শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -০৮+৯

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_08
#Writer_NOVA

কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি পুরো ভদ্র হয়ে গেলাম।কতক্ষণ ধরে মাথা নিচু করে রওনকের দলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এই মুহুর্তে আমাকে দেখলে যে কেউ বলবে,এই মেয়ে ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না। পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্বী।ওর দিকে কয়েকবার চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছি।কিন্তু বেচারী ভয়েও আমার দিকে তাকায়নি।এই ছেমরি আমার বিষয়ে সবকিছু রওনককে জানিয়ে দিয়েছে। নয়তো আমিও তো বলি ওরা আমার নাম জানলো কি করে!! রওনক এক হাতে ধীরে-সুস্থে সিগারেট টানছে আরেক হাতে মোবাইল চালাচ্ছে। খুব সম্ভবত ফেসবুকিং করছে।কারণ ওর হাতের বুড়ো আঙুলটা উপর-নীচ উঠানামা করছে।দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হওয়ার পথে।অথচ মহাশয়ের কি একটা ভাব! মনে হচ্ছে ইরাকের প্রেসিডেন্ট তাকে দেশ সামলাতে দিয়েছে।

অবশেষে রওনক মুখ খুললো।সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো উপর দিকে ছেড়ে দিলো।তারপর মাথা না তুলেই তখন আমাকে যে ছেলেটা ধমকি-ধামকি দিয়ে নিয়ে এলো সেই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,

—কি ব্যাপার, সমস্যা কি শাওন?

—ভাই, আপনি নোভা নামের মেয়েটাকে ডেকে আনতে বলেছিলেন।

—হুম বলেছিলাম।

—নিয়ে এসেছি।

—হুম দেখতে পেয়েছি।(তন্বীকে উদ্দেশ্য করে) এই মেয়ে নাম কি তোমার?

—তনীমা রহমান তন্বী।(ভয়ে ভয়ে)

—কোন ইয়ার?

—ম্যানেজমেন্টের ফার্স্ট ইয়ার।

—ওহ আচ্ছা। তুমি এখন ক্লাশে যাও।নিজের ক্লাশ করো।আর তোমার এই বোনের ক্লাশ আমরা নেই।

তন্বী ঠায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালো।আমি একটা খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।আজ ওকে বাগে পেলে কিমা বানাবো।আগে এখান থেকে ছাড়া পেয়ে নেই। তারপর বাকিটা।তন্বীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক ধমকে উঠলো,

—কি হলো যাচ্ছো না কেন?আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলছি?

—যাযাযাচচ্ছি ভাইয়া।

আমতাআমতা করা কথা শেষ করেই তন্বী দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো।যাওয়ার আগে এক হাতে কান ধরে আমার দিকে তাকিয়ে সরি বললো।আমি চোখ পাকিয়ে ইশারায় বললাম,”তোর সরির গুল্লি মারি।”
কে জানে তন্বী আমার কথা বুঝতে পেরেছে কিনা।রওনক মোবাইলটা পকেটে রেখে সোজা হয়ে পেছনের গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তারপর চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমাকে বললো,

—এই যে মিস ঝগড়ুটে এদিকে এসো।

আমাকে ঝগড়ুটে বলতেই আমি ফোঁস করে উঠলাম।তা দেখে রওনক চোখ পাকিয়ে তাকালো।তাতে আমি মিইয়ে গেলাম।আশেপাশে মানুষের আনাগোনা কম।এমনি কলেজে আজ বেশি মানুষ আসেনি।ওরা যদি আমাকে দুই-চারটা চড় মেরে অজ্ঞান করে ফেলে তাহলে আমাকে বাঁচানোর কেউ নেই। আমি ধীর পায়ে তার বরাবরি দাঁড়ালাম। শাওন নামের ছেলেটি রওনকের কাছে আমার বিচারের ঝুলি খুলে বসলো।

—জানেন বড় ভাই কি হয়েছে? এই মেয়েকে যখন আমি বললাম ভাই তোমাকে ডাকছে তখন আমাকে বলে পরে যাবে।ওর সাহস দেখছেন।আপনার কথা অমান্য করে।আমার মুখে মুখে তর্কও করছে।

রওনক শাওনকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিলো।শান্ত কন্ঠে বললো,

—আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি শাওন?

