মেঘ_বৃষ্টি পর্ব =২৯
❤❤
রোদ-রোদেলা
#তানিয়া_আনিতা
মেঘ বৃষ্টির বিয়ের সাত মাস পূর্ণ হলো।কিন্তু এখনো তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন এলো না।প্রথম দিকে তাও অনেক টা ভালো ভাবে কথা বার্তা হলেও ওইদিনের ঘটনার পর থেকে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব যেন আরো কয়েক শো গুন বেড়ে গেছে। অফিসে কাজ নিয়ে টুকটাক কথা আর দেখা হলেও বাসায় কোনো দেখা বা কথা হয়না।আলাদা রুম হওয়ায় যে যার মতো গিয়ে নিজেদের কাজ রুমে করে নেয়।একসময় যে বাড়ি হই হুল্লোড় করতো এখন তা যেন নিরবতায় পরিনত হয়েছে।।
।
।
।
।
।
।
।
রোদেলার বিয়েরও ৩ মাস হলো।কিন্তু রোদেলার সাথে শ্বশুর বাড়ির কারো সাথে সম্পর্কের কোনো উন্নতি ঘটেনি।বরং রোদের ব্যবহারের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিয়ের পর রোদ প্রথমে রোদেলাকে অনেকটা সাপোর্ট করলেও দিনকে দিন রোদের সাপোর্ট কমতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়,ইদানীং রোদ রোদেলার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে। তার প্রতি কোনো যত্ন নেই না।তার ওপর তার শ্বাশুড়ি উঠতে বসতে তাকে অপমান করে, তাকে বিভিন্ন ভাবে অত্যাচারও করে তবুও কিছু বলে না।
।
।
।
।
।
।
।
।
মাঝে মাঝে রোদকে বললেও রোদ বিষয়টা এড়িয়ে চলে যা দেখে রোদেলার আরো বেশি কষ্ট হয়।রোদেলা চিন্তা করতে থাকে এটা কি সত্যি তার সেই ভালোবাসার মানুষ যে কিনা তার জন্য পাগল ছিল,তার ব্যাথায় ব্যথিত ছিল। কীভাবে একটা মানুষ এতোটা পরিবর্তন হতে পারে। তাছাড়া বিয়ের এতোদিন চলে গেছে এখনো দুজনের মাঝে কোনো স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠে নি।রোদ রোদেলাকে সময় দিয়েছিল আর তাতে রোদেলা অনেকটা ফ্রী হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত রোদ রোদেলা নিজ থেকে কাছে টেনে নেয়নি, রোদেলা অনেকবার আকার ইঙ্গিতে রোদ বিষয় টা বোঝাতে চেয়েছিল কিন্তু রোদ বুঝেও না বোঝার ভান করে গেছে। শেষে না-পেরে রোদেলা নিজ থেকেই রোদের কাছে ধরা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এতো কিছু দিন আগে রোদ অফিস থেকে এসে রাতে রুমে কাজ করছিল হঠাৎ রোদেলা এসে রোদের কোলে বসে পরে। আচমকা এমন হওয়ায় রোদ ঘাবড়ে যায়।
——– কি হচ্ছে টা কি।এভাবে হুট করে কোলে বসে পরলে কেন
——–আমার বরের কোলে আমি যখন ইচ্ছে তখন বসতে পারি এতে কৈফিয়ত দেওয়ার কি আছে।
——–আছে কারণ হুটহাট এমন কাজ করা আমার পছন্দ না আর আমি তো বলেছি তুমি আমার থেকে দূরে থাকো তাহলে কানে যায় না নাকি।
——–তুমি এভাবে বলছো কেন, মনে হচ্ছে অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি।আচ্ছা তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি কি চাইছি।বিয়ের এতোদিন হলো এখনো তুমি আমায় টাচ পর্যন্ত করলে না।এটা ঠিক যে তুমি আমায় সময় দিয়েছিলে আর এখন আমি পুরোপুরি ভাবে নিজেকে তোমার কাছে সপে দিতে চাইছি তাহলে আপত্তি কোথায়।তুমি তো আগে এমন ছিলে না তাহলে কেন করছো এমন।আমি তোমায় ভালোবাসি আর ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া তো ভুল কাজ নয়।
রোদেলার কথা শুনে রোদ রোদেলাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো
———সব কথার উওর সবসময় থাকে না আর তোমার হয়তো সময় না লাগতে পারে কিন্তু আমি এখনো ওতটা ফ্রী হয়নি আর তাছাড়া আমি এখন ব্যবসার কাজে অনেকটা বিজি তাই আমার কাজে ডিস্টার্ব করো না।আর হ্যা আর কখনো আমার অনিচ্ছায় এভাবে আমার গায়ে আসবে না। বিরক্ত লাগে।
,
,
,
,
,
,
,
কথাগুলো বলে রোদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রোদের কথাগুলো রোদেলার বুকে গিয়ে লাগলো।কারণ প্রতিটা মেয়ে চাই নিজের স্বামীর ভালোবাসায় নিজেকে পরিপূর্ণ করতে,তার ছোয়ায় নিজেকে নতুন করে সাজাতে।কিন্তু রোদ বলছে রোদেলার ছোয়া ওর বিরক্ত আসে। এর চেয়ে আর কষ্টের কি থাকে।রোদেলা সেখানে বসে কাদতে থাকে।
