শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ১৮

#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
#’পর্বঃ ১৮

.
পদ্মর ডাকে থমকে দাঁড়ান চন্দ্রা। পেছনে ফিরতেই পদ্ম তার দাসীকে চলে যেতে বলে চন্দ্রাকে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

—” কেমন আছেন বৌমনি? ভ্রাতাশ্রী যদি কিছু না মনে করেন তবে কি আপনি আমার সঙ্গে বাগানে গল্প করতে পছন্দ করবেন?”

খুবই মিষ্টি স্বর পদ্মর। দেখতেও মায়াবতী সে। খানিকটা রুদ্রের চেহারার মতো বলা যায়। চন্দ্রা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়েই পদ্মর নম্র আচরণ দেখছিলেন। কিন্তু শেষের কথাগুলো ঠিক পছন্দ হলো না তার। তার কি এখন রুদ্রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সব কাজ করতে হবে? মোটেও না। অনেকটা রাগ হলেও প্রকাশ করলেন না চন্দ্রা। শান্ত কণ্ঠে বললেন,

—” সমস্যা নেই। নিয়ে চলো কোথায় নিয়ে যাবে!”

বিনিময়ে পদ্ম হেসে উত্তর দিলো,

—” বাগানের পূর্ব পাশটায় বিশ্রামের একটি স্থান আছে। ওখানে যাওয়া যাক! আপনার সঙ্গে গল্প করা যাবে।”

চন্দ্রা সায় দিলো পদ্মের কথায়। পদ্মর সঙ্গে যেতে লাগলো বাগানের পূর্ব পাশটায়। যেখানে রঙ-বেরঙের ফুলের ঠিক মাঝখানটায় একটি চাদর রাখা। হয়তো এটাই বিশ্রাম করার স্থান হিসেবে বিবেচিত। পদ্ম এবং চন্দ্রা চাদরে বসতেই পদ্ম শান্ত ও নম্র কণ্ঠে বলে উঠল,

—” বৌমনি? এর আগে হয়তো আপনার সঙ্গে আমার তেমন সাক্ষাত হয় নি। আপনাকে দেখে ইচ্ছে হলো একটু সঙ্গ দিতে। আপনি বিরক্ত নন তো এতে?”

পদ্মর এরুপ কথায় মুচকি হেসে বলে উঠলেন চন্দ্রা,

—” মোটেও না! তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগছে।”

বলেই কিছুক্ষণ চুপ রইলেন দু’জনেই। নিরবতা ভেঙ্গে চন্দ্রা বলে উঠলেন,

—” পদ্ম, আমি শুনেছি সম্রাটের আরও দু’জন ভ্রাতা আছেন। তারা কি এ রাজ্যে থাকেন না? তাদের কখনো দেখি নি আমি।”

—” না! ভ্রাতাগণকে ভ্রাতাশ্রী আলাদা আলাদা রাজ্য দিয়ে রেখেছেন। তাই তারা তেমন একটা আসেন না এখানে। তবে আপনার এবং ভ্রাতাশ্রীর বিবাহে এসেছিলেন তারা। আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি।”

— ” ওহ্! ”

এবারও দু’জন চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু চন্দ্রা বাহ্যিক দিক দিয়ে চুপ হলেও ভেতরে ভেতরে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে। তবে কিভাবে পদ্মকে জিজ্ঞেস করবেন সেই দ্বিধায় ভুগছেন চন্দ্রা। কিন্তু যে কোনোভাবে হলেও প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। ভেবেই চন্দ্রা পদ্মর দিকে তাকালেন। পদ্ম পাশে থাকা ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন এবার,

—” তোমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল পদ্ম। জিজ্ঞেস করতে পারি?”

—” অবশ্যই বৌমনি। কি প্রশ্ন করবেন করুন।”

চন্দ্রা অনেকটা অস্বস্থি নিয়ে বলে উঠলেন,

— ” তুমি কি জানো সম্রাটের অধিক বিবাহ করার কারণ কি? নাকি উনিও অন্যান্য সম্রাটদের মতো অধিক বিবাহ করতে পছন্দ করেন?”

পদ্মর হাসিটা হালকা হয়ে উঠল। অবাক হয়ে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আছে সে। চন্দ্রা বুঝতে পারছেন না তিনি কি কোনো ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছেন? উত্তরটা জানতে আবারও বলে উঠলেন চন্দ্রা,

— “আসলে তিনি তো তার স্ত্রীদের রাণী হিসেবে মর্যাদা দেন না। বরং রক্ষিতা হিসেবে বিবেচনা করেন। এরুপ কেন? উনার যদি ওদের পছন্দই না হয় তাহলে বিবাহ করেছেন কেন?”

পদ্ম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

— ” মাতার কারণে!”

— ” অর্থাৎ? ”