—না মানে আমি এমনি বললাম।

—এই মেয়ে সেদিন আমার সাথেও এমন করছে।আমি নাম জিজ্ঞেস করছি তার জন্য কত কথা শুনিয়ে দিয়েছে। (আমাকে উদ্দেশ্য করে) তা মিস ঝগড়ুটে, তোমার নাকি কোন নাম নেই। বাবা-মা আকিকা করার ভয়ে নাম রাখেনি।তাহলে নোভা কার নাম?

আমি কোন উত্তর দিলাম না।চুপ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজতে লাগলাম।তাতে রওনক কিছুটা ধমকের সুরেই আমাকে বললো,

—এদিক সেদিক তাকিয়ে কি দেখো?আমার দিকে তাকাও। সেদিন তো মুখ দিয়ে খই ফুটছিলো।আজ মুখের বুলি কোথায়?সিনিয়রদের সাথে কি করে কথা বলতে হয় তা কি তুমি জানো না?

আমার ইচ্ছে করছে বেশ করে কতগুলো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে।কিন্তু এতে হীতের বিপরীত হবে।তাই চুপ করে থাকায় শ্রেয়।আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শাওন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। গলা ঝাঁঝিয়ে রওনককে বললো,

—দেখছেন ভাই, দেখছেন।আপনার সামনেও কিরকম বেয়াদবি করতাছে।আপনি শুধু একবার হুকুম দেন।এই মাইয়ারে এমন শায়েস্তা করমু ২য় বার আপনার সাথে তর্ক করার সাহস করবো না।

এবার আমার রাগ সপ্ত আসমানে।এই রওনকের চামচা শাওন এবার বেশি বেশি করছে।একে তো এক ডোজ না দিলেই নয়।ভেবেছিলাম ছেড়ে দিবো।কিন্তু একে আজ ছেড়ে দিলে আরো বেড়ে যাবে।ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দুজনের মাঝে এক হাতেরও কম দুরত্ব। তৎক্ষনাৎ আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি এসে হানা দিলে।কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে শাওনের পায়ের মধ্যে দিলাম জোড়ে এক পারা।উঁচু গোড়ালির জুতা থাকায় পায়ে বেশ ভালোই লাগলো।শাওন চিৎকার করে উঠলো।ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বোকা বনে গেলো।কি হয়েছে বুঝতে সবার দুই মিনিট লাগলো।আর এই দুই মিনিটে আমি দিয়েছি ছুট।এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিপদে পরবো নাকি!!

💖💖💖

ইচ্ছে ছিলো না সব ক্লাশ করার।কিন্তু আজ মাসিক টিউটোরিয়াল পরীক্ষার সাজেশন দিবে।যার কারণে সবগুলো ক্লাশ করতে হলো।আড়াইটা অব্দি ক্লাশ চললো।তন্বীর একটা পর্যন্ত ক্লাশ ছিলো।এতক্ষণ ও কি করবে?তাই ওকে বাসায় চলে যেতে বলেছি।শারমিনকে রিকশায় তুলে দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাসা ও শারমিনের বাসা উল্টোদিকে।একটা রিকশাও পাচ্ছি না।তায়াং ভাইয়াকে যে কল করবো তারও উপায় নেই। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। এই ভরদুপুরে কোন ফেক্সিলোডের দোকানও খোলা নেই। কথায় আছে না বিপদ যখন আসে তখন সবদিক থেকে আসে।আমারও তাই হলো।

পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও কোন রিকশা পেলাম না।হঠাৎ ৭-৮টা ছেলে কোথা থেকে এসে আমাকে গোল ঘেরা দিয়ে ফেললো।এরা রওনকের দলের।
একজনের হাতে অনেকগুলো প্রাকটিকাল খাতা।আমার সামনে এসে দাঁড়ালো রওনক।শাওন আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। রওনক আমার সামনে এসে একগালে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

