মেঘের পরে মেঘ-১৬

মেঘের পরে মেঘ -১৬

এখন আর আগের মতো ছাঁদে আসে না প্রলয়।গানও গায় না।কলেজের সামনের দোকানটাতেও থাকে না।
সবকিছুই খেয়াল করেছে রুপসা।মনটা কেমন যেন করে।কেমন করে তা বলতে পারবে না।
আগে পিছু পিছু আসতো, এখন তাও আসে না।
ওকে দেখার জন্য উঁকিঝুকিও মারে না।
হঠাৎই যেন সব বদলে গেলো।কিভাবে কি হলো বলতে পারবে না রুপসা।
অবশ্য এতে তো ওর খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু কেন যে খুশি হতে পারছে না কে জানে।
সপ্তাহের উপর হবে প্রলয়ের দেখা নেই।
কোথাও গিয়েছে হয়তো?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে এতোটা সময় ও শুধু প্রলয়কে নিয়েই ভাবছে দেখে নিজের মনেই বিরক্ত হলো রুপসা।
যেখানে খুশি সেখানে যাক।ওর কি?বরং আরো ভালো হয়েছে। বেঁচেছে ও।নিজেই নিজেকে স্বান্ত্বনা দিলো রুপসা।এরপর রেডি হয়ে নিলো কলেজে যাওয়ার জন্য।
আজ এমনিতেই একটু দেরি হয়ে গেছে।ক্লাস শুরু হয়ে যাবে নাকি?
কলেজে ঢুকতেই মনিকার সাথে দেখা।এখন তো ওর ক্লাসে থাকার কথা। এখানে কি করছে? মুখটাও কেমন ভারভার।

“কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
জিজ্ঞেস করলো রুপসা।

“আর বলিস না,আমাদের সোনিয়া ম্যাডাম এক্সিডেন্ট করেছে।”

ফারহিন সোনিয়া ওদের ইংরেজির প্রভাষক।বেশ হাসি খুশি একজন মানুষ। আট বছর হলো বিয়ে হয়েছে কিন্তু কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই।অনেক চেষ্টা আর সাধনার পর মাস দুই আগে কনসিভ করেছেন।হিসেবমতো তার এখন তিন কি সাড়ে তিন মাস চলছে।এ অবস্থায় এক্সিডেন্ট মানে তো ভয়ানক বিপদ।হতভম্ব হয়ে গেলো রুপসা।বিশ্বাস করতে ভীষণ কস্ট হচ্ছে ওর।অবিশ্বাসী সুরে বললো,

“কি বলিস এসব?আমি কলেজে আসার আগেই ম্যাডামের সাথে কথা বললাম।কখন হলো এসব?”

“এই তো মিনিট দশেক হবে।কলেজের সামনের যে বাক টা আছে ওখানেই হয়েছে এক্সিডেন্ট।বাস নিচে পরে গিয়েছিল।”

“ম্যাডামের খবর কি?”

“ভালো না।সামনেই একটা হাসপাতালে নিয়ে গেছে সবাই।”

“চল যাই।দেখে আসি কি অবস্থা। ”

“যাবি?”

“হ্যাঁ।”

দুজনেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।মাঝ রাস্তায় যেতেই দেখে কিসের যেন গোলমাল।গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। অনেক কলেজ স্টুডেন্ট ও আছে সেখানে।যারা গাড়ি ভাংচুরে অংশ নিয়েছে। রিকশাওয়ালা গাড়িওয়ালা রা দ্রুত পালাতে চাচ্ছে। রুপসা মনিকা হতভম্ব হয়ে রইলো।কি হচ্ছে এসব?
সামনেই পলায়নরত এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো যে,সোনিয়া ম্যাডাম মারা গিয়েছেন।আর তাই ছাত্ররা রেগে গিয়ে এসব করছে।
লোকটা ওদের বললো দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করতে।কিন্তু তার আগেই রুপসা আহত হয়ে পরলো।কোথা থেকে যেন একটা ইটের টুকরো এসে ওর মাথায় লাগলো।
রুপসা একটা চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

