রংধনুর রঙ কালো পর্ব ৩১

#রংধনুর_রঙ_কালো
পর্ব ৩১
লিখা: Sidratul Muntaz

অরিনের অনুরোধে আহত, ক্ষত-বিক্ষত ইলহানকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। তার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। শরীর থেকে অনেক রক্ত যাওয়ায় ইমারজেন্সী ব্লাড লেগেছে। আইসিউতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অরিনের পুরো সময়টা ভয়ংকরভাবে কাটছিল। প্রতি মুহুর্তে সে ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করে অন্বয়ের কাছে এসে প্রশ্ন করেছে, ” অন্বয়সাহেব, সে বাঁচবে তো? মরে যাবে না তো!”
অন্বয় সান্ত্বনা স্বরূপ শুধু একটা কথাই বলল,” মিসেস অরিন, আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লিজ।”
অরিন চিৎকার করে উত্তর দিল,” সে বাঁচবে কি মরবে জ্ঞান না ফিরলে নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। আর আপনি আমাকে বলছেন ধৈর্য্য ধরতে? এই অবস্থায় আমি কিভাবে ধৈর্য্য ধরবো বলতে পারেন?”
অরিন কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। অন্বয় হতবাক হয়ে রইল অরিনের আচরণে। একটা বিশ্বাসঘাতক নরপশুর জন্য অরিনের কিসের এতো টান বুঝে না অন্বয়। সে মরুক বা বাঁচুক তাতে অরিনের কি? এখনও কি সে এই মানুষটাকে ভালোবাসে? এখনও! এতোকিছুর পরেও! সারাদিন অরিন হসপিটালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে কেঁদেছে। পাগলের মতো ছটফট করেছে। অন্বয় শুধু বসে অবলোকন করেছে তার নাজেহাল অবস্থা। বিকালে খবর এলো ইলহানের সুস্থতার। বিপদ কেটে যাওয়ার কথা শুনে অরিন শান্ত হলো বটে। কিন্তু ইলহানের সাথে দেখা করতে গেল না। অন্বয়কে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। অন্বয় এসবের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। তার মেজাজ মাথায় চড়ে আছে। সারাদিন কান্নাকাটি করে অপেক্ষার পর যখন ইলহানের জ্ঞান ফিরল তখন দেখা না করে ফিরে আসার মানে কি? এতোই যখন রাগ তাহলে তার জন্য কাঁদলো কেনো অরিন? তাকে হসপিটালে ভর্তি করালো কেনো? এই মেয়েটা আসলে কি চায়? অন্বয় বুঝতে পারছে না। ক্ষীপ্ত মেজাজ নিয়ে নিজের রুমে বসে ছিল৷ তখন অরিন দরজায় কড়া নেড়ে বলল,
” আসবো অন্বয়সাহেব?”
” হুম আসুন।”
অন্বয়ের কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা গেল সে মনে মনে প্রচন্ড ক্ষীপ্ত। অরিন ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বলল,
” ইলহানকে আমি হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি, ওর জন্য কেঁদেছি, অস্থির হয়েছি তার মানে এই না যে ওর প্রতি আমার এখনও কোনো দূর্বলতা আছে। আমি কেনো এসব করেছি…”
অরিনকে থামিয়েই অন্বয় বলল,” থাক মিসেস অরিন। এ বিষয়ে এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”
” আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন মি. অন্বয়?”
অন্বয় কোনো জবাব দিল না। তার নিস্তব্ধতা দেখে অরিন উত্তর বুঝে নিল। কিছুটা কাঠখোট্টা স্বরে বলল,
” আপনি এ কারণে আমার উপর রাগতে পারেন না। একজন ব্যারিস্টার হিসেবে আপনার উচিৎ ইনভেস্টিগেশন করে ইলহানকে যারা মেরেছে তাদের খুঁজে বের করা।”
অন্বয় সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। জোরে টেবিলে একটা লাথি মেরে প্রায় চিৎকার করে এতোদিনের জমে থাকা সমস্ত রাগ ঝাড়তে লাগল। বলতে লাগল,
” হ্যাঁ, আমিই তো সব করবো! সব দায় তো আমারই! আপনি যখন যেটা বলবেন ক্রীতদাসের মতো আমাকে সেটাই করতে হবে তাই না? আমি আপনার হাসব্যান্ডের হাতে শুধু মার খাবো, অপমান সহ্য করবো। আবার আমিই তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনবো৷ তাকে হসপিটালে ভর্তি করবো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু যে, আপনার জন্য তাকেই আমার বারবার সাহায্য করতে হবে। যে আপনার সাথে বারবার প্রতারণা করছে, আপনাকে ঠকাচ্ছে, এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকেই বাঁচানোর জন্য আপনি আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করছেন বাহ! অসাধারণ বিচার আপনার। আর এদিকে যে আমি মরে যাচ্ছি? আমার প্রতি কোনো খেয়াল করছে আপনার?”
