মেঘবৃত্ত পর্ব ৫

#মেঘবৃত্ত
#পর্ব_৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” খাচ্ছিস না কেনো? ”
বৃত্তের ধমকানোতে মেঘা একটু নড়েচড়ে বসলো। রুটি ছিঁড়ে তাতে সবজি পুড়ে মুখে দিলো। খাবারটা মুখে দিতেই পেটের ভিতর গুড়ুম গুড়ুম শুরু হয়ে গেলো। পেট গুলিয়ে বমি আসছে। কি একটা অবস্থা! প্রেগন্যান্সির মাত্র এক মাস দু সপ্তাহ হলো। এতেই এত বমি! বাকি দিন কি হবে, সেটা ভেবেই মেঘা ভয়ে ক্ষয়। মেঘা নিজেকে সামলালো। আস্তে আস্তে খেতে খেতে বৃত্তকে প্রশ্ন করলো,
— ” তুই কি যেনো বলতে চাইছিলি না? ”
বৃত্ত ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। কি থেকে কি শুরু করবে, ভেবে পাচ্ছে না ও। মায়ের বলা কথাটা মেঘা কেমন করে নিবে সেটাও বিরাট চিন্তার বিষয়। বৃত্ত হাফ ছাড়লো। যায় হোক, বলতেই ত হবে। কিছু করার নেই। বৃত্ত মিহিয়ে যাওয়া সুরে বললো,
— ” মা বিয়েটা মানছেন না। ”
মেঘা থমকালো। হাতের খাবার মুখ অব্দি নিয়ে আবারও প্লেটে রেখে দিলো। ভয়ার্ত চোখে বৃত্তের দিকে চেয়ে বললো,
— ” এখন? ”
বৃত্ত একহাতে কপাল চুলকালো। অস্থির হাতে ঘন চুলে হাত চালিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। মেঘার ভয়ার্ত চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” এখন নিজেদেরই বিয়ে করতে হবে। কাজী অফিসে সাক্ষী এনে। ”
মেঘার খুব দুঃখ দুঃখ লাগলো। বৃত্তের মায়ের মানা করার কারণ তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। মেঘাকে তিনি পছন্দ করেন, সেটা মেঘার অজানা নয়। তাহলে, বাঁধাটা কোথায়? মেঘা ভেবে পেল না। মেঘা বললো,
— ” এভাবে কারো মত না নিয়ে, বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে? তারা যদি পরে মেনে না নেন? তখন? ”
— ” তখনের টা তখন দেখা যাবে। এখন যেটা করা উচিৎ সেটাই করবো আমরা। বুঝেছিস? ”
মেঘা মানা করলো না। মেঘার হাতে যে আর কোনো উপায় নেই। অবিবাহিত মেয়ের পেটে বাচ্চা! বিষয়টা যে সমাজে চরম নিন্দনীয়! তবে, মেঘার ভাগ্য ভালো। অন্যান্য বাজে ছেলের মত বৃত্ত এই সময়ে মেঘার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। বরং, পাশে থেকেছে। কখনোই ভরসার হাত ধরে বলেনি, ‘ আমি আছি তো। ভয় কিসের? ‘ কিন্তু,, দুর থেকে তার জন্যে লড়াই করে গেছে। এসব নিতান্তই বন্ধুত্বের খাতিরে। আর সেটা মেঘা জানে। আর জানে বলেই তার এত কষ্ট। সে তো চেয়েছিল, বৃত্ত তার পাশে থাকবে। তবে, বন্ধু হিসেবে নয়। স্বামী হিসেবে। কিন্তু, সে কি আদৌ সম্ভব?
মেঘার হঠাৎ করেই মনে হলো, বৃত্ত তো একবারও তার সন্তানের বয়স জানতে চায়নি। জানতে চায়নি, সন্তানটা কেমন আছে? পেটের মধ্যে তার কষ্ট হচ্ছে কিনা? সন্তানটা সুস্থ আছে কিনা? না, কিচ্ছু জানতে চায়নি সে। সে শুধুই মেঘার প্রতি নিজের দায়িত্ববোধ পালন করছে। এটুকুই! মেঘা হঠাৎই জিজ্ঞেস করলো,
— ” বৃত্ত। একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ”
বৃত্ত মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে হাত চালিয়ে উত্তর করলো,
— ” হুম, বল। ”
মেঘা লালারস দিয়ে গলা ভেজালো। কম্পমান কণ্ঠ নিয়ে বললো,
— ” তোর কখনোই জানতে ইচ্ছে হয়নি, আমাদের বাচ্চাটার বয়স কত হলো? ”
বৃত্ত থমকে গেলো। মোবাইলের অর্ধেক মেসেজ টাইপ করেই তাকালো মেঘার দিকে। কিছু একটা চিন্তা করে বললো,
— ” তোর পেট দেখে যা মনে হলো, এক মাসের হবে বোধহয়। কেনো, বলতো? ”
মেঘা হতাশ হলো। বৃত্তের মধ্যে বাবা হওয়ার কোনো আনন্দই নেই। তার কাছে, সন্তান হওয়াটা যেনো নিতান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু, মেঘা তো খুশি। একটা ছোট্ট বাচ্চা তার পেটে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। মেঘার কাছে এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি দুটো নেই। হোক না বাচ্চাটা অবৈধ। তবুও, তারই তো বাচ্চা, তার সন্তান। যে তাকে আদো আদো বুলিতে ‘ মা ‘ বলে ডাকবে। পাতলা ঠোঁটে মেঘার গালে চুমু খেয়ে বলবে, ‘ মাম্মাম, তেমন আচো। ‘ বাচ্চার কথা ভেবেই মেঘার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। মন চাচ্ছে, বাচ্চাটাকে একবার যদি ছুঁয়ে দেখা যেত। শুধু একবার?

