শেষ কান্না পর্ব ১

#শেষ_কান্না
#পর্ব_১
#লেখা_Bobita_Ray

দু’মাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় একটু আগে রায়হানের সাথে অরুণির বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।রায়হান নিজে ইচ্ছেই বিয়ে করেনি রায়হানকে এক প্রকার জোর করে ধরে বেঁধে ক্লাবের ছেলেরা অরুণির সাথে বিয়ে দিয়েছে।বিয়ে নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। রায়হান পড়াশোনার জন্য ঢাকা থাকে।অরুণিদের পাশের ফ্ল্যাটে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে ব্যাচেলর বাসায়।সেখান থেকেই মূলত প্রেমের শুরুটা।আস্তে আস্তে প্রেম গভীর থেকে গভীর হতে লাগল।এভাবেই একটু একটু করে রায়হান অরুণির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।তার ফলস্বরুপ রায়হানের বাচ্চা অরুণির গর্ভে।রায়হানকে একদিন অরুণি ভয়ে ভয়ে ফোন করে বলল,
-”হ্যালো,রায়হান?
-“আরেহ্ সুইটহার্ট যে।তা কী খবর তোমার?এখন তো খুব একটা ফোন টোন দাও না।নাকী এখন আর আমাকে ভালো লাগে না!ডেটে ডাকলেও এড়িয়ে চলো!তুমি কিন্তু নিজেকে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে মহা অন্যায় করছ অরু।রাতে ঘুম হয় না।ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে সুখের সাগরে ডুব দেই।তোমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মাদকতা ছড়িয়ে দেই।
রায়হানের কণ্ঠে অভিযোগ।অরু ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল।রায়হান উত্তেজিত হয়ে বলল,
-“কী হয়েছে ময়নাপাখি কান্না করো কেন?আজ রাতে চলে এসো তোমার সব দুঃখ,কষ্ট,ভুলিয়ে দিব।
-“রায়হান প্লিজ স্টপ
রায়হান ফোনটা কাঁধের সাথে ঠেকিয়ে কানে চেপে ধরে একটা সিগারেট ধরাল।তাতে আয়েশ করে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে বলল,
-“কী হয়েছে আমার জানটার মন খারাপ?
অরু চোখ মুখ বুজে এক নিঃশ্বাসে বলল,
-“রায়হান আমার গর্ভে তোমার সন্তান।
রায়হান চমকে উঠল। মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
-“সন্তান মা-নে?
-“ইয়েস আই এম প্রেগন্যান্ট।
রায়হানের মাথা ঘুরছে,চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে।অস্ফুট স্বরে বলল,
-“এখন কী করবা অরু?
-“কী করব মানে বিয়ে করব!
-“ইয়ে অরু আমরা দু’জন স্টুডেন্ট। বিয়ের পরে অনেক খরচ। জান প্লিজ এখন বিয়ে করতে পারব না আমি।তুমি অন্য ব্যবস্থা করো।
অরু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
-“বিয়ে করতে পারবা না!সহবাস তো ঠিকই করতে পেরেছ।
-“অরু ওটা যাস্ট ক্ষণিকের ইনজয় ছিল।ভুলে যেও না তুমি আমি দুজনই মজা নিয়েছি।
-“আমি এতকিছু জানি না রায়হান তুমি বিয়ে কর প্লিজ?
রায়হান আর কিছু না বলে আচমকা ফোন কেটে দিল।অরু পাগলের মতো রায়হানের নাম্বারে কল ব্যাগ করল কিন্তু ফোনটা বার বার সুইচ অফ বলছে।অরু কী করবে?কী করা উচিৎ? কোনো দিক-দিশা না পেয়ে গুটিগুটি পায়ে বাবার ঘরে গেল।এখন একমাত্র বাবাই ভরসা।ছেলেমেয়েরা বিপদে পড়লে হয়ত বাবা-মা’কে জানাতে খুব ভয় পায়।ভয় পেয়ে না জানিয়ে জীবনে সবচেয়ে চরম ভুলটা করে।কারণ একমাত্র বাবা-মা মন থেকে সন্তানের ভালো চায়।হয়তো প্রথমে বকাঝকা করবে দু’একটা চড়,থাপ্পড় মারবে কিন্তু কঠিন বিপদের দিনে তারাই ঢাল হয়ে দাঁড়াবে, সন্তানদের ছোট বেলার মতই বুকে মাঝে আগলে রাখবে।অরু বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল,
-“বাবা আসব?
