শালিক পাখির অভিমান পর্ব -০২

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_০২
#অধির_রায়

“শালিক বিয়ের আগ পর্যন্ত এখানে থাকবে না৷ তার জন্য আমি আমার ছোট মেয়ের সর্বনাশ ঢেকে আনতে পারব না৷ শালিককে দেখা যাবে না এই বাড়িতে৷ আমি শালিককে তার তার ফুপির বাড়িতে পাঠিয়ে দিব৷”

আমি বাবার দিকে অশ্রু সিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ বাবার মুখে কোন কষ্টের ছাপ নেই। দিব্যি বড় খালার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছেন৷ মনের মাঝে কোন অনুতপ্ত নেই৷ পাশে মা মুখে কাপড় গুছে নিরবে নিভৃতে চোখের জল মুছে যাচ্ছেন৷ গর্ভধারিণী মা কখনও তার সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না৷ দাদী কপাটে বসে সব শুনতে পায়। দাদীর আমার হাত ধরে বাবার সামনে নিয়ে দাঁড়ান৷ কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল,

“আমার দিভাই এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ মানুষের রুপ দেখে তোরা বিচার করিস কেন? আমার দিভাই সব দিক থেকে গুণবতী।”

বাবা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাদের মাঝে৷ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি আমার উপর পড়তেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম৷ রাগে নেত্রদ্বয় রক্তবর্ণের ন্যায় টকবক করছে৷ ভারী গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি কখনও অপয়া মেয়ের হয়ে কথা বলবে না৷ শালিকের হয়ে কথা বললে আমি ভুলে যাব তুমি আমার মা।”

দাদী কিছু বলার আগেই আমি বললাম,

“আমি কখনও আমার বোনের ক্ষতি চাইনা৷ আমি আমার ভাই ও শাকিলার জন্য সবকিছু করতে পারি৷ আমাকে নিয়ে তোমার কোন ভয় নেই৷ আমি আজ বিকেল বেলা ফুপির সাথে উনার বাড়িতে চলে যাব৷ শাকিলার বিয়ের কাজ সম্পুর্ন হলে বাড়িতে আসবো৷ এর আগে আমি বাড়িতে আসব না৷”

দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি৷ নিজেকে আর সবার সামনে উপস্থাপন করতে ইচ্ছা করছে না৷ এক দৌড়ে দাদীর ঘরে এসে কপাট লাগিয়ে দিলাম৷ চেয়ার টেনে পড়ার টেবিলে বসলাম৷ কৃষ্ণবতী উপন্যাসের কয়েক পাতায় চোখ বুলালাম৷ উপন্যাসের সাথে আমার জীবনের গল্প মিলে যাচ্ছে৷ আগে ভাবতাম সব গল্পের মাঝেই হয়৷ বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই৷
উদরে একটা দানাও পড়ল না৷ মা এসে ডেকে গেছে৷ মায়ের কথার কোন উত্তর দেয়নি৷ আমি জানি আমার জন্য মা না খেয়ে রান্না ঘরের এক কোণে বসে চোখের অশ্রু ফেলছেন৷

সন্ধ্যার দিকে বড় ভাই নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে এসেছে। নতুন বউকে দেখার তীব্র ইচ্ছা মনের মাঝে। শুক্রবারের আগে বাড়ি ফেরা হবে না৷ চারিপাশ তাকিয়েও কোন উপায় খুজে পেলাম না৷ অবশেষে চোখে পড়ল দাদীর বোরকা। দাদীর বোরকা পড়ে ভাবিকে দেখতে গেলে কেউ জানতে পারবে না৷ দাদীর বোরকা পড়ে কপাট খুলে বাহিরে আসলাম৷ ধীর পায়ে মানুষ ঠেলে ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম৷ পাশে শাকিলা বসে আছে মন খারাপ করে৷ ভাবির সাথে ভাব করার কোন উৎসাহ তার মাঝে খুঁজে পেলাম না৷ আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চকিত হয়৷ কারণ মহল্লার মাঝে আমার দাদীই একমাত্র বৃদ্ধ। বাকী বৃদ্ধদের আল্লাহর পছন্দ হয়েছে বলে তারা পরকালে চলে গেছেন৷ আমার দিকে শাকিলা এগিয়ে এসে বলল,

“দাদী আমার সাথো আসেন৷”

আমাকে নিয়ে ভাবির পাশে বসিয়ে দিল৷ শাকিলা চলে আসতে নিলেই শাকিলার হাত চেপে ধরলাম। আমার হাত পা কাঁপছে৷ কেউ আমায় চিনতে পারলে সমস্যা হবে৷ কথাটা যদি বড় খালা বা বাবার কানে রটে তাহলে আজ আমার শেষ দিন হবে৷ শাকিলা ভদ্রতার সাথে বলল,

“আপনার কিছু লাগবে?”

