শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -০৬+৭

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_06
#Writer_NOVA

কিছু সময়ের মধ্যে কনসার্ট শুরু হয়ে গেলো।দুইটা পারফরমেন্সের পর এখন একটু বিরতি দিয়েছে।কিন্তু আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। দুপুরে কিছু খাইনি।ভেবেছিলাম কনসার্টে আসার আগে খেয়ে নিবো।কিন্তু তাড়াহুড়োয় সব লন্ডভন্ড।পেটের ভেতর আমার ইঁদুরে ড্রাম পেটাচ্ছে।আমি তায়াং ভাইয়াকে জোরে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—ভাইয়া কনসার্ট শেষ হলে কি আমাদের বিরিয়ানি দিবে না?আমি কিন্তু বিরিয়ানি না নিয়ে বাসায় যাবো না।

আমার কথা যারা যারা শুনছে তারা সবাই আমার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলো।তায়াং ভাইয়া তো রেগে বোম।চোখ পাকিয়ে বললো,

—তোর ভাসুরের বিয়ে লাগছে তো, তাই এখানে বিরিয়ানির আয়োজন করে রাখছে।

—এই অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের থেকে ৫০০ করে টাকা নিয়েছে। এখন বিরিয়ানি না দিলে আমি এখান থেকে এক পা-ও সরবো না।

—হ্যাঁ,আমিও তো বললাম।তোর ভাসুরের বিয়ে আজ।তোকে দিবে না তো কাকে দিবে বল?পুরো ডেকচি তোকে দিয়ে দিবে।

—এভাবে বলছিস কেন?আমার অনেক খুদা লেগেছে তায়াং ভাইয়া। তাইতো কথাটা বললাম।আমার তো খেয়াল নেই যে কনসার্টে বিরিয়ানি বিতরণ করে না।
যদি করে তাহলে তুই লাইনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য নিয়ে আসিস।

—তোকে আমি বিরিয়ানির ডেকচিতে বসিয়ে দিবো।আমিও দেখি তুই কত বিরিয়ানি খেতে পারিস।

আমি ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বসে রইলাম।
হঠাৎ উত্তর দিক হতে একটু ঝামেলার ঈঙ্গিত পাওয়া গেলো।সারা কলেজ ছেয়ে গেলো মারামারি লেগেছে। উৎসুক জনতা সেদিকে ছুটলো।সাথে তায়াং ভাইয়াও। এনাজ তো কনসার্ট দেখছেই না।বরং মোবাইলে গেমস খেলতে মনোযোগী।আমার জুতার ভেতরে ছোট কংকর জাতীয় কিছু একটা ঢুকেছে। যেটা কিছু সময় পরপর আমাকে জ্বালাতন করেছে।আমি সেটা বের করতে আস্তে করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে স্টেজের বাইরে চলে এলাম।যাতে এনাজ টের না পায়।আসলে দুই সারির মাঝে এতটা কম গ্যাপ যে উবু হয়ে জুতা থেকে কংকর বের করা সম্ভব নয়।জুতা খুলে বেশ কয়েকবার ঝাড়া দিলাম। এদিকটায় একটু আগে মানুষ থাকলেও এখন পুরো ফাঁকা। সবাই মারামারি দেখতে চলে গেছে। আমি জুতার কংকর বের করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে আশেপাশে কোন দিকে তাকায়নি।

দাঁড়িয়ে যেই জুতা পরবো তখুনি কোথা থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে সাইড কাটিয়ে চলে গেলো।যাতে হালকা করে আমাদের দুজনের সাথে ধাক্কা লাগলো।তার দৌড়ের গতিতে আমি নিচে পরতে পরতে নিজেকে ব্যালেন্স করে ফেলায়,আর পরলাম না।সে সম্ভবত দৌড়ে ভেতর দিকে যেতে নিয়েছিলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

—সরি বোন।

কথাটা বলে এক মিনিটও দেরী করলো না। আবার ভেতর দিকে দৌড় দিলো।আমি শুধু নিজের মনে বললাম, “আজব তো”। সে ততক্ষণে বহু দূর চলে গেছে। আমি আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।হলোটা কি?হঠাৎ কেউ আমার কানের সামনে জোরে চেচিয়ে বললো,

—এই যে মিস টিডি পোকা,এখানে কি করেন?