জামাল সাহেব মৃদু হেসে বলল,
-“হ্যাঁ রে মা আয়
অরু অনেকক্ষণ ইতঃস্তত করে একসময় বাবার পা জড়িয়ে ধরে লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে সবটা খুলে বলল।সবশুনে জামাল সাহেব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।এই মেয়েটাকে ছোট বেলা থেকে খুব আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করেছেন তিনি। অরুরা দু’ভাই বোন।ছোট ভাইটা খুব ছোট বয়স আর কত হবে তিন’চার বছর।একমাত্র মেয়ের কূকীর্তি শুনে কোনো বাবা মায়ের মাথা ঠিক থাকার কথা না কিন্তু জামাল সাহেব খুব ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ।হুটহাট রাগ করা তার ধাতে নেই।খুব শান্ত গলায় বলল,
-“দেখ অরু তুই বড় হয়েছিস।ভালো মন্দ বোঝার বয়স তোর হয়েছে।ভুল তো করেই ফেলেছিস।চাইলেও শুধরাতে পারবি না। বরং এই ভুল থেকে শিক্ষা নে। জীবনে যা’তে এরকম ভুল দু’বার না হয়।বকাঝকা কিংবা মারামারি কোনো সলিউশন হতে পারে না।তাই আমি সেসবে যেতে চাচ্ছি না।তুমি কি করবি ভাবছিস?
-“বাবা আমি ওকে বিয়ে করব।তুমি যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করে দাও।আমাদের ভুলের শাস্তি আমার অবুঝ, নিষ্পাপ বাচ্চাকে পেতে দিব না।
জামাল সাহেব ছলছল নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মেয়েটা কেমন বড় হয়ে গেল।এই তো সেদিন বাজারে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতো না নিয়ে গেলে কেঁদে কেটে বুক ভাঁসাত।আর আজ!জামাল সাহেব বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“বেশ তুই যা চাচ্ছিস তাই হবে।
জামাল সাহেব খুব কৌশলে ক্লাবের ছেলেদের বলে অরু আর রায়হানের বিয়ে দিয়েছে।প্রত্যেক বাবা মা চায় ছেলেমেয়েরা সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচুক।জামাল সাহেবও তার উঁর্ধ্বে নয়। অরুর মা সবটা জানার পর মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।হয়তো,অভিমানে, লজ্জায়,কিংবা কষ্টে।মুহূর্তেই চিরচেনা মানুষগুলো কেমন অচেনা হয়ে গেল।
রায়হান এবার অনার্স ফাইনাল এক্সাম দিয়েছে।ও অনেক মেধাবী ছাত্র।তাই তো গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এসেছে।অরু এবার ইন্টার ১ম বর্ষে ভর্তি হয়েছে।বয়স ১৭/১৮হবে।বিয়ের পর থেকেই রায়হান মুখটা ভার করে রেখেছে।অরুর সাথে কোনো কথা বলছে না।অজানা ভয়ে অরুর মুখটাও শুকিয়ে গেছে।
বিয়ের মিনিট বিশেক পর অরু আর রায়হানকে বাসে উঠিয়ে দিল জামাল সাহেব।উদ্দেশ্য রায়হানের গ্রামের বাড়ি।অরু কিছুটা সংকোচ নিয়ে ভয়ে ভয়ে রায়হানের বুকে মাথা রেখে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।রায়ান হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-“অরু ওঠো?এসে গেছি আমরা।
রায়হানের ধাক্কায় অরুর ঘুম ভেঙে গেল।রায়হান অরুকে নিয়ে বাস থেকে নেমে একটা রিক্সা নিল।রিক্সা যত দ্রুত গতিতে ছুটছে রায়হানের মুখ ততই শুকিয়ে যাচ্ছে।অরুও খুব অস্থির লাগছে। একে তো নতুন যায়গা তার উপরে গ্রামে আগে কখনো আসেনি মেয়েটা।অরু মুগ্ধ নয়নে চারপাশে তাকিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে।কী সুন্দর আঁকা বাকা মেঠো পথ
চারদিকে সবুজের সমারোহ।এত ক্লান্ত, অবসাদের পরেও অরুর খুব ভালো লাগছে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ।অবশেষে অরুর শ্বশুড় বাড়িতে এসে পৌঁছাল।অরুদের দেখে একটা বয়স্ক মহিলা দৌড়ে এসে বলল,
-“বাপজান তুই আইছা?
