শেষে ঢুকে বলল
–তুমি কিভাবে জানলে আমরা এসেছি?

অবনী মৃদু হেসে বলল
–আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। আপনাদেরকে আসতে দেখেছি।

জুনায়েদ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল
–অপেক্ষা করছিলে বুঝি আমার জন্য?

অবনী তাকাল। স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–করছিলাম। তবে আপনার জন্য না বাবার জন্য।

বলেই চলে গেলো। জায়েদ রহমানকে তার ঘরে নিয়ে গেছে। জুনায়েদ মুচকি হেসে অবনীর পেছনে চলে গেলো। সবাই ঘরের মাঝে ভিড় করেছে। জায়েদ রহমানের সাথে কথা বলতে। ডক্টর শাহেরও তাদের সাথে এসেছেন। কি যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। অবনী ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতেই জায়েদ রহমান হাত বাড়িয়ে বললেন
–আমার কাছে আসো মামনি।

অবনী এগিয়ে গেলো। জায়েদ রহমানের পাশে বসল। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–আমার জন্য তোমাদেরকে চলে আসতে হল। আ…।

অবনী তার কথা মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বলল
–আপনার চেয়ে কোন কিছুই ইম্পরট্যান্ট নয় বাবা। ঘুরতে তো আমরা পরেও যেতে পারব। তাছাড়া আপনি অসুস্থ শুনলে কি আমাদের ঘুরতে ভালো লাগতো?

জায়েদ রহমান হেসে মাথায় আদর করে দিলেন। অবনী চোখ নামিয়ে নিলো। ডক্টর শাহের এতক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে অবনীকে পরীক্ষা করলেন। গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–অবনী মা? তোমার যে কিছুদিন আগে শরীর খারাপ লাগছিল। বলছিলে যে মাথা যন্ত্রণা করত। হাত পা শিরশির করত। এসব কি এখনো হয়?

জুনায়েদ অবনীর দিকে অস্থির দৃষ্টিতে তাকাল। অবনী ভীষণ শান্ত কণ্ঠে বলল
–এখন আর ওরকম হয়না। তবে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। ঘুমটা কাটতেই চায়না।

ডক্টর শাহের মৃদু হেসে বললেন
–ঠিক হয়ে যাবে। রেস্ট নেবে আর ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবে।

ডক্টর শাহের জায়েদ রহমানের দিকে তাকিয়ে বললেন
–তুমি এখন রেস্ট নাও। তোমার রেস্ট দরকার। আমি আজ আসি।

বলেই উঠে চলে গেলেন। জুনায়েদ তার পিছু পিছু বাড়ির বাইরে এলো। তিনি থেমে বললেন
–জুনায়েদ। খবর বেশ ভালো। অবনী এখন সুস্থ। ওর তেমন প্রবলেম নেই। তুমি কাল এক সময় আমার চেম্বারে আসবে। আমি ঔষধের ডোজ কমিয়ে দেবো।

জুনায়েদ হাসল। এটা তার জন্য খুবই খুশীর খবর। অবনী সুস্থ হয়ে উঠছে। ডক্টর শাহের বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। জুনায়েদ হাসি মুখেই বাড়ির ভেতরে ঢুকল। অবনী তখন পানি খেয়ে কাচের গ্লাসটা ডাইনিং টেবিলে রাখছিল। জুনায়েদকে এভাবে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। জুনায়েদকে আজ ভীষণ খুশী লাগছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে অবনীর। কোন অজানা কারনে তার মনটাও ভালো হয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে গ্লাসটা রাখতে গিয়েই সেটা পড়ে গেলো একদম নিচে। ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। শব্দ শুনেই জুনায়েদ দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এলো। বলল
–আর ইউ ওকে?

