শুধু আমারই পর্ব ৭+৮

শুধু_আমার
পর্ব_৭

সায়ান অফিস গেলে আমি মায়ের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কিচেনে ঢুকে পড়ি। রান্নার প্রতি আগ্রহ থাকলেও পড়াশোনার কারণে কখনো ওভাবে শেখা হয়নি। মা খুব পিঠা পুলি খেতে পছন্দ করেন। উনার খুব ইচ্ছা আমিও যেন একটু আকটু তা শিখে নেই।
উনাকে খুশি করতেই আমার এ আয়োজন। বিভিন্ন পিঠা বানানো হবে আজ, অনেক সময় লাগবে। একবারে তো আর হবে না মাঝে মায়ের সাথে দুপুরের খাবার শেষে আবার কাজে লাগতে হবে। সব আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছি।

দুপুর সাড়ে তিনটায় কলিং বেল বাজতে থাকে। এ সময় কে আসবে?? হঠাৎ সায়ানের গলা শুনতে পাই। সে মায়ের রুমে ঢুকেছে। ওখান থেকেই আমাকে ডাকছে। আমি কোনোভাবে হাত ধুয়ে কিচেন থেকে দৌড়ে বের হই।
সায়ান মায়ের কোলে মাথা রেখে গল্প করছে। আজ অফিসে দুপুর তিনটায় মিটিং ছিল হায়দার গ্রুপের সাথে। ওরা বিশেষ কারনে ক্যানসেল করে পরের সপ্তাহে মিটিং ডেকেছে। ব্যাস! অফিসে আর কাজ নেই বলে সায়ান বাসায় চলে এসেছে।
আমাকে দেখে সায়ান মায়ের কোলে মাথা রেখেই বলে পিয়া আমি আজ পুরোই ফ্রি, চলো আজ বাইরে বেড়িয়ে আসি। মুভি দেখবে?? চল আজ মুভি দেখি। আম্মু চল আমাদের সাথে।
— আরে না! তোরা যা। আমি এখনও এতো সুস্থ হই নি যে তোদের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবো।

— আমিও তো আজ বাইরে যেতে পারবো না। আমি কিচেনে অনেক কাজ হাতে নিয়েছি। এগুলো শেষ করতে করতে অনেক সময় লেগে যাবে।

মা বললেন কিচেনের কাজ স্বপ্না সামলে নিবে। তুমি বরং সায়ানের সাথে ঘুরতে যাও। আজ প্রথম দুজন একসাথে বের হবে। যাও।
সায়ান খুশি খুশি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।

আচ্ছা মা দেখি কিছু কাজ গুছিয়ে দেই স্বপ্নাবুকে — বলে আমি মায়ের রুম থেকে বেড়িয়ে যাই। কাজ গুছিয়ে নিজের রুমে ঢুকলে দেখি সায়ান মোবাইল স্ক্রলিং করছে আর সামনে টিভি ছাড়া। টিভিতে সানজানার এ্যাড চলছে।
আজ কি হলো জানি না, কেন জানি সানজানাকে দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেল । সায়ান আদৌও দেখছিল কিনা কে জানে কিন্তু আমার সায়ানের উপর হঠাৎ খুব রাগ হলো। আমি মনে মনে ঠিক করলাম আজ আমি কোথাও যাবো না।
সায়ান যখন চায় তখনই আমাকে পাশে পায়। আর আমিও বেহায়ার মতো ওর কথায় নাচি।
আজ কাজ নেই তো আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে, হাসবে, পাশে বসবে, কারন ছাড়া হাত ধরবে যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আসলেই খুব স্বাভাবিক ওর কাছে।
কিন্তু আমার কাছে এসব স্বাভাবিক নয়। আমি সায়ানের একটু ছোঁয়ায় বার বার গলে যাই, একটু কাছে আসায় বিট মিস করি! কেন এতো বেহায়া হয়েছি আমি?? কলেজে, মেডিকেলে সবাই বলতো আমি মুডি মেয়ে, ভাব মারি, দেমাগ দেখাই আর আজ সেই আমিই সায়ানের প্রেমে পাগল হয়ে ঘুরছি। সায়ান আমার না তা জেনেও।
আমার ভালোবাসা সবার চোখে পড়ে। রাব্বীভাই, মা, স্বপ্নাবু সবার চোখে। সায়ানও কি টের পায়?? ও কি মনে মনে মজা নেয় আমাকে নিয়ে?? উফঃ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমার কেবলই অভিমান জমছে। আজ আমি কোথাও যাবো না। সায়ান চাইলেই যেতে হবে নাকি!

