মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -১০+১১

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১০

বাংলাদেশ সময় রাত ১২ টা। তৈয়বা নাজনিন নিজের সব কাজ শেষ করে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভ্যাপসা গরমে চারিদিকে অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু ওনার ঘরের আবহাওয়া বেশ শীতল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটা শনশন শব্দে ঘরের তাপমাত্রা পরিবর্তনে ব্যস্ত। ঘুমানোর আগে প্রতিদিনের অভ্যেস বশত এক গ্লাস গরম দুধ হাতে নিয়ে বসেছেন। রকিং চেয়ারটা ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে দুলছে। তৈয়বা নাজনিন একটা বই হাতে নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন অন্যমনস্ক হয়ে। সেটা শেষ করেই বিছানায় যাবেন। মরিয়ম খুব যত্নে বিছানা গুছিয়ে রেডি করছে। টেবিলে রাখা ফোনটায় কম্পনের আওয়াজ হতেই তিনি চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে দিয়ে সেদিকে তাকালেন। অপরিচিত একটা নাম্বার তাও আবার বাইরের দেশের। কপালে চিন্তার দীর্ঘ রেখা দেখা দিলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তিনি ফোনটা ধরলেন। গম্ভীর গলায় বললেন
–হ্যালো।

ওপাশ থেকে ভীষণ গাম্ভীর্য পূর্ণ পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো।
–মিসেস তৈয়বা নাজনিন বলছিলেন?

গলাটা চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনভাবেই পরিচিতি পেলো না। তাই বেশ কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–জি বলছিলাম। কিন্তু আপনি কে?

–আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

ভীষণ পরিচিতের মতো কথাটা বলেই লোকটা থামল। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো মৃদু হাসির শব্দ। তৈয়বা একটু হকচকালেন। এই মাঝ রাতে তার সাথে কে মজা করতে পারে সেটাই ভাবছেন। ভেবেও যখন কোন কুল কিনারা পেলেন না তখন বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন
–আপনি যেই হন না কেন? এই মাঝ রাতে এসব মজা আমার একদম ভালো লাগছে না। আমি রাখছি।

–আরে রাখবেন না। পরিচয়টাই তো পেলেন না। তাতেই রেখে দিচ্ছেন? আর এই মাঝ রাতে কেন আপনার সাথে মজা করবো বলেন? আপনার সাথে কি আমার মজার সম্পর্ক?

কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠের জবাবে তৈয়বা কিছুটা নরম হলেন। পূর্বের চেয়ে কিছুটা নরম কণ্ঠে বললেন
–এখনো তো জানতেই পারলাম না আপনি কে? আগে পরিচয়টা দিন। তারপর নাহয় সম্পর্কটা ঠিক করবো।

ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–আমি যে বাংলাদেশ থেকে ফোন করছি না সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?

তৈয়বা মৃদু হেসে বললেন
–সে তো নাম্বার দেখেই বুঝেছি। এখন পুরো পরিচয়টা দিলেই বাকিটা বুঝে যাবো।

ওপাশের ব্যক্তিটা আবারো হেসে উঠলো। বলল
–আমি সুদূর কলোরাডো থেকে ফোন করেছি। আর আমার নাম…।

বলেই থেমে গেলো। তৈয়বার মস্তিস্ক সজাগ হয়ে উঠলো। কলোরাডো নামটা শুনেই কয়েক মুহূর্ত ভাবতে বাধ্য হল। ভীষণ চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–কে?

–জুনায়েদ। জুনায়েদ ইশতিয়াক। পরিচয়টা কি যথেষ্ট নাকি আরও কিছু জানার আছে আপনার?

নামটা শুনেই থমকে গেলেন তৈয়বা। সমস্ত কথা গলার মাঝে দলা পাকিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতো শীতল পরিবেশেও তিনি ঘেমে যাচ্ছেন। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। চোখ পড়লো মরিয়মের দিকে। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে কঠিন গলায় মরিয়মকে বাইরে যেতে বললেন। মরিয়ম চলে যেতেই তিনি চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনটা আবার কানে লাগিয়ে বললেন
–তুমি কেন ফোন করেছো? কি চাও?