—অবশেষে ঝগড়ুটে ম্যাডামের আসার সময় হলো।সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছি।আর তুমি এখন এলে?দিস ইজ নট ফেয়ার।

রওনককে উদ্দেশ্য করে শাওন বললো,
—ভাই,এরে এখন ছাড়বেন না।আমার পায়ে অনেক জোরে পারা দিছে। পা-টা এখনো জ্বলতাছে। কিরকম ফুলে গেছে। বরফ ডলেও ফোলা কমলো না।

আমি দাঁত কিড়মিড় করে শাওনকে বললাম,
—মনে হচ্ছে ডোজটা অনেক কম হয়ে গেছে।মুখে একনো চটাং চটাং কথা ফুটছে। আরো খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?

—দেখছেন ভাই,দেখছেন।আবার আমারে থ্রেট দিতেছে।তাও আপনার সামনে।আপনি কিছু বলতাছেন না বলে এতো বাড়ছে।

রওনক আমাকে দিলো এক বিশাল ধমক।তাতে আমি কিছুটা কেঁপে উঠলেও তার থেকে বেশি রাগ হলো।কলেজের ভিপি হয়েছে বলে কি মাথা খাবে নাকি।চুপ করে রইলাম।রওনক জোরে চেচিয়ে বললো,

—তখনও আমাদের সাথে ফাইজলামি করলে,এখনো আবার মুখে মুখে তর্ক করছো।এতো সাহস পেলে কোথা থেকে? এর জন্য তোমাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।প্রথমে ভেবেছিলাম মাফ করে দিবো।কিন্তু এখন আর না।তোমাকে দুইটা অপশন দিচ্ছি। ১.আমার কাছে মাফ চাইবে।আর সাথে দশবার কান ধরে উঠবস করবে।২. এখানে ১০টা প্রাকটিকাল আছে। যেগুলো তোমাকে একরাতের মধ্যে কমপ্লিট করে আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে কলেজে এসে দিয়ে যেতে হবে।এখন কোনটা বেছে নিবে?এজ ইউর চয়েজ।

আমি কড়া গলায় উত্তর দিলাম,
—একটাও না।

—যেকোন একটা তো তোমাকে মেনে নিতেই হবে।নয়তো তুমি এখান থেকে আজ যেতে পারবে না। আচ্ছা যাও তোমার কানেও ধরতে হবে না। আর আমার কাছে মাফও চাইতে হবে না। তুমি এই দশটা প্রাকটিকাল করে এনো।তোমার কাজ সহজ করে দিলাম।ঐ তামিম, প্রাকটিকাল খাতাগুলো মিস ঝগড়ুটের হাতে তুলে দে।

—আচ্ছা ভাই।

তামিম নামের ছেলেটা আমার হাতে দশটা খাতা তুলে দিলো।বাপরে এগুলো কি খাতা?আমার তো মনে হচ্ছে কেউ আমার হাতে দশকেজি আটার বস্তা তুলে দিলো।একেকটা কি মোটা মোটা!!আমার এখন কান্না পাচ্ছে। এখন যদি এগুলো নিতে মানা করি তাহলে কান ধরে উঠবস করিয়ে আমার মান-সম্মান ফালুদা বানাবে।রওনকের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাতর গলায় বললাম,

—ভাইয়া!!!এবারের মতো ছেড়ে দিন না।

রওনক ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—কালকের মধ্যে সব খাতা কমপ্লিট চাই।নয়তো অনেক খারাপ হয়ে যাবে। তুমি এ কলেজে থাকতেও না পারো।ভেতরে ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে। কিভাবে কি করতে হবে তার একটা নোটসও ছাপানো আছে। সেগুলো দেখে দেখে চিত্রগুলো আঁকবে আর লিখবে।

—আমি একাউন্টিং-এর স্টুডেন্ট। আপনাদের বায়োলজির চিত্র আঁকবো কি করে?একেকটা যা কঠিন কঠিন নাম। সেগুলো উচ্চারণ করতে গেলেই আমার দাঁত ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।আর চিত্র আঁকতে গেলে পেন্সিলের আগা ভেঙে যাবে আর খাতার পৃষ্ঠা নষ্ট হবে।এর থেকে ভালো কিছু হবে না।