সায়ান আমাকে দেখে হেসে বলল চলে এসেছো? রেডি হয়ে যাও।

কত অধিকার?? এতো অধিকার কোথা থেকে পেলো সে?? আমিই তাকে দিয়েছি! নিজের উপর রাগে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠে।
সায়ান আবার বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি চিন্তা করছো?? রেডি হও!

— না! আমি এখন বেরুতে পারবো না। তুমি বলবে আর আমি ওমনি বেড়িয়ে পরবো তা সম্ভব না। আমার আরোও কাজ বাকি আছে—আমি কাট কাট করে বললাম।
সায়ান আমার কথার ঠেস কিছুই বুঝলো না। হেসে বলল আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তোমার সব কাজ শেষ কর আমি অপেক্ষা করবো।

আমি রুম থেকে নিচে চলে আসি। অযথা বাড়তি কাজ নিয়ে বসি ইচ্ছে করে। আজ আমি রাত পর্যন্ত কাজ করবো। কোথাও যাবো না।
আমার দুঃখ আমার অভিমান কিছুই সায়ান বুঝে না। আমার ভালোবাসা বুঝবে কথো থেকে! আসলে আমাকে নিয়ে সে কিছু ভাবেই না। ভালোবাসে না বলেই তো ভাবে না। আমার অভিমান জমে গলা ব্যাথা শুরু হয়। না আজ আমি কোথাও যাবো না! ব্যাস!!

সন্ধ্যার পর সায়ান দুবার নিচে আসে। জিজ্ঞেস করে আমার কাজ আর কতক্ষণ। আমি না তাকিয়েই উত্তর দেই আরোও বাকি আছে। ওর সন্ধ্যার নাস্তাও আমি উপরে পাঠিয়ে দেই। নিজে একবারের জন্যও উপরে যাই না।

রাতের খাবার সময়ে সায়ানের মুখ ছিল থমথমে। মা জিজ্ঞেস করায় উত্তরে বলে ওর নাকি মাথা ধরেছে। মা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে তোমাদের না বের হবার কথা ছিল?

আমি উত্তরে বলি আমার কাজ শেষ হতে সময় লেগেছে আর সায়ানেরও মাথা ধরেছে বলে আর বের হই নি।
সায়ান খাওয়া অবস্থায় আমার কথা শুনে একটু থেমে যায় কিন্তু চুপ হয়েই থাকে। একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায় না।

এবার আমার মন খারাপ হতে লাগে। সারাদিন ওকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমি দূরে থাকলাম অথচ এখন ওর গম্ভীর মুখ দেখে যেন আমারই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে কেন সায়ানকে কষ্ট দিলাম!

খাওয়া শেষে সায়ান কিছু না বলে রুমে চলে যায়।

মা আমাকে বলেন, পিয়া আজ অনেক কাজ করেছ, আর না। এবার তুমি রুমে যাও! খামখা আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিলে। কত শখ করে তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবে বলে এসেছিল। তোমাদের কি মান অভিমান চলছে???

আমি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে চুপ হয়ে থাকি।

—দেখো পিয়া, আমি খুব শখ করে তোমাকে আমার বউ বানিয়েছি। আমি সায়ানেরও পারমিশন নেই নি। পারমিশন নেইনি কারন সায়ান কখনোই নিজে ডিসিশন নিতে জানে না।
তুমি আমার ছেলেকে যখন তখন বকো আমি কিছু মনে করি না, সায়ানও কিছু মনে করে না আমি জানি। কিন্তু তুমি আমার ছেলের মনে কষ্ট দিবে এটা আমি মেনে নিবো না।
সায়ান জেনেশুনে কারো মনে আঘাত দিতে জানে না। আর তোমার বেলা তো প্রশ্নই আসে না। তাহলে তুমি আজ এমন করলে কেন??

