#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব: ০৫
জাহান আরা
কাঁথায় বসে ফুল তুলছিলো নিলু,সুখবর পেলো তখনই। ব্যাংকে সিনিয়র অফিসারের যেই পোস্টে নিলু ইন্টারভিউ দিয়েছে,সেখানে নিলু সিলেক্ট হয়েছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় নিলু নির্বাক হয়ে গেলো। শিলু,নিরু,মিরু তিন জনেই চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো যেনো।
নিলুর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো যেনো নিলু স্বপ্ন দেখছে,একটু পরেই ঘুম ভেঙে যাবে,তখন নিলু দেখবে সব মিথ্যে।
সব যে সত্যি তার প্রমাণ পেলো মায়ের চোখের পানিতে নিলুর পিঠ ভিজে যাওয়ায়।কখন যে সাবিনা বেগম এসে নিলুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন নিলু টের ও পেলো না।
মায়ের চোখ মুছে দিলো নিলু।নিলুর মনে হলো সে যেনো একটা যুদ্ধে জিতে গেছে।সেই সাথে নিলুর আত্মবিশ্বাস ও বেড়ে গেলো।
নিজেকে নিজে হাজার বার কনগ্রাচুলেট করলো।
ছুটে গেল ফোন নিলো শাহেদ কে খুশির খবর জানানোর জন্য,কিন্তু ফোন হাতে নিয়েই থমকে দাঁড়ালো। এতোক্ষণ যে আনন্দ অনুভব করছিলো তা যেনো বিষাদে রূপ নিলো।
কাকে বলতে যাচ্ছে নিলু খুশির খবর?
যে নিজে থেকে একটা বার ও নিলুকে কল দেয় নি তাকে?
যে স্বার্থপরের মতো নিলুর সাথে ব্যবহার করেছে তাকে?
দুচোখ ভিজে গেলো নিলুর।
কেউ নেই তার,ভালোবাসার মানুষ তার নেই।তার আছে শুধু দায়িত্ব। মা,বোন সবাইকে ভালো রাখার দায়িত্ব।
বাবা না থাকলে ছেলেদের কে বাবার দায়িত্ব পালন করতে হয়।নিলু এখন বাবার দায়িত্ব পালন করবে।এই ভাঙাচোরা সংসার জোড়া লাগাবে।
একটু একটু করে দূর করবে সংসারের অভাব।
মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিলু।শিলুকে নিয়ে তখনই বের হলো নিলু বাজারের উদ্দেশ্যে।
প্রথমে গেলো স্বর্ণকারের কাছে।শাহেদের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে হলো স্বর্ণকার পট্টিতে।শিলু ভেবেছিলো আপা হয়তো দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখবে,কিন্তু শিলুর ভাবনা ভুল করে দিয়ে নিলু তাকালো না।শিলু এক পলক তাকালো কিন্তু শাহেদ কে দেখলো না।
দোকানে গিয়ে নিলু হাতের রিং,কানের দুল,গলার চেইন ৩টাই বিক্রি করে দিলো।
শিলু চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো নিলুর দিকে।
এ কি করছে আপা?
কিছুই মাথায় ঢুকছে না।আপার কঠোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে ও পারলো না।
বেশ ভালো অংকের টাকা পেলো নিলু এগুলো বিক্রি করে।
তারপর শিলুকে নিয়ে চলে গেলো কাপড়ের দোকানে,সবার জন্য কাপড়চোপড় কিনলো,নিনের জন্য কিছু জিনিস কিনলো,ভালো একটা ব্রান্ডের ব্যাগ নিলো।
বাসার জন্য মিষ্টি নিলো,হোটেল থেকে কিছু খাবার নিলো।
তারপর আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।
শাহেদ দোকানের বাহিরে রাস্তায় পানির ঝাপটা দিচ্ছে যাতে দোকানে বালি না আসে বাতাসে,ঠিক তখনই দেখতে পেলো দোকানের সামনে দিয়ে নিলু আর শিলু হেঁটে যাচ্ছে। নিলুকে কেমন দৃঢ়চেতা মনে হচ্ছে। শিলুকে দেখাচ্ছে ভয়ার্ত।
শিলু শাহেদকে দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো,নিলু কোনো দিকে তাকালো না।চোখের কোণ দিয়ে দেখলো দূর থেকে শাহেদকে একবার,দেখেই বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
কিন্তু নিজেকে নিজে সামলে নিলো নিলু,কিছুতেই নিজেকে দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
নিলুকে দেখে শাহেদ প্রচন্ড বিস্মিত হলো,কিছু সময় পর সেই বিস্ময় রূপ নিলো রাগে।
নিলু তাকে ইগনোর করেছে?