মনিকা কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।রুপসাকে জড়িয়ে নিয়ে দেখলো রক্তে পিঠ ভেসে যাচ্ছে।
অসহায় দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো।যদি কোন পরিচিত মুখ দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু না।সবাই মারামারি করতে ব্যস্ত।মনিকা ওদের রিকশাওয়ালাকে ডেকে রুপসাকে উঠানোর চেষ্টা করলো।
হটাৎই শক্তিশালী একজোড়া হাত এসে রুপসাকে জড়িয়ে নিলো।পাঁজা কোলা করে কোলে তুলে এক দৌড় দিলো নিজের গাড়ির দিকে।মনিকা পেছন পেছনে
ছুটলো।সেই সাথে হাফ ছেড়ে বাঁচলোও।একেবারে ঠিক সময় নায়কের এন্ট্রি।

_______

রুপসা এখন ঘুমুচ্ছে।মাথায় সাতটা স্টিচ পরেছে।ক্ষত বেশ গভীর।ডাক্তার নিজের কাজ শেষ করে রুপসাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন।যার ফলে গভীর ঘুমে মগ্ন রুপসা।
প্রলয় ওর পাশে বসেছিলো।রুপসার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছে। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। মনিকা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রলয়ের সেদিকে খেয়াল নেই। এক ধ্যানে চেয়ে দেখছে রুপসাকে।
মনিকা হালকা স্বরে প্রলয়কেে ডাকলো।প্রলয় শুনতে পেলো না।এবার একটু জোরেই ডাকলো।প্রলয় চমকে উঠে উত্তর করলো।
“কি হয়েছে? এভাবে ডাকছো কেন?ওর ঘুম ভেঙে যাবে তো।”

“মানে বলছিলাম কি,এতো বড় একটা ব্যাপার আন্টিকে জানানোর প্রয়োজন না?”

প্রলয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এরপর শান্ত গলায় বললো,,
“হ্যাঁ।তাতো জানাতেই হবে।বিকেলেই ওকে ডিসচার্জ করে দিবে।তুমি বরং একটার দিকে একটা কল দাও আন্টিকে।উনার এখানে পৌঁছুতে দুটো আড়াই টা বাজবে।সে পর্যন্ত আমি এখানে থাকবো।এমন একটা পরিস্থিতি, ওকে কাছ ছাড়া করতে মন চাইছে না।কিন্তু নিজের কাছে রাখার কোন অধিকারও তো আমার নেই।”

“খুব ভালোবাসেন ওকে?”

প্রলয় একটু হাসলো। কোন উত্তর দিলো না।
মনিকাই আবার শুরু করলো,

“আমি জানি আপনি ওকে খুব ভালোবাসেন।আপনি একদম মন খারাপ করবেন না।আজকে হয়তো ওর পাশে একেবারে থাকতে পারছেন না,কিন্তু এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন ওর সমস্ত ব্যাপারে আপনার মতামতই অগ্রাধিকার পাবে।আর আজকেই যা করলেন, সেই বা কম কি?আপনি সময় মতো না পৌঁছালে আমি যে কি করতাম, খোদাই জানে।দিশেহারা লাগছিলো খুব।আচ্ছা, আপনি কি আমাদের পিছনেই ছিলেন?”

“না।আমি আজ বাসায়ই ছিলাম।তোমার বান্ধবী কলেজে আসলো তা তো বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখলাম।এক বন্ধুর কলে সোনিয়া ম্যাডামের কথা জানতে পারলাম।তাকে দেখার জন্যই বের হতে নিচ্ছিলাম,তখনই লিটন কল করলো।বললো,সোনিয়া ম্যাডাম মারা গিয়েছেন,উত্তরের রাস্তায় ছাত্ররা ভাংচুর শুরু করেছে।আমি ভাবলাম গাড়ি নিয়ে বের হই।পশ্চিম দিক দিয়ে ঘুরে হাসপাতালে পৌঁছে যাবো কোন ঝামেলা ছাড়াই।কিন্তু রাস্তায় বেরুতেই আবার লিটনের ফোন।ও নাকি তোমাদের যেতে দেখেছে উত্তরের রাস্তার দিকে।
আমি আর একটুও দেরি করিনি।আর দেরি করলে যে কি হতো আল্লাহই ভালো জানেন।ও কথা আর মনে করতে চাই না।বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে যায়।”

