শুধু আমারই পর্ব ৫

শুধু_আমারই
পর্বঃ ৫ (১৮ + কন্টেন্ট)

সায়ান তোর কি হয়েছে?—বলতেই সায়ান রাব্বিকে ধুপ করে জড়িয়ে ধরে কিন্তু কিছু বলে না। রাব্বির বুঝতে বাকি থাকে না সায়ানের মনে ঝড় বইছে। আজ রাব্বিই তার একমাত্র আশ্রয়।

★****★****★

রাত এগারোটা বাজে কিন্তু সায়ান ঘরে ফিরে নি। আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি কিন্তু সায়ান কল রিসিভ করছে না। ওদিকে মা রাতে খাবার সময় সায়ানের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। আমি মিথ্যা করে বলেছি যে সায়ান বন্ধুর বাসায় আছে। অথচ আমি নিজেও জানি না সায়ান কোথায়!

আমার ধীরে ধীরে টেনশন বাড়তে থাকে । সায়ানের মধ্যে খামখেয়ালী বেশি কিন্তু ও তো কেয়ারলেস নয়।

মোবাইলে রিং হচ্ছে, সায়ান কল দিয়েছে। আমি ঝটপট ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রাব্বি ভাই বললেন পিয়া, আমি রাব্বি! সায়ান আমার সাথেই আছে।
— রাব্বি ভাই, সায়ান কি একবারও জানাতে পারতো না ও আপনার সাথে আছে? এটা কেমন কাজ হলো??
—হ্যাঁ পারতো। কিন্তু হয়তো ওর মাথা কাজ করছিলো না।
— মানে??
— পিয়া, সায়ান ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তুমি কি ওকে কিছু বলেছিলে??

আমার মনে পড়ে আমি ডিভোর্সের পর কি করবো, কেমন ছেলে বিয়ে করবো এসব রং লাগিয়ে সায়ানকে বলেছিলাম। কিন্তু এসব তো রাব্বি ভাইকে বলা যাবে না। আমি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলাম।

— পিয়া আমি তোমাকে কিছু কথা বলব, হয়তো একটু লম্বা হবে কথাগুলো তুমি মন দিয়ে শুনো!

পিয়া, আমি কিন্তু সানজানার কথা জানি। আমি এ ও জানি তোমার আর সায়ানের ডিলের কথা। সুতরাং তুমি আমার কাছে কিছু লুকিও না।
সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা আমি জানি বা বুঝি সেটা হলো তুমি সায়ানকে ভালোবাসো।

আমার ভেতরটা ধক করে উঠে। আমার মনের গহীনের গোপন কথাটা রাব্বি ভাই কিভাবে বুঝলো?

রাব্বি ভাই আবার বলল পিয়া আন্টির সুস্থতার অপেক্ষায় তুমি রয়ে গেছো কিন্তু আন্টি তো এখন পুরোই সুস্থ, তাই না? তুমি তারপরও রয়ে গেছো সাথে মন দিয়ে সবাইকে আপন করে সংসার করছো।
বিয়ে করা জামাই বন্ধুর মতো হতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র বন্ধু হয় না, পিয়া! তুমি সায়ান কেউই কারো শুধুমাত্র বন্ধু নও, তোমরা নিজেরাও জানো না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।

আমি ঝটপট বললাম না না আমি সায়ানকে ভালোবাসি না। আমি. আসলে….. ও.. আমরা…

— পিয়া আমি চাই তুমি এভাবেই তোমার ভালোবাসার কথা অস্বীকার কর। তুমি সায়ানকে কোনোভাবেই তোমার ভালোবাসার কথা জানাবে না। তাহলে সে ফেঁসে যাবে। সানজানাকে সে যেভাবে কষ্ট দিতে চাচ্ছে না সেভাবে তোমার ভালোবাসার কথায় সে তোমাকেও কষ্ট দিতে পারবে না। আর এ দোটানায় সে যদি তোমাকে বেছে নেয় তবে ওর মনে সারাজীবন একটা অপরাধবোধ থাকবে সানজানার প্রতি। সেটা তোমার আর সায়ানের কারও জন্যই সুখকর হবে না। পিয়া, আমি চাই সায়ান নিজে থেকে অনুভব করুক,নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিক -সে কি চায়! কি তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান!