শাহেদ কে দেখে ও তাকায় নি নিলু শাহেদের দিকে?
তবে কি নিলু শাহেদকে ভুলে গেছে?
এই সেই নিলু,শাহেদের ভালোবাসার নিলু।আহারে,কি সাধের ভালোবাসা!
কেমন করে ভুলে গেলো নিলু সব?
বুকের ভিতর এক অসহ্য যন্ত্রণা শাহেদকে অস্থির করে তুললো।এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে?
শাহেদের ইচ্ছে করছে কাঁদতে,কিন্তু পারলো না।কান্না এলো না।বুকটা ভার হয়ে গেলো।
বাড়ি ফিরতে নিলুর রাত হয়ে গেলো।
বাসায় এসে নিলু মা’কে বললো,”মা আমার কিছু কথা আছে।”
সাবিনা বেগম মেয়ের কঠিন মুখ দেখে কিছুটা ভয় পেলেন।
নিলুর পাশে এসে বসলেন তিনি।
নিলু আবারও বললো,”আমরা এই বাসাটা ছেড়ে দিবো মা,এখানে থাকলে আমার আসা যাওয়ায় অসুবিধা হবে,তবে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হবে আমার শাহেদের দোকানের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করতে।
আমরা শহরে চলে যাবো মা,আমার চাকরি ও সেখানে,এখান থেকে বাসে আসা যাওয়া করতে আমার দুই আড়াই ঘন্টা চলে যাবে,তার উপর বাস ভাড়া ও যাবে অনেক টাকা।
ওখানে গেলে সব রকম সুবিধা হবে,শিলুর তো এখন আর কলেজে ক্লাস হবে না।ও শহরে কোনো ভালো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারবে,আর ওদের ফাইনাল এক্সামের কেন্দ্র ও তো শহরেই হয়।
নিরু আর মিরুর স্কুল থেকে আমি ট্রান্সপার সার্টিফিকেট নিয়ে ওদের ও ওখানে ভর্তি করিয়ে দিবো।
নতুন জীবন থেকে আমি অতীতের সব ছায়া মুছে দিতে চাই।”
সাবিনা বেগম চুপ করে মেয়ের কথা শুনলেন,কথা বলতে বলতে মেয়ের গলার কাঁপন ও তিনি অনুভব করলেন,মেয়ের যে কান্নায় গলা ধরে এলো তাও টের পেলেন।
আফসোস হলো তার ভীষণ।
শুধুমাত্র মা,বোনদের জন্য মেয়েটা নিজের জীবন নিয়ে বাজি ধরছে।
চুপ করে থেকে বললেন,”যেভাবে সুবিধা হয় তোর সেভাবেই কর।”
নিলুর তিন বোন ভীষণ খুশি হলো এই সিদ্ধান্ত শুনে।
শুধু নিলুর বুকের ভিতর এক নাম না জানা ঝড় উঠলো।সেই ঝড় নিলুকে যেনো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।বোবা কান্নারা সব বের হয়ে আসতে চাইলো কিন্তু পারলো না।নিলু শক্ত হাতে নিজেকে সামলে নিলো।
সামনে অনেক পথ বাকী আছে,জীবনের বাকীটা রাস্তা নিলুকে পার হতে হবে দৃঢ়তার সাথে।
তিন বোনকে লেখাপড়া করাতে হবে,ওদের যেনো নিলুর মতো কষ্ট পেতে না হয়।
টের পেলো নিলু তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে।
খাওয়া দাওয়া করে ঔষধ খেয়ে নিলু শুয়ে পড়লো।আপার শরীর খারাপ দেখে তিন বোন কোনো চেঁচামেচি করলো না।আপার ঘুমের যেনো কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
রুম অন্ধকার করে নিলু শুলো,তিন বোন বোনের বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে রইলো।আপার যদি মাথা টিপে দিতে হয় যাতে টিপে দিতে পারে।
মিরু ফিসফিস করে বললো,”আজকে কিন্তু আমি আপার সাথে ঘুমাবো।”
নিরু খেঁকিয়ে উঠে বললো,”ইশ,মামাবাড়ির আবদার যেনো।আজকে আমি ঘুমাবো।”
নিরুর মাথায় হালকা একটা চাটি মেরে শিলু বললো,আমি মাত্র এক রাত শুয়েছি আপার সাথে আজ আমার পালা।”
মিরু একটু জোর গলায় চিৎকার করতে যেতেই নিরু আর শিলু মিরুর মুখ চেপে ধরলো।মিরু টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে চেয়ারের সাথে মাথায় আঘাত পেলো।
কিন্তু আপার অসুবিধা হবে ভেবে আর ব্যথায় আর্তনাদ করলো না।
বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে নিলু সব শুনতে পেলো।
বোনদের এই ভালোবাসার মূল্য নিলু কি দিয়ে দিবে?
