শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ৫

‘শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’- ০৫
__________________

শ্রাবণ মাস হওয়ার দরুণ চারপাশে সর্বদাই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বিরাজমান। ঘোড়ায় চড়ে নিজ রাজ্যের পথে গমনকারী সকল সৈনিক এবং সম্রাট রুদ্রদীপ কাকভিজে প্রায়। তবে রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা তখনও অজ্ঞান অবস্থায় বিভোর হয়ে আছেন। এবং তার উপাধান(বালিশ) হলো সম্রাট রুদ্রের প্রসস্ত বুক। এত দুশ্চিন্তার মাঝেও রাজকুমারীর এই একটা কাজে অতি প্রসন্ন রুদ্র। একহাতে চন্দ্রাকে আগলে ধরে রেখেছেন তো অন্যহাতে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করছেন। এদিকে সূর্য অস্ত যেতে আর মাত্র কিছু প্রহর বাকি। তাই রুদ্র সিদ্ধান্ত নেন এখানেই তাবু টাঙ্গিয়ে আজ রাত্রি যাপন করবেন। রুদ্রের আদেশ মোতাবেক তাই-ই করা হয়। রুদ্র এবং চন্দ্রার জন্য বড় করে পাশাপাশি দু’টো তাবু স্থাপন করা হয়। তাবু টাঙ্গানো শেষে রাজকুমারী চন্দ্রাকে পাজাকোলে তুলে তাবুর শয্যায় আস্তে করে শুইয়ে দেন রুদ্র। সাথে সাথে চন্দ্রার অবাদ্ধ চুলগুলো তার পুরো মুখশ্রীতে ছড়িয়ে পরে। মুহুর্তেই বিরক্তি প্রকাশ করেন রুদ্র। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন,

— “আমার চন্দ্রা শুধু আমার ঐশ্বর্য। বিশেষ মূল্যবান ঐশ্বর্য! তার ওপর শুধু এবং একমাত্র অধিকার আমার। এমন কি চন্দ্রার কেশেরও(চুল) অধিকার নেই আমার সামনে আমারই প্রেয়সীর মুখ ঢেকে ফেলার।”

বলতে বলতেই চুলগুলো চন্দ্রার কানে গুঁজে দেন রুদ্র। চন্দ্রার মুখশ্রীতে কিচ্ছুক্ষণ তাকাতেই এক নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগে ওঠে তার মনে। ইচ্ছে দমাতে না পেরে নিজের অধর যুগল চন্দ্রার ফর্সা কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে দেন রুদ্র। সাথে সাথে খানিকটা নড়ে ওঠেন চন্দ্রা। পরপরই খাবার চিবোনোর মতো ভঙ্গিমা করে ঠোঁট নাড়ান মৃদুভাবে। পরক্ষণেই আবারও স্বাভাবিক ভাবে ঘুমিয়ে পড়েন। এতসব দেখে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে রুদ্রদীপের। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত পদে তাবু থেকে বেড়িয়ে যায় সে।

___________________________

তন্দ্রা ছুটতেই মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা অনুভব করেন চন্দ্রা। উঠে বসে পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠেন তিনি। রুদ্র এক হাতে ভড় করে চোখ বন্ধ করে আছেন। হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। চন্দ্রা নিজের হালকা বাদামী চোখের মনি দিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন রুদ্রকে। চওড়া বুক, মাথায় পাগড়ী নেই বিধায় রুদ্রের ছোট ছোট চুলগুলো মাথা ঝুঁকে থাকায় কপালে পড়ে আছে। মুখে হালকা হালকা গোফ, ঠোঁটের একটু পাশে লালচে রঙের তিল। ফর্সা মুখে তিলটা বেশ মানিয়েছে তাকে। চোখের পাঁপড়ি ঘন এবং অধর জোড়া লালচে। সবমিলিয়ে সৌম্য রুপের অধিকারী সম্রাট সে। তবে তার এই সৌম্য রুপে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল না চন্দ্রা। তাবুর ফাঁড়া স্থানে বাহিরের দিকে তাকাতেই অবাক আর বিস্ময় ঘিরে ধরে চন্দ্রাকে। যতটুকু চন্দ্রার স্মরণ পরছে সে অপরাহ্নে তার জ্ঞান হারিয়েছিল, অথচ এখন প্রায় মাঝরাত। পরক্ষণেই মনে হলো, মাঝরাত! অর্থাৎ রুদ্রের সৈন্যগণ ঘুমিয়ে প্রায়। তাছাড়া রুদ্রও তার পাশে ঘুমিয়ে আছেন। এটাই সুযোগ এখান থেকে পালানোর। পরপরই মনে হলো, এই মাঝরাতে কোথায় যাবে সে? যদি কোনো বিপদ হয় তখন? কিন্তু রুদ্রের সাথেও তো সে থাকতে পারবে না। চন্দ্রা নিশ্চিত নিজ রাজ্যে নিয়ে গিয়ে চন্দ্রাকে প্রথমেই বিবাহ করবে সম্রাট রুদ্র। নতুবা নিজের রক্ষিতা হিসেবে মর্যাদা দিবে। যা মোটেও চান না চন্দ্রা। তাই এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা।