জুনায়েদ হেসে উঠলো। ভীষণ সহজ ভাবে বলল
–আপনার অপকর্ম নিশ্চয় নতুন ভাবে আপনার কাছে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। নিজে কি করেছেন সেসব তো নিশ্চয় মনেই আছে। আর এতো বছরের ডক্টরের ক্যারিয়ারে নিশ্চয় আপনি দাগ লাগাতে চাইবেন না। কারণ আপনি তো দেশের একজন সনামধন্য ডক্টর। আপনার লাইসেন্সটা নিশ্চয়…।

জুনায়েদ কে মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন তিনি। ফাঁকা ঢোক গিলে তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেজাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হল না। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন
–তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ফোন করেছিলে?

জুনায়েদ বাকা হেসে বলল
–এই তো। একদম পারফেক্ট! আপনি খুব বুদ্ধিমতি। এখন আমার একটা কাজ আপনাকে করতে হবে যে?

–কি কাজ বলে ফেলো। আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত।

তৈয়বা সময় না নিয়েই বলে ফেললেন কথাটা। ঘর জুড়ে শুরু হল নিস্তব্ধতা। শিতাতপ নিয়ন্ত্রনের যন্ত্রটার ক্ষীণ শব্দটাও যেন মাথায় ধরছে। শীতল পরিবেশটাও বিষাক্ত গরমে ছেয়ে যাচ্ছে ধিরে ধিরে।

————–
পাহাড়ের মাথায় বিশাল সূর্যটা জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডের ন্যায় একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। রাস্তায় এখন গাড়ি ঘোড়া কিছুটা বেশী। আজ ড্রাইভার না আসায় জুনায়েদ নিজেই ড্রাইভিং করছে। সমস্ত নিয়ম মেনেই সে ড্রাইভিং করে। এই ব্যাপারে সে খুব সচেতন। সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়িতে বসেই কলোরাডোর প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ভীষণ ক্লান্ত ভঙ্গীতে সিটে মাথাটা এলিয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। জুনায়েদ কানে লাগানো ব্লু টুথ টা চেপে ভারী গম্ভীর আওয়াজে বলল
–হ্যালো।

ওপাশ থেকে বেশ ভীত আওয়াজ কানে আসলো। কাঁপা কাঁপা গলায় একজন যুবক বলল
–স্যার ম্যাম একা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। আর বাড়ির পাশের মার্কেটে এসে অসুস্থ হয়ে গেছেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।

জুনায়েদের বুক কেঁপে উঠলো। ভেতরটা কেমন অস্থির হয় উঠলো মুহূর্তেই। ভীষণ এলোমেলো অবস্থায় অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলো
–এখন কোথায় আছে?

–ম্যাম শপিং মলেই আছে। আমিও ওনার সাথেই আছি।

জুনায়েদ ঢোক গিলে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ না করেই বলল
–বাসায় নিয়ে যাও। আমি আসছি।

বলেই দ্রুত ফোন কেটে দিলো। নিজেকে ভীষণ বিদ্ধস্ত মনে হচ্ছে। এলোমেলো লাগছে। টাই টা ঢিলে করে দিল। অস্থিরতায় ঘেমে যাচ্ছে পুরো। মুখ মুছে নিলো হাত দিয়ে। ফোন থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে নাম্বার বের করে ডায়াল করলো। ওপাশে কয়েকবার রিং হয়ে ফোন ধরতেই জুনায়েদ অস্থির কণ্ঠে বলল
–আঙ্কেল অবনী…। অবনী…।

কথা শেষ করতে পারলো না। অস্থির ভাবে নিশ্বাস নিতে লাগলো। ডক্টর শাহের অবস্থা বুঝেই নরম কণ্ঠে বলল
–কাম ডাউন জুনায়েদ। অবনীর কি হয়েছে? আমাকে বল।

