মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -০৮+৯

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৮

অফিসের কেবিনে নিজের চেয়ারে বসে সামনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখেছে জুনায়েদ। ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি। গভির মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে সে। তার মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দৃষ্টির সামনে থাকা বস্তুটি অতি পছন্দের কিছু। কয়েক মিনিট ধরে দাড়িয়ে আছে রমা। দুই একবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করেছে সে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বিরক্ত হয়ে টেবিলের পেপার ওয়েটটা নিচে ফেলে দিলো শব্দ করে। নিস্তব্ধ ঘরে সেটা মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে বেজে উঠতেই চমকে উঠলো জুনায়েদ। কয়েক সেকেন্ড তকিয়ে থাকলো। মস্তিস্ক সজাগ হতেই চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বলল
–তুমি এখানে কি করছ?

জুনায়েদের এমন উটকো মেজাজ দেখে রমার রাগ হল। কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করতে পারলো না। এতো সময় ধরে দাড়িয়ে আছে সে আর তার উপরেই রাগ দেখাচ্ছে। অদ্ভুত মানুষ। রমা একটু কঠিন গলায় বলল
–মিটিং এর জন্য সবাই কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছে।

জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিজের উপরেই বিরক্ত হল সে। তো বড় একটা মিটিং এর কথা সবটা ভুলে গেলো? বেশ কঠিন গলায় বলল
–তুমি যাও। আমি আসছি।

চোখ মেলে আবারো ল্যাপটপের দিকে তাকাল। চোখ মুখ খিঁচে শাটারটা শব্দ করেই বন্ধ করে দিলো। তার জীবনে পরিবর্তন আসছে। সে তো এমন ছিল না। মোটামুটি বিরক্ত হয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে উঠে গেলো মিটিং এ।

——–
সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। দূর পাহাড়ের মাথায় চাঁদ উঠেছে। ঝলমলে জ্যোৎস্না। গাড়ির পেছনে বসে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে জুনায়েদ। সারাদিন আজ অনেক ধকল গেছে। মাথাটা বেশ ধরেছে। রেস্ট দরকার। ফাঁকা রাস্তা ধরে শা শা করে গাড়ি চলছে। যদিও বা স্পিড লিমিট আছে আর ড্রাইভার সেটাই ফলো করছে তবুও চোখ বন্ধ অবস্থায় জুনায়েদের মনে হচ্ছে গাড়ীটা অনেক জোরেই চলছে। হালকা তন্দ্রাভাবে চোখ ভারী হয়ে এলো তার। শরীর ঘুমের দেশে পাড়ি দিলেও মস্তিস্ক নিজের মতো ভাবতেই ব্যস্ত। কিছু সময় অতিক্রান্ত হবার পর কিছু একটা ভাবতেই চোখ আপনা আপনি খুলে গেলো তার। মস্তিস্ক সজাগ হয়ে উঠলো। ইন্দ্রিয় তড়িৎ গতিতে কিছু একটা জানিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে ফোন বের করলো। অন করে বাড়ির প্রতিটা সি সি ক্যামেরা চেক করে নিলো। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ফোনটা বন্ধ করে নিলো। চিন্তার ছাপ ছড়িয়ে গেলো চেহারায়। কাল সন্ধ্যার পর থেকে অবনীকে দেখেনি সে। অফিসে বের হওয়ার আগে এক পলক হলেও দেখা মেলে। কিন্তু মেয়েটা সেই উপরে উঠেছে। তারপর জুনায়েদ নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর রাতে ডিনারের জন্য নিচে নামেনি। অবনী ডিনার করেছিলো কিনা সেটাও সে জানে না। সকালে অফিসে বের হওয়ার সময় ব্যস্ততার কারনে খেয়াল করেনি তেমন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অবনী কাল রাতের পর থেকে ঘর থেকেই বের হয়নি। সারাদিনে একবারও আজ মেয়েটার দেখা পেলো না। অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো? জায়েদ রহমানও বাসায় নেই যে খেয়াল করবে। ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো তার। ছটফট করে উঠলো মেয়েটার খবর নেয়ার জন্য। এখন মনে হচ্ছে রাস্তাটা বেশ দূরে। হাঁসফাঁস লাগছে খুব। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলল। কিন্তু চাইলেই কি এখানে আর দ্রুত চালানো সম্ভব? এটা তো বাংলাদেশ না। অবশেষে বাসায় পৌঁছে গেলো সে। ব্যক ইয়ার্ডেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। অস্থির ভাবে কলিং বেল বাজাতে লাগলো। রোজ দরজা খুলে দিতেই মৃদু ধমকে উঠে বলল
–এতো দেরি হল কেন?