— ” মেঘ, চল। ”
বৃত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঘা মাথা উঁচু করে বৃত্তের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
— ” কোথায় যাবো? ”
বৃত্ত থমথমে কণ্ঠে উত্তর করলো,
–” কাজী অফিসে। ”
__________________________________
কাজী অফিসে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা আর বৃত্ত। তাদের সামনে তাদেরই চারজন বন্ধু। বৃত্ত সব ফরমালিটিস শেষ করে মেঘার পাশে এসে দাঁড়ালো। মেঘাকে জিজ্ঞেস করলো,
— ” চিন্তা হচ্ছে? ”
মেঘা চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে তার। নিজের পরিবারকে ধোঁকা দিতে তার মনটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে মায়ের আদুরে মুখ ভেসে উঠছে। বাবার রাগের আড়ালে মায়া ভাসছে মনের মাঝে। বৃত্তের মায়ের চিন্তাটাও মনের ভিতরটা কুটকুট করে খেয়ে ফেলছে। সবমিলিয়ে মেঘার অবস্থা করুন। মেঘা মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলো। বৃত্তের উদ্দেশ্যে বললো,
— ” বিয়ে কখন হবে? ”
বৃত্ত আশপাশে তাকিয়ে উত্তর করলো,
— ” মিনিট দশেক পর। ”
— ” ওহ। ”
মেঘা চুপ হয়ে গেলো।
অতঃপর, সময় এলো রেজিস্ট্রি পেপারে সাক্ষর দেওয়ার। বৃত্ত পেপারে স্বাক্ষর করে কলমটা মেঘার দিকে এগিয়ে দিলো। মেঘা কাঁপা হাতে কলম নিলো। পেপারটা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে, চোখ বন্ধ করে ফটাফট সাইন করে দিল।সাক্ষীরা সবাই করতালি দিয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো,’কনগ্রাচুলেশন ‘।
মালা বদল হলো দুজনের। সব কাজ শেষ করে কাজী অফিস ছেড়ে বের হলো ওরা। বৃত্তের বন্ধুরা বৃত্তকে নিয়ে টিটকারী করলো,
— ” ভাই, শেষমেশ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডরেই বিয়া করলা? ”
বৃত্ত হাসলো। বললো,
— ” বেস্ট ফ্রেন্ড ত কি হইলো? মেয়ে তো! একটা মেয়ে হইলেই হয়। ”
সিদ্ধার্থ বললো,
— ” বহুত ত বললা, সি ইজ জাস্ট ম্যাই ফ্রেন্ড। নাথিং এলস। এই তোমার নাথিং এলসের নমুনা? ”
বৃত্ত চোরাচোখে মেঘার দিকে একবার তাকালো। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললো,
— ” সবই বিধি কা খেল, মামা। আমি তো এক আম জনতা।”
সবাই হেসে উঠলো বৃত্তের কথায়। মেঘা এসব টিটকারীর মধ্যে নেই। ও তো একপাশে চুপটি হয়ে বসে আছে। মুখে রাজ্যের চিন্তা। সামনে কি হবে, তা ভেবেই ভয়ে তার মুখের রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। বৃত্ত সবাইকে সামলে মেঘার পাশে এসে দাঁড়ালো। মেঘার চিন্তিত মুখ দেখে সে খুব একটা অবাক হলো না। এটাই স্বাভাবিক। শুধু মেঘা চিন্তা করছে, তা নয়। সে নিজেও বিয়ে নিয়ে চিন্তিত। বৃত্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক দিলো,
— ” মেঘ? ”
মেঘা তাকালো বৃত্তের দিকে। বৃত্ত বললো,
— ” এখন যাওয়া যাক। ”
— ” কোথায়? ”
— ” আমার বাড়িতে। ”
মেঘার মুখখানা আবারও পাংশুটে হয়ে গেলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here