শেষটা সুন্দর পর্ব -০২

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।

‘চিনতে পেরেছেন?’

মেহুল কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

‘আপনি আরিয়ান খান রাবীর?’

‘জি।’

মেহুলের কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল লোকটার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে বলল,

‘আপনি জানতেন, আমার যে এই বিয়েতে মত ছিল না?’

রাবীর স্মিত সুরে বলল,

‘জি।’

মেহুল তখন ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘তাহলে বিয়ে কেন করলেন?’

রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি কেন বিয়ে করেছেন? আপনার তো এই বিয়েতে মত ছিল না, তাহলে কেন করলেন বিয়েটা?’

‘বাধ্য হয়ে করেছি। আমার অসুস্থ বাবার কথা ভেবে করেছি। আজ যদি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হতো, তাহলে আমি কখনোই আপনাকে বিয়ে করতাম না। কিন্তু, আপনি তো জানতেন আমার মত নেই; তাহলে আপনি কেন এই বিয়েতে মত দিলেন?’

‘আপনার মত না’ই থাকতে পারে। কিন্তু, আমার মত তো ছিল। তাই এই বিয়েটা হয়েছে। আমার মত না থাকলে এই বিয়েটা হতো না।’

মেহুল ক্ষেপে গেল কথাটা শুনে। সে রাগি স্বরে বলল,

‘কেন মত দিলেন? আপনি জেনে বুঝে ইচ্ছে করে আমার জীবন নষ্ট করেছেন। আপনাকে আমি কখনোই মেনে নিব না, কখনো না।’

রাবীর তার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ডিরেক্ট ওয়াশরুমে চলে যায়। মেহুল অবাক হয় লোকটার ব্যবহার দেখে। এত শান্তশিষ্ট? যেন এসব কিছুতে উনার কিছুই যায় আসেনা। এত দায়সাড়া ভাব নিয়ে চলছেন, যেন কিছুই হয়নি। মেহুল বসে বসে ফুঁসছে। লোকটার এমন ঠান্ডা মেজাজ তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। সে তো চায়, লোকটা তার উপর রেগে যাক। অনেক বেশি রাগ দেখাক। তারপর দুজনের মধ্যে খুব ঝগড়া হোক, আর দুজন আলাদা হয়ে যাক। কিন্তু, লোকটা যদি এমন শান্ত মেজাজে থাকে তাহলে তো এসবের কিছুই হবে না। মেহুল বড্ড চিন্তায় পড়ে যায়। বুঝতে পারছে না কী করবে।

এর মাঝেই রাবীর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। সে এসে মেহুলকে বলে,

‘যান ওযু করে আসুন। নামাজ পড়তে হবে।’

মেহুল সুযোগ পেয়েছে। সে কড়া স্বরে বলল,

‘না, আমি নামাজ পড়ব না।’

রাবীর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কেন, আপনি নামাজ পড়েন না?’

‘পড়ি। তবে এই মুহুর্তে আপনার সাথে পড়ব না।’

রাবীর কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর আর কিছু না বলে একটা জায়নামাজ বিছিয়ে নিজে একাই নামাজ পড়তে দাঁড়ায়। মেহুল মনে মনে খুশি হয়। লোকটাকে এভাবেই ক্ষেপাতে হবে। কতক্ষণ সহ্য করবে? তার উপর উনি তো আবার এই এলাকার বিশাল বড়ো নেতা। রাগ তো নেতাদের শিরায় শিরায় লেগে থাকে। উনারও নিশ্চয়ই আছে। এখন হয়তো সেটা ধাপা চাপা দিয়ে রেখেছে।

_____

নামাজ শেষ করে উঠতেই রাবীর দেখে মেহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। সে জায়নামাজ ভাজ করে মেহুলের পাশে গিয়ে বসে। মেহুল জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার সামনের সব চুল মুখের উপর আছড়ে পড়ে আছে। রাবীর খুব সাবধানে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। মেহুলের ঘুমন্ত মুখশ্রী’টা দেখে মুচকি হাসে সে। মনে মনে বলে,

