মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৩৪

#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ চৌত্রিশ

দিয়া তুলতুলের বাড়িতে এসেছে পযন্ত দেখছে তিয়াস তাকে এড়িয়ে চলছে। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছে না। রাগ করেছে? কিন্তু রাগ তো তার হওয়ার কথা তা না হয়ে উল্টো ইনি রাগ দেখাচ্ছে। হুহ্! তার বয়েই গেছে তিয়াসের রাগ ভাঙাতে। দিয়া সোফায় বসে আছে পাশে তুলতুল বসে কথা বলছে, তার সেদিকে মনোযোগ নেই সে ডাইনিং টেবিলে বসা তিয়াসকে আঁড়চোখে দেখতে ব্যস্ত। চোখে চোখ পড়লে দিয়ার দিকে রাগী ভাবে তাকাচ্ছে, যেনো এখনি এসে তাকে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে কতগুলো বকা শুনাবে। কিন্তু এমন কিছুই করছে না শুধু রাগী ভাবে তাকাচ্ছেই। দিয়া কথা বলতে গেলে এড়িয়ে যাচাই। দিয়া বিরক্ত হলো। আর তিয়াস পানি খেয়ে দিয়ার দিকে একবার তাকায় তারপর গদগদ করে হেঁটে নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। আর দিয়া হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এ কয়দিনে সে তিয়াসের একটুও দেখা পায়নি, আজকে একটু দেখা পেয়েছে কই একটু সামনে বসে থাকবি তা না করে গিয়ে রুমে দরজা দিয়েছে। আচ্ছা রুমে গিয়ে কি বালিশের ওপর মাথা দিয়ে কাঁদতে বসেছে যে এভাবে গটগট করে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিতে হবে? আজব!

-” ওই তুই কি ভাবছিস এতো? আমি কখন থেকে ডাকছি? ঘটনা কি বলতো? ভাইয়াকেও দেখছি চুপচাপ থাকতে, তুইও আনমনা হয়ে আছিস? কি চলছে তোদের মধ্যে? ব্যাপারটা তো সন্দেহজনক।” তুলতুল পাশ থেকে দিয়াকে গুঁতা দিয়ে বললো। দিয়া কিছু বলার আগেই তাওহী দৌড়ে এসে হড়বড় করে বলে

“দিয়ামনি দিয়ামনি
তার নাক দিয়ে পড়ে পানি,
রাগী চোখের চাহনিতে
পানি জমেছে চোখের কোণেতে”

-“সুন্দর না কবিতাটা? আমি এখন বানিয়েছি। দিয়ামনি কারো রাগ দেখে এখন কেঁদে দেবে তাই এটা নিয়েই বানিয়েছি। কি বুদ্ধিমান আমি তাইনা? মা বলেছে আমি কবি হবো।
” আমি কবি হবো, আমি কবি হবো!
পারলে আমাকে ঠেকিয়ে দেখো,
ওওওহ,আমি দেখিয়ে দেবো।”

তাওহীর কবিতা বলার ঢঙ দেখে তুলতুল খিলখিল করে হেসে উঠলো। দিয়াকে পচানো দেখে সে মজা পেয়েছে। তাওহী নিজেও দাঁত কেলিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া তাওহীর দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে বলে

-” এই এদিক আয়, কবি কিভাবে হয় আমি তোকে দেখিয়ে দেই।” দিয়ার কথায় তাওহী একটা ভেংচি কেটে বললো-

-” তুমি কবিতার ‘ক’ জাননা মনে হয়। একটা বাচ্চাকে রাগ যে দেখায় সে কাউকে কবি বানাতে পারে না। হুহ্।”