—আগামীকালের মধ্যে সবগুলো কমপ্লিট চাই। তুমি কি করে আঁকবে, লিখবে সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার।এই চল সবাই।

শাওন খুশিমনে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে
বললো,

—একদম ঠিক হয়েছে। ভাইয়ের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার ফল এবার বুঝবে।আমাকে যা পারা দিয়েছে না।আহ্ এখনো ব্যাথা করছে।পা নাড়াতে পারছি না।

আমি একবার শাওনের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রওনককে অনুরোধের সুরে বললাম,

—ভাইয়া প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন না!আমি এরপরের থেকে আপনাদের সাথে কোন ঝামেলা করবো না।

—কথাটা তো আগে ভেবে দেখা উচিত ছিলো।এখন কোন কাজ হবে না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো সবগুলো কমপ্লিট করে এনো।তাহলে একটা ললিপপ দিবো। নয়তো টি.সি পেয়ে যাবো।(সাথের ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে) এই তোরা এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?চল যাই।আজ আমি তোদের ট্রিট দিবো।মনটা ভালো আছে।

হাসতে হাসতে সবগুলো চলে গেলো।এবার আমার কি হবে?এক রাতের মধ্যে এতগুলো প্রাকটিকাল আমি কমপ্লিট করবো কি করে?একটা চিত্র আঁকতেই তো আমার অর্ধেক রাত পার হয়ে যাবে।নিজের ওপর রাগ হচ্ছে,ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ি। কেন যে তখন ওদের সাথে লাগতে গেলাম।এখন ঠেলা সামলাই। যদি আমি হাত-পা ছুঁড়ে রাস্তায় বসে কাঁদতে পারতাম,তাহলে হয়তো একটু ভালো লাগতো।ধূর,
অসহ্যকর সবকিছু!! এর জন্য বলে অতি চালাকের গলায় দড়ি।#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_09
#Writer_NOVA

পাশের ফ্ল্যাটের কিচেন থেকে একঘেয়েভাবে প্রেসার কুকার সিটি মারছে।সেই শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। মিনিট খানিক পরপর বিরক্তিকর শব্দে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। তার সাথে আমার খালামণির চেচামেচিতো আছে।কিছু সময় পর পর এসে ফ্যান বন্ধ করে দিয়ে যায়।সাথে একদফা বকা তো আছেই। হঠাৎ শরীরে তরল জাতীয় কিছু পরতেই ধরফর করে উঠে বসলাম।তাকিয়ে দেখি আমার সারা শরীর পানিতে ভিজে একাকার। তায়াং ভাইয়া মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিশাল এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

—তায়াং ভাইয়াআআআআআআ!!!

—আস্তে শাঁকচুন্নি, আমার কান ধরে গেলো।

—কি করলি এটা?

—তোর গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছি।ভালো চাইলে এখনো উঠ নয়তো বালতি এনে সব পানি ঢেলে দিবো।

—তোদের জন্য কি বন্ধের দিনও একটু আরামে ঘুমাতে পারবো না।

—ওরে আমার আরামওয়ালী! আমার বন্ধুদের কাছে আমার মান-সম্মান ফালুদা করে এখন আরামে ঘুমানো হচ্ছে? তাতো আমি হতে দিবো না। গতকাল একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে তোকে ধরতে পারিনি।এবার শাস্তির জন্য তৈরি হয়ে যা।

—জামা-কাপড় তো অর্ধেকই ভিজিয়ে দিছিস।আর তোর মান-সম্মান ফালুদা করলে একদম ঠিক করেছি পাঠা।ভালো চাইলে এখান থেকে ভাগ।আমি কিন্তু তোর অনেক সিক্রেট জানি।সেগুলো ফাঁস না করতে চাইলে আমার চোখের সামনে থেকে সর।

তায়াং ভাইয়া সামনে এসে আমার চুলের বেণীটা টেনে ধরলো।আমি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলাম।