রোজ ভয়ে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। দৃষ্টি নত করে ফেললো। জুনায়েদ দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোফায় হাতের ব্যাগটা রেখে অবনীর ঘরের দিকে তাকিয়ে রোজকে বলল
–ম্যাম কোথায়?

রোজ ভীত কণ্ঠে বলল
–ঘরে।

–সারাদিন বের হয়নি?

রোজ মাথা নেড়ে না বলল। জুনায়েদ আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে অবনীর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় দুই একবার টোকা দিলেও ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসলো না। চিন্তাটা এবার ভয়ে রুপান্তরিত হল। দরজার হাতল ঘুরাতেই সেটা খুলে গেলো। কিছুটা সস্তি পেলো। ভেতর থেকে লাগানো নেই। সে ঘরে ঢুকেই দেখল পুরো ঘর অন্ধকার। কাঁচ দেয়ালের এক পাশে ছোট্ট করে পর্দাটা সরানো। যার ফলেই বাইরের আলোটা ভেতরে আসছে। বারান্দার হলুদ আলোয় ঘরটা রহস্যময়ি মায়াপুরির মতো লাগছে। এপাশ ওপাশ তাকাল অস্থির ভাবে। অবনী কোথাও নেই। অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতেই ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। বুঝতে পারলো অবনী ওয়াশ রুমে। তাই সস্তির নিশ্বাস ফেলে টেবিলের সামনে থাকা রকিং চেয়ারটাতে বসে পড়লো। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হল। জুনায়েদের মনে হল বেশ গরম লাগছে তার। উপরের কোর্টটা খুলে চেয়ারে রেখে গরম লাগার কারণটা উদ্ধার করতে লাগলো। মস্তিস্ক কিছু সময়ের মধ্যেই জানিয়ে দিলো ঘরের রুম হিটারের পাওয়ার অনেক বাড়ান। তাই বাইরের তুলনায় রুমটা অনেক গরম হয়ে আছে। ওয়াশ রুমের দরজায় আওয়াজ হতেই জুনায়েদ নড়েচড়ে বসল। অবনী বেখেয়ালি ভাবেই তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশ রুম থেকে বের হল। তোয়ালেটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতেই চোখ পড়লো চেয়ারে। কিছুটা চমকে গেলো। ভয়ে চিৎকার দেয়ার প্রস্তুতি নিতেই জুনায়েদের মুখটা চোখে স্পষ্ট হল। চিৎকার দেয়ার কথা ভুলে গেলেও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারলো না। জুনায়েদ এই সময় তার ঘরে? তাও আবার অফিসের ড্রেস পরে। বিষয়টা মস্তিস্ক ধরতে পারলো না। অবাক হলেও আচমকাই মনের মাঝে ভাললাগা ছেয়ে গেলো। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
–জুনায়েদ সাহেব! আপনি আমার ঘরে ভাবতেই পারছি না।

জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে কাচের দরজাটা খুলে বারান্দায় দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়ে বলল
–এসেই তো কয়েকদিন পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতে আর এখন ঘর থেকেই বের হচ্ছ না যে? এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে গেলে? হার মেনে নিলে বুঝি?

জুনায়েদের চাপা অপমানটা ধরতে পারলো অবনী। কিন্তু গায়ে লাগলো না। কারণ মনটা তখন বেশ উতফুল্য। চমৎকার হেসে বলল
–ও বুঝেছি। আমি সারাদিন ঘর থেকে বের হইনি বলে আপনি আমার খবর নিতে এসেছেন। বেঁচে আছি না মরে গেছি তাই তো? তেমন কিছু না শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই।

জুনায়েদ পেছন ফিরে তাকাল অদ্ভুত দৃষ্টিতে। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–এতো তাড়াতাড়ি তুমি মরবে না।

কথা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রেলিঙ্গে দুই হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–যেমন ভেবেছিলাম তুমি তেমন নয়।

অবনী এগিয়ে গেলো। পাশে দাড়িয়ে জুনায়েদের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল
–সে যাই হোক। আপনি যে আমাকে নিয়ে ভাবেন সেটাই অনেক বেশী কিছু জুনায়েদ সাহেব। তো কেমন ভেবেছিলেন আমাকে?