‘রাবীর খানের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছ, এখন তো তোমার এত সহজে রেহাই নেই, মেহুল। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এখন তোমাকে এই রাবীর খানের অস্তিত্ব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।’

_____

মিটমিট করে চোখ মেলে তাকাতেই বিশাল দেহী পুরুষ মানুষটা চোখের সামনে প্রতিয়মান হয়। মেহুল চোখ কঁচলে ভালো ভাবে তাকায়। পেছন থেকে লোকটাকে সে চিনতে পারে না। সে চট করে উঠে বসে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে এই ভদ্র লোক তো আরিয়ান খান রাবীর, তার অপছন্দের স্বামী। সে তখন ঘড়ির দিকে তাকায়। সাতটা বাজে, লোকটা এত তাড়াতাড়ি গোসল করে ফেলল?
মেহুল উঠে দাঁড়ায়। রাবীর তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার ভেজা চুল মুছছে। আয়নার মাঝে রাবীরের প্রতিবিম্ব দেখে মেহুল ঢোক গিলে। লোকটা কী বিশাল! এই লোকের সামনে তো মেহুল এইটুকুনি একটা বাচ্চা মেয়ে।
মেহুল বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে ওয়াশরুমে চলে যায়। সে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রাবীর রুমে নেই। সেই সুযোগে সে রুমের দরজাটা আটকে দিয়ে শাড়ি খুলে একটা একটা লং টি শার্ট গায়ে দেয়। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের কাছে যেতেই দেখে, রাবীর ডাইনিং এ বসে নাস্তা করছে। এত সকালে নাস্তা! মেহুলের তো এত সকালে কিছু মুখে নিলেই বমি আসে। সে ভেতরে যায় না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকতে ভেতরে কী হচ্ছে। সে দেখে, তার মা জননী ভদ্র লোকটাকে বেশ যত্ন করে সব খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। কতশত নাস্তার আইটেম বানিয়েছেন। এত জামাই আদর দেখে মেহুলের খুব হিংসা হয়। তাই সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে এসে রাগে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

তার সেই ঘুম ভাঙে দুপুর বারোটায়। তাও আবার তার মায়ের চিৎকারে। ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে দেখে তার মা প্রচন্ড রেগে আছেন। মেহুল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে?’

রামিনা বেগম তার দিকে ফিরে চেয়ে রাগি স্বরে বলেন,

‘মহারাণীর ঘুম তাহলে ভেঙেছে! তা মহারাণী এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন কী করে? আরেকটু ঘুমাতেন, একবারে দুপুরে উঠে খেতেন।’

‘মা, তুমি জানো, ক্লাস না থাকলে আমি এই সময়ই উঠি।’

রামিনা বেগম প্রচন্ড রাগ নিয়ে বললেন,

‘আগের কথা এখন বাদ দাও। এখন তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুদিন পর শ্বশুর বাড়িতে যাবে। ঐখানে গিয়ে এসব করলে শাশুড়ি দু’দিনও রাখবেন না। বাড়িতে এসে ফেলে দিয়ে যাবেন। তাই এখন থেকেই অভ্যাস করো। সকালে জামাই একা নাস্তা করে বেরিয়েছে। উঠেছো তুমি? উঠোনি। ছেলেটা কী ভাববে বলতো। নেহাতই ভালো ছেলে, তাই অত কিছু ধরে না। নাহলে তো তোমার কপালে দুঃখ’ই ছিল।’

মেহুল বিরক্তির সুরে বলল,

‘হ্যাঁ মা, ঐ ছেলে ফেরেশতা। যত খারাপ তো আমি। এক কাজ করো, উনাকে তোমরা সারাজীবনের জন্য নিজেদের কাছে রেখে দাও। আর আমাকে ঐ বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। তাহলেই তোমরা শান্তি পাবে।’

এই বলে মেহুল ডাইনিং রুম ছেড়ে বসার রুমে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে তারা ছোট চাচাতো ভাই বোনেরা টিভি দেখা নিয়ে তুমুল ঝগড়া করছে। মেহুল গিয়ে টিভির রিমোট নিয়ে বলে,

‘তোদের কারোর দেখতে হবে না, আমি দেখব।’