মনে সাহস সঞ্চিত করে ধীর গতিতে শয্যা থেকে নেমে দাঁড়ান চন্দ্রা। তাবুর প্রবেশ স্থানে দাঁড়িয়ে আরেকবার পেছন ফিরে রুদ্রের দিকে তাকান। না! রুদ্র ঘুমুচ্ছে। এবার তাবুর বাহিরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলেন চন্দ্রা। বাহিরেও রুদ্রের সৈন্যগণ তন্দ্রায় বিভোর হয়ে আছে। মুখে হাসির রেখা ফুঁটে উঠে চন্দ্রার। বিনা শব্দে তাবু থেকে বেড়িয়ে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হোন অজানা গন্তব্যের দিকে।

০৭.

প্রায় অনেক্ষণ হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে উঠেছেন চন্দ্রা। গাছের সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়েন স্থলে। হঠাৎ চন্দ্রার হরিণী কান কারো হাঁটার শব্দ পেতেই আশেপাশে ভালোভাবে তাকান চন্দ্রা। দেখতে পান কিছুসংখ্যক লোক হাতে মশাল নিয়ে তারই দিকে অগ্যসর হচ্ছে। অনেকটা ভয় পান চন্দ্রা। দ্রুত পায়ে নিজ স্থান থেকে উঠে অন্য স্থানে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরেন চন্দ্রা। তবে চন্দ্রা অজ্ঞাত লোকগুলো এখানকার দুর্ধষ জাতির কিছুসংখ্যক ব্যক্তি। অতি চালাক ও চতুর হওয়ায় চন্দ্রাকে পেয়ে যেতে অতি প্রহর গুণতে হয় নি তাদের। দুর্ধষ জাতির সর্দার চন্দ্রার মুখশ্রীর পানে মশাল ধরতেই বিশ্রী হাসি হাসে সে। মুখ থেকে থুতু ফেলে বলে উঠে,

— “কোন রাজ্যের হ্যাঁ তুমি? পথ হাড়িয়েছো বুঝি? আসো আমাদের সাথে আসো। অতি যত্নে তোমার সেবা করব আমরা।”

বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগল তারা। ভয়ে জোড়োসরো হওয়া চন্দ্রা হঠাৎ-ই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুর্ধষ জাতির একজন চন্দ্রার দিকে এগোতেই ওড়নার আড়ালে থাকা ছোট চাকু বের করে লোকটির গর্দানে বসিয়ে দেন চন্দ্রা। সাথে সাথে স্থলে লুটিয়ে পরে তার দেহ৷ এরুপ কান্ড দেখে দুর্ধষ জাতির সর্দার অতিমাত্রায় হিংস্র হয়ে চন্দ্রার গর্দানে তলোয়াড় বাড়াতেই চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে চন্দ্রা। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করে। আফসোসে শেষ প্রায় সে। নিজ পিতা-মাতাকে রুদ্রের কবল থেকে মুক্ত করতে পারলো না সে। ভাবনার কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ মনে হলো কিছু পরে যাওয়ার শব্দ চন্দ্রার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে। অথচ সে কোনো আঘাতের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছে না। এবার চোখ খুলে তাকান চন্দ্রা। চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে যায় তার। দুর্ধষ জাতির সর্দার মন্ডু বিহীন দেহে স্থলে লুটিয়ে আছে। ভয়ে চন্দ্রা কাঁপতে শুরু করে। চোখে তুলে অগ্রে তাকাতেই কাঁপাকাঁপি আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। কেননা সম্রাট রুদ্রদীপ তার অগ্রে দাঁড়িয়ে তারই দিকে রক্তিম চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন। যেন এক্ষুণি নিজ তলোয়াড় দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলবেন চন্দ্রাকে। ভয়ে ঢোক গিললো চন্দ্রা। মনে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল,

— “আপ__আপনি এখা_নে কিভাবে এ_এ__এলেন?”