জুনায়েদ তাকাল। মাদক হেসে বলল
–এতো সহজে হার মানা তোমাকে মানায় না। প্রথমদিন যেভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলে তাতে আমি নিজেই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শেষে আবার কিনা তোমাকে গ্রহন করতে বাধ্য হতে হয়।

অবনী শব্দ করে হাসল। বেশ জোরেই। তার হাসির শব্দ পাহাড়ের নিস্তব্ধ পরিবেশে ঝঙ্কার তুলল যেন। হাসি থামিয়ে বলল
–আমি হার মেনেছি আপনাকে কে বলল? খুব বেশী বিরক্ত করে ফেলেছিলাম তাই একটু ছাড় দিয়েছি। আমি এতো সহজে হার মানিনা জুনায়েদ সাহেব। এটা ভাবলে ভুল করবেন।

জুনায়েদ ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। যার অর্থ সে অবনীর কথাটাকে গুরুত্ব দিলো না। অবনী মুচকি হেসে সামনে তাকাল। আকাশে চাঁদটা পাহাড়ের মাথায় জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–এই জায়গায় বাড়িটা বানানোর ডিসিশন টা কার ছিল? জায়গাটা কিন্তু খুব সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

জুনায়েদ সামনে তাকিয়েই মৃদু সরে বলল
–বাবা কিনেছে বাড়িটা। বাবার ইচ্ছা ছিল পাহাড়ের গা ঘেঁষে এমন একটা নিরিবিলি পরিবেশে থাকবে। সেই ইচ্ছা পুরনের উদ্দেশ্যেই বাড়িটা কেনা।

অবনী চমৎকার হেসে বলল
–অফিস থেকে এসে আপনার কফি এখনো খাওয়া হয়নি তাই না? একটু দাঁড়ান আজ আমি আপনার কফি বানাবো।

জুনায়েদ কথা বলল না। কিছু সময়ের মধ্যে অবনী দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে এলো। জুনায়েদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সে ভ্রু কুচকে কাপটা হাতে নিয়ে নাকে লাগাল। ঘ্রাণ টেনে সেটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–শুধুই কফি নাকি সাথে কিছু মিশিয়েছ?

অবনী শব্দ করে হেসে উঠলো। বলল
–ভয় পাবেন না জুনায়েদ সাহেব। আমি এতটাও নিষ্ঠুর নয়। আপনার কোন ক্ষতি করবো না।

জুনায়েদ কফিতে চুমুক দিলো। দুজনেই সামনে তাকিয়ে নীরবে কফি খেয়েই যাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না। কফি প্রায় শেষের পথে। সেই সময় অবনী বলল
–কফি কেমন লাগলো বললেন না?

জুনায়েদ তাকাল। হুট করেই কাছাকাছি চলে এলো। মাদক কণ্ঠে বলল
–আমার জীবনে এমন কফি কখনো খাইনি।

প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও জুনায়েদের কথা শুনে অবনীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। ঠিক তখনই জুনায়েদ কফির কাপটা অবনীর সামনে ধরল আলতো হাতে। ছেড়ে দিতেই সেটা মেঝেতে পড়ে গেলো। বিদঘুটে শব্দে সেটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। অবনী চমকে সেদিকে তাকাল। ভীষণ খারাপ লাগলো তার। আহত দৃষ্টি জুনায়েদের দিকে তাকাতেই সে বলল
–সব থেকে জঘন্যতম কফি ছিল।

বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অবনী অসহায়ের মতো বলল
–এই বাড়িতে আমার পছন্দের কয়েকটা জিনিসের মধ্যে এই কাপ দুইটা ছিল। তার মধ্যে একটা ভেঙ্গে ফেললেন? কেন এমন নিষ্ঠুর আপনি?

