শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -১৫+১৬

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_15
#Writer_NOVA

মিনিট পাঁচ হয়ে গেছে কেউ তো বের হয় না।একটু পর দেখলাম এনাজ ছেলে দুটোকে নিয়ে বের হলো।আমার কাছে মনে হলো ছেলে দুটো স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে না।একজন তার চোখে হাত দিয়ে রেখেছে। আরেকজন পা টেনে টেনে হাঁটছে। তবে এনাজের মুখে হাসি লেগেই আছে। আবছা আলো থাকায় আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না। আমি আইসক্রিম হাতে উৎসুক চোখে উঁকি ঝুঁকি মেরে সব দেখছি।এদিকে আমার আইসক্রিম যে গলে গলে নিচে পরছে সেদিকেও আমার খেয়াল নেই। হঠাৎ মাথায় বেশ জোরেই একটা থাপ্পড় পরলো।আহ্ শব্দ করে একহাতে মাথা ধরে পেছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি তায়াং ভাইয়া মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তন্বী খুব মনোযোগ সহকারে আইসক্রিম খাচ্ছে।যদি এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও লেগে যায় তাহলেও বোধহয় ওর কোন হুশ ফিরবে না। তায়াং ভাইয়ার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি রে পাঠা মারলি কেন?

—উঁকি ঝুঁকি মেরে কি দেখিস?

—এনজিও সংস্থা এখনো আসে না কেন?

—এনজিও সংস্থা কে? এক মিনিট, এক মিনিট তুই কি এনাজ কে এনজিও সংস্থা বলিস।

—এতদিনে গাধার বুদ্ধি খুলছে।

আমি বিরবির করে কথাটা বলেও বিপদে পরে গেলাম।কারণ ভাইয়া শুনে ফেলেছে। তায়াং ভাইয়া হুংকার দিয়ে বললো,

—এই শাকচুন্নি গাধা কে হ্যাঁ?তোর তো সাহস কম বড় না।আমাকে গাধা আর আমার জানে জিগার দোস্তকে এনজিও সংস্থা বলিস।

—কেন তোর জানে জিগার দোস্ত যে আমায় টিডি পোকা বলে, তুইও তো আমাকে শাঁকচুন্নি বলিস।তখন কিছু হয় না।আর আমি বললেই দোষ।

—তুই এত মনোযোগ দিয়ে উঁকি মেরে কি দেখছিস তাই বল?

—তোকে কেন বলবো?তুই আমাকে মারলি কেন?এমনি মাথাব্যথা করে কয়েকদিন ধরে। আবার মাথায় থাপ্পড় দিছিস।এখন আমার মাথাব্যথা উঠলে তোরে খাইয়া ফালামু কিন্তু।

আমাদের কথার মাঝখানে তন্বী আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—কি হয়েছে তোমরা ঝগড়া করছো কেন?এটা একটা বাজার।এখানেও তোমরা শুরু করছো।

আমি ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিলাম,
—শুরুটা আমি করিনি।তোর ভাই শুরু করছে।

কথা বলতে বলতে আমার চোখ পেছনের দিকে চলে গেলো।আবার দেখলাম এনাজ দুটো ছেলের গলাগলি ধরে সেই চিপা গলিতে নিয়ে গেলো।আমি ঝগড়া ছেড়ে সেদিকে মন দিলাম।মিনিট চার পর সে দুটোকে নিয়ে এনাজ হাসতে হাসতে বের হলো।কিন্তু সাথের দুটোর অবস্থা বেশি ভালো না।এই দুটোর পালা শেষ হতেই একিভাবে আরো দুজনকে নিয়ে গেলো।ওরা বের হওয়ার আগে তায়াং ভাইয়া আমাদেরকে বললো,

—নোভা,তন্বী।

— হ্যাঁ ভাইয়া বল।

আমরা দুজন একসাথে উত্তর দিলাম।ভাইয়া সবগুলো দাঁত বের করে ক্লোজআপ পেস্টের এড দিয়ে বললো,
—একটা ম্যাজিক দেখবি?

তন্বী বললো,
—কি ম্যাজিক ভাইয়া?

—দেখবি কিনা তা বল?