জুনায়েদ অস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল
–অবনী জ্ঞান হারিয়েছে। আপনাকে বাসায় যেতে হবে।

ডক্টর শাহের কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন
–ঠিক আছে আমি আসছি। টেনশন করো না।

জুনায়েদ স্থির হতে পারলো না। টেনশন তার মাথা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না। অবনীর যদি কোন সিরিয়াস কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজেকে মাফ করতে পারবে না। চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। এলোমেলো ভাবে গাড়ি চালিয়ে কোনরকমে বাড়ি পৌঁছল। গাড়ীটা ব্যাক ইয়ার্ডে রেখেই নেমে গেলো। অস্থিরভাবে বাড়িতে ঢুকে পড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। অবনীর ঘরের দরজা খোলা। সেখানে দাড়িয়েই কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। অচেতন দেহটা বিছানায় পড়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে। ডক্টর শাহের এসেছেন। তিনি খুব সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। পাশেই দাড়িয়ে আছে জন। জুনায়েদ জনের দিকে একবার তাকাল। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। এই মুহূর্তে তার সাথে কথা বলার সময় নেই তাই বিষয়টা স্কিপ করে এগিয়ে গেলো। অচেতন অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে আঙ্কেল? সব ঠিক আছে তো?

ডক্টর শাহের জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে আশস্ত করে বললেন
–একদম ঠিক আছে। সেরকম কিছু না। ঘুম হয়তো ঠিক মতো হচ্ছে না তাই একটু দুর্বলতা কাজ করছে। দুর্বলতার জন্যই জ্ঞান হারিয়েছে।

জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ডক্টর শাহের বলল
–আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি।

জুনায়েদ একবার অবনীর দিকে তাকিয়ে বের হয়ে এলো। দুজনে একদম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সোফায় বসে ডক্টর শাহের বললেন
–অবনীকে গত ৬ বছর ধরে রেগুলার ড্রাগ দেয়া হতো সেটা তুমি জানো।

জুনায়েদ হতাশ শ্বাস ছাড়ল। অসহায়ের মতো বলল
–জি। জানি।

ডক্টর শাহের জুনায়েদের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি নিচে স্থির। তিনি আবারো বললেন
–ওকে আমি যে মেডিসিন দিয়েছি ওগুলো রেগুলার নিচ্ছে তো?

জুনায়েদ মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো যে নিচ্ছে। তিনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন
–ওর ঘুমটা কমপ্লিট হচ্ছে না। আর তাছাড়াও কোন একটা মানসিক টেনশন ওর মাঝে কাজ করছে। যার ফলে আমি কিছুটা ক্ষতির আশংকা করছি।

জুনায়েদ বড় বড় চোখে তাকাল। বলল
–মানে কি আঙ্কেল?

–আমি ওর রিপোর্ট সব দেখেছি। ওর শারীরিক কোন প্রবলেম নেই। ওকে বিভিন্ন প্রবলেম এর কথা বলে অনেক ধরনের মেডিসিন দেয়া হতো। আবার ওর খাবারে ড্রাগস মিশিয়ে দেয়া হতো। এতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। ওর মস্তিস্কে এসবের অনেক প্রভাব পড়েছে। এখন ওকে যে ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে সেগুলো চালিয়ে আমি দেখতে চাই ঠিক কতোটা ডেভলোপ করছে। তারপর ধিরে ধিরে আমি মেডিসিন কমিয়ে দেবো।

জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে বলল
–আমার মনে হয় ওর স্লিপিং পিলস গুলো খুব বেশী পাওয়ার ফুল। ওর নাকি রাতে ভালো ঘুম হলেও দিনের বেলা ঘুম পায়। এরকমটাই বলছিল। এতে যদি কোন ক্ষতি হয়? তাই বলছিলাম ডোজ টা একটু কমিয়ে দিলে হয়না?