রায়হান হালকা হেসে বলল,
-“হ্যাঁ আম্মা!
হঠাৎ অরুর দিকে তাকিয়ে মহিলাটি থম মেরে রইল।অরুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল,
-“বাপজান এই মাইয়া কেডা?
রায়হান চোখমুখ শক্ত করে উত্তর দিল,
-“তোমাদের বৌমা।
মহিলা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।একটু পর উঠানে বসে চিৎকার করে বলতে শুরু করল,
-“আল্লাহ্ গো আমার কি সর্বনাশ হইলো।ছাওয়ালরে পড়ুনের লেইগা ঢাহা পাঠাইছি ছাওয়াল আমার বিয়া কইরা মাইয়া ধইরা নিয়াইছে।এহন আমি কি করুম। এই মুখ আমি কারে দেহামু।বলেই মহিলা আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল।মহিলার চিৎকার চেঁচামিচির শব্দ শুনে গ্রামের অর্ধেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে।সবাই অরুর দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে মনে হয় মেয়েটা ভিনদেশের কোন প্রানী। এদের অতিরিক্ত কৌতুহল দেখে অরুর খুব অস্বস্তি লাগছে।ভয়ে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে।রায়হানের শার্টের কোণা খাঁমচে ধরে উঠানের এক কোণে জড়সর হয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
এর মধ্যে কে যেন গ্রামের চেয়ারম্যানকেও খবর দিয়েছে।তিনি রায়ানকে সব জেরা করতেই রায়ান মাথা নিচু করে একে একে গড়গড় করে সব বলে দিল।অরুর প্রেগন্যান্সির কথাশুনে সবাই একে অপরের মুখে চাওয়া-চাওয়ি করে ফিসফিস কি জানি বলাবলি করছে।
কিছু কথা এরকম,
-“মানসে ঢাহা যাইয়া টাহা কামাই করে, পড়ালেহা শিহে হিক্ষিত হয়,আর এই পোলা মাইয়া মাইসের লগে হুইয়া পেট বাজাইছে ছেঃ ছেঃ
-“ঠিক কইছো গো বুবু। গেরাম ডা আর গেরাম রইল না। আর মাইয়াডাও কী বেসরম দেখছনি।এতগুলান মানসের সামনে রায়হেনরে জড়াইয়া ধরছে।
-“হ গো কালে কালে আরো কততা দেখমু।
-“আমার মনে হয় কি বুবু পোলাডার কুনু দুষ নাই। মাইয়াডাই মনে হয় সরল সোজা পোলাডারে ফাঁসলায়া ফুঁসলায়া বিয়া করছে?
-“কি জেনি হইবার পারে।
নানা মানুষের নানান রকম কথা শুনে অরুর খুব গায়ে লাগছে।অরু ভাবছে,আমি কি একাই বাচ্চা গর্ভে ধারন করছি না কী? সবাই এমন কেন?অনেকে তো আমার মুখের উপরেও যা তা বলে দিচ্ছে।হাইরে মানুষ, হাইরে নিয়তি!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here