আমি বললাম,
—হ্যাঁ দেখবো।

তায়াং ভাইয়া একগালে ভিলেন টাইপের হাসি দিয়ে বললো,
—ফুচকার স্টলে যে ছেলেগুলো তোদেরকে টিজ করেছিলো সে ছেলেগুলো নিজে এসে একে একে তোদেরকে সালাম দিয়ে তারপর তোদের কাছে মাফ চাইবে।

তন্বী নাক,মুখ কুঁচকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—তোরা কিছু না করলে তো আর ওরা এমনি এমনি আসবে না। এনাজ ভাইয়া যে ওদের তেরটা বাজাতে গেছে তা আমি ভালো করেই জানি।তখন তোদের চুপচাপ থাকার ভঙ্গিটাই আমার কাছে ঝড় আসার পূর্বাভাস মনে হয়েছে। যখন তোরা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলি আর তুই বললি ভালোমতো বিল দিয়ে আসিস।তখুনি আমি পুরো ক্লিয়ার বুঝে গেছি তোরা ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে মাঠে নেমেছিস।আর মোবাইলে দুজন যে একে অপরের সাথে পাশাপাশি বসে চ্যাটিং করছিলি তাও আমি জানি।তোদের আমি ভালো করেই চিনি।

তায়াং ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,
—বাহ,আমাদের তো ভালোই চিনে গেছিস।

আমি তো অবাকের ওপর অবাক।তন্বী এতকিছু টের পেয়ে গেলো আর আমি ঘন্টাও টের পেলাম না। আমি কিছুটা রেগেই তন্বীকে বললাম,
—শয়তান ছেমরি। তুই এতকিছু জানিস আর আমাকে কিছু বললিও না।তোর সাথে কথা নেই, যা ভাগ।

—আরে নোভাপু তুমি আমার ওপর রাগছো কেন? তুমি তো ধরতে গেলে এখনো নতুন। এদের সাথে আরো কয়েকদিন থাকো তুমিও বুঝে যাবে।

আমাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলে ছয়টা হুড়মুড় করে আমাদের সামনে এসে একে একে সবাই সুন্দর করে সালাম দিলো।চিকনা ছোকরাটা হাতজোড় করে বললো,

—আমাদের মাফ করে দাও বোন।আমরা না বুঝে তোমাদের সাথে অন্যায় করেছি।জীবনে আর কখনও কোন মেয়েকে টিজ করবো না।

ওদের একেকটা অবস্থা দেখে আমি আরেকদফা অবাক। একেকজন মুখে রক্ত জমে আছে। ঠোঁট কেটে রক্ত পরছে।চোখ কালা হয়ে গেছে। পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। একজন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের ওপর যে ঝড় গেছে তা তাদের প্রত্যেকটার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি টিপ্পনী কেটে বললাম,

—তা ভাইয়া আদর-যত্ন কেমন করলো? আপ্যায়নের কোন ত্রুটি হয়নি তো?

তন্বী বললো,
—হয়েছে, হয়েছে। এবার যার যার বাসায় যান।এর পরেরবার এই ধোলাইয়ের কথা মনে রাখবেন।আর কোন মেয়ের সাথে দুজন ছেলে দেখলে সাহস দেখিয়ে টিজ করতে যেয়েন না।কখন আবার দুই থেকে পুরো ক্রিকেট টিম হয়ে যায় তাতো বলা যায় না।তাহলে আবার এই অবস্থা হবে।

তায়াং ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—তা ভাইসকল খাতিরদারিটা কেমন ছিলো?মন ভরছে তো।নাকি আরো করতে হবে?আমি আরেকটু করবো নাকি?

তাদের থেকে ব্লু শার্ট পরিহিত ছেলেটা বললো,
—না ভাই তার আর দরকার নেই। এই খাতিরযত্নেই আমরা শেষ। আরো করলে মরে যাবো।

তায়াং ভাইয়া একজনের পিঠে চাপর মারতেই সে আউচ করে চেচিয়ে উঠলো।তায়াং ভাইয়া বললো,
—ওফস সরি ছোট ভাই।শরীরে বোধহয় একটু বেশি লাগছে।সমস্যা নেই। ছ্যাচা মার তো।এখন ততটা ব্যাথা করবে না। সকালে ঘুমের থেকে উঠে টের পাবে,
কত ধানে কত চাল।