ডক্টর শাহের তাকালেন। বললেন
–আমি যা ঔষধ দিয়েছি সেসবে ওর কোন ক্ষতি হবে না। আর স্লিপিং পিলের পাওয়ার কমানো এখন সম্ভব নয়। ওর শরীর মেডিসিনের সাথে একটু স্বাভাবিক রেসপন্স করলেই আমি ডোজ কমিয়ে দেবো। আপাতত কিছুই করা সম্ভব নয়। আর ও নিজে থেকে যতই বলুক ভালো ঘুম হচ্ছে। ওর ভালো ঘুম হচ্ছে না। কোন কিছু নিয়ে একটু টেনশন করছে। সেটা কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই টেনশনের কারণ বের করে সেটাকে নির্মূল করতে হবে জুনায়েদ। আমি সব কিছু ভেবেই ওর ট্রিটমেন্ট করছি। ভরসা রাখো।

জুনায়েদ হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি কিভাবে সেটা জানতে পারি আঙ্কেল। আপনি তো জানেন আমি ওর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতে পারিনা। এই অবস্থায় কিভাবে ওর টেনশনের কারণ জেনে সেটা নির্মূল করবো।

ডক্টর শাহের বেশ চিন্তিত ভঙ্গীতে বললেন
–আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার এমন অস্বাভাবিক ব্যাবহারটাই অবনীর মানসিক অবসাদের কারণ। এখন বাকি সবকিছুর থেকে অবনীর ভালো থাকাটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই তুমি বাকি সবকিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে অবনীকে গুরুত্ব দাও। একটু কৌশলে ওকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো। আসলে আমিই তোমাকে বলেছিলাম যে ওর মানসিক অবস্থাটা পুরোপুরি না বুঝে ওর কাছে নিজের অনুভূতি জাহির করতে যেও না। এতে হিতের বিপরীত হতে পারে। তোমার উপরে ভরসা করার বদলে শত্রু ভেবে বসতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি তোমার আচরণ ওর জন্য বিপদ হয়ে উঠছে। এবার কিন্তু তোমাকে সময় বেশী দিতে হবে জুনায়েদ। এমন ভাবে ওর খেয়াল রাখতে হবে যেন ও তোমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। ওর জীবনে তুমিই একমাত্র ভরসার ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারো।
#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১১

নিস্তব্ধ সন্ধ্যার মুহূর্তটা ভয়াবহ রুপ নিলো। ফায়ার প্লেসের জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ডে কাঠ পোড়ার কর্কশ আওয়াজ আসছে। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। আর জুনায়েদ রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ভীষণ শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো
–ম্যামকে একা বাইরে যেতে দিয়েছ কেন?

এমন শীতল কণ্ঠ শুনে ভয়টা আরও বেড়ে গেলো সবার। এলেক্স আর ম্যালিনা নিচের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। রোজ নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে ভীষণ ভীত কণ্ঠে দক্ষ ইংরেজদের মতো বলল
–ম্যামকে আটকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম আমরা। কিন্তু উনি কারো কথা শুনেন নি। উল্টা আরও ধমক দিয়ে চলে গেছেন।

–আমাকে কেন জানানো হয়নি তখন?

আবারো শীতল কণ্ঠে রোজ কেঁপে উঠলো। এবার আর তার মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছে না। এভাবে চুপ করে থাকলে জুনায়েদ আরও রেগে যাবে বুঝেই জন মুখ খুলল। ভীত কণ্ঠে বলল
–আসলে স্যার…।

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই গালে শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়লো। বেশ জোরেই আঘাত লাগলো তার। এক হাত গালে রেখে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়লো। জুনায়েদ চেচিয়ে উঠে বলল
–খেয়াল রাখতে পারবে না সেটা আমাকে আগে বললে না কেন? তোমাকে বলেছিলাম ওকে কখনো একা ছাড়বে না। ওর সমস্ত আপডেট আমাকে দেবে সময় মতো। কিন্তু তুমি পুরোটা সময় আমাকে কিছুই জানাওনি। যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন জানিয়েছ। তোমার ধারনা আছে ওর কি কি ক্ষতি হতে পারতো? আজ যদি অবনীর কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি তোমাদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখতাম না। মনে রেখো।

