শেষ পেইজ পর্ব -০১

– শোন, আমাদের ক্যাম্পাসের সেরা সুন্দরী ছিলো বন্যা আপু, আবীর ভাইয়াও কোন দিকে কম ছিলো না।
তাদের প্রেমে সাক্ষী পুরো ক্যাম্পাস। আজ পনের বছর পর ও আমরা সবাই সে কাহীনি সবাইকে শোনাই।
ঝড়ের দিনে বন্যা আপুর আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিল। কি বৃষ্টি সেদিন, ৮ নম্বর বিপদ সংকেত চলছিল-

পেছন থেকে কনেস্টেবল বদিউদ্দিন বলে উঠলো,

– ম্যাডাম গত বার তো ৯ নম্বর বলছিলেন।

আমি পেছন ফিরে তাকাতে সে দেওয়ালে সেঁটে গেল,

– না মানে অনেক বার শুনছি তো আপনার বন্যা আপুর গল্প তাই মুখস্ত হয়ে গেল। পুরান লাগে। আপনার নিজের টা কন না কেন?

-চুপ, বন্যা আপু আর আবীর ভাইয়ের প্রেমের গল্প যত বলি না কেন আমার পুরান লাগে না।

-শোন যা বলছি, আমি ছিলাম তাদের পোস্টম্যান সব পাগলামীর সাক্ষী আমি। চুরি করে গাছ বেড়ে আমাদের রুমে আসতো আবীর ভাইয়া। আর বন্যা আপু সেদিনের সে পাগলামী যেদিন বন্যা আপুকে এপ্রিল ফুল বানাতে সবাই বলেছি আবীর ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
আরেক টু হলে দিচ্ছিলো নিজের শিরা টা কেটে,
কি অদ্ভুত প্রেম ছিলো। আমার ভীষণ হিংসে হয় আজকাল জানো, কেন এমন করে কাউকে ভালোবাসতে পারলাম না। কেন কেউ বাসলো না। আরেক টা মজার কাহিনী আছে-

কথাটা বলতে বলতে মন্টু চা নিয়ে রুমে ঢুকল। স্টেশনের দরজা গুলো গায়ের ধাক্কা দিয়ে খুলে কিছুটা।

হল রুমের লম্বা বেঞ্চে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সবুজ জামায় একজন, কপালের উপরের দিকে চুলের সাথে লেপ্টে রক্ত জমে আছে। চেহেরাটা পরিচিত।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, সাথে আমার সামনে বসা আসামী হয়ে আসা এক বান্দবী যার বান্ধবী পালিয়েছে বলে তাকে আসামী বানিয়েছে বান্দবীর মা বাবা।
আর আমার দুজন কনেস্টেবল।

– ম্যাডাম, কি হলো এরপর,

আমি ধীরে এগিয়ে গেলাম, দরজা টা দুইহাতে ধরে খুলতে আমি চমকে গেলাম,

দ্রুত গিয়ে বললাম,

-বন্যা আপু, তুমি? তুমি এইখানে কি করছো?

উনি আমার দিকে উদাস চোখে তাকালেন। যেন আমাকে চিনতেই পারলেন না। না উনার আমাকে চেনার কোন গরজ আছে।

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন৷

ততক্ষনে বদিউদ্দিন এসে বলল,
-এইটা আপনার সেই বন্যা আপু?

আমিও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি, চিনতেই পারছি না। মনে হচ্ছে মধ্যবয়েসী কোন নারী না চাকচিক্য না সৌন্দর্য।

আমি উনার হাত ধরে বললাম- আবীর ভাইয়া কোথায়? তুমি এইখানে কি করছো? কি দরকার?