—ভাইয়া চুল ছাড়।আমার লাগছে তো।

—আকাম করে এখন আবার বড় গলায় আমাকে ব্লাকমেইল করা হচ্ছে।

—চুল ছাড় ভাইয়া।মাথাব্যথা উঠে যাবে।

—তাহলে বল আমি যা শাস্তি দিবো তা মাথা পেতে মেনে নিবি।

—না।

—তাহলে ছাড়ছি না।

—আচ্ছা মেনে নিবো।দয়া করে চুলগুলো ছাড়।নয়তো কোনকিছু মানবো না।

তায়াং ভাইয়া চুল ছেড়ে দিয়ে শয়তানি হাসি দিলো।তারপর এক লাফে খাটের ওপর হাঁটু মুড়ে বসলো।ওকে এভাবে লাফ দিতে গিয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম।

—ভাইয়া, প্লিজ এভাবে লাফ দিস না।

—কেন?

—তোর মতো হাতির লাফ আমাদের জীর্ণশীর্ণ খাট-টা সহ্য করতে পারবে না।আজই ইন্তেকাল ফরমাবে।তারপর আমাদেরকে নিচে বিছানা পেতে ঘুমাতে হবে।

—তোকে তো😤……

—কিছু করলে আমি তোর কোন কথা শুনবো না।

—আবার ব্লাকমেইল।

—ইয়েস।কি বলবি জলদী বল?আমার ঘুম পাচ্ছে।

—তোর শাস্তি হলো আমার ময়লা প্যান্ট-শার্টগুলো সব সুন্দর করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিবি।

—এ্যাহ আইছে।যা ভাগ। আমি পারমু না।

তায়াং ভাইয়া চোখ পাকিয়ে খাটের থেকে উঠতে উঠতে বললো,
—কি বললি আবার বল?

ওকে রাগতে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ করে অসহায় কন্ঠে বললাম,

—তোর প্যান্টগুলো অনেক মোটা।ধুতে গেলে ভেজা প্যান্টগুলো বালতির থেকে উঠাতে উঠাতে আমার কোমড়ের হাড্ডি লড়ে যায়।আর এতগুলো আমি ধুবো কি করে? এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে তোরা এমন করিস কেন?

তায়াং ভাইয়া কোন উত্তর দিলো না। একগালে ভিলেন টাইপের হাসি দিয়ে ওর ময়লা জামা-কাপড় নিয়ে আসতে চলে গেলো।এরা আমারে পাইছে কি?এদিকে
ঐ রওনক ব্যাটা কতগুলো প্রাকটিকাল দিয়ে দিছি।যার মাথা-মন্ডু কিছুই বুঝি না।তাই সেই যে এনে টেবিলের ওপর ভাজ করে রেখে দিছি এখন অব্দি ভাজ করাই আছে।ঐগুলো আমি ছুঁয়েও দেখবো না। আর যদি ধরি তাহলে এমন হাল করবো যেনো জিন্দিগিতে আমার কাছে প্রাকটিকাল খাতা দেওয়ার সাহস না করে।আজ কলেজে যেতে বলেছিলো। আমার মাথা খারাপ নাকি।বন্ধের দিন আমি কলেজ যাবো।তাও আবার তাদের প্রাকটিকাল খাতা কমপ্লিট করে। জীবনেও না। আমার ভাবনার মধ্যে তায়াং ভাইয়া একগাদা শার্ট,প্যান্ট,টাউজার,টি-শার্ট এনে হাজির।এতগুলো দেখে আমার অবস্থা,”ছলছল নয়নে, হাসিমাখা বদনে🥺।” তায়াং ভাইয়া বললো,

—আমার আন্ডারওয়্যারটাও কি ধুয়ে দিবি?

আমি রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—যা নিয়া আয়।সেটা আবার বাকি রাখছিস কেন?

—সত্যি নিয়া আসবো?তুই ধুয়ে দিবি তো?

