লাবণ্যর সংসার পর্ব -০৭

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_7
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

লাবণ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। চারিদিকের লোকজন থেকে ভীড় এড়িয়ে ফাঁকা জায়গায় চলে আসে। মনের মধ্যে ভয় , কান্না দুটোই আসছে। কিছু দূর এগিয়ে একটা পুরোপুরি ফাঁকা জায়গায় চলে আসে লাবণ্য। হাতের মধ্যে শাড়ির আঁচলের খুঁট টা পেঁচিয়ে নিয়ে সুইমিং পুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। কি করবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে। ফোনটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট খুলে নিজের বাবার নাম্বারটায় কল দিতে গিয়েও থেমে যায় লাবণ্য। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। নিজের স্বামীর নম্বর নিতে তার বাবার কাছে সাহায্য চাইবে! সেই বাবা যে কিনা তার কঠিন সময়ে পাশে থাকেনি! লাবণ্য দু চোখ জুড়ে নোনাপানি দের আগমন হয়। আর কোনো কিছুর রাস্তা না পেয়ে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে আসার জন্য লাবণ্য চলে আসতে যায় , ঠিক তখনই সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। আচমকা ও কে কেউ কোলে তুলে নেয়। বিশ সেকেন্ড পর নামিয়ে দেয় লাবণ্যকে। লাবণ্য ভয় পেয়ে যায় চিৎকার করতে গেলে একটা আলোর ফোকাস পড়ে। একটা দুটো পরপর চারিদিক আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশটা তাকিয়ে দেখে এটা একটা অন্য জায়গা। যেখানে কোনও সুইমিং পুল নেই। তবে ওই দূরে কিছু একটা আছে যেটায় চোখ রাখতেই। ওর চোখে কেউ হাত চেপে ধরে। কেউ কানের কাছে মুখ এনে স্লো ভয়েসে বলে উঠে,,

Tu hai jo rubaru mere
Bada mehfooz rehta hoon…
Tere milne ka shukrana
Khuda se roj karta hoon…

লাবণ্য চমকে উঠে হাতটা সরিয়ে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে উঠে। নিবিড়..
লাবণ্য কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিবিড় ওর কাঁধে নিজের হাত দুটো রেখে ও কে জড়িয়ে নেয়। লাবণ্য ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে।

—“ আপনি কোথায় ছিলেন? জানেন আমি কতো ভয় পেয়েছিলাম? এমন পরিস্থিতিতে আমি কখনো পড়িনি? ”

—“ ওলে… আমার বাবুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো? আমি জানতাম না তো! আচ্ছা বাবু অ্যাম সরি.. কান ধরি। ”

নিবিড়ের এমন আচরণে আর ওর মুখে বাবু ডাক শুনে লাবণ্যর চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে যায়। নিবিড় লাবণ্যকে দেখে কোনো কিছু না বলেই ও র নাকের ডগায় হালকা কামড় বসায়। লাবণ্য তৎক্ষণাৎ নিবিড়কে হালকা হাতে সরিয়ে দিয়ে লাফ মেরে নিবিড়ের থেকে এক হাত দূরে দাঁড়ায়।

—“ কি করছেন পাগল হলেন না কি? ”

নিবিড় লাবণ্যকে নিজের কাছে টেনে এনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।

—“ আমি তো চার ঘন্টা ধরে এই রিসোর্টের মধ্যেই আছি।”

—“ মানে! তাহলে আমি যে দুই ঘন্টা ধরে এখানে একা ছিলাম কই আপনি আমার কাছে আসলেন না তো? ”

—“ বিকজ্ আমি তোমার জন্য স্পেশাল একটা গিফট অ্যারেঞ্জ করছিলাম!”

—“ তাই বলে দুই ঘন্টা আমাকে অপেক্ষা করালেন? ”

নিবিড় অভিমানের সুরে গাল ফুলিয়ে বলে উঠে,,

—“ তুমি আমায় এখনো ক্ষমা করতে পারোনি তাই না লাবণ্যময়ী! তাই জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়েছি বলে আমার ওপর রাগ করছো? ”

—“ না না আমি আপনার ওপর রাগ করছি না। আর তাছাড়া আপনি তো আমার স্বামী আপনার জন্য দুই ঘণ্টা কেনো! সাত জনম অপেক্ষা করতে পারি! ”