তাওহীর কথায় দিয়া হা হয়ে গেলো। এই ছেলে কি থেকে কি বলে। কথা শুনে কেউ বলবে না সে ছয় বছরের পিচ্চি ছেলে। দিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় কোলে বসিয়ে রেখে গাল টেনে দেয়ার, কিন্তু যে পাকনা কোলে নিতে গেলে হয়তো বলেই বসবে “আমাকে কি নিজের পায়ে আর দাঁড়াতে দেবে না? ছোট মনে করো? আমি কিন্তু অনেক বড় মনে রাখবে বাছা। ঠিকাছে?” বা তার থেকেও কঠিন কোনো কথা বলবে। দিয়া চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো তাওহীর দিকে, যদিও সে মনে মনে হাসছে। আর তাওহী ভাব নিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো। গায়ে তার মেরুন রঙের শার্ট আর হোয়াইট প্যান্ট, ব্লাক কালার টাই, চুলগুলো স্পাইক করা, হাতে ব্লাক ওয়াচ তার হাতের মাপের। সে হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো, তারপর দিয়ার দিকে এটিটিউড নিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকালো। তারপর নিজের চুলগুলো সেট করতে করতে হেঁটে তার মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের হাত ধরে দাঁড়ালো। দিয়া হা করে দেখছিল এতোক্ষণ। আফসা বেগমের কথায় সে মুখ বন্ধ করে তার দিকে তাকায়।

-” তুলতুল কোথায়ও যাবি না, দিয়া তুইও আছিস দুজন বের হবি না কিন্তু কোথাও, তিয়াস তো রয়েছেই। আমি চলে আসবো তাড়াতাড়ি।” তুলতুল তা শুনে বলে

-” মা তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমিও যাবো।”

-” হ্যাঁ তোমার তো শুধু বাইরে যাওয়ার বাহানা। কোথাও যেতে হবে না ঘরে থাকো। আমি তাওহীর স্কুলে যাচ্ছি, প্যারেন্টস মিটিং আছে। দ্রুত চলে আসবো।” বলে আফসা বেগম তাওহীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এবার তুলতুল দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো

-” এবার বল কাহিনি কি?”

-” কিছুই না, কয়েকদিন ধরে তোর ভাই আমাকে ইগনোর করছে। কথাও বলছে না। আজকে দেখা হয়েছে দেখ কেমন রাগী ভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। হুহ আস্ত রাক্ষস! কি করেছি আমি? রাগ তো আমার করার কথা।” দিয়া মুখ ফুলিয়ে বললো। তার অবস্থা এমন যে এখনি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেবে।

-” ইগনোর করছে, নিশ্চয়ই কারন আছে। আর আমার ভাই মোটেও রাক্ষস না, সে ভালো মানুষ, শান্ত, শিষ্ট ভদ্র মানুষ। বুঝেছিস? আর ভাইয়া ইগনোর করছে, কথা বলছে না তো তুই কারন না জেনে চুপচাপ বসে আছিস কেন গাধা? ভাইয়ার পেছনে লেগে পড়। দেখবি কতসময় কথা না বলে পারে।” তুলতুল বোঝানোর স্বরে বলে। দিয়া অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে বলে

-“সত্যিই পেছনে লেগে যাবো?”

-” হু”

-” যদি থাপ্পড় মারে?”

-” আরে না মারবে না। মারতে গেলে তুই গাল আরো এগিয়ে দিবি, দেখবি ভড়কে গিয়ে আর মারবে না।” বলে তুলতুল হেসে দিল। দিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো

-” সত্যি তো?”

-” হু”

-” আচ্ছা” বলে দিয়া এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে

-” তুই ঠিকই বলেছিস তোর ভাই শান্ত, শিষ্ট, লেজবিশিষ্ট ভালো বান্দর একটা।” বলে দিয়া হনহন করে তিয়াসের রুমের দিকে গেলো। আর পেছন থেকে তুলতুল বলছে

-” ফাজিল! আমার ভাইরে বান্দর কইছিস, এবার বাঁদরামি না দেখিয়ে দেয়। বুঝিস কিন্তু!” তুলতুলের কথায় দিয়া ভেংচি কাটলো।

তুলতুল উঠে তা নিজের রুমে গেলো। তার মন একদম ভালো না। উপরে যতই হাসিখুশি দেখাক না কেন, কোন এক অজানা কারনে সবসময় তার মন খারাপ হয়ে থাকে। যখন তখন কান্না করতে মন চায়। ইদানীং সে নিজেই নিজেকে বোঝে না। কিসের একটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাকে।

