শেষ কান্না পর্ব ৬

#শেষ_কান্না
#পর্ব_৬
#লেখা_Bobita_Ray

আজ ১৭টা দিন যাবৎ রথী নিখোঁজ।পাগলের মতো খুঁজেছে রায়হান, রাকিব কিন্তু কোথাও খোঁজ মেলেনি রথীর। মেয়েটা হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তা বুঝে আসে না ফুলমতির।গ্রামে মানুষের মুখে মুখে রটে গেছে, তালোকদার বাড়ির ছাওয়াল,ম্যাইয়া গো চরিত্রের দোষ আছে।ম্যাইয়াডাও মনে হয় কার সাথে না কার সাথে ভাগছে! লোকমুখে সমালোচনা,নিন্দা,শুনে অনেকটা দমে গেছে ফুলমতি।ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরেছে।রাকিবও এখন আর অরুকে ডিস্টাব করে না,অরুর সাথে খারাপ ব্যবহার করে না,সবসময় অরুর কাছ থেকে দূরুত্ব বজায় রেখে চলে।হয়ত একমাত্র বোন হারিয়ে যাওয়ার কারণে নিজের কৃতকর্মের জন্য অপরাধ বোধ কাজ করে।
রায়হান সারাক্ষণ মনমরা হয়ে এখানে সেখানে চুপচাপ বসে থাকে।মাঝে মাঝে অরুর বুকে মাথা রেখে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যখন রথীর জন্ম হলো তখন রায়হানের বয়স ছিল মাত্র ন’বছর।বৈশাখের বিকাল বেলা, আকাশে ঝড় সেজেছে। রায়হান সেসবে পাত্তা না দিয়ে স্কুল মাঠে দলবল বেঁধে ফুটবল খেলতে ব্যস্ত।হঠাৎ খবর এল রায়হানের বোন হয়েছে।কিসের খেলা রায়হান বল ফেলে দিল ভৌ দৌঁড়।হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা-মাটি দিয়ে ভরপুর ছিল।পাশের বাড়ির চাচির কথা মতো কল থেকে কোনমতে হাত পা ধুয়ে কোলে তুলে নিল বোনকে।তারপর এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল অবুঝ,নিষ্পাপ বোনটির দিকে।কী সুন্দর নরম নরম হাত-পা মেলে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। রায়হান বোনের সারা মুখে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল।বোনটার গায়ের রঙ হয়েছে চাপা। তবুও কি সুন্দর মায়াবী চেহারা।রায়হানের কোলে কিছুক্ষণ গুটিশুটি মেরে শুয়ে থেকে একটু পরেই ঠোঁট বাকিয়ে কেঁদে দিল পিচ্চিটা।রায়হান ভয় পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চাচীর কোলে দিয়ে দিল বোনকে। আজ সেই প্রাণপ্রিয় বোনটায় হারিয়ে গেছে।বড় হয়ে রথী কতো আবদার করত মায়ের কাছে কিন্তু ফুলমতি কখনো মেয়ের কথায় পাত্তা দিত না সবসময় ধমকের উপরে রাখত।কিন্তু রায়হান মায়ের অগচড়ে বোনের ছোট ছোট আবদার পূরণ করত।গাল টেনে আদর করে দিত।কথাগুলো ভাবতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়হান।
বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।কারো মনেই শান্তি নেই,কেউ প্রাণ খুলে হাসে না,ঠিকমত কথা বলে না,খায় না,সবাই আজও রথীর ফিরে আসার দিনে গুনে।ফুলমতির মাথায় আসে না মেয়েটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল।রথী হারিয়ে যাওয়ার দু’দিন পরে থানায় গিয়ে মিসিং ডাইরি করেছিল রায়হান কিন্তু পুলিশও কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।প্রতিরাতে রথীর জন্য প্রার্থনা করে অরু।মেয়েটা অল্পদিনে কেমন আপন করে নিয়েছিল অরুকে হঠাৎ সমস্ত মায়া ত্যাগ করে হারিয়ে গেল ভাবলেই অরুর বুকটা শূণ্য শূণ্য লাগে।