শাকিলাকে টান দিয়ে নিজের পাশে বসালাম৷ ফিসফিস করে বললাম,

“আমি শালিক৷ ভাবিকে দেখতে না পেয়ে বুকের মাঝে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছিলাম৷ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা৷ আমি এখানে এসেছি কেউ জানতে পারলে বড় ধরনের অ*ঘ*ট*ন ঘটবে৷”

আমি বাহিরে আসতে নিলেই ভাবি আমার হাত ধরে ফেলেন৷ সাথে সাথে বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো৷ ভাবি মিষ্টি মধুর ফিসফিস কন্ঠে বলল,

“শালিক সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷ আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি৷”

হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ শাকিলাও ভাবির দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলছে৷ ভাবিকে আমার কথা কে বলেছে? ভাই আমার কথা ভাবিকে বলে দিয়েছে৷ নাকি পাড়ার কাকিমারা বলছে৷ মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম৷ ভাবি আমার হাতের উপর হাত রাখলেন৷ বোরকার মাথা তুলে মুখ দেখতে নিলেই হাত ধরে ফেললাম৷ ভাবি সমস্যা বুঝতে পেরে সকলের উদ্দেশ্য বললেন,

“আপনারা একটু বাহিরে যাবেন৷ না মানে একটু পরই তো সন্ধ্যার আজান দিবে৷ আমি এসব পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পড়ব৷ এসব পোশাক পড়ে নামাজ পড়তে পারব না৷”

ভাবির কথামতো সবাই বাহিরে চলে গেল। শাকিলা কপাট বন্ধ করে দিল৷ ভাবি আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন৷ ভাবির ভালোবাসায় যেন হারিয়ে গেলাম৷ চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভাবি মুচকি হেঁসে বলল,

“আমাকে তোমার কথা তোমার ভাই বলেছে৷ তোমাকে যে যাই বলুক তুমি মন খারাপ করবে না৷ স্যামের গান কবিতায় বলা হয়েছে মানুষের উপর কিছু নেই৷ সেখানে বর্ণ নিয়ে কিছু বলেনি৷ তুমি নিজেকে প্রমাণ করবে তুমি কারো থেকে পিছিয়ে নেয়৷”

আমি ভাবিকে দুই নয়ন ভরে দেখে নিলাম৷ ভাবি দেখতে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। মুখের কোণে সব সময় হাসির রেখা৷ বড় খালার ডাক শুনা যাচ্ছে৷ চিৎকার করে বলছেন,

“সাদমান শালিক ঘর থেকে পালিয়ে গেছে৷ আমি বলেছিলাম না এই মেয়ের স্বভাব ভালো না।৷ কোন জানি ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে৷”

বোরকা খুলে তাড়াতাড়ি করে উড়ানে আসলাম৷ একদম খালার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালাম৷ এখন আর নিজেকে আড়াল করতে চাইনা৷ আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,

“আমাকে খারাপ কথা বলার আপনি কে? আমাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাব আপনি আমার মায়ের বোন৷ আমাদের বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷”

ছিটকে দূরে সরে গেলাম৷ বাবা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন আমার দিকে৷ চোখের আগুনে আমাকে পুড়ে ছাই করে দিবেন৷ গালে হাত দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম৷ বাবা ঘৃণা নিয়ে বললেন,

“আমার মাথা কতো নিচু করবি৷ কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না৷ তুই এখনও এই বাড়িতে কোন? তোকে দেখে নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছা করছে৷ আল্লাহ আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন৷”

বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই৷ দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম৷ বিছানার উপর ব্যাগ গুছানো৷ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোই তাদের মূল ইচ্ছা৷ ফুপি আসতেই ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি মাথায় বিলি দিতে দিতে বলল,

“চল তুই আর এই বাড়িতে থাকবি না৷ তুই আজ থেকে আমার বাড়িতে থাকবি৷ আমি আজ থেকে ভুলে যাব আমার একটা ভাই ছিল৷ আমার কাছে আজ থেকে আমার ভাই মৃত৷”

এক বুক কষ্ট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম। চোখ থেকে অশ্রু পড়া বন্ধ হচ্ছে না৷ শেষে চোখের অশ্রুও আমার সাথে বে*ই*মা*নি করল। বাড়ির জন্য বুক ফেটে কান্না আসছে৷

—- ফুপা বাজারে গেছেন৷ আমি আর ফুপি সকালের রান্না করছি৷ এমন সময় ভাই আসলো ফুপির বাড়িতে৷ উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করল,

“শালিক..শালিক”

ফুপি উাড়ানে এসে হাসি মুখে বলল,

“আরাফ তুই কখন আসলি৷ এতো সকালে তুই এখানে৷ সবাই ঠিক আছে তো৷”

আমিও ধীরে পায়ে উড়ানে উপস্থিত হলাম৷ আমার হাত ধরে বলল,

“বাড়িতে চল৷ তুই ফুপির বাড়িতে থাকবি কেন? আমাদের কি ঘর দোয়ার নেই৷”

“আরাফ তুই শাকিলের সাথে এমন করছিস কেন? ভাতিজি তার ফুপির বাসায় আসতে পারেনা৷”

“শালিক হাজার বার আসবে৷ ফুপির বাসায় আসবে না কেন? শাকিলার বিয়ে শেষ হোক তারপর আসবে৷”

বড় ভাই কোন কথা না বলে এক প্রকার টানতে টানতে আমাকে গেইটের বাহিরে নিয়ে আসলো৷ সামনের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই আমরা দুইজনেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে পড়লাম৷ বাজার থেকে খাটিয়া করে ফুপাকে নিয়ে আসছে কয়েকজন৷ চিনতে অসুবিধা হল না৷ বাজারে যাওয়ার আগে আমি যে শার্টটা দিছি সেটাই ফুপার গায়ে জড়ানো। ফুপির সামনে ফুপার মৃত দেহ নামানো হলো৷ ফুপি চিৎকার করে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন৷

চলবে….

ব্যস্ততার মাঝো এতটুকুই টাইপ করতে পেরেছি৷ বানান ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here