সায়ান আমার কাছে সারাক্ষণ তোমার গল্প করে। গল্প করার সময় ওর চোখ মুখ উজ্জল হয়ে উঠে। তোমার প্রতি ওর অনুভূতিগুলো শুধুই বন্ধুত্ব নয়।
তুমি কি খেয়াল করেছো পিয়া, সায়ান তোমার আশেপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে! ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তুমি আছো। তুমি ওর সাথে সবসময় আছো বলে সে হয়তো সেটা বুঝতে পারছে না। সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। সত্যি কথা কি সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছে না। তার কাছে দিন তো ভালোই যাচ্ছে এমন একটা ব্যাপার। হেয়ালীপনা ওর মধ্যে খুব প্রকট।
আজ আমি তোমাদের বাসায় ওকে কিছুক্ষণ পুড়িয়েছি যেমন করে সোনা পুড়িয়ে খাঁটি করে সেইভাবে। সেই পোড়া মনে তুমি হয়তো আরও আঘাত করেছো যা সে নিতে পারে নি। তাই সে বিক্ষিপ্ত মনে এখানে এসে বসে ছিল। আমাকে কিছু বলে নি শুধু ঝিম মেরে বসে ছিল। আমি বুঝছি কিছু একটা হচ্ছে ওর মনে আর সেটা অবশ্যই তোমাকে নিয়ে।

আমি চুপ হয়ে রাব্বী ভাইয়ের কথাগুলো শুনছিলাম। এতো ভালো লাগছিল! সায়ান আমাকে ভালোবাসে, ওর অস্তিত্ব জুড়ে শুধু আমি! এ ও কি সম্ভব! রাব্বি ভাইয়ের কথাগুলো কি আসলেই সত্যি??

রাব্বী ভাই এবার উসখুস কণ্ঠে বলেন পিয়া, এতোক্ষণ যা বললাম তা মনযোগ দিয়ে শোনার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ তবে এখন যা বলবো দয়া করে তুমি রাগ করবে না প্লিজ। জানি না আমাকে তুমি পিটাতেও পারো।

–এটা কেন বলছেন?? কি হয়েছে??

দেখো পিয়া আমি শুনেছি তুমি একটু রাগী কিন্তু প্লিজ আমাকে কিছু বলো না। আমার কোনো দোষ নেই। আমি জানতামও না সায়ান এমন কাজ করবে।

আমার অস্থির লাগা শুরু হয়। কি হয়েছে সায়ানের? আপনি এভাবে বলছেন কেন??

— পিয়া… মানে হয়েছে কি… তোমার সায়ান টাল হয়ে আছে।

—- কি???

—প্লিজ প্লিজ রাগ না করে তুমি আগে কথা শোনো..
আমার বাসায় অনেকদিন ধরেই একটা ছিল। দুবন্ধু একসময় আয়েশ করে খাবো বলে রেখেছিলাম। আমাদের দুজনেরই কিন্তু ওসবের অভ্যাস নেই। ওটা বন্ধুদেরই একজন মজা করে গিফট করেছিল। ওটা কোথায় রাখা সায়ান তা জানতো। আমি কিচেনে ছিলাম আর গাধাটা ওটা বের করে বেশ খানিক গিলে ফেলেছে। ভেবেছিল হয়তো সিনেমার মতো টাল হয়ে ভাব ধরবে। কিন্তু শালা বমি করে আমার রুম পুরো ভাসিয়ে দিয়েছে। আমার পুরো রুমে শুধু ওর বমি আর বমি। আমি এখন সায়ানকে সামলাবো না বমি পরিষ্কার করবো। খুব বিপদে আছি, পিয়া! ঘরে কেউ নেই ইভেন কোনো বুয়াও নেই। তুমি আমার পরিস্থিতি বুঝছো??