💖💖💖

তায়াং ভাইয়া শেষের কথাগুলো আস্তে বললেও আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেরেছি।ভাইয়ার কথা বলা শেষ হতে দেরী ছেলেগুলো পেছনে একবার তাকিয়ে পড়িমরি করে ছুট মারতে দেরী নয়।ওদের এরকমভাবে দৌড়াতে দেখে আমি প্রথমে অবাক হলাম।পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি এনাজ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।এবার বুঝলাম ছেলেগুলোর দৌড়ানোর রহস্য। শার্টের হাতা ফোল্ড করা শেষ করে চুলগুলো পেছনে সেট করতে করতে তায়াং ভাইয়াকে বললো,

—এই কয়েকটার খাতিরযত্ন তো আমিই পারি।তুই আবার ইমরান, রায়হান, শাহেদকে কেন ডাকতে গেলি?

—তুই একা পারবি তা আমি জানি।কিন্তু তোকে যদি দু-একটা দিয়ে বসে তাহলে আমি শেষ। সেই ভয়ে ওদের ডেকে আনলাম।

এনাজ ঘেমে নেয়ে একাকার। মাথাও ঘেমে গেছে। টপটপ করে ঘাম পরছে।পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছে টিস্যুটাকে রাস্তার ওপর পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।আমি এদের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
কিন্তু মিনিট দুই পর দেখলাম ইমরান হাশমি ভাইয়া, রায়হান ভাইয়া,শাহেদ ভাইয়া সাথে আরো দুজন ক্রিকেট ব্যাট, স্ট্যাম্প হাতে আমাদের দিকে আসছে।আমাকে দেখে ইমরান হাশমি ভাইয়া রায়হান ভাইয়ার পেছনে লুকালো।আমি কপাল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলাম,

—ইমরান হাশমি ভাইয়া, আপনারা এখানে কেন? আর এই ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম নিয়ে কি করেন?

ইমরান হাশমি ভাইয়া হে হে করে হাসতে হাসতে বললো,
—ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো।সেখান থেকে ফিরছি।তাই এগুলো সাথে।তাই নারে রায়হান?

রায়হান ভাইয়াকে খোঁচা মেরে তাড়া দিতেই রায়হান ভাইয়াও ইমরান হাশমি ভাইয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
—হ্যাঁ একদম ঠিক।

তন্বী ধমকের সুরে বললো,
—ডাহা মিথ্যে কথা।আজকে কোন ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো না। যদি কোন ক্রিকেট ম্যাচ থাকতো তাহলে পৃথিবী উল্টে গেলেও তায়াং ভাইয়া ও এনাজ ভাইয়া আমাদের সাথে আসতো না।তারা দুজন যে কিরকম ক্রিকেট পাগল তা আমার থেকে কেউ ভালো জানে না। নিশ্চয়ই ভাইয়া এদেরকে ক্রিকেটের জিনিসপত্র নিয়ে এখানে আসতে বলেছে।যাতে ঐ ছেলেগুলোকে সবাই একসাথে মিলে শিক্ষা দিতে পারে।এনাজ ভাইয়াকে একা পাঠাবে না বলে ম্যাসেজে তাদেরও ডেকে আনছে।

আমি এবার অজ্ঞান হবো।এরা তাহলে মোবাইলে এসব করেছে। আর আমি কতকিছু ভেবে ফেলছি।তায়াং ভাইয়া পেছন থেকে তন্বীর হিজাবের ওপর খোপা টেনে ধরে বললো,

—মাতবর হয়ে গেছিস?আমাদের সবকিছু মুখস্থ হয়ে গেছে তোর?কি করি না করি সব দিকে খেয়াল কে দিতে বলে তোকে? ছোট আছিস ছোটদের মতো থাকবি। দু আনার মানুষ অথচ নজরদারি ছয় আনার।

তন্বী ভাইয়ার হাতে থাপ্পড় দিতে দিতে বললো,
—ভাইয়া ছাড় লাগছে।এগুলো আমার সত্যিই মুখস্থ হয়ে গেছে।

তায়াং ভাইয়া তন্বীর খোঁপা ছেড়ে ইমরান ভাইয়াদের বিদায় জানালো।এবার বোধগম্য হলো সবকিছু। এরা সবাই মিলে ঐ ছয়টাকে আচ্ছা করে শিক্ষা দিয়েছে। ইমরান হাশমি ভাইয়া, রায়হান ভাইয়া, শাহেদ ভাইয়া আমাদের থেকেও বিদায় নিলো।প্রত্যেকে তায়াং ভাইয়া ও এনজিও সংস্থাকে জড়িয়ে ধরে উল্টো দিকে পথ ধরলো।আমরাও হাঁটতে লাগলাম বাড়ির দিকে।এখান থেকে হেঁটে দশ মিনিটে বাসায় পৌঁছে যাওয়া যায়।আমরা চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম।হাঁটতে হাঁটতে আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,

