#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
#’পর্বঃ ০৭
.
কক্ষে শুধু চন্দ্রা এবং রুদ্রই আছেন। তাদের সামনে হরেক রকমের খাবার উপস্থাপন করে রাখা হয়েছে। চন্দ্রাকে নিজ অগ্যের কেদারায় বসিয়ে একটার পর একটা খাবার নিজ হাতে চন্দ্রার থালায় বেরে দিচ্ছেন রুদ্র। তবে চন্দ্রা খাবার ছুঁয়েও দেখছেন না। এতে ক্রুদ্ধ হোন সম্রাট রুদ্রদীপ। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “তোমার কি খাবার পছন্দ হয় নি চন্দ্রা? খাচ্ছো না কেন?”
চন্দ্রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
—” আমি আমার পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাত করতে চাই সম্রাট। দয়া করে তাদের কাছে আমায় নিয়ে চলুন।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকালেন। মনে মনে একটা ভয়ংকর দুশ্চিন্তা ছেয়ে গেছে তার ভেতর। তবে তা বাহির থেকে বোঝা মুশকিল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে একটু কেশে রুদ্র বলে উঠলেন,
—” আমার প্রশ্নের প্রতিউত্তর তো এটা নয়। সঠিক উত্তর দাও আমাকে।”
চন্দ্রা আমতা আমতা করে বলল,
—” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
—” কেন? ”
নিরুত্তর চন্দ্রা। রুদ্র ডান ভ্রু কুঁচকে বলল,
—” তোমার কাছে মাত্র কয়েক প্রহর আছে চন্দ্রা। খাবার শেষ করো। নতুবা নিজ পিতা-মাতার সঙ্গে কখনও সাক্ষাত করার সুযোগ কপালে জুটবে না।”
চন্দ্রা চমকালো। দ্রুত খাবার খাওয়া আরম্ভ করে দিল। চন্দ্রার এহেন বাচ্চামি দেখে হাসলো রুদ্র। চন্দ্রার পানে দৃষ্টি রেখে সেও নিজের আহার খাওয়া শুরু করল।
_____________________
আহার করা শেষে রুদ্রের একটা কাজে বেরিয়ে যেতে হয় রাজদরবারের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে রুদ্র বলেছিলেন,
—” আমার ভেতর অনেক রাগ চন্দ্রা। কখনও এমন কিছু করবে না যাতে তোমার ক্ষতি করতে হয় আমার। আমি চাই না নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে আঘাত করতে।”
বলেই চন্দ্রার কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে দ্রুত পদে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান রুদ্র। চন্দ্রা তার যাওয়ার পানে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল মাত্র। এক নতুন সম্রাটকে দেখল সে, যার ভেতর ‘অনুভূতি’ নামক শব্দটি আছে। ভাবনার মাঝে ঢুকে গেল কথাটি। রুদ্র আসলে কিরুপ? প্রশ্নটির উত্তর ভাবতেই কয়েকপ্রহর কেটে গেল তার। এর মাঝে কিরণ এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো চন্দ্রাকে। বলল,
—” ক্ষমা করবেন রাজকুমারী! আপনার সঙ্গে সম্রাটের স্ত্রী রত্নমা দেখা করতে এসেছেন।”
চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “সম্রাটের স্ত্রী অর্থাৎ তোমাদের রাণী। তাকে নাম ধরে ডাকছো যে? এটাই কি এই সিংহদীপ সম্রাজ্যের কানুন?”
— “বেয়াদবি নিবেন না রাজকুমারী। সম্রাট আমাদের আদেশ দিয়েছেন যেন উনাদের রাণী হিসেবে সম্মোধন না করি।”
— “কেন?”