থেমে আঙ্গুল তুলে প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে শীতল কণ্ঠে বলল
–অবনীর যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে কেউ বাঁচবে না। এটাই শেষবার। আমি দ্বিতীয়বার এই কথা বলবো না।

বলেই দ্রুত পায়ে চলে গেলো উপরে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিজ নিজ কাজে চলে গেলো তারা।

————
কলোরাডোতে আজ ঝকঝকে আকাশ। পাহাড়ের উপরে পড়েছে মিষ্টি রোদ্দুর। এলোমেলো হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। অবনী আজ সকাল বেলাতেই রান্না ঘরে এসেছে। নিজের মতো রান্না করছে। বাড়িতে কে আছে কে নেই সেসব নিয়ে কোন খেয়াল করেনি। দুপুরের রান্না শেষ করে এলেক্সকে বলল
–তুমি টেবিলে খাবার সাজাও। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।

বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো। যাওয়ার আগে একবার জুনায়েদের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। কিন্তু এই সময় তো জুনায়েদের অফিসে থাকার কথা। তাহলে ঘরে কে? বিষয়টা মাথায় ঢুকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিলো না অবনী। নিজের ঘরে চলে গেলো। কিছুটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো সে। ভেজা চূলগুলো ভালো করে মুছে নিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই চোখ আটকে গেলো। জুনায়েদ চেয়ারে বসে আছে। জায়েদ রহমান তার সামনের চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছেন। আর বাবা ছেলে মিলে কি যেন গল্প করছে। অবনী কিছুটা অবাক হল। জুনায়েদ অফিসে যায়নি কেন? সে তো অকারনে অফিস মিস করেনা? আর আজ তো ছুটির দিনও না তাহলে কেন বাসায়? ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। জুনায়েদ এখনো খাবার শুরু করেনি। কিন্তু জায়েদ রহমান ব্যস্ত ভঙ্গীতে খাবার খাচ্ছেন। মনে হচ্ছে খুব তাড়া আছে। অবনী এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল
–এভাবে তাড়াহুড়ো করে খাবার খাচ্ছেন কেন বাবা? ধিরে ধিরে খান।

বাবা ছেলে দুজনই ঘুরে তাকাল। জায়েদ রহমান মুখে খাবার রেখেই অস্পষ্টভাবে বলল
–একটু তাড়া আছে মামনি। একটা কাজে যাবো। তাই তোমাকে রেখেই খেতে বসেছি।

অবনী মুচকি হাসল। বলল
–ঠিক আছে বাবা। আপনি খেয়ে নিন। আমি এখন বসছি।

বলেই চেয়ার টেনে বসে পড়লো। প্লেটে খাবার তুলতে গিয়েই খেয়াল করলো জুনায়েদ অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী এক পলক তাকাতেই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। জুনায়েদের দৃষ্টি কেমন নেশাল। এভাবে তাকে কখনো দেখেছে কিনা অবনীর ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু আজ এমন কি হল? অবনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কিন্তু নিজের স্বভাব বশত কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে মৃদু স্বরে বলল
–এভাবে দেখবেন না জুনায়েদ সাহেব। দৃষ্টির সাথে মনের বড় সংযোগ আছে। কখন পরিবর্তন হয়ে যায় কে জানে।

জায়েদ রহমান কথাটা শুনতে না পেলেও জুনায়েদ ঠিকই শুনতে পেলো। অবনী ভেবেছিলো জুনায়েদকে জ্বালানোর জন্য এমন কথা যথেষ্ট হবে। এখনই রেগে যাবে সে। কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে সেসব কিছুই হল না। জুনায়েদ আলতো করে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল
–বাবা তুমি কখন আসবে?

জায়েদ রহমান খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিয়েই বলল
–লেট হবে। কেন? কিছু বলবে?