আমি ভয়ে কিছুটা চমকে সরে দাঁড়ালাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি এনজিও সংস্থা। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,

— ছোট বাচ্চা মেয়েটার কি জান নিবেন?এমন করে কি কেউ ভয় দেখায়।আরেকটু হলে আমার প্রাণপাখি উড়াল দিতো।আর টিডি পোকা কে হ্যাঁ?

— তুমি।

— আমি কোন পোকা নই মানুষ।

—তুমি তখন টিডি পোকার মতো যেরকম ফালালে। তা দেখে এই নাম ছাড়া অন্য কোন নাম খুঁজে পেলাম না।তুমিও তো আমার নাম এনজিও-র সংস্থা রাখলে।আমি কি কিছু বলছি।

—ভালো হলো না কিন্তু।

—ভালো তো এখন হবে না।পায়ে ব্যাথা পাইছো তারপরেও কেন পাকনামি করে একা একা এদিকে এলে?আমার পারমিশন নিয়ে আসছো?আমি তো তোমায় খুঁজতে খুঁজতে শহীদ হয়ে যেতাম।

মুহুর্তের মধ্যে তার হাস্যজ্জ্বল মুখটা কালো মেঘে হানা দিলো।একে রাগ দেখলে আমার একটু, না না বেশিই ভয় করে।সবার সাথে কি সুন্দর হাসি মুখে কথা বলে।আর আমার সাথে তেজ দেখায়।সবার সাথে নরম, আমার সাথে গরম।এমনি খুদা লাগছে তার মধ্যে আবার বকা শুনতে হবে।আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজ হালকা ধমকের সুরে বললো,

—ভেতরে চলো।

আমি কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম। আমাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে এনাজ তার হাত বারিয়ে দিলো।কিন্তু আমি ধরলাম না।যার দরুন উঁচু নিচু জায়গায় পা মচকে পরতে নিলাম।তখুনি আবার এনাজের বাহু খামচে ধরে ফেললাম।এনাজ আমার দিকে ঘুরে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

—কেউ আমার হাতই ধরতে চায়নি। এখন আবার বাহু ধরে রেখেছে।

তার পিঞ্চ মারা আমার সহ্য হলো না। জলদী করে হাত ছাড়িয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলাম।এনাজও আমার পিছু পিছু চলে এলো।

💖💖💖

আমরা এখন বসে আছি একটা টং দোকানে।এনাজের ইচ্ছে হয়েছে একসাথে চা খাওয়ার।কলেজে মারামারির রেশ ধরে বিশাল বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। এখন বাকি কনসার্ট হয় কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। তাই তায়াং ভাইয়া আমাদের নিয়ে চলে এসেছে। আমার ও তন্বীকে নিয়ে তার তো টেনশনের শেষ নেই। আমাদের মন খারাপ। পুরো কনসার্ট দেখতে পারিনি বলে। তন্বী আর আমি ফুসুরফাসুর করে মন খারাপের কথা শেয়ার করছি।তা দেখে তায়াং ভাইয়া ধমক দিয়ে বললো,

—এত কিসের আলাপ তোদের? সারাদিন মুখ চলতেই থাকে।একটু সময়ের জন্য কি চুপ থাকতে পারিস না।মাথা ধরে গেলো আমার।

তন্বী গাল ফুলিয়ে বললো,
—একটু কথা বললেই দোষ হয়ে যায়।

তায়াং ভাইয়া দিলো ওকে রাম ধমক।তাতে আমি সাবধান হয়ে গেছি।ঠোঁটে এক আঙুল দিয়ে বোকা ফেস করে সবার দিকে তাকাচ্ছি। তা দেখে তায়াং ভাইয়া চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,

—হয়েছে আর ন্যাকা সাজতে হবে না। তুই যে কত ভালোর ছালা তা আমার জানা আছে। বাসায় আজকে শুধু যাই।আমিও দেখবো আমার হাত থেকে তোকে কে বাঁচায়। খুব বেড়েছিস না, এর শাস্তি তোকে পেতে হবে।

আমি চোখ দুটো বড় বড় করে ঠোঁট উল্টে বললাম,
—আমি আবার কি করলাম😕?