—আমি তো ভেবেছিলাম তায়াং ভাইয়া, তোরা ওদেরকে ভয় পেয়ে গেছিস।তোরা দুইজন আর ওরা ছয়জন। তাই সব শুনেও না শোনার ভান করছিস।আর ওদেরকে কিছু না বলেই ছেড়ে দিবি।

এনাজ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
—ছেড়ে দিতাম।যদি না আমার সম্পত্তির দিকে নজর দিতো।সাহসের তারিফ করতে হয়।আমার জিনিসের দিকে নজর দেয়।ওদের সাহস দেখে সত্যি অবাক হয়েছি।আমরা বসে আছি। তারপরেও টিজ করে সহস দেখিয়েছে।এবার বুঝুক মজা।

আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
—আপনার সম্পত্তি,জিনিস মানে?

এনাজ আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করে তায়াং ভাইয়াকে বললো,
—তায়াং জলদী বাসায় যেতে হবে। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। সবাই জলদী পা চালাও।

আমার কিছুটা রাগ হলো।এনজিও সংস্থা আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো।কিন্তু কেন তা তো জানি না। সম্পত্তি বলতে কি বুঝালো সে?এসব ভাবতে ভাবতে আমি কিছুটা পেছনে পরে গেলাম।এতটাই ভাবনায় বিভোর ছিলাম যে চারিদিকে কোন খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ রাস্তার পাশে রাখা একটা ইটের সাথে বেজে পরে যেতে নিলেই পেছন থেকে কেউ আমাকে ধরে ফেললো।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এনাজ।সে দ্রুত আমাকে ধরে দাঁড় করালো।তারপর কানের সামনে ফিসফিস করে বললো,

—আশেপাশে খেয়াল করে হাঁটবে। সবসময় তো আমি থাকবো না যে এভাবে পরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবো। নিজেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।অবশ্য যখন আমি থাকবো তখন আমিই সব বাঁধা-বিপদ থেকে রক্ষা করবো। কিন্তু আমি না থাকলে কি হবে তখন? আর এতকিছু ভেবে নিজের ছোট্ট মাথাটাকে প্রেশার দিয়ো না তো।যা হচ্ছে তা হতে দাও।

উনি কথাগুলো একদমে বলে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেলো।আমি এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি।এদের রহস্যময় কথার আগাগোড়া কিছুই আমি বুঝি না। আকাশে আজ বিশাল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সেই আলোতে দেখলাম এনাজ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পর পেছনে তাকিয়ে দেখলো আমি এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি। তাই সে আবার ফিরে এলো।তারপর হাত টেনে সামনে নিয়ে যেতে লাগলো।উনি আমার হাত ধরতেই আমার শরীরে ৪৪০ ভোল্টেজে শক লাগলো।যদিও এটা প্রথম নয়।আমি একবার হাতের দিকে তাকিয়ে আরেকবার এনাজের দিকে তাকালাম।তারপর ঝাড়া মেরে আমার হাতটাকে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে তাকে ক্রস করে সামনে এগিয়ে গেলাম।এনাজ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।কিন্তু আমি পেছনে তাকালাম না।কারণ নতুন করে কারো মায়ায় পরতে চাইনা আমি।#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_16
#Writer_NOVA