–তুমি বলছিলে সানফ্রানসিসকো যেতে। আমি অফিসে কথা বলে ছুটি নিয়েছি। ১০ দিনের। ভেবেছি এই কয়দিনে সানফ্রানসিসকো ঘুরেই আসি।

জায়েদ রহমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে প্রশস্ত হেসে বললেন
–যদি তোমাদের কোন প্রবলেম না থাকে তাহলে আজ বিকেলেই রওনা হয়ে যেতে পারো। আমি এখনই কথা বলে নিচ্ছি।

জুনায়েদ একবারেই সম্মতি দিয়ে দিলো। অবনীকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না। অবনী শুধু হা করে বাবা ছেলের কথা শুনেই যাচ্ছিল। জায়েদ রহমান খাবার শেষ করে উঠে পড়লেন। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। অবনী এতক্ষন চুপ করে ছিল। জায়েদ রহমান চলে যেতেই জুনায়েদের দিকে ফিরে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–সবকিছু ঠিক করে ফেললেন অথচ আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না? আমাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার মতামত নেয়ার প্রয়োজন নেই নাকি? অদ্ভুত মানুষ তো আপনি।

জুনায়েদ খাবার খেতে খেতে সেদিকে তাকিয়েই বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল
–মতামত নেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি কারণ বাবা যেদিন এই কথাটা প্রথম বলেছিল সেদিন হানিমুনে যাওয়ার সখটা তোমারই বেশী ছিল।

বলেই থামল। অবনীর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চমৎকার হেসে বলল
–ভুলে গেছো? কি বলেছিলে মনে করিয়ে দেবো? এখন এভাবে কেন বলছ? যাবে না নাকি হানিমুনে?

অবনী কিছুটা ভড়কালো। মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথা। থেমে থেমে বলল
–তবুও আমার অনুমতি নেয়া উচিৎ ছিল।

জুনায়েদ গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। মাথাটা ঝুঁকে অবনীর কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলল
–বিয়ে করার সময় তো আমার অনুমতি নাওনি। তখন তো নিজের ভালবাসা প্রকাশ করতে ব্যস্ত ছিলে। কি থেকে কি হয়ে গেলো যে আমাকে আমার অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করে ফেললে। জিজ্ঞেস করা তো দুরের কথা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি। কবুল বলার আগ মুহূর্তেই জানতে পারি আমার বিয়ে। সেই বিয়ে করা বরের সাথে এখন হানিমুনে যেতে এতো নাটক কেন সুইটহার্ট!

জুনায়েদের এমন সম্বোধনে অবনী এলোমেলো হয়ে পড়লো। অনুভূতিগুলো কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো আচমকাই। নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লাগলো। এর মাঝেই জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালো। ফোনের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার জন্য পা বাড়াতেই অবনী মৃদু স্বরে বলল
–খাবারটা শেষ করেলেন না যে? কোথায় যাচ্ছেন?

জুনায়েদ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই উত্তর দিলো।
–ক্ষুধা নেই। খাবার শেষ করে কফি নিয়ে আসো আমার ঘরে।

অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। জুনায়েদ নিজের ঘরে চলে গেলো। খোলা ছাদের ছাউনির নিচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো অবনীর। বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর দরজায় নক করতেই মুচকি হেসে বলল
–কাম ইন!

জুনায়েদ সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠের আওয়াজ আসলো।
–স্যার কফি।

তৎক্ষণাৎ ঘাড় ফিরিয়ে এলেক্সকে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। ভেতরের নরম অনুভূতিটা গুড়িয়ে শক্ত হয়ে উঠলো। হুঙ্কার ছেড়ে বলল
–তুমি কেন এসেছ? ম্যাম কই?