অবনী নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ল। সে ঠিক আছে। বসে পড়লো ছড়িয়ে পড়া কাঁচগুলো তুলতে। জুনায়েদ নিচে বসে অবনীর হাত চেপে ধরল। বলল
–রিলাক্স! শুধু গ্লাসটাই ভেঙ্গেছে। বেশী কিছু হয়নি। তুমি ধরবে না। হাত কাটবে।

অবনী জুনায়েদের দিকে তাকাল অদ্ভুত ভাবে। কিছুদিন আগেও লোকটা তাকে সহ্য করতে পারতো না। আর আজকে তার কেয়ার করছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুনায়েদ বলল
–এভাবে কি দেখছ? তুমি অনেক কেয়ারলেস। হাত কাটবে তাই আমি তোমাকে এসব ধরতে দেবো না।

অবনী হেসে ফেলে বলল
–ঠিক আছে।

জুনায়েদ মুচকি হেসে এক হাতে অবনীর হাত ধরে আরেক হাতে কাঁচের টুকরো তুলতে তুলতেই গলা তুলে রোজকে ডাকল। রোজ এসে দাঁড়াতেই জুনায়েদ তার দিকে তাকাল। অসাবধানতা বশত হাত দিতেই তার হাতে কাঁচের টুকরো ঢুকে গেলো। জুনায়েদ ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করতেই অবনী হাত ধরে ফেললো। বিচলিত হয়ে বলল
–ব্লিডিং হচ্ছে।

জুনায়েদের হাত থেকে রক্ত টুপটুপ করে মেঝেতে পড়ছে। অবনী রোজকে ফাস্ট এইড বক্স আনতে বলেই জুনায়েদকে হাত ধরে সোফায় বসাল। নিজের শাড়ির আচল দিয়ে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–আশ্চর্য! আপনি এতো কেয়ারলেস কেন? কতোটা ডিপ হয়ে গেছে দেখেছেন?

থেমে সেদিকে তাকিয়ে ভীষণ ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল
–ইশ! কত ব্লিডিং হচ্ছে।

জুনায়েদ যেন কোন কথাই শুনল না। হাতের দিকে তাকিয়ে বলল
–শাড়িটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অবনী। এটা না তোমার অনেক পছন্দের। হাত ছেড়ে দাও। শাড়িটা চেঞ্জ করে ওয়াশ করতে দাও। আমি ম্যানেজ করে নেবো।

অবনী ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকাল। ভয়ংকর আওয়াজে বলল
–এই মুহূর্তে আপনার থেকে ইম্পরট্যান্ট কিছুই নয়। এরকম হাজারটা শাড়ী নষ্ট হলেও আমার কিছুই যায় আসবে না।

জুনায়েদ অবাক হয়ে তাকাল। এভাবে এর আগে তাকে কখনো রাগ করতে দেখেনি। নরম কণ্ঠে বলল
–রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তো জাস্ট শাড়িটা…।

–একদম চুপ। আর কোন কথা নয়।

অবনীর ধমকে জুনায়েদ চুপ হয়ে গেলো। রোজ তখনই ফাস্ট এইড বক্স এনে দাঁড়ালো। অবনী তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধমকে উঠলো
–এতো দেরি করলে কেন? প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো হাতের কাছে রাখতে পারো না?

জুনায়েদ অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। রোজ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। অবনী খুব যত্ন করে জুনায়েদের হাতের ব্যান্ডেজটা চেঞ্জ করে দিলো। ভীষণ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদ ঠিক কতোটা ব্যাথা পাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে না পারলেও অবনীর যে বেশ কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে ভালো করেই। হাসল জুনায়েদ। অবনী কাজ শেষ করেই জুনায়েদের দিকে তাকাল। তার মুখে হাসি দেখেই রেগে বলল
–হাসছেন কেন? এখানে কি মজার কিছু হয়েছে?

জুনায়েদ ধমক খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাসি কিছুতেই আটকাতে পারলো না। ঠোঁট চেপে আবারো হাসতেই অবনী প্রচণ্ড রেগে ধমকে উঠে বলল
–আপনার এই হাসি সব নষ্টের মূল। আপনার হাসি দেখতে গিয়েই এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেলো। এতো সুন্দর করে কেন হাসেন? মনে হয় দুনিয়ার সব মুগ্ধতা ঐ হাসির মাঝেই।
#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৭

প্রচণ্ড রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে অবনীর। কিন্তু রাগের সঠিক কারণ তার কাছে স্পষ্ট না। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো। ফাস্ট এইড বক্সটা রোজের হাতে ধরিয়ে দিতেই সে চলে গেলো। জুনায়েদ ভীষণ বিস্মিত কণ্ঠে বলল
–কি বললে?

অবনী বিরক্ত হল। ভীষণ বিরক্ত নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে বলল
–কি বললাম?