—তুই কি করিসনি তাই বল।

এনাজ, তায়াং ভাইয়াকে থামিয়ে বললো,
—আহ্ কি শুরু করলি তোরা?এখন একটু থাম।তায়াং আমি জানি তোর মাথাব্যথা করছে।তাই চা খেতে এলাম।একসাথে চা খাওয়া হবে।সাথে একটু সময় ব্যয় করা হবে। (দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে)মামা, চা হতে আর কতদূর?

—এই তো মামা হয়ে গেছে।

চায়ের কাপগুলো দোকানীর কাছ থেকে নিয়ে আমাদের সবার হাতে তুলে দিলো এনাজ।চায়ের কাপে চুমুক দিতেই একরাশ ভালো লাগা কাজ করলো।ক্লান্ত ভাবটা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।চা শেষ হতেই উঠে পরলাম।মাথাটা অনেকটা পাতলা লাগছে।আমি এনাজের বাইকে আর তন্বী তায়াং ভাইয়ার বাইকে উঠলো।কিছু দূর যাওয়ার পর বাইক থামলো একটা বিরিয়ানি হাউসের সামনে।এতরাত হওয়ায় এই একটাই খোলা ছিলো।বাইক থেকে নেমে আমরা সবাই ভেতরে ঢুকলাম। একটা ছেলে এসে চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার করে দিতেই আমরা বসে পরলাম।তায়াং ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—আমিও এখন দেখবো তুই কত বিরিয়ানি খেতে পারিস।তোকে বিরিয়ানির ডেকচিতে বসিয়ে দিবো।মান-সম্মান তো কিছু রাখলি না আমার।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি কপাল কুঁচকে এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম।এনাজ ও তন্বী দুজনেই মুখ টিপে হাসছে। আমি ওদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ওরা মুখে হাত দিয়ে ফেললো।ছোট একটা দোকান।ভেতরে তিনটা টেবিল।প্রত্যেকটা টেবিলে চারটা করে চেয়ার।ছোট হলেও সবকিছু গোছানো ও পরিষ্কার। আমরা বসার মিনিটখানিক পর দোকানের সাহায্যকারী ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করলো,

—ভাই আপনেগো কি দিমু?

এনাজ হাসিমুখে বললো,
—চার প্লেট কাচ্চি।

—হাফ নাকি ফুল?

—ফুল দাও।

—আইচ্ছা। আপনারা একটু বহেন আমি এহনই লইয়া আইতাছি।

ছেলেটা ভেতরের দিকে চলে গেল।কিছু সময় পর চার প্লেট কাচ্চি নিয়ে ফিরে এলো।বিরিয়ানির ঘ্রাণে পেটটা মোচর দিয়ে উঠলো।খিদেটা আবারো জেগে উঠেছে। পাশের একটা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে সবাই হাত ধুয়ে এলাম।বিরিয়ানির সাথে অর্ধেক কাটা পেঁয়াজ, আস্ত একটা কাঁচামরিচ, এক পিস লেবু ও দুই পিস শসা। ঘ্রাণেই অর্ধেক পেট ভরে গেছে। যার জন্য আমি পুরো প্লেট সাবার করতে পারিনি।অর্ধেক খেয়ে আমার পেট পুরো ঢোল।আমি একপিস গোশতের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে ভয়ে ভয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললাম,

—আমি আর খেতে পারবো না।

তায়াং ভাইয়া কাঁচামরিচে একটা কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কচকচ শব্দে চাবাতে লাগলো। যার মানে হলো তোকেও এখন আমি এই কাঁচামরিচের মতো চিবিয়ে খাবো।শান্ত গলায় বললো,

—মাইর খেতে না চাইলে চুপচাপ খেয়ে নে।

—আমি আর খেতে পারবো না।

আমার কথা শুনে এনাজ বললো,
—আরে খেয়ে নেও টিডি পোকা। এতটুকু খাওয়া কোন ব্যাপার হলো নাকি।