♠♠
রংপুর শহর পেড়িয়ে উত্তর দিকে ছোট্ট একটি গ্রাম অবস্থিত।গ্রামটির নাম ‘জামসা’।গ্রামটির চারপাশে শুধু ধানখেত।সারি সারি ধানখেতের একপাশে ছোট্ট একটা পুকুর।পুকুরের পাশেই বিশাল বটগাছ। বটগাছটি ডাল-পালা ছড়িয়ে শত শত মানুষকে ছায়া দেওয়া জন্য এক জায়গা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।পুকুরে পানা দিয়ে বোঝায়।কৃষকরা টানা ছ’ঘণ্টা একটানা জমিতে কৃষিকাজ করে এই পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে দলবল বেঁধে বসে বিশ্রাম নেয়।তারপর খুলে বসে সুখ,দুঃখের গল্পের ঝাঁপি।এই পুকুর থেকে ধানের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্যও পানি তোলা হয়।সাত,আট জন কৃষক প্রতিদিনের ন্যয় আজও একটানা ছ’ঘণ্টা জমিতে কাজ করে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পুকুর পাড়ে গেল।তারপর পুকুর থেকে সবাই হাতমুখ ধুয়ে গামছা দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে বটগাছের নিচে আয়েশ করে বসল।কৃষকদের মধ্য প্রধান হালিম। হালিম দুপুরের খাবার খেয়ে হাত,মুখ ধোওয়ার জন্য পুকুরে গিয়ে খেয়াল করল,খুঁদি পানার ঝোঁপ থেকে বুদবুদ করে একটা প্লাস্টিকের বস্তা ভেসে ওঠছে।হালিম কৌতুহলী চোখে এক ধ্যানে বস্তাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।বস্তা থেকে পঁচা দূরগন্ধ ভেঁসে আসতেই হালিম নাক ছিটকাল।কেমন বিশ্রী গন্ধে গা গুলিয়ে যাচ্ছে।এই বস্তা থেকে কিসের গন্ধ ভেসে আসছে দেখার জন্য লাঠি দিয়ে বস্তাটা পুকুরের কিনারায় টেনে আনল।তারপর দু’হাতে বস্তার মুখ ধরে টেনে তুলল পুকুর পাড়ে।পঁচা গন্ধটা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। হালিম গামছা দিয়ে ভালো করে নাক বেঁধে নিল।এতক্ষণে বিশ্রী গন্ধ সব কৃষকদের নাকেই পৌঁছে গেছে।সবাই গন্ধটা অনুসরণ করে পুকুর পাড়ে এসে পৌঁছাল।হালিম বস্তার বাঁধনটা খুলে বস্তার দু’পাশ টেনে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মাটিতে কিছু একটা ঢেলে দিল। বস্তার ভিতর থেকে যা বেড়িয়ে এল দেখে সবাই ভয় পেয়ে এক ঢোক গিলে দু’পা পিছিয়ে গেল।বস্তাটির ভিতরে ছিল একটা পঁচা, গলা লাশ।লাশটা আজ অনেকদিন যাবৎ পানিতে থাকার কারণে শরীরের মাংস খসে খসে পরছে।ছেলে না মেয়ে বোঝা যাচ্ছে না।চোখের মণি নেই,ঠোঁট নেই,কান নেই,নাক নেই,মাথায় চুল নেই,শরীরের কোনো অঙ্গই ঠিক নেই। মুহূর্তেই কোত্থেকে উড়ে এসে এক ঝাঁক মাছি বসল লাশটার উপরে।কারেন্টের তারে দাঁড়িয়ে কাক,চড়ুইও অপলক তাকিয়ে আছে পঁচা গলা লাশটির দিকে।
আপাদমস্তক লাশটিকে দেখে সবার চোখে মুখে একরাশ আতঙ্কের ছাপ ভর করল।হাত-পা শিরশির করে কাঁপছে। সবাই স্তব্ধ হয়ে বস্তটার চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।মাথা ঝিমঝিম করছে।সহজ-সরল মানুষগুলো একে একে সবার মুখে চাওয়া-চাওয়ি করে ভয়ে এক চিৎকার দিল।চিৎকার-চেঁচামিচির শব্দ শুনে মুহূর্তেই জড় ধরে গেল শতশত মানুষ।লাশটাকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে মুখে কাঁপড় গুঁজে দেখছে আতঙ্কী’ত শতশত চোখ।
গ্রামের মোড়ল পুলিশকে খবর দিল।
ঘণ্টা দুই পরে পুলিশ এসে লাশটিকে নিয়ে গেল থানায়।যাওয়ার আগে সবার কাছে জেরা করল।কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারল না।পানিতে পঁচে লাশটির চেহারায়ও বোঝা যাচ্ছে না! ছেলে না কি মেয়ে!এক নজর লাশ টিকে দেখলে গা ঝমঝমে একটি ভাব চলে আসে।ইন্সপেক্টর জাহিদ সাহেব সহ আরো দু’জন মিলে লাশটিকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে গেল।ডাক্তার পোস্ট মর্টাম করে জানাল,
-“লাশটি একটি মেয়ের লাশ ছিল। এবং বেশকিছুদিন আগে রেপড হয়েছে।মেয়েটির যৌনাঙ্গও ব্লেড বা ধারাল কিছু দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে।বেশকিছুদিন পানিতে থাকার ফলে শরীরে পঁচন ধরেছে এবং মাছও ঠুকরে ঠুকরে খাদ্য মনে করে খেয়েছে।তাই শরীরের অঙ্গগুলো খসে খসে পরছে।নাড়ীভুড়িও বেড়িয়ে গেছে।
জাহিদ সাহেব চিন্তিত মুখে বলল,
-“মেয়েটিকে কি চেনার কোনো উপায় নেই?
-“দেখুন একটানা কয়েক ঘণ্টা পানিতে থাকলেই শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যায়।চোখ গুলো লাল হয়ে যায়।সেখানে মেয়োটিকে খুব কৌশলে বস্তাবন্ধি করে পানির নিচে লাঠি গেড়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল।দিন গিয়েছে আর ফুলে ফেপে লাশটি পানিতে ভেসেছে।চোখ নেই,চুল নেই,কান নেই,নাক নেই,মুখের অনেকটা অংশ খসে খসে পড়ছে সেখানে চেহারা বোঝা যাবে কী করে?তবে মেয়েটির গলায় একটা স্বর্ণের চিকুন চেইন পেয়েছি।তাতে লকেটও ছিল।আপনি চাইলে দেখতে পারেন?
-“অবশ্যই চলুন ডাক্তার সাহেব।
জাহিদ সাহেব চেইনটা হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখল।লটেকের দুটো পাট দেখে জাহিদ সাহেবের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল যাক একটা ক্লু পাওয়া গেছে।লকেটের ভিতরে একটি উঠন্ত বয়সের মেয়ের ছবি। কালো কুচকুচে মায়াবী চেহারা,চোখ দু’টো টানা টানা,ঘনকালো চুল।আহ্, কী মায়াবী চেহারা। এই মেয়েটাকে কেউ নিখুঁত ভাবে খুন করতে পারে ভাবতেই জাহিদ সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠল।ভিতর থেকে কেসটা লড়ায় খুব তাগিত অনুভব করছে জাহিদ সাহেব।জাহিদ সাহেবের ৩৯ বছর জীবনে কত কেসই তো এসেছে।কখনো আসামীকে ধরেছে যোগ্য শাস্তি দেওয়ার আশায় কিন্তু টাকার জোরে আসামীগুলো বার বার বেঁচে গেছে।তাই জেদ থেকে জাহিদ সাহেব কেস নেয় ঠিকই কিন্তু তদরন্ত করে না।কী লাভ এত কষ্ট করে প্রমাণ যোগার করার যদি আসামী শাস্তিই না পায়??কথাগুলো ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাহিদ সাহেব।বলল,
-“লাশটা আপনি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করুণ আমি বাকিটা দেখছি। তবে সৎকার এখনি করবেন না। মেয়েটির বাড়ির লোককে খুঁজে বের করি। তারা এসে দেখবে! তারপর কবর দিবেন।ততদিন মর্গে থাক।
-“ওকে।