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
,
বৃষ্টিদের অফিসে নতুন প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই এখন সবাই সেটা নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পরেছে।মেঘ,শ্রাবন,টিনা,বৃষ্টি, তৃনা সবাই কাজটা পাওয়ার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। তাই সবার বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। আজ কাজ করতে করতে রাত ১০ টা হয়ে যায়। সবাই চলে গেলেও অফিসে ছিল মেঘ বৃষ্টি আর শ্রাবন।কাজ শেষ করে বৃষ্টি আর শ্রাবন বের হয়ে যায়। শ্রাবন বৃষ্টিকে তার সাথে যাওয়ার কথা বলে কিন্তু বৃষ্টি না করে দেয় কারন বৃষ্টি যেখানে থাকে সেটা তো মেঘের বাড়ি আর কোনোভাবে যদি শ্রাবন কিছু বুঝতে পারে বৃষ্টি এ বাড়িতে থাকে তবে কেলেংকারী হবে তাই সে ওকে চলে যেতে বলে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
অনেকক্ষণ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার পর যখন বৃষ্টি গাড়ি পাচ্ছিল না তখন হাটা ধরল। রাত হওয়ায় রাস্তাটা অনেক নিরব হয়ে যায়। বৃষ্টি এগোতে দেখে সামনে কিছু লোক যাদের বেশ দেখে বোঝায় যাচ্ছে কোনো বস্তির মানুষ। বৃষ্টি ওদের দেখে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগলো হঠাৎ লোকগুলো তার সামনে চলে আসে আর একজন লোক বৃষ্টির হাত ধরে ফেলে, বৃষ্টি সাথে সাথে কান্না করে দেয়।কিছু বুঝে ওটার আগেই লোকটা মাটিতে ছিটকে পরে গেল।বৃষ্টি চোখ তুলে তাকাতেই দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের মার খেয়ে বাকি লোকগুলো পালিয়ে যায়। মেঘ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে
——–এমনি তো খুব সাহসি তাহলে এখন সাহস গেলো কোথায়।আর গাড়ি ঠিক করোনি কেন এতোরাতে একা হেটে যাওয়ার কি আছে।
বৃষ্টি তখনও মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগলো।মেঘ কোনো উত্তর না পেয়ে চিৎকার দিলে বৃষ্টি কেঁপে ওঠে।
———আসলে গাড়ি পাচ্ছিলাম না তাই
———অপেক্ষা তো করতে পারতে।এখন যখন দিনকাল ভালো না তার ওপর প্রজেক্টের কাজ করতে রাত হতে পারে তাই আজকের পর থেকে যতোদিন কাজ শেষ না হচ্ছে ততোদিন তুমি আমার সাথে যাওয়া আসা করবে।এবার গাড়িতে উঠো
।
।
।
।
।
।
।
বৃষ্টি আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। মেঘও ওঠে গাড়ি স্টার্ট দিবে আবার কী ভেবে বৃষ্টির দিকে ঝুঁকে যায়, বৃষ্টি কিছু টা ভয় পেয়ে গেলেও দেখতে পায় যে ও সিট বেল্ট পরেনি তাই মেঘ সেটা লাগিয়ে দিচ্ছে। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো।বাসায় পৌঁছে যে যার মতো রুমে চলে গেল।
,
,
,
,
,
,
রোদেলা জানলার পাশে বসে কান্না করছে। তার হাতটা বড্ড যন্ত্রণা করছে।কারণ একটু আগে ভাতের ফেনা ফেলতে গিয়ে তার হাত পুরে গেছে। রান্না ঘরে শব্দ পেয়ে তার শ্বাশুড়ি দৌড়ে গেলে দেখে ভাতের হাড়ি মাটিতে পড়ে আছে তার পাশেই রোদেলা বসে কান্না করছে। তিনি গিয়ে চিৎকার করতে লাগলো।
——–এই মেয়ে এই কোনে কাজেই কি পারো না। যে কাজ করতে যাও একটা না একটা অঘটন করে রাখো।কেন বাবা মা কি কোনো কাজ শেখায়নি।যখন কোনো কাজ জানো না তাহলে কেন আসলে এ বাড়িতে। আগে কাজ শিখে নিতে তারপর বিয়ে করতে।
———সরি মা আসলে আমি কখন এসব কাজ করিনি তাই আর ধোয়ার ভাপে হাতে লাগতেই হাড়িটা হাত ফোসকে পরে গেছে।
———জানি তো নবাবজাদি মেয়ে, বড়লোকের মেয়ে হলে যা হয় আরকি।বলি কি কীভাবে আমার ছেলেকে তুমি নিজের ফাঁদে ফেললে। কোনো তো কর্মের নও তুমি।
কথা গুলো শুনেই রোদেলা দৌড়ে রুমে চলে যায়। আর সেখানে বসে কাদতে থাকে। রোদ অফিস থেকে এসে দেখে রোদেলা কান্না করছে।