তন্বীও আমার সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
—আমিও খেতে পারবো না ভাইয়া।পেট ভরে গেছে। এতগুলো কে নিতে বলেছিলো তোমাদের। আমাদের জন্য হাফ প্লেট করে নিতে।

তায়াং ভাইয়া বললো,
—আমার মান-সম্মান তো কনসার্টে খেয়ে এসেছিস।তা খেয়েই তো পেট ভরে গেছে।এখন বিরিয়ানি খাবি কি করে? তবে তোরা খাবি না তো তোদের ঘাড়ে খাবে।এমনভাবে একজন বিরিয়ানির কথা বলেছে যেনো বাপের জন্মে বিরিয়ানি খায়নি।জলদী খা।নয়তো আমার হাত চলবে।

এনাজ বললো,
—থাক তায়াং জোর করিস না।এগুলো জোর করে খাওয়ার মতো জিনিস না।পরে দেখা যাবে বেশি খাওয়ার জন্য অসুস্থ হয়ে যাবে।

—তুই এদের চিনিস না।এরা ডায়েট করে।খেলে তো মোটা হয়ে যাবে। তখন ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে না।এর জন্য খেতে চাইছে না।

—তায়াং ভাইয়া তোকে এসব কে বলেছে?

—কারো বলতে হবে না আমি জানি।কথা না বলে প্লেট এদিকে দে।আমার খাবার নষ্ট করা একদম পছন্দ না।

আমি শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
—হইছে আর ঢং করতে হবে না।নিজে তো পুরো ডেকচি খেতে পারবি।তবে দেহের দিকেও একটু তাকাস।দিনকে দিন তো ফুলে ঢোল হচ্ছিস।হাতির মতো শরীর অলরেডি হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে রুমের দরজা কেটে তোকে বের করতে হবে।

তন্বী মুখ টিপে হেসে উঠলো। এনাজ একবার আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলো।তায়াং ভাইয়া বললো,
—আরেকটা কথা বলবি তো সব তোকে খেতে হবে।জলদী দিলে খাবো নয়তো তোকে খাওয়াবো।

আমি খুশি হয়ে বললাম,
—হ্যাঁ নিয়ে নে।আমরা দুজনেই সাইড করে খেয়েছি। বাকিগুলো ভালো আছে।

খাবার শেষ হওয়ার পর আমরা আবার বাইকে চরে বসলাম।এবার বাইক থামলো বাসার গেইটের সামনে।সাড়ে দশটার বেশি বাজে।এনাজ চলে যেতে চাইলে তায়াং ভাইয়া রাগারাগি করলো।তায়াং ভাইয়ার রাগের কারণে রাতটা আমাদের বাসায় থাকার জন্য রাজী হলো এনাজ।রুমে ঢুকে সবকিছু খুলে এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে গেলাম।আজ আর কিছু গুছাতে পারবো না। ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলাম তন্বী ইতিমধ্যে বিছানা তৈরি করে ফেলছে।দুজনের মধ্যে মশারি টানানো নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগে গেলো।খালামণি এসে একদফা দুজনকে বকে গেলো।১. এই রাত-বিরেতে সামান্য জিনিস নিয়ে কথা কাটাকাটি করার জন্য। ২.সবার জন্য রাতের রান্না করে রেখেছিলো কিন্তু আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি কেন? খালামণির বকা এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছি।আরেক কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি।তারপর আমি আর তন্বী একসাথে মশারি না টানিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।

বিছানায় শুতেই শান্তির ঘুম এসে চোখে ভর করলো।কিন্তু আমি যদি জানতাম পরেরদিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করেছে,তাহলে হয়তো এই সাধের ঘুম আমার আজই ছুটে যেতো। #শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_07
#Writer_NOVA

❝বয়স আমার হইলো কুড়ি,
কুড়ি থিকা হইছি বুড়ি।
পাড়ার লোকে গল্প করে,
আমার বয়স নিয়া।
আমায় নাকি কেউ কোনদিন,
করবো না যে বিয়া ❞🥀