জুনায়েদ থেমে গেলো। পেছন ফিরে তাকাল না। সামনে তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–পছন্দের জিনিসগুলো যত্ন করে নিজের কাছে রাখতে হয়। এমন কোন মানুষের হাতে দিতে নেই যার আচরনে নিষ্ঠুরতার প্রকাশ পায়। আমি এটা ভালই বুঝি। তাই নিজের পছন্দের জিনিসগুলো নিজের কাছে রেখে দেই।

কথার অর্থ ধরতে পারলো না অবনী। কিন্তু তার ভীষণ খারাপ লাগছে। কফিটা ভালো লাগেনি বলে কাপটা ভাঙ্গা জুনায়েদের ঠিক হয়নি। অবনী এতে কষ্ট পাবে সেটা ভাবা উচিৎ ছিল তার। এই মানুষটাকে চিনতে তার খুব কষ্ট হয়। ক্ষণে ক্ষণে নিজের আচরন পরিবর্তন করে সে। এমন কেন মানুষটা?
#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৯

কলোরাডোর পাহাড়ি পরিবেশের বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। অবনী নিজের ঘরে ছিল সারাটা বিকেল। শরীরটা তেমন ভালো নেই। এখানে আসার পর থেকে মাত্র কয়েক দিন পর্যন্তই ভালো ছিল সে। তারপর হুট করেই কি হয়ে গেলো। প্রতিদিনের মতো আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। কাঁচ দেয়ালের পর্দাটা সরানো। অবনী সেদিকে তাকিয়েই কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়েই কাপটা টেবিলে রাখল। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই খুলে দিলো। রোজ ভীষণ মিষ্টি হেসে বলল
–ম্যাম আপনাকে নিচে ডাকছে খেতে। স্যার অপেক্ষা করছেন।

–আসছি।

অবনী ক্লান্ত হেসে কথাটা বলতেই রোজ চলে গেলো। পাতলা চাদর শরীরে জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। সিঁড়িতে পা দিতেই গতি কমে এলো। চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। মস্তিস্ক ধরতে না পারলেও দৃষ্টি জানিয়ে দিচ্ছে আজ বাড়িতে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। ধির পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো অবনী। আশেপাশে দেখতে দেখতে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। জুনায়েদ রহমান অবনীর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই বললেন
–তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সিট।

অমনোযোগী অবনী আচমকাই এমন কথা শুনে চমকে উঠলো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–জি?

জায়েদ রহমান মৃদু হেসে বললেন
–বসে পড়ো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

অবনী চেয়ার টেনে বসার আগেই খেয়াল করলো জুনায়েদ তার পাশেই বসে আছে। দৃষ্টি তার ফোনে আবদ্ধ। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। কাঁটা চামুচ আর প্লেটের টুংটাং আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। জায়েদ রহমান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন অবনীর দিকে তাকিয়ে। কয়েকদিন যাবত মেয়েটা বেশ চুপচাপ। নিজের কথাটা চেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–তোমার কি শরীর খারাপ মামনি? এমন দেখাচ্ছে কেন?

অবনী মলিন হাসল। বলল
–তেমন কিছু না বাবা। কয়েকদিন যাবত একটু শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। ওয়েদার এর জন্য হয়তো এমন হতে পারে।

জায়েদ রহমান চিন্তিত কণ্ঠে বললেন
–কি হয়েছে? ডক্টরের কাছে যাবে?

–না না বাবা। তেমন কিছুই হয়নি। ক্লান্তিটা একটু বেড়ে গেছে। আর মাথাটাও ঘুরে উঠছে। রাতে ভালো ঘুম হওয়ার পরও সারাদিন মাথাটা ঝিমঝিম করে। মনে হয় ঘুমটাই কাটছে না।

অবনী কথা শেষ করে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। জায়েদ রহমান অবনীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকালেন। জুনায়েদ বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকাল বাবার দিকে। চার চোখ একত্রিত হয়ে বিনিময় হয়ে গেলো গভীর রহস্যের। যা অবনীর ধারের কাছেও ঘেঁষল না। কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না সে। খাবার শেষ করে জায়েদ রহমান বেশ কঠিন গলায় বললেন
–জুনায়েদ তোমার কাজ শেষ করে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।

বলেই তিনি ঘরে চলে গেলেন। শুধু জুনায়েদের উদ্দেশ্যে বলা কথাটা ক্লান্ত অবনী শুনল। কিন্তু কোন কথা বলল না। খাবার শেষ করে এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। জুনায়েদ সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবনী তার ঘরে ঢুকে যেতেই জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে বাবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নেয়ার উদ্দেশ্যে দরজা ঠেলে মাথা বাড়িয়ে দেখল অস্থির ভাবে পায়চারী করছেন জায়েদ রহমান। জুনায়েদ চিন্তিত হয়ে ঘরে ঢুকেই পড়লো। অনুমতি নেয়ার কথাও ভুলে গেলো। বিচলিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে বাবা? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

জায়েদ রহমান থমথমে মুখে তাকালেন। জুনায়েদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন
–কি করছ তুমি জুনায়েদ? মেয়েটাকে কি মেরে ফেলতে চাও?