❝আগার তুম মিল যাওয়ো
পুরানডা ছোর দিংগে হাম❞

বারান্দায় বসে সকালের আকাশ দেখছি আর চেচিয়ে উল্টো পাল্টা লিরেক্সে গান গাচ্ছি।কফি ঠান্ডা হয়ে শরবত হয়ে গেছে।তাও আমার কোন তাল নেই।কফিকে শরবত বলারও একটা কারণ আছে। মনে রং লাগছে তো তাই আজ মনের সুখে এক চামচের বদলে দুই চামচ চিনি দিয়ে কফি বানিয়েছি।তাও গান গাওয়ার তালে ঠান্ডা হয়ে পারফেক্ট শরবত হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকে মনটা আজ ফুরফুরে। কিন্তু কি কারণে তা খুঁজে পাচ্ছি না।মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই আমার মন ভালো থাকে আবার কারণ ছাড়াই মন খারাপ। এক চুমুকে শরবতটুকু সাবাড় করে চোখ মুখ খিঁচে ফেললাম।বাপরে কি মিষ্টি রে।এর পরেরবার মনের সুখের ঠেলায় আর যাই করি চিনি বেশি দিয়ে কফি বানাবো না।তন্বী ঘুম ঘুম চোখে এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছে।ওর স্যার ওদের একগাদা এসাইনমেন্ট দিয়েছে। সেগুলো কমপ্লিট করতে করতে বেচারী বুড়ি হয়ে যাবে। ওকে জ্বালানোর আইডিয়া আমার মাথায় বেশ কিছু সময় ধরে ঘুরছে।তাই আবার জোরে জোরে চিৎকার করে হেড়ে গলায় গান শুরু করলাম।

❝আগার তুম মিল যাওয়ো
পুরানডা ছোর দিংগে হাম
তুমে পা কে যামানে কো
রিস্তা তোর দিংগে হাম
আগার তুম মিল যাওয়ো
পুরানডা ছোর দিংগে হাম❞

উল্টো পাল্টা কি গাইছি তা আমি নিজেও জানি না। আমি জানি ভুল হয়েছে। তারপরেও থেমে নেই। তন্বী একবার কটমট চোখে আমার দিকে তাকালো।আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো গান গাইতে লাগলাম।এবার তন্বী টিকতে না পারে চেচিয়ে উঠলো,

—নোভাপু, দয়া করে তোমার ফাটা বাঁশ গলার গান বন্ধ করো।আমি আর নিতে পারছি না।আমাকে দয়া করে শান্তিমতো একটু এসাইনমেন্টগুলো করতে দাও।আমি অজ্ঞান হলে এগুলো শেষ কে করবে?যদি তোমার গান শুনে আমি সত্যি সত্যি অজ্ঞান হই তাহলে সব এসাইনমেন্ট তোমাকে দিয়ে করাবো।তোমার যদি এতই গান গাইতে ইচ্ছে করে তাহলে দয়া করে বাথরুমে যাও।সেখানে চেচিয়ে গান গাইলেও আমার কানে ততটা লাগবে না।

আমি মুখ বাঁকিয়ে ওকে ভেংচি কেটে বললাম,
—এর জন্য কারো ভালো করতে নেই। আমি তোর একঘেয়েমী দূর করতে গান শুনিয়ে বিনোদন দিতে চাইলাম।আর তুই আমাকে অপমান করছিস।যা শুনাবো না তোকে গান।আমার গান শোনার জন্য দুদিন পর দেখিস বড় বড় অডিশন থেকে লোক আসবে।

—অনেক চাপা মারছো বোইন,এবার থামো।তোমার এই গান শুনলে সাধারণ পাবলিক তোমাকে গালি-গালাজ করে পচা ডিম,টমাটো ছুঁড়ে মারবে। আর বড় বড় অডিশনের লোকরা তো বহু দূরেই থাক।ভুলে যদি তারা এসেও পরে তাহলে তাদের জন্য এম্বুলেন্স ভাড়া করতে হবে।

—কেন?

—তারা তো সবাই অজ্ঞান হয়ে যাবে।তাদের কে তো হসপিটালে নিতে এম্বুলেন্স লাগবে।কানেও কম শুনবে।তোমার এই হেড়ে গলার গান শুনে তো তাদের কান দুটো আস্ত থাকবে বলে মনে হয় না।

আমি রেগে চিৎকার করে বললাম,
—তন্বীরে থাম জলদী।

—তুমি আর গান গেয়ো না।তাহলে আমি অটোমেটিক থেমে যাবো।

—ধূর,মুডটাই নষ্ট। আজকাল শিল্পীদের কেউ সম্মানই দেয় না।

—আসল শিল্পীদের সবাই সম্মান দেয় নোভাপু।কিন্তু বাথরুম সিঙ্গারদের কেউ সম্মান দিবে না। তাদের সম্মান দিতে গেলে দেখা যাবে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষই শিল্পী হয়ে গেছে।