—” আমরা অজ্ঞাত নই রাজকুমারী।”
চন্দ্রা কিছুক্ষন ভেবে বলল,
—” আচ্ছা তাকে পাঠিয়ে দাও কক্ষের ভেতর।”
— “যথা আজ্ঞা রাজকুমারী।”
বলেই সে মাথা নত করে কক্ষের বাহিরে চলে গেল। কিছুসময় বাদ রত্নমা এলো চন্দ্রার কক্ষে। চন্দ্রার মাথা থেকে পদ অব্দী একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে উঠল,
— “তুমিই তাহলে কূঞ্জনরাজ্যের রাজজুমারী। বেশ দেখতে তো। তাই-ই হয়তো রুদ্র তোমার প্রেমে পরেছে। তবে যাই-ই বল না কেন, নিজেকে কখনও রুদ্রের সম্রাজ্ঞী কিংবা এ রাজ্যের রাণী হিসেবে ভাববে না। মনে রাখবে তুমি একজন রক্ষিতা। এবং আমার সম্রাট থেকে দূরে থাকবে তুমি।”
চন্দ্রা চটে গেল। এত দুঃসাহস কিভাবে হয় তাকে এভাবে অপমান করার! কড়া চোখে রত্নমার দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চন্দ্রা বলে উঠেন,
—” নিজের অবস্থান সম্পর্কে আমি ভালো ভাবেই জ্ঞাত। আপনি বরং নিজের কথা ভাবুন। যেখানে সম্রাট আপনাকে এ রাজ্যের রাণী হিসেবেই মর্যাদা দিতে চাইছেন না, সেখানে আপনার অবস্থানটা ঠিক কেমন তা আমার জানা আছে। তাছাড়া আমি আপনার সম্রাটের নিকটে আসার চেষ্টা করি নি। না উনার প্রতি আগ্রহ আছে আমার। উনিই আমার নিকটে এসেছেন। তাই নিজের স্বামীকে গিয়ে বোঝান আমার নিকটে না আসার জন্যে। আমাকে বোঝাতে আসবেন না।”
রত্নমা রাগে ফুঁসে উঠল। চন্দ্রার দিকে ক্রোধ ও হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই মুখে রহস্যময় বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে উঠল,
— “এসব কথা ছাড়ো চন্দ্রা। আমি তো তোমার সঙ্গে কোনোরুপ দন্দ তৈরি করতে আসি নি। বরং একটি সংবাদ পৌঁছাতে এসেছি। যা সম্পর্কে তুমি অজ্ঞাত।”
চন্দ্রার ভ্রু কুঁচকে এলো আপনা-আপনি। এতক্ষণযাবত যে তাকে অপমান করছিল, তার এখন এত ভালো ব্যবহার! সন্দেহ হলো চন্দ্রার। তবে তা প্রকাশ করলেন না। রত্ননার দিকে বিরক্তি মাখা মখশ্রী নিয়ে বললেন,
—” কি সংবাদ?”
মনে মনে হাসলো রত্নমা। নিজের পরিকল্পনায় ভালোভাবে আগাচ্ছে ভেবে খুশি হলো প্রচুর। মিষ্টি হেসে বলে উঠল,
— “তোমার কি রুদ্রের প্রতি সন্দেহ হয় না চন্দ্রা?”
—” কোন ব্যাপারে?”
—” তোমার পিতা-মাতার? অর্থাৎ তুমি এত করে রুদ্রকে বলছ নিজ পিতা-মাতার সঙ্গে সাক্ষাত করার, অথচ সে তাদের সঙ্গে তোমার দেখা করাতেই চাইছে না। ব্যাপারটা সন্দেহ জনক নয় কি?”
চন্দ্রা রত্নমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন,
—” কিন্তু আপনি কি করে জানেন আমি সম্রাটকে এ কথা বলেছি?”
থতমত খেয়ে গেলেন রত্নমা। দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে ক্ষাণিকটা হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলেন,
—” আমার দাসীর তো আর অভাব নেই চন্দ্রা। তাদের কাছে জানা। তোমার আশেপাশেই তারা থাকে অথচ তুমি সে সম্পর্কে অজ্ঞাত।”
কথাটা ঠিক ভালো লাগলো না চন্দ্রার। এ প্রসঙ্গে পরে কথা বললেও চলবে ভেবে রত্নমার প্রথম কথাটি তুললো সে। বলল,
—” আপনি যেন কি বলতে এসেছিলেন? আবার বলুন।”
—” রুদ্রকে সন্দেহ করার কথা। আসলে তুমি কি জানো তোমার পিতা-মাতা কোথায় আছেন? কোন পরিস্থিতিতে আছেন?”
চন্দ্রা ব্যগ্র হয়ে বললেন,
—” কোথায় আছেন তারা? আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন কি?”
রত্নমা আফসোসের সঙ্গে বলে উঠল,
—” তোমার পিতা-মাতা এ ধরণীতে আর বেঁচে নেই চন্দ্রা।”
বিস্ময়ে চন্দ্রার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। ক্ষাণিকটা চিল্লিয়ে বলে উঠল,
—” অর্থাৎ?”
পরপরই আবার বলে উঠলেন চন্দ্রা,
—” আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। আপনি মিথ্যা বলছেন।”
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো রত্নমা। বলে উঠল,
—” মিথ্যা বলে আমার লাভটা কি?”