আমি ইন্সেপেক্টর মহিমের দিকে তাকালাম,

সে টেবিলে পরে থাকা একটা ফাইল অলস ভঙ্গিতে তুলে টুথপিক দিয়ে দাঁতে লাগা কি যেন বের করতে করতে বলল-

– স্বামীকে কুপিয়ে খুন করতে গিয়েছে। হাত পা সব কেটে ফেলে রেখেছে, ওখানেই বসে দেখছিলো, কেমনে মরে।

স্বামীর বোন এসে দেখে ফেলায় হাসপাতালে নিসে। মরে নাই এখনো। তবে বাঁচবে না বেশিক্ষন।
অন্ধকার রাস্তায় চলতে চলতে আমার চোখের উপর যেন কেউ তীব্র লাইট ফেলল মূহুর্তের জন্য আমি শূন্য হয়ে গেলাম।

গলাটা যেন শুকনো কোন যন্ত্র আমার, এক ফোঁটাও পানি নেই। শুকনো বাঁশের ভেতরের অংশের মতো।

বন্যা আপুকে দেখলাম আবার। শূন্য দৃষ্টি দেওয়ালের আঁকাবুকির দিকে তাকিয়ে আছে।

মহিম আবার বলতে লাগল-

-পালানোর চেষ্টাও ছিলো না। কোন কথাও বলছে না। শুধু একটা লাইন বলেছিলো। ”আমি না মারলে সে আমাকে মেরে ফেলতো। ”

আশে পাশের প্রতিবেশিরা জানিয়েছে। ওর স্বামী জোর মারধর করতো। সারারাত এই মেয়ের কান্না শোনা যেত। তীব্র চিৎকার। কেউ ধরতে আসলে ওর স্বামী তাদেরেই মারতো।

আমি যেন মূহুর্তে মূহুর্তে কোন বোম পড়া দৃশ্য দেখছি। আর ভেতর টা যেন ছুড়ি দিয়ে আঁছড় কাটছে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।

কোন মতে গলা খাকিয়ে বললাম- স্বামীর নাম কি?

কারণ আমার এখনো মনে হচ্ছে না যে স্বামীর কথা বলছে সেটা আবীর ভাইয়া হতেই পারে। হতে পারে উনাদের বিচ্ছেদ হয়েছে আর বন্যা আপু কোন শয়তান কে বিয়ে করেছে।

মহিম কাগজ উল্টে,জিব দিয়ে দাঁত থেকে কি যেন বের করে বলল-

– আশফাকুল ইসলাম আবীর।

আমার ভেতরে কোন বেলুন যেন টুস করে ফেটে গেল।
পাঁচ মিনিট আগে অবধি আমি শ্রেষ্ঠ কোন প্রেমের গল্প বলে জানছিলাম যা, তা শেষ পেইজে এমন থ্রিলার হয়ে যাবে কে জানতো।

আমার সাথে সাথে থানার সবাই তাকিয়ে আছে, কারণ আমার মুখে সবাই বন্যা আপু আর আবীর ভাইয়ের প্রেমের গল্পের সাক্ষী।

আমি বন্যা আপুর কাছে গিয়ে উনার কাঁধে হাত দিলাম,
-আপু-

তখন অনেক জোরে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো বন্যা আপু, বেঞ্চ ছেড়ে ফ্লোরে নেমে গেলে। দেওয়াল ঘেঁষে বসে দুই হাত দুই পা এক সাথে করে মুখ গুজে কাঁপতে লাগল, বিড়বিড় করে বলতে লাগল-

– মেরো না। আর মেরো না। আর মেরো না। আর মেরো না-

বন্যা আপুর ফর্সা হাতের কালসিটে দাগ আর পিঠ জুড়ে লম্বা লম্বা কালো দাগ গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো আমার মুখের উপর কেউ পলি ব্যাগ দিয়ে আটকে ধরেছে আর আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

আমার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ে কখন যেন আমার ইউনিফর্ম ভিজে যাচ্ছিলো।

মা মারা যাওয়ার পর এই বন্যা আপু না থাকলে হয়ত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো আমার জীবন, নিজের টাকায় ফরম নিয়ে চাকরিতে পাঠানো বন্যা আপুকে যে আমি এইভাবে দেখবো কখনো ভাবি নি।

নিজেকে বললাম- তোমাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব আপু।

বন্যা আপু তখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে,
– মেরো না আর মেরো না আবীর।

-চলবে

#শেষ_পেইজ
#পর্ব_1

#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here