—চুপ থাক তুই। গান গাওয়ার মুডটাই নষ্ট করে দিছিস।

তন্বী হো হো করে হেসে উঠলো। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার আকাশের দিকে তাকালাম।মেয়েটা আমার মান-সম্মান পুরো ফালুদা বানিয়ে দিলো।কোথায় যেচে গিয়েছিলাম ওকে জ্বালাতে।সেখানে আমিই অপমানিত হয়ে এলাম।আমার এই হেড়ে গলার উজ্জ্বল প্রতিভা মিশ্রিত কন্ঠটাকে কেউ মূল্যায়ন করে না।যেদিন আমি সুপার সিঙ্গার হয়ে যাবো সেদিন সবাইকে দেখিয়ে দিবো।কিন্তু আমাকে সুপার বাথরুম সিঙ্গার পুরষ্কারটা দেবে কে?এটাও তো ভাববার বিষয়। না,এই পৃথিবীতে আর্টিস্টদের কোন গুরুত্বই দেওয়া হয় না।আমি আজই মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিবো।

💖💖💖

—আসসালামু আলাইকুম বড় আপু।

কলেজ গেইট দিয়ে আমি,তন্বী,শারমিন ঢুকতেই রওনক আমাকে দেখে বিশাল বড় একটা সালাম দিলো।আমি ভিলেন স্টাইলে একটা হাসি দিয়ে সালামের উত্তর নিলাম।

—ওয়া লাইকুমুস সালাম ছোট ভাই।তা খবর কি?দিনকাল কেমন চলে?

—আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোন মানুষ নেই। তাই রওনক মহাশয় এতো জোরে সালাম দিয়েছে।মানুষ থাকলে এতক্ষণ সে লেজ গুটিয়ে পালাতো।আমার ধারের কাছেও তাকে দেখা যেতো না।তার সাঙ্গপাঙ্গরা মুখে তালা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। একেকটার মুখের ভাব-ভঙ্গি এমন যে কেউ তাদের মুখে কলুপ এঁটে দিয়েছে। আজকাল রওনক ও তন্বীর মধ্যে বেশ ভাব দেখতে পাচ্ছি। দুজন দুজনের সামনাসামনি হলেই মিষ্টি হাসি দেয়।সাথে চোখের ইশারায় কথাবার্তাও হয়।লক্ষণ বেশ সুবিধার ঠেকে না আমার।মন বলছে এদের মধ্যে কোন চক্কর চলছে।তন্বী ঠাসিয়ে ধরতে হবে।এমন ভাবে ব্লাকমেইল করে কথা বের করতে হবে যেনো সাপও না মরে আর লাঠিও না ভাঙে।

এদিক-সেদিক তাকিয়ে হাই তুলে রওনককে উদ্দেশ্য করে বললাম,

—সূর্য আজ বোধহয় পশ্চিম দিক দিয়ে উঠেছে।

আমার কথা শুনে রওনক বোকার মতো জিজ্ঞেস করলো,

—কোথায় না তো।সূর্য তো পূর্ব দিক দিয়ে উঠেছে। পশ্চিম দিক দিয়ে উঠলে তো এতক্ষণে কেয়ামত হয়ে যেতো।

—সোজা জিনিস বুঝেও না বোঝার ভান কেন করেন?আমি কোন হিসেবে কথাটা বলেছি তাতো আপনি জানেন?তাহলে আবার বোকা সাজছেন কেন?

আমি কিঞ্চিত বিরক্তির সহিত রওনককে কথাগুলো বললাম।রওনক মাথা চুলকাতে চুলকাতে তন্বীর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলো।তন্বীও চোখের ইশারায় কি জানি বুঝালো।ওদের কথা ওরাই বুঝলো।মাঝখানে আমি বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলাম।শারমিন তো সেই কখন থেকে হা করে তাকিয়ে আছে। বেচারী আমাদের কারোর কথার কিছুই বুঝতে পারছে না।আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি হচ্ছে এখানে?

তন্বী ইতস্তত গলায় বললো,
—কই কিছু না তো।

—আমি তো দেখলাম কিছু হচ্ছে। আই কানেক্টেডও দেখলাম। তা দুজনের চোখে চোখে কি কথা হলো?ভাবসাব তো আমার ভালো ঠেকছে না।কি চলছে দুজনের মধ্যে?