সারা ছাদে পায়চারি করে দাঁত ব্রাশ করছি আর বেসুরা গলায় চেচিয়ে গান গাইছি।মাঝে মাঝে আমার আবার এরকম বেসুরা গলায় জোরে জোরে চেচিয়ে গান গাইতে ভীষণ ভালো লাগে।ব্রাশটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই মুহুর্তে দাঁত ব্রাশ করে আমার গান গাওয়ার মুডটা নষ্ট করতে চাইছি না।আজ ফজরের নামাজ পরে আর ঘুমায়নি।রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছি বলে ঘুমটাও জব্বর হয়েছে। ফ্রেশ মুডে থাকায় গান গেয়ে সেটাকে আরো চাঙ্গা করে নিচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে একজন আমাকে বললো,

—কি করো বউ?আমি তোমাকে সারা বিল্ডিং-এ খুঁজে হয়রান আর তুমি এখানে?

“বউ” ডাক শুনে হেরে গলার গান থামিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে পেছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালার বড় নাতি ইফাত দুই হাত গুঁজে আমার দিকে (😒)এই ইমোজিটার মতো করে তাকিয়ে আছে।
আমি কপাল কুঁচকে ইফাতকে জিজ্ঞেস করলাম,

—এই তোর বউ কে?

—কেন তুমি!

—আমি তোর বউ কবে হলাম?

—কেন ভুলে গেছো নাকি?

—সত্যি ভুলে গেছি।

—তুমি না বলছিলা দাদাভাইয়ের থেকে ছাদের চাবি তোমাকে এনে দিলে তুমি আমাকে বিয়ে করবা।

—ঐটাতো কথার কথা ছিলো।

—আমি জানি না। তোমার এখন আমাকেই বিয়ে করতে হবে।

—কেন?

—আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

এর কথা শুনে আমার স্ট্রোক করার অবস্থা। পিচ্চি ছেলে বলে কি?বয়স মাত্র ১০ বছর।সে নাকি আমাকে ভালোবাসে।এই পিচ্চি পোলা অবসর থাকলেই আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকবে।কয়দিন ধরে ওর মায়ের কাছে বায়না ধরেছে আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না। বিয়ে করলে আমাকেই করবে।এতদিন শুধু আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ করতো।সেদিন ছাদের চাবির জন্য পটিয়েছিলাম।সকালের দিকে যেদিন তাড়াতাড়ি উঠে যাই সেদিন আমি ছাদে আসি।তাই ওকে বলছিলাম ওর দাদার থেকে চাবি নিয়ে আসতে।তখন এই পিচ্চি পোলা একটা আজব শর্ত জুড়ে দিলো।বলে কিনা আমি যদি ওকে বিয়ে করি তাহলে আমাকে চাবি এনে দিবে।তখন বিষয়টাকে দুষ্টামি ধরে আমিও বলেছিলাম ওকে বিয়ে করতে রাজী।তারপর যে এত কান্ড হয়ে যাবে তা যদি জানতাম তাহলে এই বাচ্চা ছেলের থেকে দশ হাত দূরে থাকতাম।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ইফাত আবারো জিজ্ঞেস করলো,

—তুমি আমাকে বিয়ে করবা না?

আমি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। চোখ দুটো উল্টে দুই হাত কোমড়ে রেখে বললাম,

—আমি তোর কয় বছরের বড় তা কি তুই জানিস?সঠিক সময়ে বিয়ে হলে তোর সমান একটা ছেলে থাকতো আমার।কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে বুড়ি বানাচ্ছে। তাই তো মনের দুঃখে গান গাইতাছি।

কথাগুলো বলে জোরে চেচিয়ে আবার গান গাইতে শুরু করলাম।

“বয়স আমার হইলো কুড়ি
কুড়ি থিকা হইছি বুড়ি”

পুরো গান আর গাইতে দিলো না। তার আগেই ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে তন্বী দুই হাত কানে দিয়ে চিৎকার করে বললো,

—চুপ করো নোভাপু।আমাকে অজ্ঞান করার ধান্দায় আছো নাকি? এই গান খোলা আকাশের নিচে গাইয়ো না।

আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম,

—কেন?