–এখনই কি যেন বললে? আবার বল।

অবনী হতাশ শ্বাস ছেড়ে আবার ঝাঁঝালো গলায় বলতে শুরু করলো
–আপনি যদি তখন ওভাবে হাসি মুখে বাসায় না ঢুকতেন তাহলে আমি আপনার দিকে এতো আগ্রহ নিয়ে দেখতাম না। আর গ্লাসটাও পড়ে ভেঙ্গে যেতো না। এতো কিছুই হতো না। তাই বলছি সব দোষ আপনার ঐ হাসির। আপনি এতো সুন্দর…।

থেমে গেলো অবনী। জুনায়েদের অবাক করা অদ্ভুত হাসি দেখেই তার মস্তিস্ক খুলে গেলো। কি বলছে সেটা বুঝতে পেরেই থেমে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। জুনায়েদের অদ্ভুত ভাবে তাকানোয় অসস্তি টা আরও বেড়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলো। জুনায়েদ মুচকি হেসে বলল
–তাহলে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে হাসতে দেখো। তাও আবার মুগ্ধ হয়ে। স্ট্রেঞ্জ! প্রেমে পড়েছ নাকি?

অবনী উত্তর দিলো না। ঘুরে চলে গেলো নিজের ঘরে। জুনায়েদ পেছন থেকে বলল
–শাড়িটা চেঞ্জ করে ফেল মিসেস জুনায়েদ ইশতিয়াক।

অবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঘন ঘন পলক ফেলে নিজেকে স্থির করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাজার খানেক গালি দিলো। বোকামির জন্য এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়লো। কি দরকার ছিল এমন ভাবে রেগে যাওয়ার। এই রাগের কারনেই সে জীবনে কত রকম বিপদে পড়েছে। সেসব মনে রাখলেও তো একটা কাজ হতো। সেই ঘটনার পর থেকে অবনী নিজেকে ভীষণ ব্যস্ত রেখেছে। জুনায়েদের সামনে তেমন আসছে না। ইচ্ছা করে তো নয়ই। ভুল বশত পড়ে গেলে চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। অবনীর এমন বেহাল দশা দেখে জুনায়েদ ভীষণ মজা পাচ্ছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলছে। অবনী বিষয়টা খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জুনায়েদ ঘরে বসে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। অবনী কফি নিয়ে ঘরে আসলো। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে এখন। কফি দিয়েই সে চলে যাবে নিচে। অবনী কফিটা রেখে এক পাশে পড়ে থাকা এলোমেলো জিনিসপত্র নিজের জায়গায় গুছিয়ে রাখছে। জুনায়েদ শার্ট চেঞ্জ করতে বোতাম খুলছে এক হাতে। বেশ অসুবিধা হচ্ছে তার। কিন্তু অবনী একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না। জুনায়েদ বিরক্ত হল অবনীর উপরে। কিন্তু কিছুই বলল না। নিজেই আরেক হাত লাগিয়ে খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাথা পেতেই চাপা আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। অবনী ঘুরে তাকাল। দৌড়ে কাছে এসে বলল
–কি হয়েছে?

জুনায়েদ আহত কণ্ঠে বলল
–শার্টের বোতাম খুলতে গিয়ে লেগেছে।

অবনী বিরক্ত হয়ে বলল
–নিজে নিজে কেন করতে গেলেন? আমাকে বলতে পারতেন। দেখি।

জুনায়েদের একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। এক এক করে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। জুনায়েদের গভীর দৃষ্টি তখন অবনীর শান্ত চেহারায় বিচরন করতেই ব্যস্ত। শেষের দিকে দুটো বোতাম বাকি থাকতেই সেলিনা অবনীর নাম ধরে ডাকল। গলা তুলে বলল
–আসছি ছোট মা।

অবনী শেষ বোতামটা খুলে দিতেই জুনায়েদ আলতো করে কোমরে হাত রাখল। শীতল হাতের স্পর্শে অবনী কেঁপে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেললো। জুনায়েদ ভীষণ আবেগি কণ্ঠে বলল
–কি যেন বলছিলে তখন? আমার থেকে কোন কিছুই ইম্পরট্যান্ট নয়।

অবনী জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। জুনায়েদ তার নীরব প্রশ্রয়ে হাতের স্পর্শ আরও গভীর করে বলল
–আর এখন?

