মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব -০৭

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৭

বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। হাওয়ার তোড়ে উপর থেকে নিচে নামা ফিনফিনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ধোঁয়ার মতো উড়ে চলেছে। রাস্তা বেশ পরিষ্কার। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি চলছে ধির গতিতে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো রেস্টুরেন্টের চারিদিকে ঘেরা কাঠের উপরে বাড়ি খেয়ে ছিটকে এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। অবনী স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা বেশ মনোমুগ্ধকর। বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া ভেতরে কিছু চাপা কথোপকথনের শব্দ কানে আসছে। তাদের টেবিলে শুধু ছুরি আর চামুচের টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় ধরেই দুজন নীরবে খেয়ে চলেছে। কেউ কোন কথা বলছে না। অবনী চারিদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। জায়গাটা তার খুব ভালো লেগেছে। কাঁচে আবদ্ধ ঘর দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠেছিল সে। এই রেস্টুরেন্টটা কাঁচ ঘেরা নয়। কাঠের অর্ধ বেষ্টনী দ্বারা আবৃত। মাথার উপরে ছাউনি। আর চেয়ার টেবিলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। সেগুলোতেই ভিনদেশিরা বসে তাদের লাঞ্চ উপভোগ করছে। জায়গাটা খুব একটা বড় নয়। কিন্তু অল্প পরিসরের জায়গাটাই বেশ পরিপাটি। জতদুর দৃষ্টি যায় অপরপাশের রাস্তায় সারি বেধে গাড়ি পার্ক করা। রেস্টুরেন্টের দুই পাশে দুটো ম্যাগনোলিয়া নামক তুলোর মতো ফুলের গাছগুলো বাতাসে হেলে দুলে আবার দাড়িয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক কোন মেয়েলী কণ্ঠ কানে আসতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। জুনায়েদ টেবিলের উপরে রাখা ফোনটার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুই হাতের আঙ্গুল দ্বারা নিজের চুলগুলোকে গোছাতে ব্যস্ত। গুগল খুব দ্রুত বিড়বিড় করে বলে দিলো আগামি ১ ঘণ্টায় বৃষ্টি কমার কোন সম্ভাবনা নেই। চুলের ভেতর থেকে খুব সাবধানে হাত দুটো বের করে সরু চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভাঁজ করে ফেললো জুনায়েদ। আহত কণ্ঠে সেদিকে তাকিয়েই বলল
–আই এম সরি! প্ল্যানটা অন্য কিছু হলেও এই অসময়ের বৃষ্টিটা সেটা ভেস্তে দিলো। তোমাকে দেয়া কথাটা বোধহয় ঠিকভাবে রাখতে পারলাম না। দিনটা তোমার মনে রাখার মতো হয়ে উঠলো না।

অবনী হতাশ চোখে তাকাল। রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–আপনি সত্যিই খুব আন রোম্যান্টিক। এতো সুন্দর একটা জায়গা আর এতো রোম্যান্টিক একটা ওয়েদার তবুও আপনার সামনে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটার জন্য স্পেশাল কিছুই করতে পারছেন না। মেয়েরা খুব অল্পতেই তুষ্ট হয় জুনায়েদ সাহেব। আপনি চাইলে বৃষ্টি মুখোর এই একটা ঘণ্টাকেই স্মরনিয় করে ফেলতে পারেন। কিন্তু আপনার মতো আন রোম্যান্টিক মানুষের দ্বারা এটা তো সম্ভব নয়।