আমি হাটু গেঁড়ে মায়ের কোলের কাছে বসি। কি উত্তর দিবো বুঝি না। আমার চোখ বেয়ে দু ফুটা জল গড়িয়ে পড়ে।

মা আমার গালে হাত রেখে বলেন সংসার করছো যখন মান অভিমান থাকবেই। আমি বোধহয় বেশি বলে ফেলেছি।
আসলে মায়েরা সবসময় স্বার্থপর হয়! দেখো, আমি কিন্তু ঠিকই নিজের ছেলের পক্ষ নিলাম। তোমার দিকটা দেখলামও না।

আমি হেসে আমার গালে ছোঁয়া মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বলি না মা আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি দোষ করেছি। সায়ান কিছুই জানে না। আমি দুঃখিত মা। আর এমন করবো না।
— যাও, এখন সায়ানের কাছে যাও। ছেলেটা গাল ফুঁলিয়ে বসে আছে।

আমি রুমে ঢুকে দেখি সায়ান টিভি দেখছে। দেখছে বললে ভুল হবে রিমোট টিপে অনবরত চ্যানেল বদলাচ্ছে। নাকের আগা লাল, চুলগুলো এলোমেলো। সায়ানের পাশে বসতেই ও উঠে বারান্দায় চলে গেল। কি অভিমান! একেবারে বাচ্চাদের মতো।
আমি ওর পিছে পিছে বারান্দায় এসে ওর পাশে দোলনায় বসি।
— খুব রেগে আছো??
সায়ান নিশ্চুপ।
— সরি। আরেকদিন বেরুবো। আজ সত্যিই কাজ ছিলো।
— পিয়া, তুমি মিথ্যে বলছো। ইচ্ছে করে বের হও নি তুমি, চাইলেই পারতে। তুমি যে কাজ গুলো করছিলে ওগুলো এমন কোনো জরুরি কাজ ছিলো না। তুমি ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে গেছো। তুমি আমার সাথে বের হতে চাইছো না বললেই পারতে। আমাকে আশা দিয়ে রাখলে কেন?

আমার মন ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। আসলেই তো, আমি যাবো না বললেই তো সায়ান আর আশা করে বসে থাকতো না।
সায়ানও তো আমাকে কোনো আশা দেয় নি। ওতো স্পষ্ট জানিয়েছে ও সানজানার। তবু আমি কেন আশা করে আছি। আমি কেন বার বার সায়ানকে নিজের মতো করে চাইছি? কেন আমি চাইছি সায়ানও আমাকে ভালোবাসুক??

আমার এলোমেলো চিন্তার মাঝে ছেদ করে সায়ান বলতে থাকে– কত প্ল্যান করেছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তুমি আসবে, এই বুঝি আসবে। কিন্তু তুমি এলে তো না একবার আমাকে বলারও প্রয়োজন মনে করলে না যে আশা করে বসে থেকো না। আমি যাবো না। তুমি হঠাৎ এমন করলে কেন??

আমার মনের অভিমান যেন আর মনের মধ্যে থেমে থাকে না। আমি সাথে সাথে বলে উঠি সায়ান তুমি আমাকে এতো রাগ দেখাচ্ছো কেন? একদিন তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী না- ই বা চললাম। তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই সব হবে নাকি? এতো অধিকার কেন দেখাও তুমি? তুমি সানজানাকে ভালোবাসো এটা জেনেও আমি তোমার সাথে বন্ধুর মতো আছি। একসময় সানজানা তোমার জীবনে আসবে আমার কোন নাম গন্ধও থাকবে না তোমার জীবনে। তারপরও তুমি আমার উপরেই অধিকার দেখাচ্ছো। কেন??

সায়ান স্তম্ভিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার বলা এ কথাগুলোর জন্য সে হয়তো মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ওর চেহারায় যে অভিমান ছিল তা এখন অনুশোচনার রুপ নিয়েছে।

ওর মলিন মুখ দেখে আমার ভেতরে জমা সকল অভিমানের বরফ গলতে থাকে।
উফ! আমি কেন এ ছেলেটার উপর রাগ করে থাকতে পারি না!! এ ছেলেটা আমাকে দিনে দিনে পাগল করে দিচ্ছে ।
আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বলি, আচ্ছা বাদ দাও সব কথা। খামখা আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো।
তুমি বোধহয় অনেক দিন সানজানার সাথে কথা বল না। বরং ওর সাথে কিছু সময় কথা বল দেখবে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। আমি এই ফাঁকে একটা শাওয়ার নিয়ে আসি।

সায়ানের এলোমেলো চুলগুলো আঙুল দিয়ে আরো এলোমেলো করে বারান্দা থেকে আমি চলে আসি।

****★*****

পিয়া চলে যাবার পর সায়ান ওভাবেই দোলনায় বসে থাকে। ইদানীং পিয়া প্রায়ই সায়ানের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। সায়ানের বেশ ভালো লাগে।

কিন্তু আজ পিয়ার কথাগুলোর কারণে মন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আসলেই তে কিসের অধিকারে পিয়াকে রাগ দেখাচ্ছিলো সায়ান !!