মনে পড়ে গেলো নিলুর কিছুদিন আগের কথা।সকাল থেকে নিলুর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিলো।নিলু গামছা দিয়ে মাথা বেঁধে রাখলো,শাহেদ কে বললো রুমের জানালা বন্ধ করে দিতে,লাইট অফ করে দিতে।
বসার ঘরে রেহানা বেগম জোর গলায় নিলুকে ডাকলেন চা নাশতা দেয়ার জন্য।এদিকে বালিশ থেকে মাথা উঠাতে পারছে না নিলু,মাথা কেমন ভার হয়ে আছে।যেনো মাথা নয় দশমণের পাথর একটা।
শাহেদ উঠে গিয়ে বললো,”মা নিলুর মাথাব্যথা,ও শুয়ে আছে।ভাবীদের কাউকে বলো আজ চা নাশতা বানাতে। আমি দোকানে যাচ্ছি,বাজারে গিয়ে চা খেয়ে নিবো।নিলু বিশ্রাম করুক।”
রেহানা বেগম কিছু আর বললো না।শাহেদ যাওয়ার পর রেহানা বেগম চিৎকার করে বললেন,”দুনিয়াতে আল্লাহ এই নবাবজাদিরেই মাথা দিছে একলা,আমগো কারো আর মাথা নাই,কারো মাথা ধরে না যেনো।বউরা যাইবো এখন স্কুলে,পোলারা অফিসে যাইবো,কি খাইয়া যাইবো হেরা?
কেমন ডাকাইত বউ অইতে পারে,নিজের স্বামীরে পর্যন্ত না খাওয়াইয়া বাজারে পাঠাইছে।
শাহেদের বাপে দ্যাশে থাকতে কোনোদিন ও তো কইতে পারবো না শরীল খারাপের উছিলা দিয়ে কোনো দিন হুইয়া আছিলাম।এহনকার বউরা ও বউ,আমরা ও আছিলাম বউ।আধুনিক যুগের আধুনিক বউ,শরীল খারাপ অইলে আর বিছানা ছাড়তো পারে না।আবার আমার পোলা এই বউর লাইগা মজনু অইছে।আল্লাহ এমন ছোডোলোকের মাইয়া আমার পোলার বউ করছে।”
দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো নিলুর।চুপচাপ উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো। রুটি আর ডিম ভেজে সবাইকে খেতে দিলো।তারপর সব ঘুচিয়ে নিলো রান্না করার জন্য।
চুলার আগুনের তাপে নিলুর মাথাব্যথা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেলো। দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে নিলু দেয়ালে মাথা পিটিয়েছে,আর নিরবে কেঁদেছে।
ভাত,মাছ,হাঁসের মাংস,ডাল,বেগুন ভর্তা,কলমি শাক ভাজি করতে করতে দুপুর দু’টো বেজে গেলো।নিলুর মনে হলো যেনো দোযখের যন্ত্রণা অনুভব করছে।
এর মাঝে শাহেদ কল দিলো একবার।নিলুকে জিজ্ঞেস করলো কি করো?
নিলু নিজের যন্ত্রণা গোপন করে বললো রান্না করছি।
শাহেদ রাগ করে বললো,”তোমার না শরীর খারাপ,কেনো উঠতে গেলে?”
নিলু জবাব দিলো,”এখন ঠিক আছি,ব্যথা সেরে গেছে আমার।চিন্তা করো না।”
সেদিন ও নিলু শাহেদ কে বলে নি কিছু।সেদিন কেনো,কোনোদিনই নিলু শাহেদের কাছে রেহানা বেগমের নামে কোনো অভিযোগ করে নি।
অযথা মা ছেলের মাঝে ফাটল হবে ভেবে।
কান্না আর বাঁধা মানলো না নিলুর,হুহু করে কেঁদে উঠলো। শিলু,মিরু,নিরু বোনের কান্না শুনে লাফিয়ে বিছানায় উঠলো। ৩ বোনকে জড়িয়ে ধরে নিলু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওপাশের বাতির আবছা আলোয় রুমের এই দৃশ্য দেখে সাবিনা বেগম নিজের চোখ মুছলেন।
চলবে…..???
(রিচেক দিই নি,বানান ভুল হলে সরি)