—তাহলে যে কাক তাদের দলের সদস্য মনে করে তোমাকে নিয়ে যাবে।

—তন্বীরে!!আজ তোর খবর আছে😤।

আমি দৌড়ে ওর কাছে যাওয়ার আগেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো।আমি আবার ইফাতের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কাঠ কাঠ গলায় বললাম,

—তোর মায়ের কাছে বিচার দিতে হবে। বাচ্চা পোলাপাইন পেকে গেছে। তোরে যেন সামলে রাখে।

—তুমিও মিলায় নিয়ো আমি ছাড়া তুমি আর কারো হতে পারবা না।বউ হলে এই ইফাতের হইবা।তুমি যদি আমার না হইতে পারো তাহলে আর কারো হতে দিবো না।তুমি শুধু আমার।আমি তোমারেই বিয়া করুম।

—বুঝছি,তোর দাদারে কইতে হইবো এই বাচ্চা পোলাপাইন নিয়া বাংলা ছায়াছবি দেখতে বসবেন না।আপনার নাতির ওপর বাংলা মুভির বিখ্যাত ডায়লগের প্রভাব পরছে।যার কারণে আমারে সারাক্ষণ মুভির ডায়লগ শোনায়।ঐ তোর দেখি এখনো নাক টিপলে সর্দি পরে।তুই আমারে কিভাবে বিয়ে করবি হ্যাঁ?

—আমার তোমার ভবিষ্যতের জামাই হই।তাই সম্মান দিয়া কথা কইবা।তুই কইরা কও কে?ভালোবাইসা তুমি কইতে পারো না।

—ওরে আমার ভালোবাসার নাগররে!! আমি এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনমু।এর মধ্যে যদি না যাস এখান থিকা,তাহলে তোরে কোলে কইরা ছাদের থিকা ফালায় দিমু।জানে বাঁচতে চাইলে জলদী ভাগ।১…….২…….৩

—যাইতাছি, যাইতাছি।তবে মনে রাইখো একদিন তুমি বুঝবা আমি তোমারে কত ভালবাসতাম।তখন তুমি আমার লিগা কাঁদবা।কিন্তু আমারে পাইবা না।বুঝবা আমি তোমার জন্য কত পাগল ছিলাম।

—তোর বাংলা ছবির ডায়লগ শেষ হইছে?পড়ালেখা রেখে সারাদিন বাংলা মুভি দেখা ছুটাইতাছি তোর।দুই আনার পুঁচকে পোলা কথা কয় ষোল আনার মতো।আবারো দাঁড়ায় রইছিস।গেলি এখান থেকে। তোরে যদি আমার আশেপাশে দেখি।তাহলে সত্যি কথা তোরে কোলে নিয়া এমন আছাড় মারমু তুই পুরা গাইল্লা যাবি।

—একদিন বুঝবা এই ইফাত তোমার জীবনে কি ছিলো!!

—আবার!!

আমি ঠোঁট কামড়ে রাগি ভঙ্গিতে ইফাতের দিকে তেড়ে যেতে নিলেই ইফাত ছাদের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালালো।এই পিচ্চি পোলা দাদার সাথে বাংলা মুভি দেখতে দেখতে পেকে ঝুনা হয়ে গেছে। কি করলাম এই ব্যাঙের ছাতার জীবনে।একটা ১০ বছরের পিচ্চি পোলা নাকি আমারে ছাড়া মইরা যাইবো।ভাই তোমরা কেউ বিষ খাও আমি মরে যাই।