নিরুত্তর সম্রাট রুদ্র। তবে কয়েক কদম এগিয়ে এলেন চন্দ্রার দিকে। ভয়ে চন্দ্রা গাছের সাথে আরও ঠেঁসে দাঁড়ালো। তা দেখে রাগের পাশাপাশি ভ্রুঁ কুঁচকে এলো রুদ্রের। আগের নেয়ই তাকিয়ে রইল চন্দ্রার দিকে। এদিকে দুর্ধষ জাতির সংখ্যা প্রায় রুদ্রের সৈন্যগণের সংখ্যার সমান। তাই রিতিমতো ছোটখাটো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এখানটায়। তবে সেখানে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই রুদ্রদীপের। সে চন্দ্রার পানে তাকিয়ে আছে তো আছেই। হঠাৎ এক দুর্ধষ জাতি রুদ্রকে পেছন থেকে আঘাত করার জন্য আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। ইহা দেখে চন্দ্রার আঁখি জোড়া অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে উঠল। পরক্ষণেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল সে- যেন এই দুর্ধষ জাতির তলোয়াড়ের আঘাতেই রুদ্রের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে যদি নিজের মৃত্যুও হয়, তাতেও আফসোস হবে না চন্দ্রার। তবে চন্দ্রার প্রার্থনা শুনলেন না ঈশ্বর। দুর্ধষ জাতি তলোয়াড় নিয়ে আরেকটু নিকটে আসতেই রুদ্র বিদ্যুৎ গতিতে নিজ তলোয়াড় দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়। ফলসরুপ কিছু বিন্দু বিন্দু রক্ত এসে রুদ্র এবং চন্দ্রার শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। রুদ্রের মুখের রক্ত এবং তার হিংস্রতা দেখে চমকে উঠে জ্ঞান হাড়ান চন্দ্রা। ঢোলে পড়েন রুদ্রের বুকে। রুদ্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয় চন্দ্রার মুখশ্রীর পানে। কে বলবে চন্দ্রা একটি রাজ্যের রাজকুমারী, যে কি-না একটু আগেও নিজের সাহসিকতা দেখিয়ে একজন দুর্ধষ জাতিকে মৃত্যুর শয্যায় শুইয়ে দিয়েছে। রুদ্রের মনে প্রশ্ন এলো একটা। আসলে কিরুপ চন্দ্রা? অতি ভীতু? নাকি অতি সাহসি হয়েও ভীতু?

________________________

চন্দ্রার জ্ঞান ফিরেছে অনেক্ষণ। তাবুর শয্যায় আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে সে। তার অগ্রেই সম্রাট রুদ্র তাবুর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটছেন। কি যেন বিড়বিড় করছেন উনি। যা কিছুটা হলেও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে চন্দ্রার। যেন রুদ্র বলছে- ‘এর শাস্তি পেতে হবে তোমাকে রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা।” কথাটা যেন বারংবার বলছেন রুদ্র। একসময় হুট করে চন্দ্রার কাছে এসে তার হাতটা শক্ত করে ধরেন রুদ্র। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

— “তুমি জানো আমার কথা অমান্য করার শাস্তি কি? মৃত্যু! তোমার ভাগ্য ভালো তোমাকে মেরে ফেলার মতো কঠিন হৃদয় এখনও হয় নি আমার। নয়তো এতদিনে ঠিক এই গহীন জঙ্গলের মাঝেই মরে পঁচে থাকতো তোমার মন্ডু বিহীন দেহ।”

থেমে থেমে আবারও বলে উঠেন রুদ্র,

— “আমার কথার আর অমান্য করবে না চন্দ্রা। না পালানোর কোনো প্রয়াস করবে। নতুবা…”

কথা বলতে বলতেই থেমে যান রুদ্র। চন্দ্রা চট করে বলে উঠেন,

— “নতুবা কি?”

রুদ্র চোখ তুলে তাকান চন্দ্রার দিকে৷ চন্দ্রা চোখ নামিয়ে ফেলেন তৎক্ষণাৎ। রুদ্র কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেন,

— “তোমাকে আশ্রয় দেওয়া বৃদ্ধা-বৃদ্ধর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। তারা কিন্তু এখনও আমাদের সাথেই আছেন। তাই তুমি যদি পালানোর কোনো প্রয়াসও করে থাকো তাহলে তাদের প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা কয়েকাংশ বেড়ে যাবে।”

চন্দ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের দিকে। এ কেমন সম্রাট? সম্রাটরা তো প্রজাদের সুখ, দুঃখের অংশীদার হয়। তাদের দুঃখ ভোলানোর প্রয়াস করে। অথচ সম্রাট রুদ্র! তার মতো নিষ্ঠুর সম্রাট জীবনেও দেখে নি চন্দ্রা। নির্দোষ প্রজাদের আঘাত করতেও হাত কাঁপে না তার। এমন কেন সে? উত্তরটা অজানা চন্দ্রার!

.
.
-ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
_______________চলবে_______________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here