দিয়া তিয়াসের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতে ভয় লাগছে। তিয়াসের রাগী নজর তার মনে পড়ছে। তারপরও বুকে ফু দিয়ে দরজায় হালকা ধাক্কা দিল। দরজা দেখে খুলেই রেখেছে। সে দুরুদুরু বুকে ভেতরে ঢুকলো। ইশশ! ভেতরে ঢুকেই মনে হচ্ছে সে কোনো গুহার ভেতর ঢুকে পড়েছে। পুরো রুম অন্ধকার করে রেখেছে, বিছানার ওপর কাপড় চোপড় রেখেছে। দিয়া বিরক্ত হলো। তার অগোছালো কোনো কিছুই ভালো লাগে না। এই লোক সবসময় নিজে এতো ফিটফাট থাকে অথচ রুমের কি অবস্থা করে রেখেছে। তুলতুল নিজেও অগোছালো নিজের রুম গোছাবে না, শুধু দৌড়ে বেরানোর ধান্দা অতএব, সে যে গোছাবে না জানা কথা। তিয়াসকে রুমে দেখা যাচ্ছে না,হয়তো ওয়াশরুমে আছে। দিয়া ওড়না ভালো ভাবে ঠিক করে নিল আগে, তারপর জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিল। পর্দা সরিয়ে দিতেই যেনো হুড়মুড় করে একঝাঁক আলো রুমের ভেতর ঢুকে রুমটাকে আলোকিত করে তুললো। দিয়া এবার বিছানার কাছে গিয়ে কাপড় গুলো আগে সুন্দর করে ভাজ করে রাখলো সোফায়। তিয়াস পড়ে কাবার্ডে রেখে দিবে। তারপর সে বিছানা সুন্দর করে গোছালো, টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, চার্জার, কিছু বই সব ঠিক করা সহ অন্যান্য কাজ করে একদম সবকিছু গুছিয়ে ফেললো। রুম টাকে এখন কোনো মানুষের রুম মনে হচ্ছে, এতক্ষণ গরুর ঘর লাগছিল তার কাছে। সে একটা দম নিল দাঁড়িয়ে, এর ভেতরই ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ হলো। সে বেখেয়ালে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে আবার সেদিকে তাকিয়ে রোবটের মতো হয়ে যায়। তার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গিয়েছে। তিয়াস একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে বের হয়েছে শুধু। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সামনে তাকাতেই দিয়াকে দেখতে পেল। তাকে কিছু বলতেই তার ওইদিনকের কথা মনে পড়ে গেলো। ভালোবাসে তাকে আর হাত ধরে হাঁটবে অন্য লোকের? মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে দিয়াকে বলে

-” তুই এখানে আমার রুমে কি করছিস? তোর সাহস তো কম না!” তিয়াসের কথা শুনে দিয়ার খেয়াল আসে সে কি করছিল, লজ্জা পায় নিজের কাজে আবার ভয়ও পায় সে উল্টো ঘুরে চলে যেতে চায় পরে আবার তুলতুলের কথা মনে করে গেলো না। তিয়াস এতোক্ষণে টিশার্ট পড়ে ফেলেছে। সে দিয়ার দিকে ভ্রু উঁচু করে তাকালো। দিয়া জোর পূর্বক হেসে বললো

-” তিয়াস! ওহ! তিয়াস ভাইয়া, আমি কেন এসেছি? ওইতো এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি। মানে ভুলে চলে এসেছি। হে হে হে।” দিয়া দাঁত বের করে বললো।

-” তা তো ভুলবিই। ভুলবি না? একজনকে ভালোবাসি বলে আরেকজনের হাত ধরে হাঁটলে তো সব ভুলে যাবি।” দিয়া তিয়াসের কথা কিছু বুঝতে না পেরে বললো

-“কার হাত ধরে হেঁটেছি? আপনি কার কথা বলছেন?”