জাহিদ সাহেব হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে সোজা থানায় চলে গেল।মাথার ভিতর অনেক গুলো প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে!কে এই মেয়ে?বাড়ি কোথায়?কী করে?তাকে কে রেপড করতে পারে, বয়ফ্রেন্ড না কি অন্যকেউ?রেপড করে এত নিখুঁত ভাবে হত্যা করার বা কারণ কী?যে হত্যা করেছে তার আসল উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?জানতে হবে যে করেই হোক জানতে হবে তারপর আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হবে।জাহিদ সাহেব আর দেরি করল না ফোনে মেয়েটির লকেট থেকে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে এবং লাশটিরও কিছু ছবি তুলে ফেসবুকে ভাইরাল করে দিল।সাংবাদিককেও জানানো হলো।কয়েক ঘণ্টায় পুরো বাংলাদেশ জুরে মেয়েটির ভয়ংকর হত্যার কাহিনী ছড়িয়ে গেল।পেপার,ফেসবুক,টিভি চ্যানেল সব জায়গা রমরমা হয়ে গেল।মুহূর্তেই লাশটিকে কেন্দ্র করে মন গড়া কাহিনী বানিয়ে সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে প্রচার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

রাকিব ব্যবস্ততার কারণে অনেদিন ফেসবুকে স্ক্রল করে না।তাছাড়া মন মেজাজও ভালো নেই।আজ কী মনে যেন রাতে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে ডাটা অন করে নিউজফিড ঘুরতেই একটি ভয়ংকর হত্যা কাণ্ডের কথা জানতে পারল।স্ট্যাটাসে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,”বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত-দুপুরে পালিয়ে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের হাতে ধর্ষণ হয়ে মর্মান্তিক ভাবে খুন হয়েছে একটি কিশোরী মেয়ে।”স্ট্যাটাসটিতে লাইক,কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।কেউ আহারে বলে সমোবেদনা জানাচ্ছে,কেউ বা মেয়েটির দোষ,ক্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে করছে।স্ট্যাটাসের সাথে বেশিকিছু ছবি যোগ করে দেওয়া হয়েছে।রাকিব কৌতুহল বসত ছবিটা জুম করে ভালো করে দেখল।ছবিটা দেখে রাকিবের আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।এ যে আর কেউ না তারই প্রাণ প্রিয় ছোট বোন রথী।ভয়ে রাকিবের হাত কাঁপছে,মুখ শুকিয়ে গেছে,পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল,গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।কোনরকমে চিৎকার দিয়ে বলল,
-“আম্মা….রথী..আর….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here