রওনক কিছুটা চমকে বললো,
—কি আর চলবে?আমি তো শুধু ওর দিকে তাকালাম।তাতেই কি দোষ হয়ে গেলো?

—শুধু তাকালে দোষ হতো না। কিন্তু চোখ চোখ তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে তাই দোষ হয়েছে।

রওনক মৃদুস্বরে আমাদের বললো,
—তেমন কিছুই না।(সাথেরগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললো)এই চল তোরা।আসছি।

রওনক “আসছি” কথাটা তন্বীর দিকে তাকিয়ে বলে দ্রুত প্রস্থান করলো।শব্দটা উচ্চারণ করার সময় যে রওনকের দুই ঠোঁটের মাঝখানে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিলো তা অন্য কেউ খেয়াল না করলেও আমার জহুরি চোখের আড়াল হয়নি।যে জিনিসটা আমার সন্দেহ হবে আমি সেটা জহুরির তীক্ষ্ম চোখে লক্ষ্য করি।তাই তেমন কিছু নজরে এড়ায় না।তন্বী দ্রুত পায়ে সামনে চলতে চলতে বললো,

—আমার ক্লাশে দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম।

তন্বী যে সাইড কাটিয়ে চলে গেল। তা ভালো করে বুঝে ফেলছি।কিন্তু ওকে তো আমি পরে জোকের মতো জেঁকে ধরবো।এখন কিছুই বলবো না। শরমিন অসহায় মুখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—আমাকে কি বলবি একটু আগে এখানে কি হলো?আমি তো তোদের কথার কিছুই বুঝলাম না। রওনক তোকে সালাম দিলো,তোকে আপু বললো।তুই ওকে ছোট ভাই বললি।তন্বীর এভাবে চলে যাওয়া।কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।

—আচ্ছা তোকে প্রথম থেকে সব খুলে বলি।

—জলদী বল।

শারমিনকে প্রথম থেকে সব খুলে বললাম।সব কথা শুনে শারমিন চোখ দুটো রসগোল্লা করে বললো,

—তুই একা এতকিছু করে ফেলছিস।আর আমাকে একটু জানালিও না।

—এই যে এখন জানালাম।বকরবকর না করে জলদী পা চালা।ক্লাশে বোধহয় স্যার চলে গেছে।

দুজন দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ আমার চোখ পরলো প্রিন্সিপালের রুমের দিকে।আমাদের ক্লাশে যেতে হলে তার রুম ক্রস করে যেতে হয়।স্যারের রুম থেকে এ্যাশ কালারের ব্লেজার, গলায় ছাই কালার ওড়না,কালো প্যান্ট পরিহিত একটা সুদর্শন চেহারার ছেলে বের হলো। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করলো। তাকে দেখে অলরেডি আমার পা থেমে গেছে। সারা পৃথিবী মনে হচ্ছে ঘুরছে।ছেলেটার পেছন দিকে ঘুরে থাকলেও তার এক সাইড আবছা বোঝা যাচ্ছে। আর সে যে আমার ভয়ানক অতীত।তাকে চিনতে তো আমার ভুল হতে পারে না। আমি এক কদমও এগুতে পারলাম না। সারা শরীর আমার ঠান্ডা হয়ে আসছে।আমার মস্তিষ্ক তখন একটা কথাই জানান দিলো। তা হলো,”নোভা এখান থেকে পালা।নয়তো তুই তোর অতীতের সম্মুখীন হবি।যা তোকে আবারো কুঁড়ে কুঁড়ে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলবে।” আমিও মস্তিষ্কের কথায় সায় দিলাম।সে আমার দিকে ঘোরার আগেই আমি পেছন দিকে দৌড় দিলাম।পেছন থেকে শারমিন ডেকে বলছে,

—এই নোভা কি হয়েছে তোর?তুই দৌড়াচ্ছিস কেন?বলবি তো কি……

ওর কথা শোনার টাইম নেই আমার।আমি ঐ মানুষটার মুখোমুখি হতে চাই না।কিছুতেই চাই না।
এর জন্যই তো সব ছেড়ে এখানে চলে এসেছি।কলেজের পেছন দিকে এসে হাঁপাতে লাগলাম। আরেকটু সময় সেখানে থাকলে আমি নির্ঘাত জ্ঞান হারাতাম।কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না,”সে এখানে কেন?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here