—খাচ্চোর বেডা।সর সামনের থিকা।তোরটা তুই ধুইয়া নিস।আমি পারবো না।

—তুই তো বললি।

—চুলগুলি ছিঁড়তে না চাইলে সর তায়াং ভাইয়া। মুখের মধ্যে পর্দা নাই।বোনেরে কি বলিস?যা তোর বউরে কো ধুইয়া দিতি।

—তুই তো বললি।বউ থাকলে কি তোকে বলতাম নাকি?

—আবার!!

—শোন,সবগুলো ভালোমতো ধুয়ে কড়া রোদে শুকাবি।তারপর ইস্ত্রি করে আমার ওয়ারড্রবে ভাজ করে রেখে আসবি।

—আরেকটা কথা বলবি তো কিছু করুম না।

—নোভাপু তোমারে আম্মু ডা…..

তন্বী নাচতে নাচতে রুমে ঢুকে কথাটা বলা শুরু করেছিলো।কিন্তু তায়াং ভাইয়াকে দেখে পুরো কথা না বলেই আবার উল্টো দিকে পল্টি মারলো।কারণ ও ভালো করে জানে এখন আমাদের দুজনের মাঝখানে আসলে ওকে বিপদে পরতে হবে।তায়াং ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।আর আমি এতগুলো জামা-কাপড়ের দিকে তাকিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলাম।সবাই কি কলুর বলদ বানাতে আমাকেই পায়?

💖💖💖

সারাদিন কাজ করতে করতে কোমড় ধরে গেছে। এতগুলো ইয়া মোটা মোটা প্যান্ট-শার্ট ধোওয়া কি চারটি খানি কথা।এখন কোমড় নাড়াতে পারছি না। আবার ইস্ত্রি করা বাকি আছে। ইস্ত্রি করার কথা মনে এলেই আমার কান্না পায়।কারণ আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহ্য কাজের মধ্যে একটা হলো ইস্ত্রি করা।আবার রওনকের প্রাকটিকাল খাতার চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না।এখন শুধু কান্না পায়।বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিলেও মনের মধ্যে কোন প্রশান্তি পাচ্ছি না। এত ঝামেলা মাথায় ঘুরলে কি কোন শান্তি লাগে।তখুনি পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে একজন চিৎকার করে ডেকে উঠলো,

—ভাবীইইইইইই!!!

—আস্তে ছেমড়া।আমি বয়রা নাকি?

—কি করো ভাবী?

—ঐ কিসের ভাবী, কে ভাবী?

—তুমি আমার ভাবী।তুমি তো আমার ইফাত ভাইয়ার একমাত্র বউ।ভাইয়া তো বাসার সবাইকে বলছে তুমি ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।

এমনি মেজাজ সপ্ত আসমানে তার মধ্যে এই পুঁচকে ছেলের কথা শুনে আরো রাগ হলো।এই ছেলে হলো ইফাতের ভাই সিফাত।মাত্র ৭ বছর।বাড়িওয়ালা জামিল সাহেবের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে বাহিরে পরিবার নিয়ে স্যাটেল আছে।মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন ভোলা জেলায়।ছোট ছেলের সাথে তারা থাকেন।ছোট ছেলের আবার দুই ছেলে।বড় ইফাত আর ছোট সিফাত।ওর আম্মু পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট। আরেকটা বাবু হবে।ইফাতের আব্বু সারাদিন নিজস্ব চালের আড়ত দেখাশোনা করে। ইফাতের আম্মু ভীষণ মিশুক মেয়ে।একটা মেয়ের আশায় তৃতীয় সন্তান নেওয়া।কিন্তু পিচ্চি ছেলে দুটো হয়েছে বদের হাড্ডি। বড়টার থেকে ছোটটা আরো বেশি। বড়টাকে তাও ধমক,ধাওয়া দিলে ভয় পায়।আর এ পুচকে তো কাউকে ভয় পায় না।পাঁচতলা দালানের চারতলায় তায়াং ভাইয়ারা ভাড়া থাকে।আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে আবার বাড়িওয়ালারা থাকে।

—ও ভাবী কি ভাবো?