-” কিছু না। যা বের হ, মেজাজ খারাপ করিস না।” দিয়ার মন খারাপ হলো ভারি এ কথা শুনে। কিন্তু তাকে জানতেই হবে তিয়াস কেনো এমন করছে। সে তিয়াসের দিকে এগিয়ে গেলো, তারপর বললো,

-” তিয়াস ভাইয়া আপনি কি রাগ করেছেন? কিন্তু রাগ তো আমার করার কথা।” দিয়ার কথা শুনে তিয়াস তার দিকে তাকালো। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছে শুধু রাগ না তোকে ইচ্ছা মতো থাপড়াতে মন চাচ্ছে। কেন তুই ওই লোকের হাত ধরে হেঁটেছিস আমাকে ভালোবাসি বলে? কিন্তু সে বললো না রাগী ভাবে তাকিয়ে রইল শুধু। এতে দিয়া তিয়াসের হাতের এক আঙুল ধরে তার হাত ঝাঁকি দিয়ে জেদ করে বললো

-” বলুন, বলুন, বলুন, আপনি রাগ করেছেন আমার ওপর কিন্তু কেন? কি করেছি আমি? নিজেতো উল্টো পাল্টা করেছে এতে রাগ আমার করার কথা কিন্তু উল্টো আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন?” দিয়া ঠোঁট ফুলালো। এখনি সে কেঁদে দেবে এমন অবস্থা। তিয়াসকে ভয় পেলেও এখন তার ভয় কাজ করছে না। আর তিয়াস দিয়াকে এভাবে করতে দেখে মন চাইলো তাকে জড়িয়ে ধরে বলে -” পিচ্চি তোর সাহস তো কম না তুই অন্যের হাত ধরে হাঁটিস। আমাকে ভালোবাসি বলে। এরপর আর এমন কিছু দেখলে একদম মেরে ফেলবো। আমাকে ছাড়া আর কারো হাত ধরা তো দূরে থাক তাকাবিও না।” কিন্তু সে বললো না। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়ার হাত সরিয়ে এক ধমক দিয়ে বলে

-” এক থাপ্পড়ে একদম দাঁত ফেলে দেব। বেশি সাহস হয়েছে না। যা বের হ। আমার সামনে আসবি না আর।” দিয়ার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে একবার তিয়াসের দিকে তাকায়, তারপর অভিমান করে পেছন ফিরে যতে যেতে বলে

-” ধমক দিলেন তো দেখবেন আসবো না আপনার সামনে, কি যেনো বললেন হাত ধরার কথা। আমি নিজেই জানি না কার কথা বলছেন, কিন্তু আমি তাকে খুঁজে বের করে তার হাত ধরে আবার হাঁটবো, আর তাকে বিয়ে করে নেব একবারে। ভালো হবে তখন।” তিয়াসের মেজাজ খিঁচে গেলো এবার। হাত ধরে হেঁটেছে দেখেই তার কষিয়ে থাপ্পড় দিতে মন চাচ্ছে আর সে এখন বছে বিয়ে করবে। তিয়াস ঝড়ের বেগে গিয়ে দিয়াকে দরজার সামনে থেকে টেনে ধরলো। তারপর দেয়ালের সাথে লাগিয়ে গাল চেপে ধরে বললো

-” কি বললি তুই বিয়ে করবি? একদম মেরে ফেলবো তোকে।

-” হু করবোই তো তাতে আপনার কি?” দিয়া রাগ করে বললো। গালে ব্যাথা লাগছে তার। তিয়াস দিয়ার কথা শুনে আরো রেগে যায়। সে দিয়ার গাল আরো শক্ত করে ধরে বলে

-” তাই নাকি? আমিও দেখবো তুই কিভাবে আর কাকে বিয়ে করিস। একদম পা ভেঙে বন্দী করে রেখে দেব। তিয়াসকে নিয়ে খেলা কি এতই সহজ?”