এমন কথা শুনে জুনায়েদ হকচকাল। আহত দৃষ্টিতে তাকাল বাবার দিকে। অসহায়ের মতো বলল
–কি বলছ বাবা? আমি কেন এমন করবো? বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপরে?

জায়েদ রহমান কঠিন গলায় বললেন
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয় জুনায়েদ। এটা মেয়েটার জীবন মরণের প্রশ্ন। তুমি যা করছ সেটা ওর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি কি এই জন্যই তোমার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছিলাম? এখন আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি তুমি ওর যোগ্য কিনা।

জুনায়েদ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বলল
–বাবা!

জায়েদ রহমান গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলল
–আমার মেয়েটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। আমি ওকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না। তোমার উপরে ভরসা করাটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি এখন যেতে পারো।

জুনায়েদ অস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার কথাটা শোন বাবা। আমি এমন কিছুই করিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।

জায়েদ রহমান উল্টা দিকে ঘুরে বললেন
–আমি এই মুহূর্তে তোমার কোন কথা শুনতে চাইছি না। তুমি যাও এখন।

জুনায়েদ নিজেকে সামলাতে পারলো না। হতাশ হয়ে চলে গেলো ঘরে। নির্দিষ্ট স্থান থেকে একটা বোতল বের করে ঢাকনা খুলে গলায় ঢেলে দিলো। বোতলটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। বাবা তাকে কোন ভাবেই বিশ্বাস করছে না। সে কেন অবনীর ক্ষতি করবে? সে তো অবনীর কোন ক্ষতি চায় না। ক্ষতি চায়না বলেই তো তাকে এনে নিজের কাছে রেখেছে। বোতলটা পাশের টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে থেকে ভাবল। হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বের হল ঘর ছেড়ে। অবনীর ঘরের দরজার হাতল ঘোরাতেই বুঝে গেলো ভেতর থেকে লক করা। তাই পকেট থেকে চাবি বের করে খুলে ফেললো। অবনী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জুনায়েদ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার পাশে গিয়ে বসল। একটু ঝুঁকে এলোমেলো চূলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিলো। কপালে গাড় চুমু খেয়ে ঘোলাটে কণ্ঠে বলল
–বাবা এমন কেন বলল অবনী? আমি সত্যিই তোমার যোগ্য নই? আমি কি তোমাকে ভালো রাখতে পারছি না? তোমার ক্ষতির কারণ কি আমি নিজেই?

কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উঠে বসল। সোজা হয়ে বসে কঠিন গলায় বলল
–এমন হতে পারে না। আমি তোমার ক্ষতির কারণ কিছুতেই হতে পারি না। ডক্টরের সাথে কথা বলেই তো আমি তোমাকে স্লিপিং পিলস দেই। এটা তোমার কোন ক্ষতি করবে না। তাহলে বাবা কেন ভরসা করতে পারছে না আমার উপরে? আমি তো তোমার ক্ষতির কথা কোনদিন ভাবতেই পারি না। তোমাকে ভালো রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করি। সেসব কিছু কেউ বুঝতে পারেনা অবনী। আমি যে চাইলেও তোমার ক্ষতি করতে পারব না। কারণ…।

আবারো ঝুঁকে গেলো অবনীর কাছাকাছি। আলতো করে গালে হাত রেখে বলল
–আমি তোমাকে ভালোবাসি অবনী। খুব বেশী ভালোবাসি। যতটা ভালবাসলে সেই মানুষটা নিশ্বাসের সাথে মিশে যেতে পারে ঠিক ততটাই ভালোবাসি তোমাকে। তোমার হৃদপিণ্ডের গতির সাথে আমার হৃদপিণ্ড চলে। ওটা থেমে গেলে এটাও যে থেমে যাবে। বেঁচে থাকতে পারব না আমি। তবুও কিভাবে আমি তোমার ক্ষতি করছি অবনী? বলতে পারো? একটা মানুষ কিভাবে নিজের অস্তিত্বকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারে।

চলবে……
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here