এলেক্স কিছুটা ভয় পেলো। নত দৃষ্টিতে বলল
–ম্যাম পাঠিয়ে দিলো স্যার।

জুনায়েদ সামনে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রাগে তার সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটার কাজ কর্মে সে ভীষণ অতিস্ট। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে এমন উদ্ভট কাজের জন্য শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না। মেয়েটার কষ্ট হয়তো সে সহ্য করতে পারবে না। তাই সুপ্ত রাগটা প্রকাশ হওয়ার আগেই ঝিমিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে কঠিন গলায় বলল
–চলে যাও।

এলেক্স দ্বিতীয় কোন বাক্য উচ্চারন না করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জুনায়েদ শীতল কণ্ঠে বলল
–দাঁড়াও।

এলেক্স থেমে গেলো। জুনায়েদ উঠে এসে কফির কাপটা ওর হাত থেকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে নিচে ফেলে দিলো। কাপটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে কফিটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। জুনায়েদ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–এটা দ্রুত পরিস্কার করবে। আর ম্যামকে বল যে স্যার রাগ করে কাপ ভেঙ্গে ফেলেছে। এবার কফিটা আপনাকেই নিয়ে যেতে হবে।

এলেক্স এমন অদ্ভুত আচরনের কারণ বুঝতে পারলো না। অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কিছু না বুঝেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। জুনায়েদ আবারো নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। এলেক্স পুরো ঘর পরিস্কার করে নিতেই অবনী কফির কাপ হাতে ঘরে ঢুকল। জুনায়েদের দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–আপনার কফি।

জুনায়েদ ঘুরে তাকাল। মুচকি হেসে কাপটা হাতে নিয়ে বলল
–থ্যাঙ্কস!

অবনী কিছুটা অপমানের স্বরে বলল
–আমার হাতের বানানো কফি তো জঘন্য হয় জুনায়েদ সাহেব। তাহলে আজ হঠাৎ কি মনে হল যে আমাকেই কফিটা বানাতে বললেন।

জুনায়েদ কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েই থেমে গেলো। মেয়েটার এমন গা জ্বালানো কথা তার অসহ্য। সে কি বোঝেনা? দীর্ঘশ্বাস টা গোপনে লুকিয়ে বলল
–আমার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশী। যেমন তুমি।

বলেই অবনীর দিকে তাকাল। ভীষণ অদ্ভুত ভাবে হাসল। অবনী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–আমার কাজ আছে। আমি আসছি।

জুনায়েদ থামিয়ে দিলো। বলল
–গুছিয়ে নাও সবকিছু। আমরা একটু পরেই রওনা দেবো।

অবনী কথার বিপরীতে কিছুই বলতে পারলো না। নীরবে নিজের ঘরে চলে এলো। তার কাছে আর কোন উপায় নেই। জুনায়েদ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই ডক্টর শাহের এর নাম্বারে ডায়াল করলো। তিনি ফোনটা ধরেই বলল
–কি খবর জুনায়েদ? সব ঠিক আছে তো?

জুনায়েদ আশস্তের সুরে বলল
–সব ঠিক আছে আঙ্কেল। আমি আসলে একটা কথা জানাতে ফোন করেছিলাম। অবনী কে নিয়ে সানফ্রানসিসকো বেড়াতে যাচ্ছি। আমার মনে হয় একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলেও ওর মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন হবে।

ডক্টর শাহের কিছুটা সময় নিয়ে বললেন
–প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার এর পেশেন্টরা আসলে কিভাবে ভালো থাকতে পারবে সেটা তাদের পরিবেশের উপরে ডিপেন্ড করে। ঘুরতে যাও। সিদ্ধান্তটা ভালো। কিন্তু একটা বিষয় তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে। তোমার ওর প্রতি দুর্বলতা খুব বেশী প্রকাশ করে ফেল না। এই ধরনের পেশেন্টরা কাছের মানুষকেই বেশী সন্দেহ করে। তাদের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা করে। তাই তোমাকে আমি এতদিন অবনীর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। যদি কোনভাবে তোমাকে ওর শত্রু ভাবতে শুরু করে তাহলে কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে জুনায়েদ। ইউ হ্যাভ টু বি ভেরি কেয়ারফুল।

চলবে……
চলবে……

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here