-” আপনি…”

দিয়ার মুখ দিয়ে আর কিছু বের হলো না৷ সে নিজের মুখে হাত দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হলো তার সাথে এটা? তিয়াস এমন কিছু করেছে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তিয়াস একটু দূরে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বললো

-” কি যেনো বলছিলি? কন্টিনিউ কর।” কিন্তু দিয়া কোনো কথা বলতে পারল না। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তিয়াসের দিকে। তিয়াস এগিয়ে এসে দিয়ার গাল টেনে দিয়ে বললো

-” অন্যকে বিয়ে করার কথা ভুলে যা। মুখে অন্য কারো নাম নিবি তো মেরে ফেলবো। আর আজকের পর থেকে আশা করি আমার কথা তোর মাথা থেকে বের হবে না। আমি চাই নি তোকে নিজের জীবনে জড়াতে কিন্তু তুই বাধ্য করলি, নিজে নিজেই বিপদে পড়লি। এখন দেখি আমার নজর থেকে কিভাবে বাঁচিস। এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নে।” বলে তিয়াস চোখ টিপ দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো যেনো কিছুই হয়নি, সব স্বাভাবিক। সে যে কিছুক্ষণ আগেও ভয়ানক রেগে ছিল তা বোঝার কোনো উপায় নেই। দিয়া দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। সে ঘোরের ভেতর আছে এখনো। আশেপাশে কি হচ্ছে তার কোনো ধারণা নেই। সে ঠোঁটের ওপর হাত রেখে আস্তে আস্তে চোখ পিটপিট করতে করতে রোবটের মতো হেঁটে বাড়ির বাইরে চলে গেলো।

.

রাত দশটা সাড়ে দশটার মতো বাজে। চারপাশে অন্ধকার ছেয়ে আছে। এই অন্ধকারের ভেতর সবকিছুই ভয়ানক লাগে। কিন্তু তুলতুলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আনমনা হয়ে হাঁটতে ব্যস্ত। বাড়িতে তার অস্থির লাগছিল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিছুর শূন্যতা তাকে একদম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছিল মনে হয়। তাইতো কিছু না বলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছে যাতে একটু প্রশান্তি পায়। দিনের ভেতর অনেকবার কারনে অকারনে তার রাফসানের কথা মনে পড়ে। খুব করে মনে পড়ে। কেন তা জানে না। অনেকদিন হলো লোকটার দেখা নেই। সেই যে সেদিন গাড়ির ভেতর দেখেছিল এরপর আর দেখে নি। তুলতুল বের হয় যখন এদিক ওদিক তাকিয়ে মনের অজান্তেই তার চোখ দুটো রাফসানকে খোঁজে। কেন হয় এটা? সে কি পছন্দ করে লোকটাকে? কিন্তু পছন্দ করার মতো কিছুই নেই লোকটির ভেতর, উল্টো অপছন্দ করার হাজার কারন আছে। তারপরও কি তুলতুলের এমন একটা মানুষকে ভালো লাগে? সবাই বলে ভালোলাগার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই, আদৌও কি তাই? হয়তো! তাইতো রাফসানের ভেতর ভালোলাগার মতো কোনো কারন না থাকলেও হাজার অপছন্দের জিনিসগুলো বিদ্যমান থাকলেও ইদানীং তুলতুলের ভালো লাগে। ভালো লাগে রাফসানকে নিয়ে ভাবতে। কিন্তু যখন বাস্তবতা হানা দেয় তখন নিজের ওপরই রাগ হয়। যে মানুষটাকে নিয়ে সে ভাবে সে হয়তো তাকে ভুলেই গেছে। দিনে কেন মাসেও বোধহয় একবার তাকে স্মরণ করে না। আর করবেই বা কেন? না তারা পূর্বপরিচিত, না আত্মীয়, না কোনো প্রিয় মানুষ তাহলে কেন তুলতুলকে মনে করবে? তুলতুলের মন খারাপ হয়। চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। কি আশ্চর্য! যাকে সে নিজে কখনো চোখের দেখাও দেখতে চাইতো না তার জন্য তার চোখ ভরে উঠছে? আর সে কার জন্য কাঁদছে? গুন্ডা একটা, আদোও কি কাউকে সে ভালোবাসতে পারে বা তার কাউকে ভালোলাগতে পারে? হয়তো না৷ তুলতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিন্তু সামনে তাকাতেই সে চমকে যায়। রাফসান? রাফসান কি সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? সে চোখ কচলিয়ে আবার তাকায় না সত্যিই আছে। রাফসান হাসি দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে তুলতুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে

-” খারাপ! খুব খারাপ তুমি। কেন আমার ভেতর জেঁকে বসেছো? কেন আমি হাজার চেষ্টা করেও তোমাকে ভুলতে পারছি না? কেন বলো?” তুলতুল চোখ মুখ কুঁচকে বললো

-” আপনি ড্রিংকস করেছন?”

-” হ্যাঁ করেছি তো? তোমার কি? তোমার এতে কিছু যায় আসে না।” রাফসান ভাবলেশহীন ভাবে বললো।

-” আপনি এতো রাতে এখানে কেনো এসেছেন? আর নিজের এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে ছ্যাঁকা খেয়ে একদম ব্যাকা হয়ে গেছেন। বাইরে থাকা এখন আপনার জন্য ঠিক হবে না। যান বাড়ি যান।”

-” ছ্যাঁকা? হু খেয়েছি তো অনেক বড় একটা ছ্যাঁকা খেয়েছি। আমার মন আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। ছ্যাঁকা খেয়েছি।” বলে রাফসান পাগলের মতো হাসতে লাগলো। তুলতুল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। লোকটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে ড্রিংক করে। কি উল্টো পাল্টা বকছে। তুলতুল রাফসানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম হয় না, চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে। চেহারাও মলিন হয়ে আছে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি কিছুটা বড় হয়েছে। তুলতুল কিছু বলবে তার আগেই রাফসান এগিয়ে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে

-“ভালোবাসি”

তুলতুল স্তব্ধ হয়ে যায়। সে নড়চড় বিহীন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটোয় একরাশ বিস্ময়। সে কি ভুল শুনলো? নাকি সত্যি? নাকি রাফসান মাতাল হয়ে উল্টো পাল্টা বকছে? তুলতুলের আওয়াজ না পেয়ে রাফসান তুলতুলকে সামনে এনে তার চেহারা দেখলো, তারপর মুচকি হেসে আবার জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলে

-” ভালোবাসি”

কতটা সময় তুলতুল ওভাবে ছিল তা সে বলতে পারবে না। তার মাথা ফাঁকা হয়ে আছে। আবির এসে রাফসানকে হাত ধরে টেনে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর তুলতুলের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলে

-” তেলুতেলু ভাই কি তোমাকে কিছু বলেছে? বললেও ভুলে যাও। ভাই নেশার ঘরে উল্টো পাল্টা বকে কিন্তু নেশা কেটে গেলেই সব ভুলে যায়। আমি ভাইকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমিও বাড়ি যাও রাত হয়ে গিয়েছে।” বলে আবির রাফসানকে টেনে নিয়ে যেতে লাগে। কিন্তু রাফসান তখনো পাগলের মতো হাসছিল। সত্যিই কি তুলতুলকে সে নেশার ঘোরে ভালোবাসি বলেছে? নাকি সত্যিই সে ভালোবাসে? তুলতুল কিছু বুঝতে পারলো না। রাফসান তাকে কেন ভালোবাসবে? এটা হতেই পারে না। যে তাকে দেখলেই রাগ করে সে তাকে কিভাবে ভালোবাসে তার মস্তিষ্ক এটা বলছে কিন্তু মন অন্য কিছু বলছে। তুলতুল স্তব্ধ ভাবেই পেছনে ফিরে বাড়ির দিকে যেতে লাগে। কিন্তু হঠাৎ করেই তারসামনে একটা মাইক্রো দাঁড়ায়, কিছু লোকজন বের হয়ে তুলতুলের মুখ চেপে ধরে গাড়িতে তোলে। তুলতুল চেয়েও নিজেকে ছাড়াতে পারে না। ঘটনা টা এত দ্রুত ঘটেছে যে সে কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। তার ওপর রাফসানের কথা গুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here