— ” ভ্রাতাশ্রী এখন পর্যন্ত যার যার সঙ্গে বিবাহ করেছেন সবার সঙ্গে মাতার কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্ক ছিল…. বৌমনি আপনি যেহেতু ভ্রাতার সম্রাজ্ঞী সেহেতু আপনাকে কিছু কথা বলব। আমাদের মাতা পুরুষ লোভী ছিলেন। অনেক ছোট রাজ্যের রাজকুমারী হলেও স্বর্গের কোনো দেবীর চেয়ে কম ছিলেন না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যের রাজার সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন। এর জন্য কেউ এমনকি মাতাও সঠিক ভাবে বলতে পারবেন না তার সন্তানদের আসল পিতা কে। আমাদের সকলের মাতা এক হলেও পিতা আলাদা আলাদা। তবে মাতার গর্ভে যখন ভ্রাতাশ্রী ছিলেন তখন মাতা এ রাজ্যের রাজা অর্থাৎ পিতাকে বিবাহ করেন। সবাই ভাবতো ভ্রাতাশ্রী তার সন্তান। শুধু পিতা আর মাতা ছাড়া। পিতা মাতার সকল দোষ জানা সত্ত্বেও মাতাকে মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি পিতার সঙ্গে বিবাহের পরও যখন মাতা অন্য পুরুষদের সঙ্গে লিপ্ত ছিলেন তখনও পিতা কিছু বলেন নি। কেননা মাতা চলে যাওয়ার হুমকি দিতেন পিতাকে। আর পিতা! তিনি মাতাকে অধিক ভালোবাসতেন। কিন্তু ভ্রাতাশ্রী জন্মের কয়েক বছর পর যখন জানতে পারেন মাতার সকল সত্য তখন থেকে ঘৃণা করতেন মাতাকে। তবে মাতাকে ভালোবাসতেনও প্রচুর। ঘৃণার আড়ালে সেটা প্রকাশ করতেন না৷ এবং মাতা যখন আমার দুজন ভ্রাতাকে জন্ম দেন তখন থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন। আমাকে জন্ম দেওয়ার পর আরও বেশি। যেমনই হোক তিনি আমাদের মাতা, তাই ভ্রাতাশ্রী নাকট হলেও মাতার সঙ্গে প্রীতিময় আচরণ করতেন। কিন্তু আমি এবং আমার দুজন ভ্রাতা মাতাকে সহ্য করতে পারতেন না। পিতা মারা যাওয়ার পর ভ্রাতাগণ মাতার সঙ্গে মেলামেশা আরও বন্ধ করে দেন। এ রাজ্য থেকে চলে যেতে চাইলেন। তাই বাধ্য হয়ে ভ্রাতাশ্রী তাদের আলাদা করে দিলেন। রইলাম আমি এবং ভ্রাতাশ্রী। মাতার সঙ্গে আমি সাক্ষাত না করলেও ভ্রাতাশ্রী সবসময় পাশে থাকতেন মাতার। এবং এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভ্রাতাশ্রীর জন্য।”

চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

—” কিরুপ?”

পদ্ম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,

—” মাতা তার অসুখের অসৎ ব্যবহার করতেন। যেমন ভ্রাতাশ্রী যদি মাতার কথা শুনতে না চাইতেন তাহলে মাতা তার অসুখ বেড়ে যাওয়ার নাটক করতেন। তেমনি অন্যান্য রাজ্যের রাজকন্যা অর্থাৎ মাতা সেসব রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে থেকেছিলেন সেসব রাজাদের কন্যা বিন্দু, লতা এবং রত্নমাকে বিবাহের জন্য ভ্রাতাশ্রীকে জোড় করেন। ভ্রাতাশ্রীও বিবাহ করেন। তবে কিছুদিন পর জানতে পারেন এই রাজ্যের লোভে তারা ভ্রাতাশ্রীকে বিবাহ করেছেন। আর তাদের সঙ্গে মাতাও মিলিত। এবং তখন থেকেই ভ্রাতাশ্রী কেমন গম্ভীর, নির্মম আর নিষ্ঠুর হয়ে পরেন। মাতার অসুখের কারণে তার সঙ্গে বাহিরে বাহিরে প্রীতিময় আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে প্রচুর ঘৃণা করেন….! জানেন বৌমনি, আপনার জন্য ভ্রাতাশ্রীকে এই এত বছর পর আমি মন খুলে হাসতে দেখেছি। ধন্যবাদ আপনাকে বৌমনি!”

এতটুকু বলেই থেমে গেল পদ্ম৷ চন্দ্রা অবাক এবং বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন পদ্মর পানে। তবে ভাবছেন রুদ্রকে নিয়ে। রুদ্র আসলেই একজন রহস্যময় সম্রাট। তাকে চেনা বড় মুশকিল!

_____________________

রাতের আহার শেষে রুদ্রর কিছু কাজ থাকায় রাজদরবারে চলে যান তিনি। এতটুকু সময়ে চন্দ্রা বেশ কয়েকবার রুদ্রের পানে আড়চোখে তাকিয়েছিলেন। যেটা দেখতে পেয়ে রুদ্র বাঁকা হেসে তার বিখ্যাত ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন,

—” নির্লজ রাণী! লজ্জা লাগছে তো আমার।”

প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রা তার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন রুদ্রের কাছ থেকে। চন্দ্রা ভেবে পায় না রুদ্রের কি কষ্ট হয় না? নিজ মাতার প্রতি? দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রা আকাশের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আজ খুব করে নিজ মাতা-পিতা এবং কিরণের কথা মনে পরছে তার। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চক্ষুজোড়ে বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন চন্দ্রা৷ হঠাৎ রুদ্র তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। চন্দ্রার কাঁধে থুতনি রেখে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,

—” ও মোর প্রিয়তোষ প্রিয়তমা,
কার লাগি উদাসীন তুমি?
কার লাগি দুঃখ-বেদনা?
যদি কারনটা আমিময় মানুষটি হয়ে থাকি!
তাহলে তুমিময় মানুষটা সুধরিয়ে দাও আমায়।
তখন দেখবে,
আমিময় আমিটা তুমিময় প্রাণ!”

____________চলবে_____________
(ছোট হওয়ার জন্য দুঃখীত)
Priya Saha, Ontora Akter Fatema, Aysha Siddika, সহ সবার মন্তব্য দারুণ ছিল❤
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here