সায়ান হাতের মোবাইলের দিকে তাকায়। পিয়া বলেছে সানজানার সাথে কথা বললে মন ভালো হবে। কিন্তু এখন সানজানাকে নিয়ে ভাবতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। বরং অনেকটা অনাগ্রহে পাশে থাকা কর্ণার টেবিলে মোবাইলটা রেখে দেয় সায়ান।

আকাশ খুব থমথমে ছিল এতোক্ষণ। এখন ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। খুব বেশি বাতাস হচ্ছে না তবে খুব ধুলো উড়ছে। কারেন্ট চলে যাওয়ায় আশেপাশের বাড়িগুলোর বাড়তি আলো নিভে গেছে। সায়ান ধুলোর মধ্যেই অন্ধকারে দোলনায় বসে আছে। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু স্লাইড ডোরটা চাপিয়ে দিলো যেন ধুলো রুমে না ঢুকে নইলে পিয়া এসে এটা নিয়ে আবার রাগারাগি করবে।
আজ পিয়ার বকা খাওয়ার মতো মানসিক শক্তি সায়ানের নেই।
মনের ঝড়ের চেয়ে বাহিরের ঝড় অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক লাগছে!

ঝড়ো হাওয়া থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বসন্তে বৃষ্টি হচ্ছে বলে বেশ ঠাণ্ডা বাতাস।
পিয়া ডোর ঠেলে সায়ানের পাশে এসে বসে। কেবল শাওয়ার নেয়ায় ওর গা থেকে চমৎকার সতেজ সুবাস আসছে। সায়ান অজান্তেই পিয়ার দিকে তাকায়। অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে ভেজা চুলে শাড়ি পরা পিয়াকে দেখতে অনেক বেশি স্নিগ্ধ লাগছে যেন কোনো দক্ষ হাতে আঁকা জলছবি।

***★****

সায়ানের পাশে চুপচাপ বসে আমি বৃষ্টি দেখছি। সায়ানও নিশ্চুপ। ওর বিধ্বস্ত মুখ আমি অন্ধকারেও টের পাচ্ছি। সানজানাকে কী সায়ান কল করেছে? কি কথা হয়েছে তাদের?? সায়ানকে জিজ্ঞেস করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। তবে ওর মলিন মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ওর মন ভালো নেই।
প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে আমি শাড়ি বদলে জামা পরি। এখন শাওয়ার শেষে আমার শাড়ি না পরলেও চলতো। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই পরেছি। আমার শাড়ি পরা নিয়ে সায়ান যতই হাঁকঝাক করুক না কেন আড়ালে সে ঠিকই পছন্দ করে। শাড়ি পরে ওর মন ভালো করার একটা ফালতু প্রয়াস করলাম বলা চলে।
থমথমে পরিবেশ সহজ করার জন্য আমি বলি বছরের প্রথম বৃষ্টি, কেমন লাগছে??
— বেশ ঠাণ্ডা।
— বৃষ্টি পছন্দ করো??
—- সাধারণ লাগে। আলাদা ভাবে কিছু ভাবি নি।
— বৃষ্টি নিয়ে কোনো স্মৃতি নেই??
— না।
— মানে কি? তুমি বৃষ্টি কখনও উপভোগ করো নি?? ছোটবেলায়ও না??
— না! বৃষ্টির পানিতে আমার সমস্যা হয়। তাই ওটা বরং আমার সব সময় বিরক্তই লাগে।
—- তুমি তোমার জীবনে কখনোও বৃষ্টিতে ভেজো নি??
— নাহ!
—হায় হায়! আমি তোমার পুরোই উল্টো। আমি জীবনে যদি কোন ঢং করে থাকি তবে সেটা বৃষ্টি নিয়ে করেছি। বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল থেকে ফিরা, বান্ধবী নিয়ে রিক্সায় করে ভেজা, বৃষ্টিতে ছাদে ভিজে ভিজে নাচা, দাদাবাড়ির পুকুরে বৃষ্টিতে ভিজে সাঁতার কাটা কত কি! কোনো শখ বাকি রাখি নি। শুধু একটা শখ বাকি আছে পূরণ করার।
— কি??
— শিলং গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় শিলঙের বর্ণনায় তো আমি একদম ফিদা। খুব শখ পাহাড়ের আঁকাবাকা পিচের রাস্তায় বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে বর্ষাতি হাতে খালি পায়ে বৃষ্টির মাঝে হেঁটে যাবো।
— খালি পায়ে??
— হু!
— বর্ষাতী কি??
— আরে বোকা… ছাতা!
— ও আচ্ছা!