প্রলয়ের চোখে মুখে এখনো অসহায়তা ঘিরে আছে।চোখ দুটোতে খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয়।

_______

রুপসা বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার দিকে।শায়েরী আর মনিকা সাথে ছিলো।বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই প্রলয় এগিয়ে এলো।ও এতোক্ষন নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

“এসেছেন আন্টি? রুপসার অবস্থা এখন কেমন?”

“আর অবস্থা বাবা।ভালো মেয়ে বেরুলো কি হাল হলো।”
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো শায়েরী।মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর।তবুও তো শক্ত থাকতে হবে।শায়েরী ছাড়া রুপসার আর কে আছে?তাই তো মনকে প্রবোধ দেন নিজেই।ভেঙে পরলে চলবে না।শক্ত হতে হবে।

“চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
ঠিকঠাক ভাবে বলতে চাইলেও গলাটা যেন একটু কেঁপে উঠলো প্রলয়ের।নিজেকে নিজেই শাসালো।আন্টির সামনে কিছুতেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না।যদিও মন মানছে না কিছুতেই।

“তাই যেন হয়।”

“আন্টি আপনি না হয় উপরে যান, আমি রুপসাকে নিয়ে আসছি।”
বলেই বুঝতে পারলো কথাটা বলা একদমই ঠিক হয়নি।

“তুমি তো ওকে ব্যালেন্স করতে পারবে না বাবা।তুমি একটু বেশিই লম্বা। তুমি বরং ছাঁদে গিয়ে আমাদের রুম টা খুলে দাও।আমি আর মনিকা ওকে নিয়ে আসছি।এই নাও চাবি।”

প্রলয় হাফ ছাড়লো।যাক বাঁচা গেছে।আন্টি তেমন কিছুই মনে করেন নি।ও চাবিটা নিয়ে ছাঁদে গিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। সোফা বসানো ছোট একটা রুম।খুব ছিমছাম করে সাজানো।আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই একদমই।হাতের জিনিসপত্র গুলো সেন্টার টেবিলে রাখলো প্রলয়।
তারপর আবার বেরুলো।
ততক্ষণে শায়েরী,মনিকাও রুপসাকে নিয়ে এসে পরেছে।রুপসাকে বিছানায় তুলে দিয়ে গায়ে কাথা জড়িয়ে দিলো শায়েরী।
ক্লান্ত মুখ রুপসার।এই কয়েক ঘন্টায় চেহারার কি আমূল-পরিবর্তন।
প্রলয় ততক্ষণে আবারো এসে দাঁড়িয়েছে।হাতে ঔষধের
ব্যাগ।ব্যাগটা শায়েরীর হাতে দিলো প্রলয়।

“আন্টি, আমি আসি তাহলে।কোন প্রয়োজন হলে ডাকবেন।আপনার মোবাইলটা একটু দিবেন প্লিজ! ”

শায়েরী নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলো।সেখানে নিজের নম্বর সেভ করে দিলো প্রলয়।

“এখানে আমার নম্বর আছে।যে কোন দরকারে কল দিবেন।সংকোচ করবেন না।আসি এখন।”

“এসো বাবা।”

প্রলয়ের গমন পথে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো শায়েরী।এ যেন আরেক নাবিল।

চলবে………

মুনিরা মেহজাবিন।

(নাবিল শায়েরীর দেখা হওয়ার বিষয় টা আরো দেরিতে আসবে।ধৈর্য ধরুন পাঠক।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here