অরিন প্রায় থতমত খেয়ে অন্বয়ের কথা শুনছে। অন্বয় অরিনের কাছে এসে তার বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” স্বার্থপরতার একটা সীমা থাকা উচিৎ মিসেস অরিন। আপনি সেই সীমাটুকুও অতিক্রম করেছেন।”
অরিন কতক্ষণ চেয়ে থেকে শীতল কণ্ঠে বলল,” আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
অন্বয় ধাক্কা মেরে অরিনকে ছেড়ে বলল,” বুঝতে পারবেনও না। কারণ আপনি বুঝতে চান না।”
” কি বুঝতে চাই না আমি?”
” আপনি বুঝেন না আমি কি চাই?”
অরিন সাহসী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি চান?”
অন্বয় আক্রমণাত্মক গতিতে আলমারীর দিকে এগিয়ে গেল। শব্দ করে আলমারী খুলল। আলমারীর সমস্ত জিনিসপত্র ঢিল মেরে ফেলতে লাগল৷ অবশেষে একটা ডায়েরী বের করল। ডায়েরীটা অরিনের পায়ের কাছে ছুড়ে মেরে বলল,
” এই ডায়েরী তো আপনি অনেক আগেই পড়েছিলেন। আমার অনুভূতির কথা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি মিসেস অরিন। আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না? আই নিড ইউ।”
অন্বয় উদ্ভ্রান্তের মতো আলমারীর দেয়ালে চপোটাঘাত করল। অরিন কেঁপে উঠলো শব্দে। ধীরে ধীরে মেঝে থেকে ডায়েরীটা তুলল। তার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। কাঁপছে কণ্ঠনালী। চোখ দিয়ে অচিরেই জল বেরিয়ে গেছে। সে ভাবেনি অন্বয় এখনও তাকে ওই নজরে দেখে। অন্বয়ের কাজের জন্য ফিস দিয়েই তো অরিন তাকে অস্ট্রেলিয়া এনেছে। তাই তাদের সম্পর্কটা ব্যারিস্টার আর ক্লায়েন্টের মধ্যে যেমন সম্পর্ক হয়, তেমনই হওয়া উচিৎ। তাছাড়া অরিন এই ডায়েরীর কাহিনি জানার পরদিনই অন্বয় তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। অন্বয় বলেছিল অরিনকে শ্যানিন ভেবে সে ডায়েরীতে এইসব লিখেছে। তাহলে ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। আজ এতোদিন পর অন্বয় আবার কেনো এই প্রসঙ্গ তুলে আনছে? সে অরিনকে পাওয়ার স্বপ্ন কিভাবে দেখছে? অরিনের মনে হয়, এখন সময় এসে গেছে অন্বয়কে সবকিছু জানানোর। অরিন নিজেকে প্রস্তুত করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অন্বয় আলমারীর দেয়াল চেপে ধরে রাগ সামলাতে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার গলার রগ, হাতের রগ ফুলে উঠেছে। অরিন বলল,
” আমি তো প্রেগন্যান্ট, অন্বয় সাহেব।”
অন্বয় চকিতে মাথা তুলে তাকাল। তুমুল বিস্ময়ে বলল,” হোয়াট?”
অরিন ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” বেশিদিন হয়নি, মাত্র দুইমাস। ভেবেছিলাম কাউকে জানাবো না। কিন্তু আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি। আমি ইলহানের থেকে ডিভোর্স নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাবো। আমার বাচ্চাকে আমি একা মানুষ করবো।সিঙ্গেল মাদার হবো। তাও আমাদের লাইফে অন্যকেউকে থাকতে দিবো না। আমি কাউকে জীবনে আনতে চাই না। কাউকে না! তাই আপনি যেটা চাইছেন, সেটা কখনও সম্ভব না অন্বয়সাহেব।”
” তার মানে তো এটাই দাঁড়ায়, আপনি এখনও মি. ইলহানকেই ভালোবাসেন। এতোকিছুর পরেও?”
” না! ওর মতো বিশ্বাসঘাতককে আমি ভালোবাসি না৷ কোনোদিনও না। কিন্তু আমি চাই ও বেঁচে থাকুক। এই বাচ্চার উপর ওরও অধিকার আছে। আর এই বাচ্চারও অধিকার আছে তার বাবাকে পাওয়ার। আমি ইলহানের কাছে কোনোদিন ফিরবো না ঠিক। কিন্তু ওকে তো বাবার কাছে ফিরতেই হবে। ইলহান ভালো স্বামী না হতে না পারুক, ভালো বাবা নিশ্চয়ই হবে। আমি চাই, ইলহান ওর বাচ্চার জন্য হলেও বেঁচে থাকুক। একদিন আমার বাচ্চার সাথে তার বাবার দেখা হোক। সেদিন হয়তো আমি পৃথিবীতে থাকবো না। কিন্তু আমার বাচ্চা যেনো কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত না হয়। সে যেনো তার বাবাকে খুঁজে পায়।”
অরিন আর কথা বলতে পারল না। তার খুব কান্না আসছে। মুখে হাত রেখে সে শুধু কাঁদছে। কান্নার তোড়ে তার সারা শরীর কাঁপছে। অন্বয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন কি বলবে সে? তার যে কিছুই বলার নেই।

চলবে

(আগামী পর্বেই শেষ হবে ইনশাল্লাহ। কিন্তু আগামী পর্ব কবে দিবো জানিনা।🙆‍♀️ এখন কেউ কেউ এন্ডিং প্রেডিক্ট করে ফেলবে।🤦‍♀️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here