লাবণ্যর কথা শুনে নিবিড় ও কে ঝট করে আরো কাছে এনে কপালে গাঢ় চুম্বন দিয়ে বসে। লাবণ্য নিবিড়ের শার্ট খামছে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

—“ ওখানে না দাঁড়িয়ে থেকে এবার এখানে তো আসুন! তা না হলে আমার চার ঘন্টার পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যাবে। ”

লাবণ্য নিবিড়ের কথা শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে লজ্জায় মুখ নীচু করে ফেলে। বোকার মতো এতোক্ষণ ও চোখ বন্ধ করেছিলো। নিবিড় তো ও কে কখন ছেড়ে দিয়েছে।

—“ কি হল ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে না কি! আরে আসো তো! ”

লাবণ্য গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। নিবিড় এসে ও কে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে এসে নামিয়ে দেয়।

চারদিকে সুন্দর লাইট, লাভ সাইন আকারের সাজানো বেলুন। নিবিড়ের হাত ধরে দু – তিন পা হেঁটে এসে চার – পাঁচ ধাপ সিঁড়ির সাহায্যে উঠে এসে সামনে তাকিয়ে অবাক হয় লাবণ্য। অনেক গুলো রঙীন ক্যান্ডেলের সাথে একটা লাভ সাইন আকারের কেক। লাবণ্য নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিবিড় হাসছে।

—“ আজ তো আমার জন্মদিন নয়। তবে কি আপনার জন্মদিন!”

নিবিড় লাবণ্যর দুটো কাঁধে হাত দিয়ে কেকের সামনে নিয়ে দাঁড়াতেই হাজার ফুলের পাপড়ি ওদের মাথায় এসে পড়ে। লাবণ্য দুই হাত ধরে পাপড়ি গুলো ধরে নেয়।

—“ আজ কারুর জন্মদিন নয় আজ আমাদের জন্মদিন! আমাদের নতুন সম্পর্কের সূচনার জন্মদিন! ”

লাবণ্য নিবিড়ের দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে আছে। নিবিড় হাসি মুখে লাবণ্যকে দেখছে। বেশ কয়েকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর নিবিড় লাবণ্যর কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে এনে , ওর চোখের সামনে হাতের তুড়ি বাজায়। লাবণ্যর চমক ভাবে।

—“ কোথায় হারিয়ে গেছিলে আমার লাবণ্যময়ী! ”

—“ ভাবছি যা আমার চোখের সামনে ঘটছে সব সত্যি কি না! আমি স্বপ্ন দেখছি কি না! যা ঘুম ভাঙলেই হারিয়ে যাবে। ”

—“ তুমি স্বপ্ন দেখছো কি না তার প্রমাণ এই কেকটা কাটলেই বুঝে যাবে। আর তোমার চোখের সামনে যে সবকিছু সত্যিই ঘটেছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তুমি এক্ষুনি পাবে। ”

নিবিড় কথাগুলো বলতে বলতে লাবণ্যর হাতে ছুরি ধরিয়ে দেয়। লাবণ্যর কানের কাছে মুখ এনে গুনগুনিয়ে বলে উঠে,,

Yeh dil pagal bana baitha

Isey ab tu hi samjha de…

Dikhe tujhme meri duniya

Meri duniya tu banja re…

লাবণ্য নিবিড়ের করা ইশারায় ক্যান্ডেল গুলো নিভিয়ে, নিবিড়ের হাত ধরে কেক কাটে। নিবিড়কে কেকের এক টুকরো খাইয়ে দেয়।

নিবিড় ওর হাতে একটা বড়ো বক্স ধরিয়ে দেয়। লাবণ্য কি আছে জানতে চাইলে নিবিড় ও কে খুলতে বলে। একটার পর একটা বক্স খোলার সপ্তম বক্সটা ছোট্ট ব্লু রংএর হয়। লাবণ্য কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তাই বক্সটা নিজে আর না খুলে নিবিড়ের হাতে ধরিয়ে দেয়।

—“ আমি আর পারবো না আপনি খুলুন , বক্স খুলতে খুলতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি! ”

নিবিড় মুচকি হেসে হাঁটু মুড়ে ওর সামনে বসে। লাবণ্যর বাম হাতটা টেনে নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়।