ওর একজন বোন বলে উঠল,

‘না আপু, আমি নিকোলোডিয়ান দেখব।’

আরেকজন তখন বলে উঠল,

‘না। আপুওওও, আমি দূরন্ত দেখব। তুমি প্লিজ দূরন্ত দাও।’

এই টিভি দেখা নিয়ে এক বিশাল ঝগড়া লেগে যায়। মেহুল কাউকেই থামাতে পারছে না। শেষে সে বিরক্ত হয়ে গিয়ে টিভি’ই অফ করে দেয়। বাচ্চাগুলো তখন তার উপর আরো ক্ষেপে যায়। মেহুল ওদের ধরে এক জায়গায় নিয়ে বসিয়ে বলে,

‘শোন, দেখ ঘড়িতে এখন বারোটা বিশ বাজে। বারোটা চল্লিশ পর্যন্ত যে একদম চুপ থাকতে পারবে সে’ই টিভির রিমোট পাবে। আর তখন সে তার ইচ্ছে মতো চ্যানেল দেখতে পারবে। কিন্তু যদি কেউ এর আগে কথা বলে ফেলে তাহলে সে এই গেইম থেকে আউট। তাকে আর রিমোট দেওয়া হবে না। বুঝেছিস?’

বাচ্চাগুলো মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

‘ওকে, তাহলে তোদের সময় শুরু হচ্ছে এখন।’

_____

রামিনা বেগম খাবার নিয়ে ঢুকলেন। খাবারের প্লেট মেহুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘এবার থেকে নিজে নিজে একটু কাজ করতে শেখো। শ্বশুরবাড়িতে গেলে এসব আর কেউ করে দিবে না।’

মায়ের কথা শুনে মেহুল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,

‘মেয়েরা বিয়ের পর খুব পর হয়ে যায় তাই না, মা?’

রামিনা বেগম শক্ত গলায় বললেন,

‘মেয়ের ভালোর কথা বললে, মেয়ে যদি ভুল বুঝে তাহলে মেয়ে পরই হয়ে যায়।’

রামিনা বেগম চলে গেলেন। মেহুল নিশ্চুপ বসে বসে খাবারগুলো খাচ্ছে। তার চাচি তখন তার পাশে এসে বসলেন। মেহুলের এই চাচিকে বরাবরই খুব ভালো লাগে। ভীষণ সহজ সরল ধরনের মানুষ। মনে কোনো কথা রাখেন না। যেটা বলার দরকার বলে ফেলেন।

তিনি এসে হেসে বললেন,

‘কী গো সুন্দরী, মুখটা এমন করে রাখছো কেন? জামাই পছন্দ হয় নাই? নাকি রাইতে জামাই আদর কম করছে?’

চাচির কথা শুনে মেহুলের রাগ হলো না। বরং সে হেসে বলল,

‘তুমি না চাচি! বাদ দাও এসব। চাচা কবে আসবে সেটা বলো।’

‘তোমার চাচা? সেই কবে থেকে বলতেছেন, আসব আসব। এখনও তো কোনো খবর নাই। আল্লাহই জানেন কবে আসবেন।’

‘আসবে চাচি, তাড়াতাড়িই চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না।’

‘হে। এই মেহুল, তুমি জানো তোমার জামাই তো বলে অনেক বড়ো নেতা। এই এলাকার মানুষ বলে উনারে অনেক ভয় পায়। আমি তো আজকেই শুনলাম ভাবির কাছ থেকে। তা তুমি কালকে রাতে কতটুকু কী বুঝলা?’

‘না, আমার তো তেমন কিছু মনে হয়নি। আমার সাথে তো স্বাভাবিকই ছিল।’

‘হ, আমিও তাই ভাবি। ব্যবহারে তো কিছু মনেই হয়না। কত সুন্দর ব্যবহার। নেতা মানুষের ভাব’ই তো অন্যরকম থাকে। কিন্তু, উনারে দেখে তো আমার চিন্তাই পাল্টাই গেছে। যাক, তুমি ভালো মানুষ পাইছো, আমার সেইটা ভেবেই শান্তি।’

চাচি এই কথার বিপরীতে মেহুল কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here