কিছুক্ষণ নীরবতা।

—- আমাকে নিবে তোমার সাথে??
— তোমাকে নিলে তো ভিজতে পারবো না। তোমার না বৃষ্টির পানিতে সমস্যা?
— তুমি তো বর্ষাতী নিবে। এ জীবনে না হয় তোমার সাথেই একবার বৃষ্টিতে ভিজলাম!
— হুম ঠিক আছে! …..চলো, তোমাকে নিয়ে এখনই শিলং ঘুরে আসি। ওখানে ইচ্ছেমতো ভিজলেও তোমার কিছু হবে না।
—- এখন? কিভাবে?
— কল্পনায়! যাবে?
—- হু, যাবো!

সায়ান আমার কোলে মাথা রেখে দোলনায় পা লম্বা করে শুয়ে পড়ে।
বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ, শীতল বাতাস, আধো অন্ধকারে সায়ানের সঙ্গ সবকিছুই যেন আমাকে অনেক বেশি স্পর্শ করে যাচ্ছে । হোক না তা ক্ষনিকের মায়া, তবুও।

আমি ওর চুলে আঙুল বুলাতে থাকি।

সায়ান চোখ বন্ধ করে বলে আমি কিন্তু শিলঙের নির্জন পাহাড়ের পিচ ঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। দুপুরের আলোটা অনেক মিষ্টি লাগছে। তুমি কোথায়?
—- আমি তোমার ঠিক পেছনে। ঘুরে দেখো!
— পেয়েছি! তার আগে বলো, তুমি কি শিলং এ ও শাড়ি পরে আছো??
— তুমি না চাইলে পরবো না।
— না পরো! কিন্তু কি রংয়ের সেটা??
—- তুমিই বলো!
— রংয়ের নাম তো জানি না। সূর্য ডোবার রং। কেমন যেন কুসুম রং!
—ঠিক আছে কুসুম রংয়ের শাড়িই পরেছি। আর কিছু??
— হু! সবসময় যেমন কাচের চুড়ি আর টিপ পরে থাকো তা-ই চাই! সাথে খোলা চুল।
—- তুমি আমার এতোকিছু খেয়াল করো??
—- তা করি!
— আমি কিন্তু খালি পায়ে হাঁটছি।
— আমিও তোমার সাথে খালি পায়ে হাঁটছি।
.
.
.
.
—-পিয়া???
—হু!!
—-আমার বেশ ভালো লাগছে!
—- আমারও!
.
.
— পিয়া!!
— হু!
—- তোমার……
— কি আমার ?
— তোমার হাত ধরে হাঁটি??
.
.
—…. হু!..
.
.
.
—- তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো পিয়া??
—-… হু!…. কিছুটা…
.
.
——পিয়া!
— বলো!
.
.
— কিছুনা..
.
.
.
এভাবে অনেকক্ষণ বর্ষাতী হাতে সায়ান আর পিয়া হেঁটে চলে। বৃষ্টির বেগ যেন আরোও বেড়েছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস। সায়ান হঠাৎ ছাতাটা বাতাসে উড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় সায়ান আর পিয়া ভিজে যাচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভেজায় বুঝি এতো আনন্দ!
বৃষ্টির ঠাণ্ডা শীতল হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে পিয়া। ওর চোখের পাতায়, ঠোঁটে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মুক্তদানার মতো ছুঁয়ে আছে। সায়ান মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। পিয়াকে কোমর জড়িয়ে খুব কাছে টেনে নেয়। পিয়ার তির তির করা ঠোঁট সায়ানের বুকে ঝড় তুলে। সব দ্বিধা ছাড়িয়ে সায়ান পিয়ার ঠোঁট ছুঁতে চায়। পিয়া নত মুখে সায় দিলেও হঠাৎ কেন জানি সজোরে ধাক্কা দিয়ে সায়ানকে দূরে সরিয়ে দেয়।