Hoon khushkismat jo kismat se

Tumhe aise main paaya hoon…

Main tumse ishq karne ki

Ijaazat Rab se laaya hoon…

লাবণ্যর হাতে নিবিড় গাঢ় চুম্বন করে। লাবণ্যর লজ্জায় গাল লাল হয়ে যায়, মুখ নীচু করে ফেলে।

—“ তুমি যে স্বপ্ন দেখছো না এটাই তার সবথেকে বড়ো প্রমাণ।”

লাবণ্য হাতে থাকা আংটি টা নিয়ে ভালো করে দেখে। আংটি টা ধরে অনুভব করে সত্যিই ও কোনও ঘোরের মধ্যে নেই। লাবণ্যর চোখের কোণে পানি চিকচিক করে।

—“ ডায়মন্ড রিং! ”

—“ হুম আমার হীরের মতো বউ এর জন্য হীরের আংটি! ”

লাবণ্য ফুঁপিয়ে বলে উঠে,,

—“ আমি কি সত্যিই আপনার জন্য হীরে! হীরের মতোন! আমি তো অপয়া, এই প্রথম কোটি টাকার ডিল হাতছাড়া হয়েছে। আমার মতো অপয়া মেয়ে আপনার জীবনে আসার জন্য। ”

—“ ওহ কাম অন লাবণ্য। অ্যাটলিস্ট আজকের মতো স্পেশাল একটা দিনে এইসব কথা ছেড়ে দাও না। পরে না হয় হিসাব-নিকাশ করা যাবে। ”

—“ হিসাব – নিকাশ মানে! কিসের হিসাব-নিকাশ করবেন আপনি? ”

নিবিড় আর কিছু বলে না। পুনরায় লাবণ্যকে কোলে তুলে নেয়। আচমকা কোলে তুলে নেওয়া লাবণ্য ভয়
পেয়ে যায়। তাই নিবিড়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নেয়। নিবিড় ও কে সুইমিং পুলের পাশে নিয়ে চলে আসে। ওখানটা ফাঁকা থাকলেও এখন আর ফাঁকা নেই। ওখানে টেবিল – চেয়ার রাখা হয়েছে, ডেকরটিং খুব সুন্দর করা হয়েছে। লাবণ্যর চোখ ধাঁধায়ি যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এতো কিছু কি করে হতে পারে! নিবিড় ও কে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

ওর সামনে সবকিছুই ওর ফেভারিট খাবার রাখা আছে! নিবিড় মুচকি হেসে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর হয়ে যায়। হঠাৎ নিবিড়ের চোখে চোখ পরতেই লাবণ্য মুখ নীচু করে নেয়। কারণ নিবিড়ের চোখে কিঞ্চিত রাগ স্পষ্ট।

—“ তোমার কি এইসব পছন্দ নয় লাবণ্য? ”

খানিকটা রূঢ় কন্ঠে নিবিড় লাবণ্যকে প্রশ্ন করে। লাবণ্য কাঁপা গলায় বলে উঠে,,

—“ আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছেন কেন? ”

—“ তুমি আমার কথার উত্তর আগে দাও? তখন থেকে আমি এতোকিছু করছি তোমার জন্য। বিনিময়ে আমি তোমার মুখ থেকে এক ফোঁটা হাসিও পাচ্ছি না , চোখের পানি ছাড়া। অ্যাই সমস্যা কি বলতো তোমার? কি সমস্যা? ”

নিবিড়ের ধমকে বলা কথায় কেঁপে উঠে লাবণ্য। পুরনো ভয়টা পুনরায় মনের মধ্যে চেপে বসে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

—“ আমার কপালে সত্যিই কি এতো সুখ লেখা আছে? আসলেই কি এগুলো আমার সাথে ঘটছে! কি়ংবা ঘটা উচিৎ! এতো সুখ আমার কপালে সইবে কি! ”

—“ উফফ আবার সেই বোরিং কথাবার্তা। এতো ইমাজিন করো কেন তুমি? বাস্তবের মাটিতেই পা দিয়ে চলো না। ”

—“ বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে চলি বলেই তো ভাবলাম। ”

লাবণ্য ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলে ফেললো। নিবিড় সজোরে টেবিলে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়ালো।

—“ তোমার ভাবা হয়ে গেলে বাড়ি চলে এসো। বাইরে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার ওয়েট করে থাকবে। ”

নিবিড় হনহনিয়ে উঠে চলে যায়। লাবণ্য নিবিড়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে।

চলবে… .

(লেখায় কোনও ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন 🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here