💖💖💖

আজ সকাল সকাল তায়াং ভাইয়া ও এনজিও সংস্থা একসাথে কোথায় জানি গিয়েছে। কি একটা কাজ আছে নবাবপুত্তরদের।তাই উদ্ধার করতে গেছে। যার দরুন আমি ও তন্বী রিকশায় করে কলেজ চলে এলাম।তায়াং ভাইয়া থাকলে একটানে বাইকে করে দিয়ে যেতো।কলেজে এসে শুনলাম রাতে নাকি আর কনসার্ট হয়নি।মারামারির রেশ ধরে সব ভন্ডুল হয়ে গেছে। এতে একটু খুশি হলাম,কেউ কনসার্ট দেখতে পারেনি তার জন্য। গতকালের মারামারির আজ বিচার হবে।একজনের মুখে শুনতে পেলাম ছাত্রদলের ছেলেরা নিজেদের মধ্যেই মারামারি করেছে। তার জন্য কলেজ কতৃপক্ষ বিচার ডেকেছে। তাতে আমার কি?আমি এই ভেজালে নেই। এসব থেকে যতদূর সম্ভব আমি দূরে থাকি।কোনদিকে না তাকিয়ে ক্লাশে চলে গেলাম।

গতকাল কনসার্ট ছিলো কোথায় আজ বন্ধ দিবে।তা না করে কলেজ করতে হচ্ছে।যার কারণে হেব্বি বিরক্ত আমি।ক্লাশে ঢুকতেই চিকনা-চাকনা দেশি মুরগীর মতো দেখতে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।তারপর পিঠে চাপর দিতে দিতে বললো,

—এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো?

এই চিকনা-চাকনা দেশী মুরগীটা হলো আমার কলিজার টুকরো বান্ধবী শারমিন। এতবড় নাম ডাকতে আমার কষ্ট লাগে বলে আমি শারু বলে ডাকি।গত দুই দিনের কনসার্টে ও আসেনি।ওর বাসার থেকে রাতে আসতে দিবে না।তাছাড়া একটু অসুস্থও ছিলো।

আমি গাল ফুলিয়ে ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বললাম,

—তোকে খুব মিস করছি।তুই এলে অনেক খুশি হতাম।

—তুই তো জানিস আমার পরিবার কেমন! তোর তো তাও আপন ভাইয়ের মতো একটা খালাতো ভাই আছে। আমার তো কেউই নেই। একা বাসা থেকে কি করে ছাড়বে বল?আমার নিজের বিবেকেও তো বাঁধে।

—তাই তো তোকে বেশি জোর করিনি।

শারমিনের মনটা বিষন্ন দেখে আমারও খারাপ লাগলো।তাই আমি কথা পাল্টানোর জন্য বললাম,

—দেখতো কার ভালো লাগে এসব!গত দুইদিন এতো কিছু হলো কোথায় আজ বন্ধ দিবে।তা না করে আজও কলেজ খোলা।উনারা পড়াশোনা করিয়ে আমাদের একদম বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলবে।

—বন্ধ তো আগামীকাল।

—কেন?

—ওমা,তুই দেখছি কিছুই জানিস না।আমি দুই দিন না এসে খবর পেয়ে গেলাম।আর তুই এসেও কিছু জানিস না।

—তুই জানিস না,আশেপাশের কোন খবর আমি রাখি না।আমি আমার মতো থাকি।

—হ্যাঁ, জানি।শোন,আজ বুধবার।আজ যদি বন্ধ দিতো তাহলে আগামীকাল আবার কলেজে আসতে হতো।তাই আগামীকাল বন্ধ দিবে আর আজ খোলা।এতে করে সবাই একসাথে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুই দিন বন্ধ পাবে।তাই প্রিন্সিপাল বুদ্ধি করে আজ বন্ধ দেয়নি।এটা তো সিম্পল হিসাব।

—ওহ আচ্ছা। আমার মাথায় তো এই বিষয়টা আসেনি।

—আসবে কি করে?সারাক্ষণ তো তোর মাথায় শয়তানি বুদ্ধি ঘুরে।কিভাবে মানুষকে জব্দ করতে পারবি,কিভাবে ভেজাল করবি,কিভাবে তোর খালাতো ভাইকে ঝামেলায় ফেলতে পারবি।এসব নিয়ে থাকলে সিম্পল বিষয় ঢুকবে কি করে?