আমি কি বলবো আমার মাথা কাজ করছে না। আমি কি রাব্বি ভাইয়ের উপর রাগ করবো না সায়ানের জন্য অস্থির হবো, আমি কি করবো? আমি শুধু বললাম সায়ানকে এখনই বাসায় দিয়ে যান।
— পিয়া রুমের অবস্থা খুবই শোচনীয় ! একটু গুছিয়ে নেই। দুবার পরিষ্কার করেছি। এখন আবার করতে হবে। একটু পর দিয়ে যাচ্ছি।
— না আপনি এক্ষুনি নিয়ে আসেন। পরিষ্কার পরে করবেন।

রাব্বি ভাই কাতর স্বরে বলল প্লিজ পিয়া একটু পর দিয়ে যাই!!

— না এখুনি এখুনি। আমার শেষ কথা। আর আপনি না সায়ানকে সবসময় আগলে রাখেন! এই আপনার আগলে রাখা??
—- ধুর ধুর শালা! আবার বমি করছে। পিয়া আমি ওকে আনছি, এখুনি আনছি। তুমিই ঠিক। আপদ আগে সরানো উচিত। ধুর!!

রাব্বী ভাই বাসার নীচে এলে আমি চুপিচুপি বের হয়ে সায়ানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে রুমে নিয়ে আসি। ছ’ফুট লম্বা শরীর দোতালা পর্যন্ত ধরে আনা তাও সবার অগোচরে আমার জন্য একটু কষ্টকর ছিল। পুরো সময়টা সায়ান বিড়বিড় করে গান গাইচ্ছিল আর হাসছিল। আমার দেখা জীবনে প্রথম মাতাল তাও সেটা সায়ান।
রুমে এনেই সায়ানকে শাওয়ার নিতে ঢুকাই। শাওয়ার ছেড়ে ওটার নিচে বসিয়ে বলি চুপচাপ এখানে বসে থাকবে ঠিক আছে?
সায়ান ঢুলুঢুলু চোখে হেসে বলে, আমার পিয়া সোনা, তুমি যা বলবে তাই হবে।
আমি বুঝি সায়ান নিজের মাঝে নেই। আমি চোখ ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বেড়িয়ে আসি।

অনেকক্ষণ ধরে সায়ান শাওয়ার নিচ্ছে সাথে উচ্চ স্বরে “মোকাবেলা, মোকাবেলা ও লাইলা “বলে গান করছে। সে গান বদলে এখন গাইছে “ডাম ডাম ডিগা ডিগা” ।
আমি মুখ টিপে হাসতে থাকি। দরজার এপাশ থেকে বলি সায়ান অনেক হয়েছে এবার বের হয়।
সে দরজা হালকা খুলে মাথা বের করে আবার হাসি মুখে বলে এভাবেই বের হবো?? আমার গায়ে তো কিছুই নেই!

আমি জলদি দরজা টেনে ধরে বলি দাঁড়াও দাঁড়াও! খবরদার বের হবে না। আমি তোমার ট্রাউজার দিচ্ছি।
সে উচ্চস্বরে ওপাশ থেকে বলে, ওকে আমার পিয়া সোনা!
ট্রাউজার পরে খালি গায়ে সায়ান যখন বের হয়ে আসে তখন আমার স্বাভাবিকভাবেই লজ্জা পাওয়ার কথা। কিন্তু লজ্জা পাওয়া বাদ দিয়ে ওকে সামলানোটা আমার জন্য বেশি জরুরি।

সায়ানের মাথা থেকে টপটপ পানি পড়ছে, পুরো গা ভিজা। আমি তাড়াতাড়ি ওর মাথা মুছার চেষ্টা করি কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওতো লম্বা মানুষের মাথা মুছা বেশ কঠিন। তাই ওকে বিছানায় বসিয়ে কোনোভাবে আগে টিশার্ট পরাই তারপর মাথা মুছি। সায়ান বার বার বিছানায় ঢোলে পড়তে চায় আর আমি টেনে ধরি। শেষে ও নিজেই আমার কোমর জড়িয়ে ওর মুখ আমার পেটে চেপে ধরে রাখে।

ওর শ্বাসের উষ্ণতা আমার মাঝে শিহরণ জাগায়। আমার হাত কাঁপতে থাকে। নিজের অনুভূতিকে দমন করে আমি ওর ভেজা মাথা মোছায় ব্যস্ত থাকি।
সায়ান আমার কোমর জড়িয়ে ধরেই মুখ তুলে বলে পিয়া সোনা গান শুনবে??
— তুমি তো কখন থেকে গান গেয়েই যাচ্ছো।
— না, ওগুলো না। তোমার জন্য গান গাইবো! খুব রোমান্টিক গান!
— গাও শুনি!
সায়ান গুনগুন করে গান ধরে। কিছু লাইন আমি বুঝতে পারি তো কিছু লাইন বাতাসেই ভেসে যায়–

…….
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই,
শুধু আমারই ….. শুধু আমারই….

কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না”……

অল্প কিছু লাইন কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।

সায়ান হঠাৎ বিছানায় ধপ করে পড়ে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে শরীর কাঁপিয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকে।

উফঃ এই মাতাল আমি কিভাবে সামলাবো! সায়ানকে বালিশ পর্যন্ত নেয়ার যুদ্ধে নামি আমি। আজ শাড়ি পরার জন্য নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগছে। আগেই শাড়ি পাল্টে জামা পড়া উচিত ছিলো। এতো বড় মানুষটাকে শাড়ি পরা অবস্থায় টেনে টেনে বালিশে শুইয়ে আমি যেন হাঁপিয়ে যাই।

কিছুক্ষণ দম নিয়ে উঠতে গেলে ওমনি সায়ান আমাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে নিজেই আমার উপরে ঝুঁকে আসে।
আমি এমন আকস্মিকতায় একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ি। সায়ান হঠাৎ করে আমার এতো কাছে আসায় আমি ওর শ্বাসের উষ্ণতা ওর গায়ের গন্ধ সব অনুভব করতে পারি। আমি নিজেই যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছি।

আমার দিকে তাকিয়ে সায়ান মিটমিট হাসছে। এতো নির্মল সে হাসি আমি যেন নতুন করে আবার ওর প্রেমে পড়ে যাই।

আমার চুলে আমার গালে সে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। আমি ক্রমেই ওর ছোঁয়ায় বিগলিত হতে থাকি।

কি যেন ভেবে ওর হাসি মুখ হঠাৎ মলিন হয়ে যায়।
—পিয়া তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে??

ওর কণ্ঠে এতো মায়া জড়ানো! আমি শুধু চেয়ে থাকি।

—তুমি অন্য কারো জন্য শাড়ি পরবে পিয়া?
অন্য কারো কাঁধে মাথা রাখতে চাও?
আমি কি এতোটাই অযোগ্য? বলো পিয়া?
তুমি! তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না পিয়া!

আমার চোখ ভিজে আসে। কি করে বলি আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি সায়ান, তুমি শুধু হাত বাড়াও!

—প্লিজ বলো পিয়া , তুমি যাবে না !!

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলি আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না সায়ান।

সায়ানের চোখে আবার আনন্দ ফুঁটে উঠে।
ওর আঙুল আমার গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঠোঁটে এসে থামে। আমার বুকের ধুপ ধুপ শব্দ বেড়েই চলেছে।

সায়ান আমার খুব কাছে ঝুঁকে আসে। আরও কাছে এসে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁতে চায়।
আমি চোখ বন্ধ করে সে আবেশ নেয়ার জন্য পুরোই প্রস্তুত হই।

পরক্ষণেই আমার মনে হয় এ আমি কি করছি!!

মাতাল তো সায়ান হয়েছে আমি নই আমি কেন তাতে সায় দিচ্ছি? এখন সায়ান যা করছে তা আগামীকাল ওর মনে নাও থাকতে পারে এমনকি এ ঘটনার জন্য সে সরি ফিল করতে পারে।

আমি একঝটকায় সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে বসি।

সায়ান পাশেই বালিসে পড়ে বিড়বিড় করে গান গাইতে থাকে “ও পিয়া ও পিয়া তুমি কোথায় “—
একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।।

চলবে।।
লেখকঃ ঝিনুক চৌধুরী

“কেনো রোদের মতো হাসলে না “— গীতিকার রণজয় ভট্টাচার্যের লেখা “মন কেমনের জন্মদিন ” গানটির কিছু লাইন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here