সায়ান জোড়ে ঝাকুনী খেয়ে চমকে উঠে। প্রথমে বুঝতে একটু সময় লাগে তারপর টের পায় সে বারান্দায় শুয়ে আছে। এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নটা এতোটাই বাস্তব ছিল যে পিয়ার খুব কাছে আসার অনুভূতিটা সায়ান এখনও টের পাচ্ছে। অজান্তেই সায়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। স্বপ্নটার কথা ভাবতেই কেমন এক শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। সে চোরা চোখে পিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে পিয়া বসে বসেই মাথা হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
যাক! সায়ানের স্বপ্ন পিয়া কিছুই টের পাবে না।

পিয়াকে দুবার ডাক দিলেও পিয়া সাড়া দেয় না। রাতে খুব গাঢ় ঘুম ঘুমায় পিয়া এতো দিনে তা টের পেয়ে গেছে সায়ান। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাসে পিয়ার শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। পিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় সায়ান। বিছানায় গুটিসুটি মেরে বাচ্চাদের মতো শুয়ে রয় পিয়া।

রাতে শোবার আগে পিয়া সবসময় শাড়ি বদলে কামিজ পরে, মুখে ভারি ক্রীম মাখে, লম্বা চুলগুলোকে বেনী করে মোটামুটি বেশ আয়োজন করে শুতে যায়। কিন্তু আজ দোলনায় শুয়ে পড়ায় পিয়ার ঘুমনোর আয়োজন করা হয় নি। এখন শাড়ি পরেই শুয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে।

সায়ান পিয়াকে মন ভরে দেখতে থাকে ।

পিয়া ঘুমোনোর সময় আলো সহ্য করতে পারে না বলে ঘুম না আসলেও সায়ানকে লাইট ওফ করে অন্ধকারে বিছানায় পড়ে থাকতে হতো। মাঝে মাঝেই পিয়াকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতো কিন্তু অন্ধকারের আধো আলোতেই যা দেখতে পেতো।

আজ পিয়াকে দেখতে কোনো বাঁধা নেই। পিয়ার দিকে চেয়ে চেয়ে কেমন এক দম বন্ধ হয়ে আসা ভালোলাগায় আচ্ছাদিত হয় সে।
এতো ভালো লাগে কেন এই মেয়েটাকে! মনে হয় যেন বুকের ঠিক মাঝখানে পুষে রাখি। সমস্ত শিরা উপশিরায় যেন পিয়া ঘুরে বেড়ায়।
এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতেই সায়ান পিয়ার গালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দেয়। পিয়া ঘুমের মধ্যেই একটু নড়ে উঠে। ওর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগে আছে। তা দেখে সায়ানও হেসে দেয়। কিছু না ভেবেই সে পিয়ার খুব কাছে গিয়ে ওর কপালে চুমু খায়। পিয়ার উপর ঝুঁকে থেকে ওকে দেখতে দেখতে হঠাৎই সায়ানের স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন ঠিক এভাবেই পিয়ার খুব কাছে ঝুঁকে ওকে চুমু খেতে গিয়েছিল সে আর পিয়া ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। আজ স্বপ্নেও একই কাজ করতে গিয়ে সে আবার পিয়ার ধাক্কা খেয়েছে।

বিদ্যুত গতিতে পিয়ার কাছ থেকে সরে আসে সায়ান।

সবকিছুই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

পিয়াকে খুব কাছে পাওয়ার কথা মনে হলেই মিষ্টি এক অনুভূতি হয় কিন্তু পিয়া ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মনে হতেই মন কেমন খারাপ হয়ে যায়।

ডিভানে গা এলিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে সায়ান।
মনকে অনেক বুঝালেও নিজের কাছ থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। আজ সে স্বীকার করে নিচ্ছে পিয়াকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে সে। পিয়ার প্রেমের অতল সাগরে কেবলই ডুবে যাচ্ছে সায়ান।

দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে মন থেকে। সে দীর্ঘশ্বাসের নাম সানজানা।

চলবে।।
লেখকঃ ঝিনুক চৌধুরী।।

গত পর্বে আপনারা এতো সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করেছেন যে আমি একেবারে সিক্ত। গল্পের কোনো এক লাইন, চরিত্র, সায়ান বা পিয়ার অনুভূতি আপনারা অল্প কথায় অনেকেই ব্যাখা দিয়েছেন। আমার অনেক বড় পাওয়া সেগুলি।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন সানজানা কবে আসবে। আগামীপর্বেই সানজানার আগমন ঘটবে।

সবাইকে রঙ্গিন বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন।
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here