—এদিকে আয় বজ্জাত ছেলে।তোর কান দুটো মলে দিবো।সেবার যে তোর মায়ের হাতের আচ্ছা করে পিটুনি খাওয়ালাম তা বোধহয় ভুলেই গেছিস।

—ভাইয়ের জন্য দু-একটু মার খেলে কিছু হয় না ভাবী।

—এই বিচ্ছু ছেলে কথায় কথায় ভাবী বলবি না তো।

—একশ বার বলবো,হাজার বার বলবো।কি করবে? হ্যাঁ,কি করবে?

—আমার হাতের সামনে আয় দেখ কি করি?

—কিচ্ছু করতে পারবে না।আচ্ছা বাদ দাও তো ভাবী।তোমার জন্য ভাইয়া একটা চিঠি পাঠিয়েছে। তুমি নাকি কালকে ভাইয়াকে ধাওয়া দিয়েছো। তাই তোমার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে। তাই আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।

আমি চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালেও ও কোন গাহ্য করলো না।বরং বারান্দার গ্রিল দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে একটা টুকরো কাগজ ছুঁড়ে মেরে রুমে দৌড় দিলো। আমি রাগ ও বিরক্ত নিয়ে কাগজটা তুলে ভাজ খুললাম।ভেতরের লেখা পড়ে আমার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। কাগজের লেখাগুলো ছিলো এরকম;

প্রীয় জান,

আমি তুমাকে অনেক ভালবাসি।কিন্ত তুমি আমাকে বুঝো না।তুমার জন্য আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিছে তার খবর কি রাখো তুমি।তুমাকে না পেলে আমি মরে জাবো।মনে রাইখো তুমারে না পাইলে আমি বাচব না।তুমি এই ইফাতের না হলে আর কাউর হইবা না।তুমি তো আমারে তুমার সামনেও যাইতে দেও না। যানো আমার প্রষুড় কস্ট হয়।আমি তুমাকে সত্য অনেক ভালবাসি।আম্মু-আব্বুকে বলছি তুমার কথা।খুব সিঘ্রই তুমাকে আমার বউ করবো।তুমি শুধু একটু আপেক্ষা করো।

ইতি তুমার
ইফাত

ক্লাশ ফোরে পরা এক ছেলের হাতের লাভ লেটার পেয়ে আমার কি রিয়েকশন দেওয়া উচিত তাও বোধহয় ভুলে গেছি। অগণিত বানান ভুল হওয়া লাভ লেটার হাতে নিয়ে থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আপাতত আমার অবস্থা এখন, “আমি জ্ঞান হারাবো,মরেই যাবো।বাঁচাতে পারবে না কো।” তারপরে জোরে চিৎকার করে বললাম,

—ইফাতরেএএএএএএএ!!! তোর ভালুপাসা আমি ছুটাইতাছি।একবার শুধু তোরে হাতে পাই।ভালোবাসার ভূত তোর ঘাড় থেকে কেমনে নামাই তুই শুধু দেখবি! ফাজিল পোলা।মাত্র ১০ বছর বয়সে এখনই এসব? আর দিন তো পরেই আছে। তোর থেকে ১১ বছরের বড় আমি।তোর বয়সে একটা ফ্রক পরে কুতকুত খেলতাম।আর তুই আমারে লাভ লেটার দিস।আজ তোরে শুধু হাতের কাছে পাই!!! চ্যালাকাঠ দিয়া পিটাইয়া তোর ভালোবাসার ভূত তাড়ামু।

#চলবে

অনেকে বলছেন রওনককে নায়ক দিতে।কিন্তু এটা কখনো সম্ভব নয়।কারণ নোভা❤️এনাজের এটা প্রথম গল্প নয়।এটা ওদের তৃতীয় গল্প। প্রথম গল্প হলে রওনককে নায়ক হিসেবে ভাবা যেতো।কিন্তু তৃতীয় গল্পে কিছুতেই সম্ভব নয়।নোভানাজ জুটিই থাকবে।রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আর গল্পে কোন ভুল হলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।আজ গল্প দেওয়ার কোন ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আজ আমার লেখালেখি জগতের ১ বছর পূর্তি উপলক্ষে দিয়ে
দিলাম🥳।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here