—😁😁

—দাঁত বের করে হাসিস না।

আমি শারুকে টেনে নিয়ে একসাথে বেঞ্চে বসলাম।তারপর ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

—শোন শারু,তায়াং ভাইয়া আর আমার মধ্যে হলো টম এন্ড জেরী সম্পর্ক।দুজন সুস্থির হয়ে কখনো মিলেমিশে থাকতে পারি না। ঝগড়াঝাটি লাগবেই। আমার বয়স ২১ বছর আর ওর ২৮ বছর। অথচ আমার মনেই হয় না আমরা ৭ বছরের ছোট-বড়।বরং মনে হয় আমরা পিঠাপিঠি ভাই-বোন। ও কিন্তু আমাকে তন্বীর থেকে কোন অংশে কম ভালোবাসে না।তুই হয়তো অন্য কিছু ভাবতে পারিস।কিন্তু ভাইয়া আমাকে নিজের বোনের চোখে দেখে। ওর যে আমার প্রতি বোনের ভালোবাসা আছে সেটা কখনো প্রকাশ করে না।কিন্তু আমার কিছু হলে পাগল হয়ে যায়।আমি সত্যি ধন্য ওর মতো একটা ভাই পেয়ে।যে কোন অংশে আমার নিজের ভাইয়ের থেকে কম নয়।

—দোয়া করি তোরা যেনো সবসময় এমনি থাকতে পারিস।

—শুকরিয়া!!জানিস শারু কি হয়েছে?

—কি?না বললে জানবো কি করে?

—তায়াং ভাইয়ার এক ফ্রেন্ড আসছে অস্ট্রেলিয়া থেকে।দেখতে,শুনতে মাশাআল্লাহ 😍।আমি কিন্তু সেই লেভেলে ক্রাশ খাইছি।

—তাই নাকি!!!

—হো😌।

—ঘটনা কি সব খুলে বলতো?

—ম্যাম আসছে। পরে বলবোনি।

—ওকে।

আমাদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাশে ম্যাম ঢুকে পরলো।লক্ষ্মী মেয়ের মতো ক্লাশ করছি।হঠাৎ ক্লাশের শেষ পর্যায় কতগুলো ছেলে ম্যামের পারমিশন নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।একজন আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—তোমাদের মধ্যে নোভা কে?

আমার নাম শুনে চমকে আমি শারমিনের দিকে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি ও আগের থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেগুলোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম রওনকের দলের।ওমনি আমার হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো।ছেলেটা বিরক্ত মুখে আবারো জিজ্ঞেস করলো,

—তোমাদের মধ্যে নোভা কে বলো?

আমি শারমিনের বাহুতে এক হাত ঢেকে মুখ লুকালাম।কিন্তু কাজ হলো না। এক মেয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলো।ছেলেটা আমার সামনে এসে বললো,

—লুকিয়ে কাজ হবে না। আমাদের সাথে চলো।

আমি বড়সড় একটা ঢোক গিলে তাদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কেন?

—রওনক ভাই তোমাকে ডাকছে।

–কিসের জন্য ডাকছে?

—সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।

—আমি পরে যাবো।

—বড় ভাই এখন ডাকছে মানে এখুনি যেতে হবে।

—পরে গেলে হবে না।

—তুমি তো দেখছি অতিরিক্ত কথা বলো।এখুনি,এই মুহুর্তে তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।

ছেলেটার ধমক মিশ্রিত কন্ঠে আমি কিছুটা কেঁপে উঠলাম।শারমিনের দিকে তাকাতেই ও চোখের ইশারায় যেতে বললো।আমি মনে মনে লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায যলিমিন পড়তে পড়তে দুরুদুরু বুকে ক্লাশ থেকে তাদের সাথে বের হয়ে গেলাম।আল্লাহ জানে আজ আমার কপালে কি আছে!!!সবাই দোয়া করেন।আমি যাতে ঐ বেডা রওনকের হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারি।কিন্তু সেখানে গিয়ে……….

#চলবে

“নায়ক কে” তা অনেকে বুঝতে পারছেন না!! যারা আমার এই জুটির গল্প আগে পড়ছেন তারা তো জানেন কে নায়ক।কিন্তু যারা নতুন তাদেরকে বলেছি, গল্পের নায়ক হলো এনাজ।আমি কাজিন লাভ স্টোরি লিখি না।তাই তায়াং নায়ক হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here