——— কি হয়েছে কাদছো কেন
———কিছু না তুমি বসো আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।
রোদেলা চা নিয়ে এসে রোদকে দিতেই রোদের চোখে রোদেলার পোড়া হাতটা চোখে পরে।
——— তোমার হাতে কি হয়েছে।
———আসলে তেমন কিছু না রান্না করতে গিয়ে পুরে গেছি।
———ও সমস্যা নেই ঔষধ লাগিয়ে দাও ভালো হয়ে যাবে।
।
।
।
।
।
।
।
বলে ওয়াশরুমে চলে গেল। আর রোদেলার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।কারণ ও ভেবেছিলো হয়তো রোদ বিষয়টা দেখে তাকে ঔষধ লাগিয়ে দিবে কিন্তু রোদের এমন ভাবলেশহীন কথা দেখে রোদেলার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আর সেখানে বসে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ হাতে কেমন জানি জ্বালা করছে।তাই চোখ পিটপিট করে খুলতেই দেখে রোদ তার হাতে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে। আর তাই তার হাত জ্বলছে।রোদেলা চোখ বন্ধ করে দু ফোটা জল ছেড়ে দিল। রোদ ঔষধ লাগিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর রোদেলা ও গেলো।
———কি হলো ঘুমাও নি
——–না ঘুম ভেঙে গেছে। হাতটা বড্ড জ্বালা করছে তাই।
——— ও কিছু না ঔষধ লাগিয়ে দিছি দু একদিনে ভালো হয়ে যাবে।
———তুমি ঘুমচ্ছ না কেন।
——–এমনি যাও ঘুমিয়ে পরো।
——–আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।তুমি তো আগে এমন ছিলে না। যখন থেকে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে তখন থেকে তুমি আমার অনেক যত্ন অনেক কেয়ার করতে।বিয়ের আগে তুমি যেভাবে আমায় ভালোবেসেছিলে বিয়ের পর তার ছিটেফোঁটা টুকুও আমি পায়নি।বরং দিনের পর দিন তোমার অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি তোমার কথায় আমি তোমার মায়ের কথার ও কোনো জবাব করিনি তাহলে কেন করছো আমার সাথে এমন, কি অন্যায় করেছি তাহলে কি তোমায় ভালোবাসাটা আমার অন্যায়।মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমায় কখনো ভালোবাসনি, কারন আগের রোদ আর এ রোদের মাঝে যে অনেক তফাৎ।
রোদেলার কথা গুলো শুনে রোদ চুপ করে রইলো।কারণ চাইলেও যে তার কাছে এর উওর টা অজানা।কি উওর দিবে সে।রোদেলা আবারও বলতে শুরু করে,
———কি হলো রোদ কিছু বলছো না কেন বলো আমার অপরাধটা কি।সত্যি করে বলোতো তুমি কি আমাকে কখনো ভালোবেসেছিলে নাকি অভিনয় ছিল সবটা।
রোদ এবার চুপ থাকলো না। সে রেগে গিয়ে রোদেলার মুখ বরাবর দাঁড়িয়ে রোদেলার দু বাহু চেপে ধরে,
——-হুমম অভিনয় ছিল সবটা, আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি, কেননা আমার ভালোবাসা ছিল একজন আর সেও হারিয়ে গেছে। তুমি কি বলতে পারো আমার তো কোনো দোষ ছিল না, তাহলে আমাকে কেন শাস্তি পেত হলো।অপরাধ সবাই করে না তবুও শাস্তি কিন্তু নির্দোষকে পেতে হয়।তাই তুমি নিরপরাধী হলেও তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে। মনে করো তোমার কাছের কারো ভুলের মাসুল তোমাকেই দিতে হচ্ছে।
———কার ভুলের জন্য তুমি আমায় শাস্তি দিচ্ছো আর কাকে তুমি ভালোবাসো কই এর আগে তো কিছু বলোনি। আজ যখন বলছো তবে সবটা পরিষ্কার করে বলো আমিও জানতে চাই।
———সময় হলে সব জানতে পারবে।আর এ নিয়ে তোমার সাথে আর কথা বলতে চাইছি না।
বলে হনহন করে রুমে গিয়ে শুয়ে পরল আর রোদেলা এখনো ওভাবে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো রোদ কি বলে গেলো।আর কাকে ভালোবাসে।নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে হবে তা রোদেলার কল্পনার বাহিরে। সেতো এমন কিছু আশা করে নি।তার মানে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে ভালোবেসেছে তা কি ভুল ছিল। তার মানে কি জীবন সঙ্গী বাচাই করতে রোদেলা ভুল করলো।আর এ ভুল কি তার জীবনে বিপদ আনতে চলেছে।,
,
,
,
,
,
,
,
,
চলবে……….