অবনী চোখ খুলে ফেললো। নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ভুলে গেছি।

জুনায়েদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে। এখন জুনায়েদের সামনে যাওয়া তার জন্য ভয়ংকর ব্যাপার। সবাই রাতের খাবারের জন্য নিচে নেমেছে। অবনী বেশ চুপচাপ। জুবায়ের রহমান ওর দিকে তাকিয়ে বলল
–অবনী মামণি। তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি শরীর খারাপ?

অবনী কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। বলল
–আমার কিছু হয়নি ছোট বাবা। এমনিতেই।

কথা শেষ করে পাশে বসে থাকা জুনায়েদের দিকে চোখ পড়তেই তার অদ্ভুত চাহুনি দেখে আবারো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ভেতরটা কেমন করে উঠলো তার। কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করে ফেললো। সব কাজ শেষ করে ঘরে গিয়ে দেখে জুনায়েদ বিছানায় শুয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। অবনীর চোখ পড়তেই সে অসস্তিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত প্রমান করার চেষ্টা করলো। জুনায়েদ কোন কথা বলল না। অবনীকেই দেখছে সে। অবনীর কাজ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে হাত ধরে ফেললো। অবনী চমকে তাকাল। জুনায়েদ ভীষণ শান্ত কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড়।

অবনী চোখের পলক ফেলে তাকাল। জুনায়েদ বলল
–বোঝনি কি বলেছি?

অবনী মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে। জুনায়েদ হাত ছেড়ে দিলো। খুব একটা সময় নিলো না অবনী। দ্রুত কাজ শেষ করে শুয়ে পড়লো।

————-
সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলো জুবায়ের রহমান চলে যাচ্ছেন। জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় আজই ফিরতে হচ্ছে। আরও দুইদিন থাকার কথা থাকলেও সেলিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনিও যাবেন। সামনে মাসে আবারো একটা ছুটি আছে। তাই এখন আর তেমন কেউ জেদ করলো না তাদের। তবে অবনীর কিছুটা মন খারাপ হয়েছে। বাচ্চা দুটোর সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। সময়টা কিভাবে কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। ওরা চলে গেলে যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর অবনীকে একা থাকতে হয় সারাদিন। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। কিছু বলেও তো লাভ নেই। সকালের নাস্তা করেই তারা চলে গেলো। জুনায়েদও বের হয়ে গেলো তাদের সাথে। যাওয়ার সময় বলে যায়নি কখন আসবে। জায়েদ রহমান নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। অবনীও নিজের ঘরে এসে বসে আছে চুপচাপ। বাইরের আবহাওয়া আজ খুব সুন্দর। চারিদিকে ঝলমলে রোদ উঠেছে। একদম বাংলাদেশের মতো ওয়েদার। অবনী আনমনে আকাশের দিকে তাকাতেই তার ফোন বেজে উঠলো। বাংলাদেশ থেকে ফোন দেখেই রিসিভ করে ফেললো। অবনী কয়েকবার হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেয়ার আগ মুহূর্তে ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে এলো। অবনী স্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে তৈয়বা নাজনিন কিছুটা কাঁপা গলায় বললেন
–কেমন আছিস মা?

অবনী অবাক হয়ে গেলো। কথা বলতেও ভুলে গেলো সে। কয়েক সেকেন্ড পরই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল
–ভালো আছি মামনি। তুমি কেমন আছো? আর এতো রাতে ঘুমাওনি তুমি?

তৈয়বা অপ্রস্তুত হেসে বলল
–আমি তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাইনা। তোর কি খবর বল। শরীর কেমন আছে?

অবনী একটু থামল। বলল
–তুমি ঠিক আছো মামনি? শরীর ঠিক আছে? তোমার কথা কেমন যেন শোনাচ্ছে?

তৈয়বা অস্থির হয়ে বললেন
–না না আমি ঠিক আছি। আচ্ছা শোন। তুই বাংলাদেশে কবে আসছিস?

অবনী থমকাল। বলল
–মানে?

–তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। আর তোর বাপিও খুব মিস করছে তোকে। বাপিকে তো তুই চিনিস। মুখ ফুটে কখনো কিছুই বলবে না। কিন্তু মনে মনে খুব মিস করে। তুই এসে সারপ্রাইজ দিয়ে দে। খুব খুশী হবে।

অবনী খুশী হল। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–বাপি আমাকে মিস করে? রাগ করবে না তো? আমি আসবো মামনি। আমি আজই জুনায়েদের সাথে কথা বলবো।

তৈয়বা এবার বলল
–সামনে সপ্তাহে আয় মা।

অবনী আরও কিছুক্ষন কথা বলে রেখে দিলো। সে আজ খুব খুশী। মুখ থেকে হাসি যেন সরছেই না। নিচে গেলো অবনী। সে যখন খুব খুশী হয় তখন রান্না করে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের মন মতো রান্না করলো। সবাইকে খাওয়াল। বিকেলের দিকে জুনায়েদ বাসায় ফিরে এলো। এসেই তার চোখে পড়লো অবনীর হাসি। পুরো দিন জুনায়েদ খেয়াল করলো অবনী বেশ খুশী। রাতের খাবার শেষে অবনী দুই কাপ কফি নিয়ে এলো ঘরে। জুনায়েদ জানালা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে পাতলা একটা টি শার্ট। বেশ এলোমেলো হাওয়া বইছে। অবনী পেছনে দাঁড়িয়ে বলল
–ঠাণ্ডা লাগছে না?

জুনায়েদ ঘুরে তাকাল। দুই হাতে দুটো কফির কাপের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল
–লাগছে না।

অবনী একটা কাপ জুনায়েদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। জুনায়েদ সেটা নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–আজ এতো খুশীর কারণ কি ম্যাডাম?

অবনী বেশ অবাক হয়ে তাকাল। ঠোঁটের হাসিটা আরও প্রশস্ত হল। তার মানে জুনায়েদ তাকে খেয়াল করে। সে বুঝতে পারে অবনীর মনের অবস্থা। হেসে বলল
–মামনি ফোন করেছিলো।

জুনায়েদ একটু থেমে গেলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কি বলল?

–বাংলাদেশে যেতে বলল। কয়দিন থেকে আবার ঘুরে আসতে বলল।

আনমনেই জুনায়েদের ভেতর থেকে একটা হতাশ শ্বাস বেরিয়ে এলো। ছোট্ট করে বলল ‘ওহ’। কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–কবে যাচ্ছ?

অবনী মুচকি হেসে জুনায়েদের পাশের দেয়ালটাতে পিঠ ঠেকাল। জুনায়েদ সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার ঘরে বাইরে থেকে হালকা আলো আসছে। জুনায়েদের চূলগুলো বাতাসে হেলেদুলে আবার কপালে এসে পড়ছে। অবনী কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
–ভাবছি সামনে সপ্তাহে যাবো।

জুনায়েদ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। আমাকে বলে দিও। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো।

জুনায়েদের কণ্ঠ শুনে অবনী তাকাল। বলল
–আপনার মন খারাপ কেন জুনায়েদ সাহেব? কি হয়েছে? হাত ব্যাথা করছে?

জুনায়েদ ফিরে তাকাল অবনীর দিকে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি কি ছোট বাচ্চা যে হাত ব্যাথা করলে মন খারাপ করে কাদব?

অবনী শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসির রেশ কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত থাকলো। জুনায়েদ স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আনমনেই বলে উঠলো
–তোমার এই ভবন ভুলানো হাসিটা আমার জন্যই বরাদ্দ থাক। সারাজীবন আমি এই হাসি মন ভরে দেখতে চাই।

অবনী থেমে গেলো। অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কিন্তু জুনায়েদের চাহুনির সামনে তার সেই দৃষ্টি ফ্যাকাশে পড়ে গেলো। দৃষ্টি নত করে নিতেই জুনায়েদ এগিয়ে এলো। আনমনেই অবনীর গালে আলতো করে হাত রাখল। অবনী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরেই হাত সরিয়ে ফেলে বলল
–তুমি চাইলে নিজের ঘরে শুয়ে পড়তে পারো। এখন আর কোন বাধা নেই।

অবনী চোখ খুলে তাকাল। জুনায়েদ আবারো জানালার বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। জুনায়েদের কথার কোন উত্তর না দিয়েই বিছা্নায় শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ এক পলক সেদিকে তাকাল। মুচকি হাসল। মেয়েটা যে তার উপরে ধিরে ধিরে দুর্বল হতে শুরু করেছে সেটা ভেবেই সস্তি পেলো। কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়েই কাপটা রেখে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো। কঠিন হয়ে গেলো মুখভঙ্গি। মাথায় একটাই বিষয় ঘুরছে। অবনীকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কোন প্ল্যান নয়তো?

চলবে……
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here