জুনায়েদ এমন কথা শুনে হতাশ হল। কথাগুলো মস্তিস্কে ঢুকিয়ে নিয়ে ভালো করে আওড়াল। অবনীর কথা অনুযায়ী সে কি সত্যিই আন রোম্যান্টিক। অনেকবার মেয়েদের সাথে ডেটে এসেছিলো। কিন্তু সবটাই অফিসিয়ালি ছিল। এরকম ভাবে কাউকে নিয়ে এর আগে ডেটে আসার সুযোগ হয়নি তার। তাই হয়তো বুঝতেও পারছে না ঠিক কি করা দরকার। তবে মেয়েটাকে কথা যখন দিয়েছে তখন কিছু একটা ভাবতেই হবে। কোনভাবেই এই মেয়ের কাছে সে হার মানতে রাজি না। গভীর ভাবনার মাঝেই জুনায়েদ খেয়াল করলো অবনী ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ এই পরিবেশে থাকার অভ্যেস তো তার নেই। সে প্রথমবার এসেছে এই দেশে। জুনায়েদ উঠে অবনীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের কোর্টটা খুব যত্ন করে তার গায়ে দিলো। অবনী বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। জুনায়েদ পুনরায় নিজের জায়গায় এসে বসে বলল
–রিলাক্স! এই ঠাণ্ডা সহ্য করার অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু তোমার নেই। তাই ওটা জড়িয়ে নিলেই ঠাণ্ডা কিছুটা কমবে।

বলেই থেমে গেলো। অবনীর ঠোঁটের কোনে সূক্ষ্ম হাসির দেখা মিলল। জুনায়েদ খেয়াল করলো কিনা কে জানে। কিন্তু অবনী মনে মনে ভীষণ খুশী হল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জুনায়েদ বলল
–কফি খাবে?

অবনী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মুচকি হেসে বলল
–খাবো।

জুনায়েদ ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ কফি দিতে বলল। ওরা দুজন কাঠের রেলিং এর কাছাকাছি একটা টেবিলে বসেছে। বৃষ্টির ফোটাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গায়ে এসে পড়ছে। জুনায়েদ বলল
–চেয়ারটা এপাশে ঘুরে নিয়ে বসো। গায়ে পানি পড়ছে। গায়ে পানি পড়লে আরও বেশী ঠাণ্ডা লাগবে।

অবনী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। এর মাঝেই ওয়েটার কফি দিয়ে গেলো। জুনায়েদের ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কথা বলতে বলতে উঠে চলে গেলো রেলিঙ্গের ধারে। গরম কফিতে চুমুক দিয়ে সেখানে দাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে সে। অবনী কিছু একটা ভেবে উঠে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জুনায়েদ নিজের মতো কথা বলায় ব্যস্ত। সে অবনীকে খেয়াল করলো না। অবনী অন্যমনস্ক হয়ে কফির কাপটা এগিয়ে ধরতেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি তার কাপে টুপ করে পড়লো। জুনায়েদ ঘুরতেই সেটা চোখে পড়লো তার। হেসে বলল
–কফির সাথে বৃষ্টির পানি মিশে ঠাণ্ডা গরমের ককটেল হয়ে গেছে। এখন খাবে কিভাবে?

অবনী গভীর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–বলেছিলাম আপনি ভীষণ আন রোম্যান্টিক একজন মানুষ। এসব রোম্যান্টিক ব্যপার স্যাপার আপনার মাথায় ঢুকবে না। আপনি তো রুম হিটারের সামনে বসে কফি খান। এরকম বৃষ্টি মুখোর পরিবেশে বৃষ্টিতে ভিজে কফি খাওয়ার মজাটা বুঝবেন না।

বিষয়টা জুনায়েদের কাছে বেশ মজার মনে হল। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল
–হাউ ফানি।

বলেই আবার নিজের জায়গায় এসে বসে পড়লো। অবনী মুচকি হেসে নিজের জায়গায় বসে আবারো বৃষ্টি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