—” আছে, লাভ আছে। নতুবা আপনি আমাকে এসব মিথ্যা বলছেন কেন? হ্যাঁ, আমি জানিনা আপনার লাভটা ঠিক কোথায়। তবে আপনি যে নিজ স্বার্থে আমাকে এসব বলছেন তা আমি জানি।”
রত্নমা আবারও হাসলো। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—” বাহ্ঃ! তুমি তো দেখছি অধিক চতুর। তো শুনো মেয়ে। আছে আমার স্বার্থ। এবং তা হলো রুদ্রকে তোমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া। আমি চাই তুমি রুদ্রের আশেপাশেও না থাকো। তবে তোমার ধারণা এটা ভুল যে আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি। একবার ভেবেই দেখো না। কেন রুদ্র তোমাকে তোমার পিতা-মাতার সঙ্গে দেখা করাতে চাইছে না? তুমি তো তার কাছে বন্দী। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
কিছু একটা ভেবে চন্দ্রার চোখ ভরে এলো। রত্নমা তো ঠিকই বলছে। যেহেতু চন্দ্রা রুদ্রের কাছে বন্দী সেহেতু রুদ্র কেন চাইছেন না তাকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সাক্ষাত করাতে? কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো চন্দ্রার। তবুও কণ্ঠে জোড় এনে চন্দ্রা বলে ওঠেন,
—” সত্যিই কি আমার পিতা-মাতা বেঁচে নেই।”
রত্নমা মুখে শোকের ছায়া এঁটে নিলো। নাটকীয় ভাবে চোখে কৃত্রিম জল এনে বলে উঠল সে,
—” তোমার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার চন্দ্রা। এতটুকু মেয়ে তুমি অথচ জীবনের কোন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছো। নিজ পিতা-মাতাকে অন্তিমবার দেখার সুযোগও পেলে না।”
কেদারায় ধপ করে বসে পড়লেন চন্দ্রা। বিরতিহীন ভাবে চোখ থেকে জল পরছে তার। কিন্তু পরক্ষণেই ক্রোধে জ্বলে উঠলেন চন্দ্রা। প্রবল ক্ষোপ নিয়ে বলে উঠলেন,
—” সম্রাট রুদ্রদীপকে ধ্বংস করে দেবো আমি। আমার পিতা-মাতার সঙ্গে করা অন্যায়ের শাস্তি পাবেন তিনি। আমার অগ্যে জবাবদিহি করতে হবে তার।”
রত্নমা বিচলিত হলো। দ্রুত গতিতে বলল,
—” এমন স্পর্ধা করবে না চন্দ্রা। তোমাকে এরজন্যই সত্যিটা বলি নি আমি। আমি শুধু চাই তুমি তোমার মতো থাকবে আর রুদ্র রুদ্রের মতো।”
—” আপনি কি চাইছেন আমি আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবো না? অবশ্যই নেবো।”
—” দেখো চন্দ্রা এমন করলে আমি তোমাকে বন্দী করে ফেলবো এক্ষুণি।”
কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন চন্দ্রা। রত্নমা আবারও বলে উঠলেন,
—” দেখো! আমি যদি তোমাকে বন্দী করি তাহলে কিছুই হাসিল হবে না তোমার। বরং বছরের পর বছর রাজকারাগারে বন্দী থাকবে তুমি। হয়তো রুদ্র প্রথম প্রথম তোমার সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু তোমার প্রয়োজন ফুঁড়িয়ে গেলে ছেড়ে চলে যাবেন। তাই বলছি, আমার কথা শোনো। তাহলে তোমার উপকার হবে।”
—” কি বলতে চাইছেন আপনি?”
—” আমি তোমাকে এখান থেকে পালাতে সাহায্য করবো। এবং কথা দিচ্ছি তোমার রাজ্য তোমাকে ফিরিয়ে দেবো। এর বিনিময়ে তোমাকে রুদ্রের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে।”
চন্দ্রা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন,
—” তাহলে আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর শাস্তি…?”
—” দেখো চন্দ্রা, রাজা-রাণীদের এমন মৃত্যু হয়ই। তারা বিভিন্ন রাজ্য জয় কিংবা রাজ্য রক্ষা করতে না পেরে অন্য সম্রাটের হাতে মৃত্যু বরণ করার জন্যই সৃষ্ট৷ এটা স্বাভাবিক। তুমি বরং তোমার কথা ভাবো। নিজ রাজ্যের রাণী হওয়ার কথা ভাবো। প্রজাদের সুখ-দুঃখের সাথী হও। জানো তো চন্দ্রা। রুদ্র কূঞ্জনরাজ্যের সম্রাট হওয়ার পরপরই তোমাদের রাজ্যে অত্যাচার বেড়ে গেছে।”
চন্দ্রা নির্লিপ্ত ভাবে তালিয়ে রইলেন রত্নমার পানে। কি উচিত কিংবা অনুচিত তা বুঝে উঠতে পারছেন না চন্দ্রা। এসবে বিরক্ত না হয়ে অনুরক্ততার সঙ্গে নিজ মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেও চন্দ্রা ব্যর্থ। শুধু দীর্ঘশ্বাসেরা এসে হানা দিচ্ছে তার পানে। সে তো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রত্নমার মনে মনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসা হাসির ওপর।
.
.
_______________চলবে_______________
Tahmina Akond, Ishita Das, Yasmin Putul উভয়ের মন্তব্য দারুণ ছিল❤