———
বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশের কালো মেঘ এখনো আছেই। ঝকঝকে রাস্তা ধরে শা শা করে গাড়ি চলছে। পেছনের সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে অবনী। কালো মেঘের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে আলো উঁকি দিচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় মেঘগুলো কেমন ধাক্কা খেয়ে এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই দৃশ্যটাই অবনীকে মুগ্ধ করছে। হিটারের উষ্ণতায় কিছুটা আরামবোধ হতেই অবনীর চোখ লেগে এলো। গাড়ির ঝাকুনিতে গভীর ঘুমে তলে গেলো সে। ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছিল সেটা বুঝতে পারলো না। তবে ঘুম ভাঙ্গার পর যা দেখল রীতিমতো অবাক করে দেয়ার মতো। গাড়ির ভেতরে একাই ঘুমিয়ে আছে অবনী। জুনায়েদ কোথাও নেই। চারিদকে অন্ধকার। মানে সন্ধ্যা নেমেছে। গাড়ীটা লক করা। অবনী আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কোথায় আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মস্তিস্ক তার অবস্থান নিশ্চিত করলো। এটা তাদের বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ড। কিন্তু তাকে এভাবে একা রেখে জুনায়েদ গেলো কোথায়। আর কিছু না ভেবে গাড়ির লক খুলে সেখান থেকে নেমে এলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকল। যে যার মতো কাজ করছে। অবনীকে দেখেও কেউ খুব একটা আশ্চর্য হল না। অবনী বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েই নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। সিঁড়ির মুখেই জুনায়েদের সাথে দেখা হল তার। জুনায়েদ এক হাতে ফোন ধরে আরেক হাতে নিজের চুল উল্টে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। অবনীকে দেখেই থেমে গেলো। অবনী খেয়াল করলো জুনায়েদের গায়ে বাহিরের পোশাক নেই। তার মানে সে বাড়িতে এসে চেঞ্জ করে ফেলেছে। এতে নিশ্চয় অনেকটা সময় লেগেছে। কিন্তু এতটা সময় ধরে তাকে একবারও ডাকেনি কেন? চোখাচোখি হল দুজনের। অন্য কোন সময় হলে হয়তো অবনী অসস্তিতে পড়ে যেতো। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মস্তিস্কে এক রাশ প্রশ্ন ঘুরাফেরা করছে। জুনায়েদের উপরে তির্যক চাহুনি ফেলে বলল
–আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আপনি আমাকে ডাকেন নি কেন? আর একা একা গাড়িতে ওভাবে রেখে এসেছেন কেন?

শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল জুনায়েদ। দুই কদম নিচে নেমে এলো। মুখোমুখি দাড়িয়ে শীতল কণ্ঠে বলল
–এরকম তো কথা ছিল না যে তুমি ঘুমিয়ে গেলে ডেকে তুলতে হবে। বাইরে পর্যন্তই সময়টা আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় আসার পর তোমাকে সময় দেবো সেটা বলিনি। তাই বাসায় ফিরেই আমার দায়িত্ব শেষ।

অবনী বেশ অবাক হল। বিকেল পর্যন্তই মানুষটা অন্যরকম ছিল। বাসায় আসতে না আসতেই বদলে গেলো। এমনো মানুষ হয়? অবনী হতাশ সরে বলল
–সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে আমাকে গাড়িতে ওভাবে রেখে আসবেন এটা কেমন কথা? যদি আমার কোন বিপদ হতো? আর আপনার কি মানবতা নেই?

জুনায়েদ মাথাটা একটু ঝুঁকে আর একটু কাছাকাছি এসে বলল
–আমি এমনই। আর তুমি কি ভেবেছিলে যে আমি ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে আসবো? ওহ কামান! ফরগেট দ্যাট। এমন কিছুই হবে না।

ঠোঁট বাকিয়ে হেসে নেমে চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে। অবনী হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকলো। এই মানুষটার সাথেই সে এতো ভালো একটা দিন কাটিয়ে আসলো সেটা বিশ্বাস করতেই পারছে না। কিভাবে এতো দ্রুত একটা মানুষ বদলে যায়। মনটা ভীষণ খারাপ হল তার। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উল্টা দিকে ঘুরে নিজের ঘরে চলে গেলো সে। জুনায়েদ ফায়ার প্লেসের সামনে বসে শান্ত দৃষ্টিতে সবটা দেখছিল। অবনী নিজের ঘরে যেতেই ম্যালিনা জুসের গ্লাস এনে জুনায়েদের সামনে দিলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে একবার চুমুক দিয়ে আবারো ম্যালিনার হাতে দিয়ে মুচকি হেসে বলল
–এটা ম্যামকে দিয়ে আসো। বলবে এটা খেলে ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। আর হ্যা ম্যাম ডিনারে কি খাবে সেটা জেনে নিও। আজ ম্যামের পছন্দ মতো ডিনার হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here